
‘ইউক্রেনের ইতিহাস’ সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে আজ থাকছে কিয়েভান রুশের কথা। কী এই কিয়েভান রুশ, কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল, কীভাবে ভেঙে গিয়েছিল, মাঝের সময়ে কী কী হয়েছিল- এসব নিয়েই এই পর্ব।
বর্তমান ইউক্রেনীয়দের পূর্বপুরুষ বলা হয়ে থাকে স্লাভদের (Slavs)। এরা মূলত ইউরেশীয় অঞ্চলের বাসিন্দা, যারা ধীরে ধীরে ইউরোপের পূর্বাঞ্চলের দিকে ছড়াতে থাকে। ইউক্রেনে তারা নিজেদের উপস্থিতি ভালভাবে প্রকাশ করতে শুরু ৬ষ্ঠ শতকের দিক থেকে। ৭ম শতাব্দীর শুরু থেকেই তারা ইউক্রেন থেকে ছড়িয়ে যেতে থাকে তার আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে। স্লাভরা নতুন কোনো জায়গাতে দখলদার হিসেবে কখনোই যেত না। তারা নতুন স্থানে গিয়ে কলোনি তৈরি করে বসবাস করত। তাই তাদের ইউরোপে ছড়িয়ে পড়াতে এক বাইজেন্টাইনদের ছাড়া অন্য কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জেরই মুখোমুখি হতে হয়নি।
বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকায় তাদের যে অংশ যে অঞ্চলে ছিল, তারা সেই অঞ্চলের ভাষার সাথে নিজেদের ভাষা মিলিয়ে ফেলছিল, এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়াই বটে। তবে এভাবে মূল স্লাভিক ভাষা থেকে তাদের অনেকেরই ভাষা পরিবর্তিত হতে হতে একপর্যায়ে তিন ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ইতিহাসবিদরা তাদের চিহ্নিত করেছে ইস্ট স্লাভিক, ওয়েস্ট স্ল্যাভিক, এবং সাউথ স্লাভিক হিসেবে, যাদের মধ্যে ইস্ট স্লাভিকদের বসবাস ছিল রাশিয়া, ইউক্রেনের মতো অঞ্চলে। ৭ম এবং ৮ম শতাব্দীতে তারা রাশিয়া, ইউক্রেন এবং বেলারুশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে, নিজেদের বসতি স্থাপন করে।
তিন ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়া এই স্লাভদের কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব ছিল না, তাদের কোনো নির্দিষ্ট একজন শাসকও ছিল না। তারা এত দূরদূরান্তে চলে যাওয়ার পরও তাদের ঐক্যের একমাত্র জায়গা ছিল একই দেবতার উপাসনা। ঐতিহাসিকগণ তাদের চিহ্নিত করেছেন কর্মঠ, অধ্যবসায়ী, সহনশীল হিসেবে। তারা যুদ্ধ, শীত, উষ্ণতা, জঙ্গল, গিরিখাত সবকিছুই জয় করে বেঁচে থাকতে পারত।
৮ম শতাব্দীতে ইস্ট স্লাভিকরা ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন করে আরবের সাথে। এই শতাব্দীর শেষেই তুরস্কের খাজারদের (Khazars) সাথে তাদের ব্যবসায়িক চুক্তি সম্পন্ন হয়। এই খাজাররা সে সময়ের রাশিয়া, ইউক্রেন, ক্রিমিয়া, কাজাখস্তানসহ মোটামুটি এক বিশাল অঞ্চল জুড়ে ব্যবসায়িক রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই সময়ে ইউক্রেনের কিছু অঞ্চলে ভাইকিংরাও প্রবেশ করে। সময়ের হিসেবে এরও প্রায় ১৫০ বছর পর কিয়েভান রুশ (Kievan Rus’) প্রতিষ্ঠিত হয়। কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই কিয়েভান রুশ- এ নিয়ে মতপার্থক্য আছে ইতিহাসবিদদের মাঝে। কিছু মতপার্থক্য রাজনৈতিক হলেও অধিকাংশই স্বাভাবিক।

‘Bygone Years’ নামক প্রাচীন স্লাভিক উপাখ্যানে কিয়েভান রুশের সৃষ্টির গল্প বলা আছে। সেখানকার ভাষ্য অনুযায়ী- ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ভাইকিংরা এই অঞ্চলে আসে এবং আধিপত্য বিস্তার করার একপর্যায়ে স্লাভসহ অন্যদের বাধ্য করে ভাইকিংদের রাজস্ব দিতে। ওই একই সময়ে খাজাররা পলিয়ানিয়ান (Polianians), সেভেরিয়ানদের (Severians) উপর করারোপ করে। ৮৬০-৬২ খ্রিস্টাব্দে ভাইকিংরা যাদের উপর রাজত্ব করত তারা বিদ্রোহ করে বসে, এবং নিজেদেরকে নিজেরাই শাসন করতে চায়। কিন্তু তাদের নিজেদের কোনো আইন ছিল না, কেন্দ্রীয় সরকারের মতো কোনো কিছু ছিল না, নির্দিষ্ট শাসক ছিল না। শুনতে অবাক লাগলেও সত্য যে তারা নিজেদের শাসন করার জন্য ভাইকিংদের আমন্ত্রণ জানায়। তারা একজনকে প্রিন্স হিসেবে মানতে চায় যে নির্দিষ্ট আইনের মাধ্যমে তাদের পরিচালিত করবেন। উপাখ্যানমতে, ভাইকিং রাজা ওলেগের (Oleg, Oleh’) নেতৃত্বে ৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে কিয়েভান রুশের সৃষ্টি।

এই উপাখ্যান এবং অনেক ঐতিহাসিকগণের মতে, এই ভাইকিং বা ভ্যারাঙ্গিয়ানদের হাতেই কিয়েভান রুশের শুরু। তবে এর বিপরীতেও মতামত আছে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, ভাইকিংরা না, স্লাভরাই কিয়েভান রুশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। এই মত ধারণ করে তা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চলেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকাকালীনই। সোভিয়েত ঐতিহাসিকদের এই মতের পক্ষ নেয়াটা রাজনৈতিক হলেও কিয়েভান রুশের সৃষ্টির পেছনে মূলত কারা ছিল সেটা নিয়ে সত্যিই তর্ক-বিতর্ক আছে। তবে কিয়েভান রুশের শুরুর দিকের শাসকরা ভাইকিংদের মধ্য থেকে হওয়ায় প্রথম মতই অধিকতর গ্রহণযোগ্য।
কিয়েভান রুশ শব্দের অর্থ কী? কিয়েভান রুশের সৃষ্টির পেছনে মূল ভূমিকা কাদের সেই মতপার্থক্যের উপর ভিত্তি করেই হয়তো কিয়েভান রুশের অর্থও একেকজনের কাছে একেকরকম। কিয়েভান শব্দটা কিয়েভ থেকে এসেছে। নিপার নদীর তীরবর্তী কিয়েভে এই সাম্রাজ্যের সৃষ্টি বলেই এই নাম। মূল মতপার্থক্য আসলে রুশ শব্দটুকু নিয়ে, যারা বিশ্বাস করে কিয়েভান রুশের সৃষ্টি ভাইকিংদের হাত ধরে, তাদের মতে রুশ (Rus’) শব্দ দ্বারা ভাইকিংদের বোঝানো হতো, পুরনো উপাখ্যানগুলো এমনটাই বলে থাকে। এদেরই একাংশের মতে Rus’ শব্দটি এসেছে ফিনিশ শব্দ ‘Ruotsi’ থেকে যা দ্বারা সুইডিসদের বোঝাত। সেসময়ে ফিনিশদের সাথে ভাইকিং এবং স্লাভদের ভালো সম্পর্ক থাকাটা এই মতের পক্ষের পাল্লা ভারী করে। এর বিরোধী মতের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকগণ বলে থাকেন, Rus’ শব্দটি এসেছে ইউক্রেনের রুশনা নদীর নাম থেকে। কেউ কেউ আবার বলেন, রুশ শব্দটি Roxolany-দের সাথে সম্পর্কিত, যাদের নাম আবার এসেছে ইরানিয়ান শব্দ rhos থেকে, যার অর্থ আলো।
কিয়েভান রুশ যারাই প্রতিষ্ঠা করুক না কেন, এর মূল উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন করা। অনেকেই একে আবার ভারতবর্ষ শাসন করা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথেও তুলনা করে থাকেন। সেসময় ব্যবসা-বাণিজ্যের ঘাঁটি হিসেবে কিয়েভ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পৃথিবীর বহু বড় বড় শহর, যেমন- কোনো একটি নদীকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয়েছে, কিয়েভও তাই। নিপার এমন এক নদী যার মাধ্যমে একদিকে বাল্টিক থেকে, অন্যদিকে বাইজেন্টাইন পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপন করা যেত। আরবদের সেসময়কার ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র বাগদাদ পর্যন্ত পৌঁছানোর পথও এই নিপার নদী করে দিত।
কিয়েভান রুশের শুরুর দিকের শাসকেরা ভাইকিং। ভাইকিং ওলেগ কিয়েভান রুশের প্রথম শাসক। ৯১২ সাল পর্যন্ত তার শাসনেই চলে কিয়েভান রুশ। তার পরবর্তী শাসক ইগর (Ihor) তার থেকে তুলনামূলক কম সফল। ৯৪৫ সালে তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী হেলগা (Olga, Olha) পরবর্তী ১৭ বছর শাসন করেন। এই সাম্রাজ্য তার শিখরে পৌঁছায় ৯৮০ সালে ক্ষমতায় আসা ভলোদিমিরের (Volodymyr, Vladimir the Great) হাত ধরে, যা তার ছেলে ইয়ারোস্লাভের (Yaroslav the Wise) রাজত্ব পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ৯৮৮ সালে ভলোদিমিরের খ্রিস্টধর্মকে তার রাজত্বের ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবে তাকে অনেকটাই শক্ত অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছিল। ভলোদিমির মারা যান ১০১৫ খ্রিস্টাব্দে।
ভলোদিমিরের মৃত্যুর পর কিয়েভান রুশ সাময়িক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যায়। সিংহাসন নিয়ে ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট ভালোই পোহায় কিয়েভান রুশ। প্রায় ২১ বছরের লম্বা সময় পর ১০৩৬ সালে ভলোদিমিরের ছেলে ইয়ারোস্লাভ সিংহাসনে বসেন। ভলোদিমিরের কাজগুলোকে আরও সুন্দরভাবে এগিয়ে নিতে থাকেন। তবে তার মৃত্যুর পর আবার সিংহাসন নিয়ে কাড়াকাড়ি হবে এমন ভয়ে তিনি একটি নিয়ম তৈরি করে যান।

তার ছেলে ছিল পাঁচজন। বড় থেকে ছোট হিসেবে তিনি তার পাঁচ ছেলেকে কিছু অঞ্চলের দায়িত্ব ভাগ করে দেন। শর্ত করে দেন এমন, তিনি মারা গেলে তার জায়গায় সবচেয়ে বড় ছেলে আসবে। তার বড় ছেলের জায়গা তার মেজো ছেলে নেবে। এভাবে সবাই এক ধাপ করে উপরে উঠতে থাকবে। তবে এভাবে চলতে থাকলে একসময় না একসময় চাচা-ভাতিজার যুদ্ধ যে লাগবেই সেটাও বোধগম্য। সে যা-ই হোক, ইয়ারোস্ল্যাভের প্রথম তিন ছেলের (Iziaslav, Sviatoslav, Vsevolod) কল্যাণে এভাবে সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। তবে ১১১৩ সালে সেভলদের (Vsevolod) মৃত্যুর পর এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে। পূর্বে ১১০৩, ১১০৭ এবং ১১১১ সালে সেভলদেরের ছেলে ভলোদিমির মনোমাখ (Volodymyr Monomakh) কিয়েভান রুশের স্বার্থে মোট ৮৬টি ক্যাম্পেইনে নেতৃত্ব দিয়ে দুশোর বেশি বিদ্রোহী সর্দারকে মারায় কিয়েভানের সাধারণ জনগণ তাকেই শাসক হিসেবে চাচ্ছিল, এবং তিনিই ১১১৩ থেকে ১১২৫ সাল পর্যন্ত কিয়েভান রুশের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিয়েভান রুশের গল্পটা এরপর আর খুব বেশি ভাল ছিল না।
কিয়েভান রুশের গড়ে ওঠার এবং টিকে থাকার পেছনের সবচেয়ে বড় কারণ ছিল কিয়েভের অবস্থানগতভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিশাল প্রভাব রাখার ব্যাপারটি। তবে একাদশ শতাব্দীর শেষে এসে ইতালি সরাসরি এশিয়া মাইনর, মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের অনেক অঞ্চলে বাণিজ্য শুরু করায় গুরুত্ব হারাতে থাকে কিয়েভ। এর সাথে নিজেদের মধ্যকার রাজনৈতিক দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণে কিয়েভান রুশ ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। একপর্যায়ে মঙ্গোলদের আক্রমণে বড়সড় এক যুদ্ধের শেষে ১২৪০ খ্রিস্টাব্দে ইউক্রেনের ইতিহাস থেকে বাদ পড়ে কিয়েভান রুশ, যা রাশিয়া-ইউক্রেনের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য এক অংশ।