‘খান’ শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে আসে সালমান খান, শাহরুখ খান কিংবা তুঘলক খান বা মুর্শিদ কুলি খানের কথা। ‘খান’ শব্দটি শুনলেই আরেকটি বিষয় আমাদের মাথায় আসে, সেটা হলো- খান হচ্ছে মুসলমানদের উপাধি। অর্থাৎ, খান নামে যাকে ডাকা হচ্ছে সেই ব্যক্তি নিশ্চিত মুসলিম। বর্তমান প্রেক্ষাপট ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে’ এমন হলেও খানদের ইতিহাস কিন্তু মোটেও এমন ছিল না। এমনকি খানদের সাথে ইসলামের ন্যূনতম সম্পর্কও ছিল না। হয়তো ভাবছেন, তাহলে কীভাবে মুসলিমদের নামের সাথে খান এলো? আজ চলুন সেই বিষয়েই জেনে নেওয়া যাক।
‘খান’ বা ‘খাঁ’ উৎপত্তিগতভাবে একটি মঙ্গোলীয় শব্দ। মঙ্গোলীয় বা তুর্কি ভাষায় এর অর্থ সেনাপতি, শাসক বা নেতা। এছাড়া খান বলতে তৎকালে গোত্রপতিকেও বোঝানো হতো। ‘খানম’ বা ‘খাতান’ হলো খানের স্ত্রীবাচক রুপ। অর্থাৎ, খান বা শাসকদের স্ত্রীদের ‘খানম’ বলে ডাকা হত। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ‘খান’ শব্দের ব্যবহার রয়েছে আফগানিস্তানে। বিশেষ করে হাজারা ও পশতুন অঞ্চলে এই রীতিটা বেশি দেখা যায়।
মঙ্গোলরা সর্বপ্রথম ‘খান’ উপাধিটি আফগানিস্তানে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে মধ্যযুগে মুঘল শাসনামলে সম্রাটদের প্রতি আনুগত্যের স্বীকৃতিস্বরুপ ‘খান’ উপাধিতে ভূষিত করা হত। সম্রাটের বিশ্বস্ততা অর্জন ও দায়িত্বে সফলতা অর্জনের মাধ্যমে সবাই এই সম্মানিত উপাধি পেতে চাইত। সে সময় সম্রাটের কাছ থেকে মানুষেরা ব্যাপকভাবে খান উপাধিতে ভূষিত হতে শুরু করে। এভাবেই ভারতবর্ষে বিস্তৃতভাবে খান শব্দটি ছড়িয়ে পড়ে।
‘খানাত’ বা ‘খাগানাত’
‘খানাত’ হলো মূলত সাম্রাজ্যের একটি নির্দিষ্ট প্রশাসনিক অঞ্চল। আর খানাতের শাসককে বলা হত ‘খান’। ধারণা করা হয়, মঙ্গোল সাম্রাজ্যের পূর্বেই এই খানাতের উৎপত্তি হয়েছিল। তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য হলো ‘রোরা খানাত’। পরবর্তীতে মঙ্গোল সাম্রাজ্যে খানাতের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। মঙ্গোল সাম্রাজ্য ছাড়াও তুর্কি, আফসারী সাম্রাজ্য, সালাভি সাম্রাজ্য এবং তিমুরী সাম্রাজ্যে এর বিস্তার লক্ষ্য করা যায়।
মঙ্গোল খানাত
চেঙ্গিস খান তার রাজত্বকালে মঙ্গোল সাম্রাজ্যে তার পরিবারের জন্য আপানিজ ব্যবস্থা স্থাপন করেন। এই আপানিজ ব্যবস্থার মাধ্যমে চেঙ্গিস খানের পুত্র, কন্যা এবং পৌত্রগণ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশের উত্তরাধিকারী হন। এ থেকে মঙ্গোল খানাতের আবির্ভাব হতে থাকে।
দশম শতাব্দীতে মঙ্গোল সাম্রাজ্যে সর্বপ্রথম ‘খামাগ খানাত’ নামে একটি খানাত প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় মঙ্গোলীয়রা সমভূমি, অনন, খেরলেন ও তুল নদীর অববাহিকায় বসতি স্থাপন করে। এই অঞ্চলকেই ‘খামাগ খানাত’ বলা হত। মঙ্গোল সাম্রাজ্য কর্তৃক আরেকটি বিখ্যাত খানাত হলো ইলখানাত। চেঙ্গিস খানের নাতি হালাকু খানের পরিবার কর্তৃক ইলখানাত শাসিত হত। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত এই খানাতের ভিত্তিভূমি ছিল ইরান।
ইলখানাত মূলত চেঙ্গিস খানের খোয়ারিজমীয় সাম্রাজ্য অভিযানের উপর ভিত্তি লাভ করে এবং হালাকু খান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সাম্রাজ্যটি বর্তমান ইরান, ইরাক, তুর্কমেনিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, জর্জিয়া এবং তুরস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এছাড়া আফগানিস্তান এবং দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। মাহমুদ গাজান থেকে শুরু করে পরবর্তী ইলখানাতের শাসকগণ ইসলাম ধর্মের অনুসারী ছিলেন।
চাগতাই খানাত মঙ্গোল সাম্রাজ্যের আরেকটি উল্লেখ্যযোগ্য খানাত। চাগতাই খানাতের প্রথম শাসক ছিলেন চেঙ্গিস খানের দ্বিতীয় পুত্র চাগতাই খান। প্রথমত, এটি মঙ্গোল সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। ১২৫৯ সালে পর যখন মঙ্গোল সাম্রাজ্যে ভাঙন শুরু হয়, তখন এটি স্বাধীনতা লাভ করে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর দিকে চাগতাই খানাত আমু দরিয়া থেকে শুরু করে আলতাই পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
মঙ্গোল পরবর্তী খানাত
মঙ্গোল সাম্রাজ্যের খানাত প্রতিষ্ঠার পরে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের খানাতের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন- ১৬৪২ সালে গুশি খান ‘খশুত খানাত’ প্রতিষ্ঠা করেন। আনুমানিক ১৬৩০ সালে ‘কালমিক খানাত’ প্রতিষ্ঠিত হয়। কালমিক খানাতের বিস্তৃতি ছিল ভলগা নদীর নিম্নভূমি থেকে রাশিয়া এবং কাজাখস্তান পর্যন্ত।
১৬৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জুঙ্গার খানাত’। চীনের শিনচিয়াং অঞ্চল, কিরগিজিস্তান, পূর্ব কাজাখস্তান এবং পশ্চিম মঙ্গোলিয়া জুড়ে জুঙ্গার খানাত বিস্তৃত ছিল। তুর্কি খাগানাতের অধীনে বেশ কিছু খানাতের আবির্ভাব ঘটে, যেমন: পশ্চিম তুর্কি খাগানাত, পূর্ব তুর্কি খাগানাত, কিরগিজ খাগানাত, কারা-খানী খাগানাত, তুর্গেশ খাগানাত, খাজার খাগানাত, উইঘুর খাগানাত ইত্যাদি।
এ তো গেল প্রভাবশালী খানদের কথা। কিন্তু উৎপত্তিগতভাবে খানরা ছিল মূলত ক্ষুদ্র গোত্রপতি বা দলনেতা। এরা প্রধানত ইউরেশিয়া উপত্যকা ও এর নিকটবর্তী বিস্তৃত শুষ্ক অঞ্চলসমূহে বাস করত। ইউরেশিয়ান স্তেপ জুড়ে খানেরা কিছু ছোট ছোট রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এই রাজ্যগুলো স্বল্পকালের জন্য স্থায়ী হলেও তৎকালীন চীন, রোম ও বাইজেন্টিয়াম সাম্রাজ্যের জন্য হুমকির কারণ ছিল।
পরবর্তীতে বুলগেরিয়ার শাসকগণ উপাধি হিসেবে ‘খান’ শব্দটি ব্যবহার করতেন। এদের মধ্যে বিখ্যাত কয়েকজন হলেন খান কুব্রাত, যিনি মহান বুলগেরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা; খান আস্পারুখ, যিনি দানুবিয় বুলগেরিয়ার (বর্তমান বুলগেরিয়া) প্রতিষ্ঠাতা; এবং খান তেরভেল, যিনি ইউরোপের ত্রাণকর্তা নামে খ্যাত।
‘খান’ উপাধি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে চেঙ্গিস খান ক্ষমতায় আসার পর থেকে। মঙ্গোল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি এক অনন্য সামরিক প্রতিভার পরিচয় দেন। তার উপাধি ছিল ‘খাগান’, মানে ‘খানদের খান’। এটা অনেকটা পার্সী শাহানশাহ্এ-র মতো, এর অর্থও ‘রাজাদের রাজা’। কিন্তু সংক্ষেপে তিনি চেঙ্গিস খান হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিতি পান।
চেঙ্গিস খানের উত্তরাধিকারীরাও মহান খান হিসেবে পরিচিতি পায়। বিশেষ করে চেঙ্গিস খানের পৌত্র কুবলাই খান, যিনি চীনের ইয়ুয়ান রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। চেঙ্গিস খানের বংশের প্রধান শাখাটির শাসক বংশধররা ‘মহান খান’ হিসেবেই উল্লেখিত হন। পরবর্তীতে ‘খানদের খান’ বা ‘খাগান’ উপাধিটি অন্যান্য উপাধির সাথে ওসমানীয় সুলতানগণ এবং গোল্ডেন হোর্ড ও সেখান থেকে সৃষ্ট রাজ্যগুলোর শাসকেরাও ব্যবহার করতেন। জুরচেন এবং মাঞ্চু শাসকেরাও ‘খান’ শব্দটি ব্যবহার করতেন। মাঞ্চুরিয়ান ভাষায় খানকে বলা হয় হান, যেমন- গেংগিয়েন হান।
মুঘল সাম্রাজ্যে ‘খান’
ভারতে মুঘলদের আনুষ্ঠানিকতাগুলো ব্যাপকভাবে পারস্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত। মুঘলরা মুসলিম ও পার্সিদেরকে খান এবং খান বাহাদুর (মঙ্গোলীয় ‘সাহসী বীর’) উপাধি প্রদান করতো। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা আভিজাত্য ও রাজার প্রতি বিশ্বস্ততার জন্য এই প্রথা অব্যাহত রাখে।
‘খান সাহিব’ ছিল আরেকটি সম্মানজনক উপাধি। এটা ছিল ‘খান’ থেকে এক পদ উপরের মর্যাদা। এই উপাধিও মুসলিম ও পার্সিদের দেয়া হত। খান বাহাদুরের ন্যায় এটিও ব্রিটিশ শাসনামলে প্রদান করা হতো।
এদিকে আবার ‘খান’ ছিল ভারতীয় মুসলিম রাজ্য হায়দ্রাবাদে সর্বনিম্ন স্তরের অভিজাত খেতাব। ‘খান’ উপাধি ছিল খান বাহাদুর, নওয়াব, জং, দাউলা, মুল্ক, উমারা এবং জাহ-এর পদমর্যাদার নিচে। আর রাজ্যের হিন্দু আমাত্যদের সমমর্যাদার উপাধি ছিল ‘রায়’।
মুঘল শাসনামলে বাংলা সালতানাতে যে সকল উপাধির ধারা পরিচিত ছিল, যেমন- খান, খান-উল-আযাম, খান উল মুয়াযযাম, খান-উল-আযাম-উল-মুয়াযযাম ইত্যাদি, এবং খাকান, খাকান-উল-আযাম, খাকান-উল-মুয়াযযাম, খাকান-উল-আযাম-উল-মুয়াযযাম ইত্যাদি ছিল সামরিক পদের সাথে সংস্লিষ্ট। কিছু কিছু পদবি আবার সম্মানসূচকও ছিল।
অন্যান্য উপাধির মতোই খানও ধীরে ধীরে তার বিশিষ্টতা হারিয়েছে। পারস্য ও আফগানিস্তানে অনেক মুসলিম ভদ্রলোকের নামের শেষের শব্দে এসে ঠেকেছে। আবার কিছু হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তির নামের সাথেও ‘খান’ পদবীটি যুক্ত হতে দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে খান এবং খানম মানুষের মূল নামে পরিণত হয়েছে, যার সঙ্গে আভিজাত্যের কোনো সম্পর্কই নেই।