১৩১৬ সালে হিন্দুস্তানের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ, শক্তিশালী আর কৃতি শাসক সুলতান আলাউদ্দীন খিলজী মৃত্যুবরণ করেন। আলাউদ্দীন খিলজির মৃত্যুর পর শিহাব-উদ-দ্বীন খিলজি ক্ষমতায় বসলেও বেশিদিন নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেন নি। সুলতান আলাউদ্দীন খিলজি যে বছর মৃত্যুবরণ করেন, সে বছরেই সিংহাসনে বসেন কুতুব উদ্দীন মুবারক। কিন্তু প্রায় ৪ বছর হিন্দুস্তান শাসনের পর ১৩২০ সালে তিনি তারই এক বিশ্বস্ত আমির খসরু খানের হাতে নিহত হন। কুতুব উদ্দীন মুবারকের হত্যাকন্ডের সাথে সাথেই পতন ঘটে হিন্দুস্তানের অন্যতম শক্তিশালী আর প্রভাবশালী খিলজি শাসনামলের।
খসরু খান তার প্রাথমিক জীবনে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তবে পরবর্তীতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। খসরু খান দিল্লীর সিংহাসনে উপবিষ্ট হয়ে প্রথমে জনসমর্থন আদায়ের জন্য প্রচুর অর্থ দান করলেন। দিল্লির জনগণ, অভিজাত সম্প্রদায়- সবাইকেই তিনি সন্তুষ্ট করে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করলেন। এরপর তিনি নিজের স্বরুপে ফিরে গেলেন। ইবনে বতুতার বর্ননানুযায়ী,
‘খসরু মালিক (খসরু খাঁ) ক্ষমতাসীন হয়েই গো-হত্যার বিরুদ্ধে আদেশ জারি করলেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা গরুকে পূজা করে। ধর্ম ও ঔষধীয় জ্ঞানে তারা গো-মূত্র পান করে এবং তার মল দিয়ে গৃহ ও প্রাচীর লেপন করে। খসরু খাঁ-র ইচ্ছা ছিলো মুসলিমরাও এমনটিই করুক। এর ফলে মুসলিম জনসাধারণ তাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে তুঘলক শাহের পক্ষ অবলম্বন করল।’
এছাড়াও খসরু খান সিংহাসনে আরোহণ করে তার বিভিন্ন ফরমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠাতে শুরু করলো। একই রকম একটি ফরমান পৌঁছলো সুলতান আলাউদ্দীন খিলজিরই বিখ্যাত সেনাপতি গাজী মালিকের কাছে। গাজী মালিক খসরু খানের এই ফরমান ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে পায়ের নিচে ফেলে দিলেন। রাজকীয় ফরমানের প্রতি এমন অবজ্ঞা প্রদর্শনের একটি মানেই দাঁড়ায়, আর তা হলো যুদ্ধ। আলাউদ্দীন খিলজির একসময়ের বিশ্বস্ত সেনাপতি গাজী মালিক, আর খসরু খান দিল্লি সালতানাতের সিংহাসন অধিকারের প্রশ্নে পরস্পর যুদ্ধের ময়দানে মুখোমুখি হলেন।
এরপরের বর্ণনা ইবনে বতুতার নিকট থেকেই শোনা যাক। ইবনে বতুতা লিখে গেছেন,
‘সাম্রাজ্যের উপর তুঘলকের এ আক্রমণ ভয়াবহ হলো। যখন সম্রাটের (খসরু খান) সমস্ত সৈন্যই পালিয়ে গেলো, সম্রাটের সাথে আর কেউ রইলো না, তখন অশ্বপৃষ্ঠ থেকে তিনি অবতরণ করলেন। রাজপোষাক আর অস্ত্রশস্ত্র সব ফেলে দিয়ে হিন্দুস্তানের সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো মাথার চুল পিছনের দিকে ফিরিয়ে এক বনে আশ্রয় নিলেন। তিনি তিন দিন ধরে বনের মধ্যেই পালিয়ে রইলেন।’
গাজী মালিকের আক্রমণে খসরু খানের সংক্ষিপ্ত শাসনামলের পতন হলো। খসরু খানের পতনের পর ১৩২০ সালে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করলেন গাজী মালিক। সিংহাসনে আরোহণের পর তিনি ‘গিয়াসউদ্দীন তুঘলক’ উপাধী ধারণ করেন। নিজের প্রকৃত নাম গাজী মালিক অপেক্ষা গিয়াসউদ্দীন তুঘলক নামেই ইতিহাসে তিনি অধিক পরিচিত হন। সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলকের পূর্বপুরুষদের পরিচয় প্রসঙ্গে অনেক ইতিহাসবিদের ধারণা, তিনি তুঘলক নামের কোনো গোত্র থেকে এসেছেন বিধায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য ‘তুঘলক’ সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচিত। কিন্তু আবার কিছু ইতিহাসবিদই মনে করেন, ‘তুঘলক’ আসলে তাঁর ব্যক্তিগত নামের অংশ, যা তাঁর উত্তরসূরীরা নিজেদের নামের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলক ও তাঁর উত্তরসূরীদের শাসনকালই পরবর্তীতে ‘তুঘলক’ শাসনামল হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে।
ইতোমধ্যেই খসরু খানকে জঙ্গল থেকে ধরে আনা হলো। ধরে আনার পর খসরু খান সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলকের নিকট খাবার ও পানীয় চাইলেন। তাকে খাবার ও পানীয় দেয়া হলো। খসরু খান সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলককে বললেন, তিনি একজন সম্রাট ছিলেন, আর তাই তার সাথে যেন সম্রাটের মতোই আচরণ করা হয়। সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলক বললেন, ‘আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য!’
এরপর তিনি আদেশ দিলেন, খসরু খান তার সম্রাট কুতুব উদ্দীন খিলজিকে ঠিক যেভাবে হত্যা করেছিলো, তাকেও যেন ঠিক সেভাবেই হত্যা করা হয়। কুতুবউদ্দীন খিলজিকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছিলো, ঠিক সেভাবেই খসরু খানকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হলো। আর এভাবেই একজন ‘সুলতান হত্যাকারী’ পরাজিত সম্রাটের শেষ ইচ্ছাকে পালন করা হলো!
হিন্দুস্তানের তুঘলক শাসকরা ছিলেন মূলত তুর্কী বংশোদ্ভুত মুসলিম। খসরু খানের বিরুদ্ধে গাজী মালিকের বিদ্রোহের (গিয়াসউদ্দীন তুঘলক) ফলশ্রুতিতে হিন্দুস্তানের তুঘলক সালতানাতের যুগ শুরু হয়। খসরু খানের শাসনের ফলে দিল্লী সালতানাতের বিভিন্ন প্রদেশে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলক বিচক্ষণতার সাথে সব বিশৃঙ্খলা নির্মুল করে দিল্লী সালতানাতে শান্তি ফিরিয়ে আনেন।
সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির শাসনামলে বিভিন্ন সংস্কার কাজের জন্য ভূমিকর বৃদ্ধি করা হয়েছিলো। সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলক এই ভূমিকর হ্রাস করে উৎপন্ন ফসলের ১০ ভাগের ১ ভাগে নামিয়ে আনলেন। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় খরচে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় কৃষিকাজে সেচের জন্য খাল খনন করা হলো। সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলকের অমর কীর্তি হচ্ছে তাঁরই নির্মিত তুঘলকাবাদ। পুরো শহরটি গোলাপী রঙয়ের গ্রানাইট পাথর দ্বারা তৈরি করা হয়েছিলো। নিরাপত্তার জন্য শহরটি উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিলো। এই প্রাচীরগুলোকেও দেখলে অনেকটা দুর্গের মতো মনে হয়। শহরটির মাঝখানে একটি কৃত্রিম হ্রদ ছিলো, যদিও হ্রদটি এখন পুরো শুকিয়ে গেছে। দুই একটি সমাধিসৌধ ছাড়া পুরো শহরটিই এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়ে আছে।
১৩২৩ সালে সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলক তেলেঙ্গানার কাকতীয় রাজা প্রতাপ রুদ্রের বিরুদ্ধে একটি অভিযান চালান। কাকতীয় রাজ্যের রাজধানী ওয়ারঙ্গল দখল করে এর নাম রাখা হলো সুলতানপুর। পুত্র জুনাহ খানের নেতৃত্বে দাক্ষিণাত্যেও তিনি একটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। সে সময় বাংলায় বিভিন্ন স্বাধীন সুলতানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিলো। সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলক বাংলাকে দিল্লী সালতানাতের অধীনে নিয়ে আসতে চাইলেন। ১৩২৪ সালে তিনি বাংলায় অভিযান চালালেন। ১৩২৪ সালের শেষের দিকে সফলতার সাথে বাংলা অভিযান সমাপ্ত করে সুলতান গিয়াসদ্দীন তুঘলক দিল্লী অভিমুখে রওয়ানা দিলেন। দিল্লীতে প্রবেশের পূর্বে তিনি তাঁর পুত্র জুনাহ খানকে দিল্লীর উপকন্ঠে একটি কাঠের মঞ্চ তৈরির নির্দেশ দেন। পুত্র জুনাহ খান পিতার ইচ্ছানুযায়ী দ্রুত কাঠের একটি মঞ্চ তৈরি করেন। কিন্তু সুলতান যখন তাঁর হাতি নিয়ে মঞ্চের একটি অংশে ওঠেন, সাথে সাথেই মঞ্চটি ভেঙ্গে পরে। কাঠের নিচে চাপা পরে মৃত্যুবরণ করেন হিন্দুস্তানের তুঘলক রাজবংশের প্রথম সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলক।
তবে সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলকের এই মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা নাকি এর পেছনে তাঁর পুত্র জুনাহ খানের হাত আছে, তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। নির্দিষ্ট করে কিছুই বলা যায় না। তাই আপাতত এই প্রসঙ্গ বাদ থাকুক।
১৩২০-২৫ সাল পর্যন্ত মোট ৫ বছর হিন্দুস্তানের দন্ডমুন্ডের কর্তা গিয়াসউদ্দীন তুঘলকের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র উলুগ খাঁ জুনাহ খান দিল্লির রাজসিংহাসনে বসেন। ইতিহাসে তুঘলক বংশের এই শাসক মুহাম্মদ বিন তুঘলক নামেই বেশি প্রসিদ্ধ। ‘মুহাম্মদ বিন তুঘলক’ নামের মানে হচ্ছে তুঘলকের পুত্র মুহাম্মদ। ১৩২৫ সালে সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের সিংহাসনে আরোহণের পর হিন্দুস্তান যেন এক নতুন যুগে প্রবেশ করলো। তাঁর মতো প্রতিভাসম্পন্ন সুলতান হিন্দুস্তানের ইতিহাসে আর কখনো আসে নি।
সিংহাসনে বসেই তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে লাগলেন। রাজনৈতিক দিক থেকে তিনি একজন বৈপ্লবিক চিন্তাধারার মানুষ ছিলেন। সমগ্র হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক ঐক্যে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। সাম্রাজ্যের আকার বিরাট হওয়ায় রাজধানী থেকে দূরবর্তী অঞ্চলের শাসকরা প্রায়ই অবাধ্যতা প্রদর্শন করতেন। আর তাই তিনি তাঁর গোটা সাম্রাজ্যকে একটি একক কেন্দ্রীয় কমান্ডের আওতায় নিয়ে আসতে চাইছিলেন।
মুহাম্মদ বিন তুঘলকের সমসাময়িক সময়ে পারস্যের আবু সৈয়দ আর মিশরের আন নাসিরের মাঝে বেশ কিছু ব্যাপার নিয়ে মনোমালিন্য বেধে যায়। আর তাই সুলতান খোরাসান অভিযানের জন্য প্রায় ৩,৭০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল সেনাবাহিনী প্রস্তুত করেন। কিন্তু পরবর্তীতে মিশর আর পারস্যের মাঝে সমস্যা মিটে গেলে তিনি তার এই সেনাবাহিনী ভেঙ্গে দিতে বাধ্য হন। এছাড়া হিন্দুস্তান আর চীন সীমান্তের উদ্ধত পার্বত্য সর্দারদের বিরুদ্ধে কারাচল (অথবা কুর্মাচলে) একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। ১৩২১-২২ সালে তিনি বারাঙ্গলে একটি অভিযান প্রেরণ করেন।
সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের সময়ের সবচেয়ে আলোচিত একটি ঘটনা হচ্ছে তাঁর রাজধানী পরিবর্তন করা। আলাউদ্দীন খিলজির এক সেনাপতি মালিক কাফুর দাক্ষিণাত্য দখল করে নেন। মুহাম্মদ বিন তুঘলক পাঞ্জাব বা সিন্ধুর চেয়ে দাক্ষিণাত্যকে গুরুত্ব দিতেন বেশি। দাক্ষিণাত্যে স্বর্ণ, রৌপ্য ও অন্যান্য মূল্যবান পাথরের খনি ছিলো। এসব সম্পদ হিন্দুস্তানের উন্নয়নের জন্য তিনি ব্যবহার করতে চাইছিলেন। কিন্তু মালিক কাফুর দাক্ষিণাত্য জয় করে নিলে সুলতানের পরিকল্পনায় ব্যঘাত ঘটে। আর তাই সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক তাঁর রাজধানী দিল্লি থেকে প্রায় ৭০০ মাইল দূরের বর্তমান ভারতের মহারাষ্ট্রের দেবগিরিতে স্থানান্তর করেন। তিনি দেবগিরির নামকরণ করেন দৌলতাবাদ। তবে আসলে দিল্লী থেকে তিনি তাঁর রাজধানী স্থানান্তর করেন নি, দেবগিরির ভৌগোলিক সুবিধার কথার বিবেচনা করে একে সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছিলেন। সীমান্ত প্রদেশ থেকে দিল্লির দুরত্ব কম হওয়ার দিল্লীকে সবসময় মঙ্গোল আক্রমণের হুমকিতে থাকতে হতো। এছাড়া দিল্লী থেকে দাক্ষিণাত্যের দূরত্ব অনেক বেশি ছিলো, যার ফলে দাক্ষিণাত্য থেকে প্রায়ই বিদ্রোহ হতো। তাই সুলতান চাচ্ছিলেন সাম্রাজ্যের মাঝামাঝি কোনো জায়গায় আরেকটি রাজধানী স্থাপন করতে, যাতে সাম্রাজ্যের সবদিকেই কেন্দ্রের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে দেবগিরি দিল্লীর মতো গুরুত্ব ধরে রাখতে পারে নি। দিল্লীর সাথে রাজদরবার কিংবা দিল্লীর মুসলিমদের যে আত্মিক বন্ধন ছিলো, তা দেবগিরিতে ছিলো না। ফলে রাজধানী স্থাপনের ২/৩ বছর পরেই ১৩৩৫-৩৬ সালে সুলতান তাঁর রাজদরবার নিয়ে পুনরায় দিল্লীতে চলে যান।
মুহাম্মদ বিন তুঘলক দোয়াব অঞ্চল নিয়ে বেশ ভালো সমস্যায় পড়েছিলেন, যার কারণে দোয়াব নিয়ে সুলতানের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ পাওয়া যায়। খিলজি বংশের পতনের ফলে দিল্লী সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিশৃংখলার কারণে দোয়াব অঞ্চলে বেশ কয়েক বছর কর আদায় করা হয় নি। সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক দিল্লীর সিংহাসনে উপবিষ্ট হওয়ার পর এই কর আদায়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু দোয়াবে আসলে সেই সময় এই কর আদায় করার মতো অবস্থায় ছিলো না। কারণ দোয়াব পরপর ৭ বছর, কোনো কোনো বর্ণনামতে ১২ বছর অনাবৃষ্টিতে ভুগছিলো। আর তাই দোয়াবে তীব্র দুর্ভিক্ষ চলছিলো। এই অবস্থায় তিনি তাঁর প্রজাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানীয়, শস্যবীজ আর রাষ্টীয় কোষাগার থেকে ঋণের ব্যবস্থা করে দেন। তবে এই দুর্ভিক্ষে জনগণের দুর্ভোগ যে তাঁর দীর্ঘশাসন গৌরবের অনেকটাই বিনষ্ট করে দিয়েছিলো এ কথা অস্বীকার করা যাবে না।
মুহাম্মদ বিন তুঘলকের আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিলো হিন্দুস্তানে তাম্রমুদ্রার প্রচল করা। সুলতানকে তাঁর অপরিমিত উদারতার দরুন প্রচুর দান, দেবগিরিতে নতুন রাজধানী স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয়, দুর্ভিক্ষ আর পুনরায় দিল্লীতে পুনর্বাসনের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। রাজকোষের উপর চাপ কমাতে সুলতান তাই স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রার সমমূল্যের তাম্রমুদ্রার প্রচলন করেন। কিন্তু হিন্দুস্তানবাসী তাম্রমুদ্রার উপর ঠিক বিশ্বাস আনতে পারছিলো না। তাই তারা তাম্রমুদ্রার সাথে স্বর্ণ কিংবা রৌপ্যমুদ্রা বিনিময় করতো না।
এক্ষেত্রে একটি অভিযোগ অবশ্য আছে যে, তাম্রমুদ্রা খুব সহজে নকল করা যেত। আর বাজার নকল তাম্রমুদ্রায় ছেয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু অভিযোগটি আসলে সত্য নয়, কারণ আস্থাহীনতা সৃষ্টি হওয়ায় সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক বাজারের সব তাম্রমুদ্রা পরবর্তীতে স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্মিত মুদ্রা দ্বারা প্রতিস্থাপন করেছিলেন। যদি তাম্রমুদ্রা ব্যপকহারে নকল করা হতো, তাহলে তিনি এ কাজে সফল হতেন না। সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক অবশ্য তাম্রমুদ্রা ছাড়াও প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা এবং রৌপ্যমুদ্রা বাজারে ছেড়েছিলেন। তার স্বর্ণমুদ্রায় বিভিন্ন আরবী ক্যালিগ্রাফি থাকতো। তার স্বর্ণমুদ্রাকে বলা হতো ‘টংকা’। তার রৌপ্যমুদ্রাগুলো ‘আধুলী’ নামে পরিচিত ছিলো।
মুহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসনের শেষের দিকে হিন্দুস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে বিদ্রোহ মাথাচারা দিয়ে ওঠে। সিন্ধু আর মুলতানে তার বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহগুলো হয়েছিলো, তিনি তা দমন করতে সক্ষম হন। তার শাসনামলে মোঙ্গলরা আরেক দফায় হিন্দুস্তানে আক্রমণ চালায়। আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কুতলুগ খাজার ভাই তারামাসিরিন। মুহাম্মদ বিন তুঘলক কালানাউরের যুদ্ধে মোঙ্গলদের গতিরোধ করেন। ১৩৩৭ সালে সুলতান হিমাচল প্রদেশে একটি অভিযান পাঠান। কিন্তু এই অভিযানটি ব্যর্থ হয়। শাসনামলের শেষ দিকে তিনি বাংলার সোনারগাঁ, লক্ষ্ণৌতি আর সাতগাঁও-এ তাঁর নিয়ন্ত্রণ হারান। ১৩৪১ সালে দাক্ষিণাত্য থেকে তার বিরুদ্ধে আরেকটি বিদ্রোহ হয়। গুজরাটের আমিররা জোটবদ্ধ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। তবে তিনি এই আমিরদের পরাজিত সক্ষম হন। সুলতানের অন্যদিকে মনোযোগের সুযোগে হাসান গাঙ্গু নামের একজন দৌলতাবাদ আক্রমণ করে বাহমনি সালতানাত নামে নতুন একটি রাজ্য গঠন করে। ১৩৫১ সালে সিন্ধুতে একটি বিদ্রোহ দমন অভিযানকালে সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক মৃত্যুবরণ করেন।
শাসক হিসেবে এবং ব্যক্তিগত জীবনেও মুহাম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন উদার নীতির অনুসারী। ধর্মের দিক থেকে তিনি বিশুদ্ধ ইসলামের অনুসারী ছিলেন। আর রাজনীতির ক্ষেত্রে যুগ থেকে অনেকদূর এগিয়ে গিয়ে চিন্তা করতেন। তাঁর এই চিন্তাধারাই পরবর্তীতে তাঁর সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, গণিত আর জ্যোতির্বিজ্ঞানে একজন দক্ষ পন্ডিত ছিলেন। এছাড়া চিকিৎসাবিজ্ঞানেও তাঁর ভালো দখল ছিলো। তিনি আরবি, ফার্সি, তুর্কী আর উর্দুসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন কোরআনের হাফেজ ছিলেন, আর মুসলিমরা যাতে ঠিকঠাকভাবে ইসলাম মেনে চলে, সেই দিকে লক্ষ্য রাখতেন। তার সময়ে সাম্রাজ্যে ব্যভিচার, মদ্যপান ইত্যাদি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিলো। তিনি নিজেও এসবের ধারেকাছে যেতেন না। তিনি যে শুধু মুসলিম সমাজের সংস্কার করতে চেয়েছিলেন তা না, হিন্দু ধর্মের ভয়াবহ সতীদাহ প্রথাও তিনি বিলুপ্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হিন্দু ধর্মের নেতৃস্থানীয়দের হস্তক্ষেপে তিনি তাঁর পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। তিনি নিজে মুসলিম ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন বিধায় অনেক মুসলিমই বিভিন্নভাবে সুযোগ নিতে চেয়েছিলো, কিন্ত তিনি শুধুমাত্র মুসলিম বলে কাউকে অন্যায় কোনো বিষয়ে অনুমোদন দেন নি। একজন সম্রাট হিসেবে তাঁর কাছে মুসলিম ধর্মালম্বী যা, হিন্দু ধর্মালম্বীও ঠিক তাই ছিলো।
১৩৫১ সালে সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের সিন্ধু অভিযানকালে আকস্মিক মৃত্যু হলে সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আর তাই সুলতানের ভ্রাতুষ্পুত্র মালিক ফিরোজ শাহ ১৩৫১ সালে তুঘলক সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসেন। তিনি ফিরোজ শাহ তুঘলক নামেই বেশি পরিচিত। ১৩৮৮ সাল পর্যন্ত এক সুদীর্ঘ সময় তিনি হিন্দুস্তান শাসন করেন।
ফিরোজ শাহ তুঘলক জনদরদী শাসক ছিলেন। তাঁর সময়ে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে জনহিতকর বিভিন্ন কাজ হয়েছে। নতুন নতুন শহর, মসজিদ, মাদ্রাসা, পথিকদের বিশ্রামের জন্য সরাইখানা, উদ্যান, স্নানাগার, পানি সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য খাল, পথিকদের চলাচলের জন্য রাজপথ, দাতব্য চিকিৎসালয় এবং আনুমানিক প্রায় ১,০০০ বিদ্যালয় তাঁর শাসনামলে হিন্দুস্তানের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এসব কীর্তির জন্য তিনি বেশ প্রশংসিত ছিলেন।
শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ চরিত্রের অধিকারী। সম্রাট হওয়াটাকে তিনি ভোগ-বিলাস কিংবা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মাধ্যম হিসেবে না নিয়ে দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছিলেন এবং সেই দায়িত্ব ঠিকঠাকভাবে পালন করতে পারছেন কিনা, তা নিয়ে সবসময় চিন্তিত থাকতেন। তিনি হিন্দুস্তানের সংহতি নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলেন। তবে তুঘলকদের রাজ্য বিস্তার নীতি থেকে কিছুটা সরে আসেন। কারণ ইতোমধ্যেই বিশাল আকারের জন্য তুঘলক সাম্রাজ্যে পতনের বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছিলো। তবে তিনি বাংলা, সিন্ধু আর দাক্ষিণাত্যের তুঘলক ভূমিগুলো পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন। ১৩৫৩ সালে ফিরোজ শাহ তুঘলকের সময় বাংলার ক্ষমতায় ছিলেন শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ-এর নেতৃত্বাধীন নবপ্রতিষ্ঠিত ইলিয়াস শাহী সালতানাত। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ইলিয়াসশাহী সালতানাত আক্রমণ করেন। তবে ছোটখাট কিছু সংঘর্ষের পর শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ-এর সাথে শান্তি চুক্তি করেন। বাংলার সাথে তাঁর এই চুক্তিতে উভয় পক্ষই লাভবান হয়।
১৩৫৮ সালে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের সময় মোঙ্গলরা হিন্দুস্তানে আক্রমণ চালিয়ে দিপালপুর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ফিরোজ শাহ তুঘলক দিপালপুরে তাদের বাঁধা দান করে পরাজিত করেন। হিমাচল প্রদেশের নগরকোটে আক্রমণ চালিয়ে তিনি নগরকোটের রাজাকে পরাজিত করেন। তিনি নগরকোটের নামকরণ করেন ‘মোহাম্মদাবাদ’। তিনি পূর্বের তুঘলক ভূমিগুলো উদ্ধারের চেষ্টা ছাড়া আর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য যুদ্ধযাত্রা করেন নি। তাঁর সময়ে আসলে হিন্দুস্তান বেশ শান্তই ছিলো।
৩৭ বছর শাসন করার পর ১৩৮৮ সালে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথেই হিন্দুস্তানে কমতে থাকে তুঘলক রাজবংশের প্রভাব।
মৃত্যুর পূর্বে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক তাঁর পুত্র মুহাম্মদ শাহকে সিংহাসনের উত্তরাধীকার হিসেবে ঘোষণা করে যান। মৃত্যুর পর মুহাম্মদ শাহ গিয়াসউদ্দীন বিন তুঘলক উপাধি নিয়ে তুঘলক সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের দাস দলপতিরা নতুন সুলতানকে অস্বীকার করে গিয়াসউদ্দীন তুঘলকের ভাই ফতেহ খানের নাতি আবু বকর খানকে সিংহাসনে বসানোর চেষ্টা করে। সুলতান গিয়াসউদ্দীন বিন তুঘলক আবু বকর খানের বিরুদ্ধে একটি সেনাবাহনী প্রেরণ করেন, কিন্তু তাঁর সেনাবাহিনী ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসে। এ সময় গিয়াসউদ্দীন বিন তুঘলকের বেশ কিছু আমির আবু বকর খানের সাথে যোগদান করে।
১৩৮৯ সালে সুলতান গিয়াসউদ্দীন বিন তুঘলক তাঁর বিরোধীদের হাতে নির্মমভাবে হত্যাকান্ডের শিকার হন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি মোট ৩ বার সিংহাসনচ্যুত হন কিন্তু তিনি ৩ বারই সিংহাসন পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। সুলতান গিয়াসউদ্দীন বিন তুঘলকের শাসনকাল স্থায়ী হয়েছিলো মাত্র ৫ মাস ১৮ দিন।
গিয়াসউদ্দীন বিন তুঘলকের মৃত্যুর পর আবু বকর খান সিংহাসনে বসেন। ১৩৮৯-৯০ সাল, অর্থাৎ মাত্র এক বছর তিনি হিন্দুস্তান শাসন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তুঘলক সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসেন মুহাম্মদ শাহ। তিনি ১৩৯৪ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। ১৩৯৪ সালে সিংহাসনে বসেন হুমায়ুন খান। তাঁর উপাধি ছিলো আলাউদ্দীন সিকান্দার শাহ। তিনি মুহাম্মদ শাহ-এর পুত্র ছিলেন। তবে মাত্র ১ মাস পরেই তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হলে মুহাম্মদ শাহ ইবনে মুহাম্মদ শাহ সিংহাসনে বসেন। তাঁর উপাধি ছিলো নাসরুদ্দীন মাহমুদ। তাঁর শাসনামলেই জৌনপুরে শর্কীরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
ক্রমাগত শাসক পরিবর্তনের কারণে সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় শাসন ভেঙ্গে পড়ে। চারদিকে স্বাধীন শাসকদের উদ্ভব ঘটতে থাকে। সুলতান নাসরুদ্দীন মাহমুদ শাহ কেন্দ্রীয় শাসন পুনরুদ্ধার করতে চাইলেন। তিনি বিদ্রোহী শাসদের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করতে লাগলেন। গোয়ালিয়র পুনরুদ্ধারে তিনি নিজে সেনাবাহিনীর সাথে অংশ নিয়ে দিল্লী ত্যাগ করেন। সুলতানের রাজধানী ত্যাগের সুযোগের অপেক্ষায় থাকা বিরোধী আমিররা এবার সক্রিয় হয়ে ফতেহ খানের পুত্র নুসরাত খানকে ১৩৯৫ সালে দিল্লীর সিংহাসনে বসিয়ে দেয়। নুসরাত খান নাসরুদ্দীন নুসরাত শাহ উপাধী ধারণ করেন। ফলশ্রুতিতে দুই সুলতানের নিজেদের অধিকার রক্ষার্থে লড়াই করতে থাকেন।
কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতার সুযোগে দীপালপুরের শাসক সারাং খান ও মুলতানের শাসক খিজির খান ১৩৯৫ সালে এক রক্তক্ষয়ী লড়াই শুরু করেন। সারাং খান তাঁর ভাই মল্লু ইকবাল খাঁ’র সহায়তায় মুলতান দখল করে নেন। এদিকে খোকার উপজাতী নেতা সুজা খোকার ইরানের দিকে চলে যান। তিনি বিশৃঙ্খল হিন্দুস্তানের দখল নিতে ‘একজন’-কে হিন্দুস্তানে আক্রমণ চালাতে অনুরোধ করেন। সেই ‘একজন’ কিন্তু সুজা খোকারের অনুরোধ রেখেছিলেন। ‘একজন’ এসেছিলেন ঝড়ের বেগে, ঝড়ের বেগে তিনি আক্রমণ চালালেন, ঝড়ের বেগে হিন্দুস্তান দখল করলেন, আবার ঝড়ের বেগেই হিন্দুস্তান ত্যাগ করে চলে গেলেন। আর এর সাথে সাথেই চূড়ান্ত পতন ঘটলো হিন্দুস্তানের অন্যতম শক্তিশালী তুঘলক সাম্রাজ্যের। যা-ই হোক, এই ‘একজন’-এর পরিচয় আগামী পর্বের জন্যই তোলা থাকলো।
তুঘলক শাসনামলে হিন্দুস্তানে মুসলিম সাম্রাজ্য বিশাল আকার ধারণ করেছিলো। প্রায় ২৩টি প্রদেশে ভাগ করা হয়েছিলো তুঘলক সাম্রাজ্যকে। এর ভেতরে পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, বিহার, ত্রিহুত, বাংলা, সিন্ধু, গুজরাট, দাক্ষিণাত্য আর মালওয়াও অন্তর্ভুক্ত ছিলো। অন্যান্য বৃহৎ সাম্রাজ্যগুলোর মতোই তুঘলক সাম্রাজ্যের পতনের মূল কারণ ছিলো সাম্রাজ্যের বিশাল বিস্তৃতি। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে সাম্রাজ্য বড় হলে সাম্রাজ্যের রাজধানীর সাথে বিভিন্ন অঞ্চলের যোগাযোগে অসুবিধা হতো। ফলে সুযোগ সন্ধানীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করতো, বিদ্রোহ-বিদ্রোহ দমন এই চক্রে আবর্ত হয়ে সাম্রাজ্যের ক্ষয় হতে থাকতো। স্বার্থান্বেষী আমিররা তাদের নিজ নিজ স্বার্থ অনুযায়ী দল-বদল করতো। এই শ্রেণীর আমিররা গিরগিটির চেয়েও দ্রুত নিজেদের চেহারা পাল্টাতো, আর তারা স্বভাবের দিক থেকে শেয়ালের চেয়েও ছিল ধূর্ত। নিজেদের স্বার্থের জন্য রাষ্ট্রকে বিক্রি করে দিতেও তারা পেছাত না। এই শ্রেণীর আমিরদের জন্য কত শক্তিশালী সম্রাটের যে পতন ঘটেছিলো, তার কোনো হিসেব নেই!
তুঘলক সাম্রাজ্যের পতন অবশ্য মুহাম্মদ বিন তুঘলকের সময় থেকেই দেখা যাচ্ছিলো। তার মানে এই না যে মুহাম্মদ বিন তুঘলক যোগ্য শাসক ছিলেন না। বরং তিনি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অনেক শাসকের তুলনায় বেশি যোগ্য ছিলেন। হিন্দুস্তানের ইতিহাসে তার মতো যোগ্য, মেধাবী, উদ্যমী, যুগের থেকে একটু এগিয়ে চলা শাসক খুব কমই এসেছেন। কিন্তু সমস্যা হলো, তার এই স্বকীয় বৈশিষ্টগুলোই তাঁর সাম্রাজ্যের পতনের কারণ হয়ে দেখা গিয়েছিলো। হিন্দুস্তানের মানুষ আসলে তাঁর সংস্কারমূলক কর্মকান্ডের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝতেই পারে নি! ফলে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাকে বিদ্রোহ মোকাবেলা করতে হয়েছিলো। তাছাড়া পরবর্তী শাসকেরা যোগ্যতার দিক থেকে পূর্ববর্তী শাসকদের ছাপিয়ে যেতে পারেন নি। এছাড়া আমিরদের বিরোধীতা আর বিশ্বাসঘাতকতার মোকাবেলাও করতে হয়েছিলো তাদের। বাইরের শত্রুকে চাইলেই পরাজিত করা যায়, কিন্তু ভেতরের শত্রুদের পরাজিত করবে কে?
তথ্যসূত্র:
১। বাবরনামা (জহির উদ দিন মুহাম্মদ বাবর, অনুবাদঃ মুহম্মদ জালালউদ্দীন বিশ্বাস)
২। ইবনে বতুতার সফরনামা (অনুবাদ: মুহম্মদ জালালউদ্দীন বিশ্বাস)
৩। ইতিহাসের ইতিহাস- গোলাম আহমেদ মোর্তজা
৪। মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়- সাহাদত হোসেন খান
৫। তারিখ-ই-ফিরোজশাহী (জিয়াউদ্দীন বারানী)
৬। ভারতবর্ষের ইতিহাস- কোকা আন্তোনোভা, গ্রিগোরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি
৭। বিশ্বসভ্যতা- এ. কে. এম. শাহনাওয়াজ
এই সিরিজের আগের পর্ব
১। প্রাক-মুঘল যুগে হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা
২। তরাইনের যুদ্ধ: হিন্দুস্তানের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া দুই যুদ্ধ
৩। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: দাস শাসনামল
৪। রাজিয়া সুলতানা: ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক
৫। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: খিলজী শাসনামল
ফিচার ইমেজ- Youtube.com