Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

উপমহাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইংরেজির সূচনা হলো যেভাবে

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলায় শাসন অনেকটাই পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে। বক্সারের যুদ্ধে তাদের জয়ের মাধ্যমে এলাহাবাদ চুক্তির ভেতর দিয়ে ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরু হয়ে যায়। ১৭৯৩ সালের চার্টার অ্যাক্ট-এ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতে একচেটিয়া ব্যবসা করার সুযোগ দিয়ে দেয় ব্রিটিশ সরকার। এ সুযোগ দেওয়া হয় পরবর্তী বিশ বছরের জন্য।

ভারতীয় উপমহাদেশে শাসন করতে এসে কোম্পানিকে প্রায়শই কিছু ঝামেলার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতির ভারতে এসে প্রথমেই পড়তে হয় ভাষাজনিত সমস্যায়। মুঘল শাসকদের অনেক বছর রাজত্বের জন্য এখানে আরবি আর ফার্সি ভাষা প্রচলিত ছিল অনেক আগে থেকে। এমনকি আদালত আর অনেক অফিসের প্রধান ভাষা ছিল ফার্সি। আর হিন্দুদের আধিক্যের এ এলাকায় সংস্কৃত ভাষার চর্চাও অপ্রচলিত ছিল না। আবার একেক অঞ্চলের লোকেদের নিজস্ব মাতৃভাষা তো আছেই।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলের একটি তথ্যচিত্র; Image source: indiafacts.org

ভারতে ব্যবসা বাণিজ্য প্রসারের জন্য কোম্পানির আগমনের শুরু থেকেই তারা ভাষার সমস্যা উপলব্ধি করতে লাগল। এখানকার স্থানীয় ব্যবসায়ীর কাছেও ইংরেজি ভাষা প্রায় অনেকটাই নতুন। আর কোম্পানির সাথে ব্যবসা করার জন্য ইংরেজি ভাষাটাও একটা ব্যাপার হয়ে দাড়াতে লাগল। কারণ, স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানির ব্যবসায়ীরা এমন কাউকেই তাদের অধীনে কর্মচারী হিসেবে চাইবে যারা কিনা তাদের সাথে ভাবের আদান প্রদানে সহজে লিপ্ত হতে পারবে। এক্ষেত্রে ইংরেজি একটি মুখ্য ভাষা হয়ে দাড়াতে লাগল সমাজের একটি বিত্তশ্রেণীর জন্য। আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও প্রশাসনিক কার্য ভালভাবে চালানোর জন্য স্থানীয় লোকেদের মুখের ভাষায় দক্ষ হওয়াটাকেও গুরুত্বের সাথে নিতে লাগলেন।

যেহেতু প্রথমদিকে ব্যবসায়িক কাজের পাশাপাশি এ অঞ্চলের প্রশাসনিক দেখভাল করাটাও তাদের হাতেই ন্যস্ত ছিল তাই প্রথমদিকে এ অঞ্চলের শিক্ষার প্রসারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকেও অনেকটাই ইচ্ছার বিরুদ্ধে দায়ভার নিতে হয় যদিও তখনো ব্রিটিশ রাজের পক্ষ থেকে সেটা তাদের উপর বাধ্যতামূলক করা হয়নি।

ভারতের শিক্ষার প্রসারে খ্রিস্টান মিশনারীরও অবদান উল্লেখযোগ্য। আমরা যদি তখনকার শিক্ষা ব্যবস্থার কথা চিন্তা করি তাহলে কলকাতা মাদ্রাসা আর সংস্কৃত কলেজের দিকে দৃষ্টিপাত করলে তা সহজে বোঝা যাবে। ১৭৮১ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতায় একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন যেখানে সাধারণত প্রথমদিকে মুসলিমদের আইন কানুন, আরবি আর ফার্সি ভাষায় শিক্ষাদান করা হতো। পরে জোনাথান ডানকান ১৭৯১ সালে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে সাধারণত হিন্দুদের রীতি নীতি, দর্শন আর সংস্কৃত ভাষার উপরেই জ্ঞান দান করা হতো। সে সময় ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে খুব একটা কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করা যায়নি।

ওয়ারেন হেস্টিংস; Image source: npg.org.uk

কিন্তু ঘটনার মোড় ঘটে ১৮১৩ সালের দিকে, যখন চার্টার অ্যাক্ট-১৮১৩ অনুমোদন পায়। এই অ্যাক্টের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ভারতে একচেটিয়া ব্যবসা করার যে স্বাধীনতা, তা অনেকটাই খর্ব হয়। ব্রিটেনের অনেক প্রাইভেট কোম্পানিও এ অঞ্চলে বিনিয়োগ করার সুযোগ পায়। আর ব্রিটিশরাজ থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উপর কিছু শর্ত। এর ভেতরে রয়েছে শিক্ষার ব্যাপারটিও। ব্রিটিশরাজ থেকে বলা হয় যে, এখন থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার উপরেও নজর রাখবে। এমনকি প্রতি বছর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতের শিক্ষা ও সাহিত্য বিস্তারের জন্য এক লক্ষ রুপি দিতে হবে এমন বিধানও রাখা হয়। এরপর ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার দেখভাল করা প্রায় অনেকটাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে যায়।

ঠিক সে সময়ে ভারত উপমহাদেশে দুই শ্রেণির লোকের আবির্ভাব ঘটে। এক শ্রেণির লোক চাইত যে ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থা নিজ নিজ অঞ্চলের মাতৃভাষা, আরবি, ফার্সি আর সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমেই হোক। তাদেরকে বলা হয় প্রাচ্যবাদী যারা ভারতীয় সংস্কৃতিকে ধরে রাখাই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য বলে ধরে নিতেন। অন্য শ্রেণীর লোকেরা হলেন পাশ্চাত্যবাদী যারা কিনা ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারকে প্রাধান্য দিতেন। এদের অনেকেই পাশ্চাত্যের শিক্ষা সংস্কৃতিকে প্রাচ্যের তথা ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষা সংস্কৃতির তুলনায় বড় করে দেখতেন।

১৮২০ থেকে ১৮৩০ সালের দিকে এ দুই শ্রেণির বিতর্ক চরম পর্যায়ে ওঠে। প্রাচ্যবাদী ধারণার মনীষীরা দাবি করেন যে, শিক্ষা ব্যবস্থার যে অনুদান সেটি এমন স্কুল কলেজেই দান করা হোক যেখানে আরবি, ফার্সি আর সংস্কৃতের চর্চা হয়। আর পাশ্চাত্যবাদী ধ্যান ধারণার মনীষীরা দাবি করতে থাকেন যে শিক্ষা ব্যবস্থার অনুদান সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই দেওয়া হোক যেখানে ইংরেজি ভাষা দিয়ে জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসার ঘটানো হয়।

লর্ড ম্যাকলে; image source: rakuten.com

এ দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে পরে লর্ড ম্যাকলে’র মাধ্যমে। লর্ড ম্যাকলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের একজন সদস্য ছিলেন আর খুব জোরালোভাবেই পাশ্চাত্যবাদী ধারণায় বিশ্বস্ত ছিলেন। ১৮৩৫ সালের ফেব্রুয়ারির ২ তারিখ প্রচার করেন ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার উপর তার নিজস্ব মতামত। ‘মিনিট অন এডুকেশন’, যেখানে খুব জোরালোভাবেই তিনি দাবি করেন যে ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার ইংরেজি ভাষা দিয়েই হবে। তার ফলশ্রুতিতে ১৮৩৫ সালেই তখনকার ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিংক ‘ইন্ডিয়ান এডুকেশন অ্যাক্ট’ প্রস্তাব করেন এবং ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসারে ইংরেজি ভাষাকেই বৈধতা দান করেন।

লর্ড ম্যাকলে যে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিকে অন্য দেশের সংস্কৃতির তুলনায় কি পরিমাণ বড় করে দেখতেন তা তার মিনিট অন এডুকেশনের লেখাতেই ফুটে উঠে, যেখানে তিনি বলেন, “ভালো একটা ইউরোপীয় লাইব্রেরীর বইয়ের একটি তাকে যে পরিমাণ সাহিত্যজ্ঞান আছে, পুরো ভারত আর আরব সাহিত্যেও সেরকম জ্ঞানের প্রাচুর্যতা নেই।”

বাংলার গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিংক; image source: padmad.org

ইংরেজিই তখন হয়ে উঠে অনেক স্কুল কলেজে শিক্ষা বিস্তারের জন্য মূল ভাষা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও সেসব স্কুল কলেজেই অনুদান দিতে থাকে যেখানে ইংরেজি ভাষা দিয়ে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা করা হয়। এ আইন ভারতের অনেক জ্ঞানী ব্যক্তিদের ভেতরেই অসন্তোষের তৈরি করে। যারা প্রাচ্যবাদী ধারণায় বিশ্বাসী তাদের অনেকেই দাবি করেন যে, ইংরেজি যেহেতু ভারতবর্ষে একদম অপ্রচলিত এবং নতুন ভাষা তাই এখানে আগে মাতৃভাষায় শিক্ষাদান করাটাই উচিত, আর তা নাহলে ইংরেজি শিক্ষা খুব একটা ফলপ্রসূ হবে না বলে তারা মনে করতেন। আবার অনেকেই ইংরেজি ভাষায় জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসারকে ভালো চোখে দেখতেন।

১৮৩৫ সালের পর ভারতে অনেক স্কুল কলেজ নির্মাণ করা হয় আর সে সময়টাতে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার ভালোই প্রসার ঘটে। কিন্তু তারপরেও অনেক জায়গাতে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের দিকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠা স্কুল কলেজে নিজেদের মাতৃভাষাতেই শিক্ষাদান চলতে থাকে। যদিও সেখানে ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা একদম থাকতো না বললেই চলে। ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার উপর একটি তদন্ত চালানো হয়, যেখানে উঠে আসে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার এসব করূণ চিত্র। এরপর প্রায় বিশ বছর পর ভারতের লোকজনের জন্য আশার বার্তা বয়ে নিয়ে আসে চার্লস উডের শিক্ষা কমিশন, যা কিনা ব্রিটিশ ভারতের আধুনিক শিক্ষার ম্যাগনা-কার্টা হিসেবে প্রবর্তিত হয়। এখানে বলা হয় প্রাথমিক স্কুলগুলোতে নিজ নিজ অঞ্চলের মাতৃভাষাতেই শিক্ষাদান করা হবে, এরপর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাও শেখানো হবে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষাতে জ্ঞানদান করা হবে।

স্যার চার্লস উড, যিনি চার্লস উড শিক্ষা প্রস্তাব পেশ করেন; Image source: indianetzone.com

চার্লস উডের এই শিক্ষা প্রস্তাবে ইংরেজির পাশাপাশি যেমন মাতৃভাষায় পাঠদানকে সম্মতি দেওয়া হয় ঠিক তেমনই নারীদের জন্য শিক্ষাকেও এখানে বৈধতা দেওয়া হয় যার ফলশ্রুতিতেই পরে গড়ে উঠে কলকাতায় নারীদের জন্য বেথুন কলেজ। ১৮৩৫ সালের ইন্ডিয়ান এডুকেশন অ্যাক্টের পরেই চার্লস উড কমিশন যেন ভারতীয় প্রাচ্যবাদীদের জন্য আশার বাণী নিয়ে এল।

চার্লস উডের এই শিক্ষা প্রস্তাব পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসনামলের অন্যান্য শিক্ষা কমিশনের জন্য এক আদর্শ হয়ে ওঠে। যেভাবে মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চা বাড়তে থাকে ঠিক সেভাবেই ইংরেজি ভাষায়ও ভারতীয়দের দক্ষতা বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে ব্রিটিশদের অনুদানে ভারতে গঠিত হয় আরো অনেক স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়। এভাবেই জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চায় প্রাচ্যবাদী আর পাশ্চাত্যবাদী সমাজের মেবন্ধন ঘটে।

This article is written in the Bengali language. This is about the arrival of the English language in the Indian education system. All important sources are hyperlinked.

Feature image: learn.culturalindia.net

Related Articles