Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রাচীন মিশর এবং ফারাওদের কিছু না বলা কথা (পর্ব – ২)

প্রাচীন মিশরের ফারাওদের ছিল অসীম ক্ষমতা, অফুরন্ত বিত্ত ও অবিশ্বাস্য পদমর্যাদা। শুধুমাত্র এই জীবনেই এসব ভোগ করে তারা তৃপ্ত ছিলেন না। বরং মৃত্যুর পরেও এতসব সুবিধা উপভোগ করার যাবতীয় বন্দোবস্ত করে রেখেছিলেন একেকজন ফারাও। তাদের সমাধিগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেই এ ব্যাপারে একটি ভালো ধারণা পাওয়া যায়। কী ছিল না সেসব সমাধিতে! স্নানাগার, বালিশ, খাবার, সুরা থেকে শুরু করে গর্ভধারণরোধী সামগ্রী পর্যন্ত পাওয়া গেছে সমাধিগুলোতে। আর তার সঙ্গে অবশ্যই বহুমূল্যবান অলংকার এবং সোনায় মোড়ানো ফারাওদের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র তো ছিলই।

কিছু সমাধিতে সোনায় আচ্ছাদিত রথ এবং সুবিশাল নৌকাও পাওয়া গিয়েছে। আসলে ফারাওদের কাছে মৃত্যুর সংজ্ঞা এমন ছিল না যে, আমি চলে যাচ্ছি সবকিছু ছেড়ে। বরং তাদের কাছে মৃত্যু ছিল অনেকটা- “আমি চলে যাচ্ছি সবকিছু নিয়ে” ধরনের! তবে সবথেকে ভয়ানক ব্যাপারটি হলো সমাধিগুলোতে ফারাওদের অসংখ্য ভৃত্যের মৃতদেহ পাওয়া যাওয়া। বিভিন্ন ফারাওয়ের নিষ্ঠুরতা, তাদের অপকর্ম, লাগামহীন যৌনতা এবং জনগণের ওপর তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে লেখা কয়েক পর্বের ধারাবাহিকের মধ্যে আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।

আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে প্রথমবারের মতো মিশর একটি ঐক্যবদ্ধ একক রাজ্যে পরিণত হয়। এর ফলে তৎকালীন ফারাও জায়ার (Djer) লাভ করে অসীম ক্ষমতা, যা প্রাচীন পৃথিবীতে আগে কখনো দেখা যায়নি। তিনি ছিলেন প্রথম রাজবংশের তৃতীয় ফারাও। তার এই অসামান্য ক্ষমতা তাকে নিষ্ঠুর সব কাজকর্মের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিল।

শাসনকালের কোনো একসময় হয়তো ফারাও জায়ারের মনে মৃত্যুর চিন্তা উঁকি দিয়েছিল। সব কিছু ভেবে-চিন্তে তিনি দেখলেন যে, পরপারে একা একা যাওয়া তার মতো মহান শাসকের জন্য মানানসই নয়। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তার অধীনস্থ দাসদেরকেও নিজের সঙ্গে পরপারে নিয়ে যাবেন! জায়ারের এই ইচ্ছাপূরণের জন্য সেই সময় শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।

ফারাও জায়ারের সমাধি; Image Source : Tomb of Djer

মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো, মৃত্যু পরবর্তী জীবনে সকলকে এক বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিতে হবে। যে পথ বিভিন্ন অপদেবতা এবং ভয়ংকর সব সরিসৃপে পরিপূর্ণ। এরা মৃতদেহের নাড়িভুঁড়ি ভক্ষণ করে, রক্ত পান করে এবং পাপী আত্মাদের গোগ্রাসে গিলে ফেলে। সকলকেই পরকালের এই কঠিন পথযাত্রার জন্য প্রস্তুত থাকতে হত। এসব বিপদ থেকে বাঁচতে মিশরীয়রা কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় বিভিন্ন ফারাওদের সমাধিতে পাওয়া কিছু অদ্ভুত জিনিস থেকে। তারা এক্ষেত্রে নিজেদের সমাধিতে বিভিন্ন প্রাণী, যেমন-পাখি, বিড়াল, বানর,কুমির, সিংহ, বেবুন ইত্যাদির মমি সঙ্গে নিয়েছিল। আর সাথে নিয়েছিল নিজেদের দাসদের।

একটি মমি করা কুকুর; Image Source : Daily Mail

ফারাও জায়ার নিজের জন্য হয়তো বা কোনো নিয়ম নির্ধারণ করেছিলেন যাতে করে মৃত্যুর পর তার সমাধিতে তার ভৃত্যদের মৃতদেহও মজুদ করা হয়। এই ঠান্ডা মাথার নরহত্যার পক্ষে দৃঢ় প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রায় একশত বছর আগে প্রত্নতত্ববিদগণ আবিদোস (Abydos) এর পতিত জমিতে ফারাও জায়ারের নির্মম কর্মকান্ডের প্রমাণ পেয়েছিলেন। তার সমাধি প্রায় ৩১৮টি মৃতদেহ দ্বারা বেষ্টিত ছিল।

ফারাও জায়ারের ভৃত্যরা কীভাবে তাদের করুণ পরিণতি বরণ করেছিল তা পরিষ্কার নয়। কারণ তাদের শরীরে কোনো দৃশ্যমান ক্ষত বা ভাঙ্গা হাড় পাওয়া যায়নি এবং তারা সকলেই একই সঙ্গে মৃত্যু বরণ করেছিল। তাদের সমাধি কক্ষগুলোর ছাদ একই সঙ্গে এবং একই প্রচেষ্টায় বন্ধ করা ছিল। এ থেকে ধারণা করা হয় যে বিষপ্রয়োগের মাধ্যমে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছিল। জায়ার এর ভৃত্যদের মৃতদেহ থেকে এটুকু অন্তুত বোঝা যায় যে, তারা কোনো প্রকার হিংস্রতার শিকার হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, তাদের মৃত্যু কি স্বেচ্ছায় নাকি জোরপূর্বক সংঘঠিত হয়েছিল?

ফারাও জায়ারের হুকুমের ফলে তিনি মারা যাবার পর কয়েকশত মানুষকে এক রকম হত্যা করা হয়। তাতে কার কী আসে যায়! পাঁচ হাজার বছর পরে আজকের দিনে এই ঘটনা শুধুমাত্র প্রাচীন মিশরীয় ইতিহাসের একটি নিষ্প্রাণ অধ্যায় হিসেবেই টিকে আছে।

ফারাও জায়ারের সময়কালে নরবলির প্রচলন থাকলেও তিনি জীবিতাবস্থায় তার প্রজাদের সাথে নিষ্ঠুর কোনো আচরণ করেছিলেন কি না তা জানা যায়নি। তবে মিশরের অন্যান্য অনেক শাসকগণের বিরুদ্ধে তুচ্ছ কারণে অধীনস্থ মানুষদের ওপর সীমাহীন অত্যাচার ও নৃশংসভাবে তাদের হত্যা করার যথেষ্ট নজির ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়। এ শাসকেরা সামান্য কারণে শত শত মানুষের লাশ ফেলে দিতে পিছপা হত না। এরকমই একজন ফারাও হলেন দ্বিতীয় আমেনহোটেপ, যিনি হাজার হাজার মানুষকে নির্দয়ভাবে হত্যা করেছিলেন বলে জানা যায়। তার নিষ্ঠুরতার তীব্রতা তাকে প্রাচীন মিশরের অন্যতম সাইকোপ্যাথে পরিণত করেছিল।

দ্বিতীয় আমেনহোটেপ; Image Source : Egypt Guide

ফারাও দ্বিতীয় আমেনহোটেপ আনুমানিক ১৪২৭ খ্রিস্টপূর্বে সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি ছিলেন অষ্টাদশ তম রাজবংশের সপ্তম ফারাও। বিখ্যাত ফারাও তৃতীয় তুত্‌মোসিস ছিলেন তার পিতা। অষ্টাদশ রাজবংশের সবচেয়ে নৃশংস এবং রক্তপিপাসু শাসক হিসেবে দ্বিতীয় আমেনহোটেপের কুখ্যাতি রয়েছে। তার সমাধি থেকে পাওয়া যাওয়া বিভিন্ন সামগ্রী থেকে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে তিনিও নরবলি সমর্থন করতেন। তার সমাধি থেকে একটি নৌকার সঙ্গে বাধা অবস্থায় মস্তকে ফাটল যুক্ত একজন মানুষের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া সমাধির ভেতরের কক্ষতে পাওয়া গিয়েছে একজন নারী ও একটি বাচ্চার মমি। এ থেকে ধারণা করা হয়, তিনি তার বিশ্বাস মতে দেবতা ওসাইরিসের স্বর্গে তার পরিবারের প্রিয়জনদের নিয়েই থাকতে চেয়েছিলেন।

দ্বিতীয় আমেনহোটেপ হয়তো বা তার পিতার মতো অসংখ্য যুদ্ধ করেননি, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে তার নিষ্ঠুরতা সেই ঘটতি পূর্ণ করে দিয়েছে। তিনি আক্ষরিক অর্থেই শত্রুপক্ষের মস্তক চূর্ণবিচূর্ণ করেছিলেন। তার রক্তলোলুপতা তাকে অতি নির্দয় করে তুলেছিল। তিনি আনন্দ পাওয়ার জন্য মানুষ হত্যা করতেন। বর্তমান যুগের মনোবিদেরা তাকে হয়তো সাইকোপ্যাথের সবথেকে খারাপ দৃষ্টান্ত হিসেবেই উপস্থাপন করতেন।

বিশাল সম্রাজ্যের অধিকারী দ্বিতীয় আমেনহোটেপ তার রাজত্বকালে খুবই কঠিন এক দায়িত্বের মুখোমুখি হয়েছিলেন। সাম্রাজ্যের আকার বড় হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তার অনেক শত্রু জন্ম নিয়েছিল। সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতার জন্য শত্রুপক্ষের দমন অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এসব শত্রুরাজ্যের মধ্যে সিরিয়া ছিল অন্যতম। দ্বিতীয় আমেনহোটেপ তার রাজত্বকালের সপ্তম বছরে এবং নবম বছরে সিরিয়ার বিরুদ্ধে দুটি অভিযান পরিচালনা করেন। দুটি অভিযানই ছিল সফল। এই দুটি অভিযানে জয়ের সাথে সাথে মিশরীয় বাহিনী লাভ করেছিল বিপুল পরিমাণে স্বর্ণ-রৌপ্য, ৫৫০ জন যুদ্ধবন্দী এবং ২১০টি ঘোড়া। তবে এসব ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে বিপক্ষশক্তির ওপর চালানো দ্বিতীয় আমেনহোটেপের নিষ্ঠুরতা।

চলন্ত রথ থেকে তীর ছুঁড়ছেন দ্বিতীয় আমেনহোটেপ; Image Source : Flickr

মিশরীয় যোদ্ধাদের সবথেকে প্রিয় অস্ত্র ছিল কুঠার এবং গদা। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় আমেনহোটেপের প্রথম পছন্দ ছিল গদা। তিনি গদা দিয়ে ক্ষিপ্রতার সাথে খুব জোরে আঘাত করতেন শত্রুদের মাথায়। শত্রু কিছু বুঝে ওঠার আগেই মৃত্যু বরণ করত। সিরিয়া অভিযানে তিনি সেখানকার সাতজন গোত্রপ্রধানকে হত্যা করেছিলেন। তাদের দেহ বিজয়স্মারক হিসেবে রণতরীর সম্মুখে লাশের পায়ে রশি বেঁধে উল্টোভাবে ঝুলিয়ে নিয়ে আসেন। পরে ছয়জন গোত্রপ্রধানের দেহ থিবেসের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল এবং অপরজনকে প্রেরণ করা হয়েছিল নুবিয়ার নাপাতায়। সাতজনেরই মাথা ধড় থেকে আলাদা করে ফেলা হয়েছিল এবং এই কাজ দ্বিতীয় আমেনহোটেপ সম্পাদন করেছিলেন নিজ হাতে! নিজের শত্রুদের কাছে সতর্কবার্তা পাঠানোর এর চেয়ে ভালো উপায় আর কী-ই বা হতে পারে।

একেবারে ছোটবেলা থেকেই যোদ্ধা হিসেবে গড়ে ওঠা দ্বিতীয় আমেনহোটেপ শত্রু দমনের ক্ষেত্রে হয়তো বা নিষ্ঠুর পন্থা অবলম্বন করেছিল। কিন্তু তা পরবর্তী দীর্ঘ সময় জুড়ে মিশরকে বহিঃআক্রমণ থেকে নিরাপদ রেখেছিল।

প্রায় দুইশত বছর পর মিশরের সীমান্ত আবারও শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়। আর ফারাওদের যুদ্ধক্ষেত্রেই তার সমাধান করতে হয়েছিল। এরই মধ্যে আরও একজন শাসক যুদ্ধক্ষেত্রে তার নিষ্ঠুরতার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছিলেন। তিনি হলেন তৃতীয় রামেসিস। আগামী পর্বে তৃতীয় রামেসিস এবং আরও কয়েকজন ফারাও সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।

প্রথম পর্ব: প্রাচীন মিশর এবং ফারাওদের কিছু না বলা কথা

This article is in Bangla language. It is an article about ancient Egypt and its mighty rulers. Necessary references have been hyperlinked.

Feature Image: Tour Egypt

Related Articles