পৃথিবীর ইতিহাসে হাজার হাজার বছর আগে থেকেই মানুষ বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসনা করে আসছে। কম-বেশি অনেক দেশেই এসব প্রাচীন দেব-দেবীর মূর্তি এখনও দেখা যায়।প্রাচীন ভারতবর্ষ এবং গ্রীস অঞ্চলের অনেক দেব-দেবীর নাম আমরা শুনেছি এবং তাদের মূর্তি দেখেছি। তবে আজ আমরা আলোচনা করব প্রাচীন আরবের কিছু জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী দেবী সম্পর্কে।
আমরা জানি, ইসলাম আগমনের পূর্বে আরবের লোকেরা বহু দেব-দেবীর উপাসনা করতো। এছাড়া কাবা ঘরে তারা ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করেছিল বলে আমরা জানি। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী তিন দেবীর নাম আল-লাত, আল-উজ্জা এবং মানাত। প্রাচীন আরবের পৌত্তলিকরা এই তিন দেবীকে ‘আল্লাহর কন্যা’ হিসেবে বিশ্বাস করত এবং এদের পূজা করত।
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এদের সম্পর্কে বলেছেন:
“তোমরা কি ভেবে দেখেছো লাত এবং উজ্জা সম্পর্কে?
এবং তৃতীয় আরেকটি মানাত সম্পর্কে?
তবে কি তোমাদের জন্য পুত্রসন্তান এবং আল্লাহর জন্য কন্যাসন্তান?
তাহলে এই বন্টন অসঙ্গত।
এগুলো তো কেবল কিছু নাম যা তোমরা এবং তোমাদের পূর্বপুরুষরা রেখেছ, যার সমর্থনে আল্লাহ কোনো দলিল বা প্রমাণ প্রেরণ করেননি। তারা তো কেবল অনুমান এবং নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, অথচ তাদের কাছে তাদের রবের পক্ষ থেকে পথনির্দেশ এসেছে।”
সূরা নজম (আয়াত: ১৯-২৩)
মূলত, প্রাচীন আরবের পৌত্তলিকদের বিশ্বাস ছিল- যেহেতু এই তিন দেবী আল্লাহর কন্যা, তাই তারা নিজেদের জন্য কন্যাসন্তান নেয়াকে অনেকটা অভিশাপ হিসেবে নিত। প্রকারান্তে, পুত্রসন্তান লাভের আশায় তারা প্রার্থনা করত।
মক্কার পৌত্তলিকরা মনে করত, ফেরেশতারা আল্লাহর কন্যা, এবং লাত, উজ্জা ও মানাত তাদের প্রতিকৃতি। কেউ কেউ আবার এরকম ধারণা করত যে, জিনদের স্ত্রী বা পরীরা আল্লাহর কন্যা। তাই তারা তাদের প্রতিমাগুলোকে কল্পনা করত নারীরূপে। তারা নির্ধারণ করেছিল আল্লাহর স্ত্রীলিঙ্গ আল্লাত। আর পার্থক্যসূচক বিশেষণের শব্দরূপে তাআজজু এর স্ত্রীলিঙ্গ উজ্জা। [১]
পাঠকবৃন্দ, আসুন আমরা মূল আলোচনায় চলে যাই।
আল-লাত
ইসলাম-পূর্ব যুগে মক্কাসহ সমগ্র আরব উপদ্বীপে এই দেবীর উপাসনা করা হতো। তাকে যুদ্ধ, শান্তি ও সমৃদ্ধির দেবী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সিংহ, গেজেল (হরিণ বিশেষ), অর্ধচন্দ্র এবং ঘনকাকৃতির পাথর হলো তার প্রতীক। এছাড়া সিংহ, গেজেল (হরিণ) এবং উট তার পবিত্র পশু হিসেবে বিবেচিত।
এক হাতে খেজুর পাতাসহ সিংহের সাথে আল-লাতের প্রতিমূর্তি দেখা যায়। মূলত উত্তর আরবে এই দেবীর উপাসনা বেশি হতো। তবে মক্কার হেজাজ অঞ্চলেও তার উপাসনা হতো এবং এই চর্চা সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
আরবের সংস্কৃতিতে বর্ষগণনা মূলত চন্দ্রকেন্দ্রিক। তাই আল-লাতের একটি প্রতীক চাঁদ। তাকে তিন দেবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ হিসেবে ধরা হতো। তার প্রধান উপাসনা কেন্দ্র ছিল তায়েফের পালমিরাতে। সেখানে এটি ‘লেডি অব দ্য টেম্পল’ হিসেবে পরিচিত ছিল। তাকে গ্রিক দেবী এথেনা এবং রোমান দেবী মিনার্ভার সাথে তুলনা করা হতো। তবে গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস তাকে আফ্রোদিতির সাথে তুলনা করেছেন।
পাঠকবৃন্দ, আসুন এবার আমরা আরবীয় পৌত্তলিকতা সম্পর্কে হিশাম ইবনে আল ক্বালবি তার ‘বুক অফ আইডলস (Book of Idols)’-এ যা লিখেছেন সেটা একটু দেখি:
আল-লাত ছিল তায়েফে এবং এটা মানাতের চেয়ে বেশ নতুন ছিল। এটা ছিল ঘনকাকৃতির পাথর, যার পাশে একজন ইহুদী যব দিয়ে জাউ তৈরি করত। এর দায়িত্বে ছিল সাকিফ গোত্রের বনু আত্তাব ইবনে মালিক, যে এর উপর একটি প্রাসাদ নির্মাণ করে। কুরাইশসহ অন্যান্য আরবরা একে অনেক সম্মান করত। তারা এই দেবীর নামে তাদের সন্তানদের নাম রাখত ‘জায়েদ আল-লাত’ এবং ‘তাইম আল-লাত’ এভাবে। আল তায়েফ মসজিদের মিনারের বামদিকে এটি দাঁড় করানো ছিল।
সাকিফ গোত্র ইসলাম গ্রহণ না করা পর্যন্ত আল লাতের উপাসনা অব্যাহত রেখেছিল। যখন আল্লাহর নবী (হযরত মুহাম্মদ সা.) আল মুগিরাহ ইবনে-শুবাহকে পাঠান, তিনি একে ধ্বংস করেন এবং তার মন্দির মাটির সাথে মিশিয়ে দেন।
দক্ষিণ আরবে আল-লাতের জনপ্রিয়তা না থাকলেও ধারণা করা হয় ইয়েমেনের আরব গোত্রগুলোর মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ছিল। এছাড়া পূর্ব আরবেও তার উপাসনা করা হতো।
পুরাতন কিছু উৎস থেকে জানা যায়, আল-লাত ছিল মেসোপটেমীয়দের পাতালের দেবী, যিনি এরেশকিগাল নামে পরিচিত। কার্থেজে তাকে আল্লাতু নামে ডাকা হতো।
আরবের পৌত্তলিকরা আল্লাহর স্ত্রীলিঙ্গ হিসেবে আল্লাতকে নির্ধারণ করেছিল। কাবা ঘরে তারা তাকে প্রদক্ষিণ করত এবং তার উদ্দেশ্যে স্তুতিবাক্য পড়ত। বিশেষ করে শান্তি, সমৃদ্ধি, দয়া ও কল্যাণের জন্য তারা তাকে ডাকত। শত্রুর হাত থেকে রক্ষা, আক্রমণকারী বিরুদ্ধে প্রতিশোধ এবং অনুকূল আবহাওয়ার জন্যও তাকে স্মরণ করত। এছাড়া গাছ, কৃষি, উর্বর মাটির দেবী এবং ব্যবসা-বাণিজ্য, সম্পদ ও শক্তির স্বর্গীয় দেবী হিসেবেও তাকে সম্মান করা হতো। তার উদ্দেশ্যে অনেক কবিতাও লেখা হতো।
তায়েফে তার মন্দিরে অনিক্স নামের বিশেষ রত্নপাথর পাওয়ার পর এগুলোকে তার জন্য পবিত্র বলে মনে করা হয়। বিভিন্ন মূল্যবান অলঙ্কার দিয়ে আল-লাতের মূর্তি সজ্জিত ছিল। জায়গাটি পবিত্র মনে করা হতো। তাই সেখানে কোনো গাছ কাটা হতো না, কোনো প্রাণী শিকার করা হতো না, এমনকি মানুষের রক্ত ঝরানোও নিষিদ্ধ ছিল।
হযরত ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ, রহওয়াইহ এবং আবু সালেহ লাত শব্দটি পাঠ করতেন এর ‘তা’ বর্ণে তাশদীদ যোগ করে। তারা এর নামকরণের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে যে, এটা একটি পুরুষমূর্তি। ঐ কল্পিত পুরুষ তার জীবদ্দশায় ঘি ও ছাতু দ্বারা হাজীদের আপ্যায়ন করত। তার মৃত্যু হলে লোকেরা তার কবরের চতুর্দিকে তাওয়াফ শুরু করে দিল। পরবর্তী সময়ে তার মূর্তি বানিয়ে শুরু হলো পূজা অর্চনা। কাতাদা বর্ণনা করেছেন, তায়েফের বনী সাক্বিফের একটি প্রতিমার নাম ছিল লাত। ইবনে যায়েদ বলেছেন, নাখলা নামক স্থানে ছিল লাত নামের একটি কুঠুরি। ওরা ঐ কুঠুরির পূজা করত। [১]
আল-উজ্জা
প্রাচীন আরবের প্রধান তিন দেবীর একজন আল-উজ্জা। সে ছিল শক্তি, সুরক্ষা ও ভালোবাসার দেবী। তাকে গ্রিক দেবী আফ্রোদিতি এবং রোমান দেবী ভেনাসের সাথে তুলনা করা হয়।
এই দেবীর প্রতীক ছিল তিনটি গাছ (একেশিয়া)। পেট্রা ছিল তার প্রধান উপাসনার কেন্দ্র। মক্কা অঞ্চলেও তার উপাসনা করা হতো। মক্কার পূর্বে তাইফের নাখলা নামক স্থানে এই দেবীর মন্দির ছিল। কুরাইশরা সমৃদ্ধি ও কল্যাণের আশায় তার পূজা করত।
হিশাম ইবনে আল ক্বালবি লিখেছেন,
তার (উজ্জা) উপরে একজন আরব বাস (Buss) নামে একটি বাড়ি তৈরি করেছিল যেখানে লোকেরা ভবিষ্যদ্বাণী পেত। আরবদের পাশাপাশি কুরাইশরাও তাদের বাচ্চাদের নাম রাখত ‘আবদুল উজ্জা’। অধিকন্তু, আল-উজ্জা ছিল কুরাইশের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিমা। তারা তার কাছে যাতায়াত করত, তাকে উপহার দিত এবং কোরবানির মাধ্যমে তার অনুগ্রহ কামনা করত।
আবদুল উজ্জা নামটি আরবে বেশ জনপ্রিয় ছিল। ইবনে আল ক্বালবির মতে, আরবি কবিতাগুলোতে এই নামকে সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। এছাড়া এই নাম ধরে শপথ ও কসম নেয়া হতো।
ইবনে আল ক্বালবির বই থেকে আরো জানা যায়,
তার বোনদের মতো, পাথরের পরিবর্তে তার মূর্তিটি ছিল তিনটি একেশিয়া গাছ (বাবলা জাতীয় গাছ) এবং এই গাছের মধ্যেই দেবীর আবির্ভাব হতো বলে বিশ্বাস ছিল। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. এই গাছগুলো কেটে ফেলেন। তিনি ঐ মন্দিরের শেষ রক্ষাকর্তাকেও মেরে ফেলেন।
জুহাক বর্ণনা করেছেন, উজ্জা ছিল বনি গাতফান জনপদের একটি প্রতিমা। এটি প্রতিষ্ঠিত করে সাঈদ ইবনে সালেস গাতফানি নামে এক ব্যক্তি। সে একবার মক্কা শরীফে দেখতে পেল লোকজন সাফা ও মারওয়া পাহাড় দুটোর মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করছে। আপন জনপদে ফিরে এসে সে তাদের গোত্রের লোকদের বলল, মক্কাবাসীদের রয়েছে সাফা ও মারওয়া। তোমাদের সেরকম কিছু নেই। তারা একজনের উপাসনা করে। তোমাদের তো কোনো উপাস্য নেই।
লোকেরা বলল, তাহলে আমরা কী করতে পারি? সাঈদ বলল, আমি সবকিছু ঠিকঠাক করে দেব। একথা বলে সে সাফা ও মারওয়া পাহাড় থেকে একটি করে পাথর আনল। কিছুটা দূরত্ব রেখে এক খোলা ময়দানে পাথর দুটো স্থাপন করল। বলল, এ দুটো পাথরই তোমাদের সাফা ও মারওয়া। এরপর মধ্যবর্তী এক বৃক্ষের নিচে তিনটি বৃহৎ পাথর সাজিয়ে দিয়ে বলল, আর এটা হচ্ছে তোমাদের প্রভু। তখন থেকে লোকেরা সেখানে দৌড়াদৌড়ি করতে শুরু করল, এবং পূজা করতে লাগল মধ্যবর্তী পাথর তিনটির।[১]
মুজাহিদ বলেছেন, উজ্জা ছিল গাতফান গোত্রের আবাসভূমিতে অবস্থিত একটি বৃক্ষের নাম। গাতফানিরা ঐ বৃক্ষের পূজা করত। ইবনে ইসহাক বলেছেন, নাখলার একটি কুঠুরির নাম ছিল উজ্জা। কুঠুরিটি রক্ষণাবেক্ষণ করতো বনি শায়বানের লোকেরা। আর বনি শায়বান ছিল কুরাইশদের সঙ্গে সন্ধিবদ্ধ। কুরাইশ ও বনি কেনানাদের এটাই ছিল সর্ববৃহৎ মূর্তি। আমর ইবনে লুহাই বনি কেনানা ও কুরাইশদের বলেছিল, তোমাদের প্রভু শীতকালে তায়েফে এসে লাতের সঙ্গে এবং গ্রীষ্মকালে উজ্জার সঙ্গে কালযাপন করে। লোকেরা তাই দুটো প্রতিমাকেই সম্মান করত এবং প্রতিমা দুটোর জন্য তারা একটি করে কামরাও নির্মাণ করে। সেখানে কাবাগৃহের উদ্দেশ্যে যেমন কোরবানির পশু প্রেরণ করা হতো, তেমনি তারা কোরবানির পশু প্রেরণ করত ঐ প্রতিমা দুটির উদ্দেশ্যও। [১]
মানাত
মক্কার প্রধান তিন দেবীর একজন ছিল মানাত। সে ছিল সৌভাগ্য, দুর্ভাগ্য, সময় ও মৃত্যুর দেবী। প্রধান তিন দেবীর মধ্যে সে ছিল সবচেয়ে প্রাচীন। তাকে গ্রিক দেবী আনাঙ্কের সাথে তুলনা করা হয়।
ধারণা করা হয়, এই নামটি আরবি মূল শব্দ ‘মানা’ থেকে এসেছে যার অর্থ ‘নির্ধারণ করা’। আরেক মতানুসারে, এটি আরবি শব্দ ‘মানিয়া’ থেকে এসেছে যার অর্থ ‘ভাগ্য’। অর্থাৎ, নামের দুটি অর্থই এই দেবীর কাজের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। অনেকেই দেবতা হুবালকে এই দেবীর স্বামী বলে মনে করেন। প্রাচীন আরবের লোকেরা তার নামের সাথে মিল রেখে তাদের সন্তানের নাম রাখত ‘আবদুল মানাত’ এবং ‘জাঈদ মানাত’।
ধারণা করা হয়, মক্কা ও মদিনার মাঝামাঝি কোনো স্থানে লোহিত সাগরের তীরে মানাতের প্রধান মন্দির ছিল। তার একনিষ্ঠ উপাসক ছিল বনু আউস এবং বনু খাওরাজ।
কেউ কেউ বলেছেন, লাত, উজ্জা ও মানাত তিনটি বিগ্রহমূর্তিই ছিল মক্কায় কাবাপ্রাঙ্গণে। ইসলাম আগমনের পূর্বে লোকেরা সেগুলোর পূজা-আরাধনা করত। এছাড়া পৌত্তলিকেরা কোরবানির পশুকে মানাতের কাছে নিয়ে জবাই করত। [১]
এই দেবীর প্রাচীন প্রতিমূর্তি ছিল একটি কাঠের উপর আঁকা। তবে উল্লেখযোগ্য প্রতিমূর্তির অবস্থান ছিল আল মুসাল্লালে। তীর্থযাত্রীরা যখন এখানে আসত, তারা নিজেদের মাথা মুণ্ডন করত এবং তার মূর্তির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকত। তারা মনে করত, এই দেবীকে দর্শন না করলে তাদের তীর্থযাত্রা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে।
ইবনে আল ক্বালবির মতে, প্রাচীনকালে মক্কায় আগত তীর্থযাত্রীরা যখন কাবা তাওয়াফ করত, তারা আল লাত এবং আল-উজ্জার সাথে মানাতের নামও স্মরণ করত, যাতে তারা আল্লাহর কাছে এই দেবীদের আশীর্বাদ ও সুপারিশ পেতে পারে।