মানবসভ্যতা কখনোই পেছনে অগ্রসর হয়নি। বরং মানুষ অতীতের ইতিহাস থেকে শিখে বর্তমান এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে সুন্দর একটি পৃথিবী উপহার দিয়েছে। হাজার হাজার বছর আগে মেসোপটেমীয় সভ্যতার লোকেদের আবিষ্কৃত লাঙ্গল যেমন মানুষকে কৃষিকাজ করে বাঁচতে শিখিয়েছে, তেমনি এর পরের অগণিত সভ্যতার মানুষও এমন এমন কিছু আবিষ্কার করেছে যা পৃথিবীকে আধুনিকায়ন করেছে। নিঃসন্দেহে আমরা এখন অবধি পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত সভ্যতায় বসবাস করছি। শুধু তা-ই নয়, অতীতের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করে সেটির প্রমাণও পাওয়া যায়।
এই আধুনিক সভ্যতার ক্রমবিকাশে কয়েক শত বছর আগে যে যন্ত্রপাতিগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলো এই সভ্যতারই অংশবিশেষ। কারণ হাজার বছর আগেকার সভ্যতা আমাদের স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রকৌশলের শিক্ষা দেয়নি। শুধুমাত্র ধারণা দিয়েছে একতাবদ্ধ হয়ে নিজ হাতে কীভাবে কোনো কিছু তৈরি ও ব্যবহার করতে হয় সে সম্পর্কে। পনের শতাব্দীতে এমনই একটি আবিষ্কার যুগান্তকারী বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলো। ১৪৩৯ খ্রিস্টাব্দে জার্মান স্বর্ণকার গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করেন, যা মানুষের শিক্ষাগ্রহণ এবং জ্ঞানকে ছড়িয়ে দিতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছিলো।
যদিও তিনি মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করার পূর্বে নবম শতাব্দীতে চীনারা কাঠের মধ্যে লিপিবদ্ধ করে প্রথম বই প্রকাশ করেন। তবে বেশিরভাগ ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন গুটেনবার্গের আবিষ্কৃত মুদ্রণযন্ত্রটি ছাঁপার কাজে অ্যানালগ যুগে প্রবেশে মূল ভূমিকা পালন করেছে। কারণ সে সময় তার যন্ত্রটিতে স্ক্রু ব্যবহার করে অক্ষর লেখার জন্য কালিযুক্ত ধাতব পাত ছিলো। আর এই মুদ্রণযন্ত্রের কল্যাণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে পত্রিকাও প্রকাশিত হতে থাকে।
যদিও অল্প কয়েক বছরের মধ্যে এই যন্ত্রটিকে আধুনিকায়ন করে ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরু করেছিলো ইউরোপীয়রা। সে সময় থেকেই শিক্ষাদীক্ষা, বাণিজ্য এবং গবেষণায় কয়েক ধাপ এগিয়ে যায় তারা। ঐতিহাসিকদের মতে, মুদ্রণযন্ত্র ইউরোপকে অন্ধকার যুগ থেকে নতুন আলোকিত পথ দেখিয়েছিলো। যদিও পরবর্তীতে পুরো পৃথিবীতে মুদ্রণযন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয় যা আমাদের আজকের সুন্দর, উন্নত পৃথিবী উপহার দিয়েছে। চলুন জানা যাক মুদ্রণযন্ত্র আমাদের কীভাবে কীভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে সে সম্পর্কে।
একটি বৈশ্বিক সংবাদ প্রকাশের প্রচলন ঘটায়
গুটেনবার্গ তার আবিষ্কৃত যন্ত্রের বিপ্লবের সময়টুকু দেখে যেতে পারেননি। তবে তিনি এটি আবিষ্কারের পর ল্যাটিন ভাষায় ২০০টি বাইবেল মুদ্রণ করেন, যাতে সময় লেগেছিলো প্রায় ৩ বছর। এতে করে তার আবিষ্কৃত যন্ত্রটি খুব অল্প সময়ে বড় বড় বিনিয়োগকারীদের নজরে পড়ে। যদিও সে সময় তার এতগুলো বাইবেল ছাঁপানো লাভজনক ছিলো না। কারণ তিনি এমন এক জায়গায় ২০০টি বাইবেল প্রকাশ করেছিলেন যেখানে ল্যাটিন ভাষা বোঝেন এমন লোকের সংখ্যা ছিলো খুবই কম। এতে করে অন্য ব্যবসায়ীরাও লোকসানের মুখে পড়েন। যদিও এই ব্যবসায়ের বাজার খুঁজে পেতে অন্য মালিকরা দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছিলেন। পরবর্তীতে তাদের কেউ কেউ ব্যবসা গুটিয়ে নেন। তবে একদল ব্যবসায়ী ভেনিস গমন করেন এবং নতুন বাজার সৃষ্টি করেন।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোপিয়ান ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক পালম্যার ব্যাখা করেন কীভাবে সে সময় ছাপাখানার ব্যবসাটি নতুন বাজার সৃষ্টি করেছিলো। তার মতে, জার্মান ব্যবসায়ীরা সে সময় বন্দর নগরী ভেনিসে গমন করে প্রতিটি জাহাজের নাবিকের নিকট ৫টি করে বাইবেল বিক্রি করতেন। আর ভেনিস থেকে জাহাজে করে সে সমস্ত ধর্মীয় বই ছড়িয়ে যেতো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। একসময় এর চাহিদা বাড়তে বাড়তে ধর্মীয় বই ছাড়াও আরো বিশেষ কিছু বইয়ের প্রস্তাব আসে। শুধু তা-ই নয়, জাহাজের যাত্রীদেরকে অলস সময়ে ব্যস্ত রাখতে জাহাজ মালিকরা তাদের নিকট বই বিক্রি শুরু করেন। যদিও দেখা যেতো, প্রতি ১০০ জনে মাত্র ৫ জনই সেসব বই পড়তে পারতো। কারণ তখন প্রায় মানুষই শিক্ষিত ছিলেন না।
অতঃপর ভেনিসের ছাপাখানার ব্যবসায়ীরা একসময় ধর্মীয় বইয়ের পাশাপাশি ছোটখাট পত্রিকা ছাপাতে শুরু করেন যাতে সাম্প্রতিক সময়ের সংবাদ উল্লেখ থাকতো। মূলত বাইবেল কিংবা অন্যান্য বইয়ের দাম বেশি হওয়ায় কম দামে সংবাদের কাগজগুলো বাজারজাতকরণের সিদ্ধান্ত নেয় ব্যবসায়ীরা। ১৪৯০ এর দশকে ভেনিসে ব্যাপকভাবে সে সমস্ত সংবাদপত্রের প্রচলন শুরু হয়। মূলত গুটেনবার্গের মুদ্রণযন্ত্র ভেনিসেই প্রথম বাণিজ্যিক সফলতা অর্জন করে।
ইতালির নবজাগরণ নতুনত্ব লাভ করে
গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের শতবছর পূর্বে ইতালিতে নবজাগরণ শুরু হয়েছিলো। আর সে সময়কে ইতিহাসে রেনেসাঁস যুগ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মূলত রোম এবং ফ্লোরেন্সের প্রাচীন রোমান শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনরুদ্ধার করার জন্যই এই নবজাগরণ সংগঠিত হয়েছিলো। আর সিজার, সিসেরো, সেনেকারা এই নবজাগরণেরই সৃষ্টি। তবে সে সময়ের সবথেকে বড় প্রকল্প ছিলো প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের সৃষ্টিগুলোকে উদ্ধার করে তা সংরক্ষণ করা। যদিও ধনীক শ্রেণীর প্রত্নতত্ত্ববিদরা আল্পস পর্বতের দিকে প্রাচীন স্থাপনার খোঁজে নেমে পড়েন। শুধু এসবেই থেমে যাননি ইতালিয়ান ঐতিহাসিকেরা। তারা একপর্যায়ে অটোমান সাম্রাজ্যে গমন করে প্রাচীন গ্রিক এবং আরবি ভাষা শিখে তা ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করে পাণ্ডুলিপি আকারে সংগ্রহ করেন। আর এই সমস্ত বই বা পাণ্ডুলিপি লিপিবদ্ধ করা হত হাতে লিখে যাতে দীর্ঘ সময় ব্যয় হত।
হাতে লিখতো হতো বিধায় প্রত্নতত্ত্ববিদরা খুব সহজেই সবকিছু লিপিবদ্ধ করতে পারতেন না। যারা খুব ধনী ব্যক্তি ছিলেন তারা হয়তো প্রচুর লেখক নিয়োগ দিয়ে কার্যসম্পাদন করতেন। যদিও সংখ্যায় তারা ছিলেন অতি নগণ্য। এত কিছুর পরেও চৌদ্দ শতাব্দীতে প্যারিসের একটি লাইব্রেরিতে ৩০০ পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা হয়েছিলো বলে ঐতিহাসিকরা নিশ্চিত করেন। আর নবজাগরণের যুগে তখনও ধীর গতিতে চলছিলো ইতালিয়ানদের পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের কাজ।
কিন্তু ১৪৯০ এর দশকে ভেনিস যখন ছাপাখানার রাজধানীতে পরিণত হয় তখন ইতালিয়ান রেনেসাঁসরা তাদের কাজের গতি বৃদ্ধি করতে পেরেছিলেন। কারণ সে সময় তারা ঐতিহাসিকদের সকল তথ্য-উপাত্ত দ্রুত ছাপিয়ে সংরক্ষণ করতে সক্ষম হন। এছাড়াও বাণিজ্যিকভাবে বইগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয় ইতালিয়ান সরকার। রেনেসাঁস যুগের শুরুটা ধীরগতিসম্পন্ন হলেও শেষটা ছিলো অতি দ্রুত এবং সাফল্যমণ্ডিত, যার পেছনে সবটুকু অবদান গুটেনবার্গের মুদ্রণযন্ত্রের।
বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের শুভসূচনা
ইউরোপীয়দের মাঝে বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার উদয় ঘটেছিলো হাজার বছর আগে। যদিও পনের শতাব্দীতে উল্লেখযোগ্য কিছু মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হন। পরবর্তীতে তারা বিভিন্ন সময় পূর্ববর্তী বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার নিয়ে নানারকম গবেষণা শুরু করেন। শুধু তা-ই নয়, সে সময়ের শিক্ষিত সমাজের মাঝে নতুন কিছু আবিষ্কারের প্রবল আগ্রহ লক্ষ্য করা যেত।
আর এই আগ্রহের কল্যাণে আমরা যুগান্তকারী কিছু যন্ত্রপাতি এবং জিনিসপত্র পেয়েছি। মূলত বিজ্ঞান হচ্ছে নির্জনতায় সাধনার একটি বিষয়। সে সময়ের গণিতবিদ, দার্শনিকরা নানারকম গবেষণা করলেও সেগুলোকে সংরক্ষণ এবং প্রকাশের জন্য সহজ মাধ্যম খুঁজে পাননি। অনেক গবেষক গবেষণায় পারদর্শী হলেও লেখালেখিতে ছিলেন একেবারেই কাঁচা। এছাড়াও সবার পক্ষে অনেক অর্থ ব্যয় করে লেখক নিয়োগ দেয়া কষ্টসাধ্য ছিলো। মূলত এই কারণে অনেকের অনেক গবেষণালব্ধ ফলাফল খুব সহজে সংরক্ষণ করা যায়নি। বরং লোকজনের মুখে মুখে কিংবা খোদাই করে রাখা হতো। এতে করে আসল তথ্যাবলী নানাভাবে বিকৃত হয়েছিলো।
অতঃপর ১৫ ও ১৬ শতাব্দীতে এসে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এবং পরীক্ষামূলক তথ্যগুলো প্রকাশের নতুন মাধ্যম হিসেবে অবদান রাখে মুদ্রণযন্ত্র। সে সময় বিজ্ঞানীরা এই যন্ত্রের সহায়তায় স্থায়ীভাবে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ করতেন এবং মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতেন। পনের শতাব্দীর গোড়ার দিকে পোলিশ জ্যোতির্বিদ নিকোলাস কোপার্নিকাস ছায়াপথে সূর্যকেন্দ্রিক মডেলটির বিকাশ ঘটিয়ে উপাত্তগুলো লিপিবদ্ধ করার পাশাপাশি মুদ্রণ করেন। অন্যথায় আমরা এখন তার আবিষ্কারগুলোর সঠিক তথ্য পেতে পারতাম না। কারণ মোটামুটি সবগুলোই ছিলো গাণিতিক হিসেবনিকেশ। আর এই থেকে বোঝাই যায় বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সে সময় মুদ্রণযন্ত্রের ভূমিকা ঠিক কতখানি ছিলো।
ইতিহাসবিদ এলিজাবেথ এইজেনস্টাইন ১৯৮০ সালে মুদ্রণযন্ত্রের প্রভাব নিয়ে একটি বই লিখেন। বইয়ের সূত্রমতে, বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উপহার ছিলো মুদ্রণযন্ত্র। এটি লক্ষ লক্ষ তথ্য শত শত বই আকারে মানুষের নিকট পৌঁছে দিয়েছিলো বলে একে এত গুরুত্ব দেননি তিনি। বরং গবেষণার মূল তথ্যগুলো অনুলিপি আকারে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সংরক্ষণ করতে পেরেছিলো বলেই একে সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। বর্তমান যুগে এসে বিজ্ঞানীরা সে সময় মুদ্রিত সূত্র কিংবা তথ্যাবলীতে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস রাখতে পারে এবং ভবিষ্যতের গবেষণায় কাজে লাগাতে পারে। আর এজন্যই হয়তো ১৬২০ সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস বেকন লিখেছেন যে, তিনটি আবিষ্কার পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। সেগুলো হলো, “গানপাউডার, নটিক্যাল কম্পাস এবং মুদ্রণযন্ত্র।”
জনমানুষের মতামত থেকে বিখ্যাত সব বিপ্লবের সূচনা
মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের ২০০ বছরের মধ্যে এটি সমস্ত ইউরোপ পাড়ি দিয়ে আমেরিকাসহ কয়েকটি মহাসাগরীয় অঞ্চলে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। ততদিনে ইউরোপ এবং আমেরিকায় আলোকিতকরণের যুগ শুরু হয়। তখন জন লুক, ভোল্টায়ার, জিন জ্যাক রুশোর মতো দার্শনিকদের মতবাদ শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত মানুষদের নিকট সহজে পৌঁছে যেত। ফলশ্রুতিতে মানুষ গণতন্ত্রবাদী হয় এবং স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্দী করে। এতে করে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ইউরোপ এবং আমেরিকায় বিভিন্ন সময় একাধিক বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিলো।
বর্তমান সময়ের ঐতিহাসিকদের মতে মুদ্রণযন্ত্রের পূর্বে দার্শনিকদের মতবাদ সাধারণ মানুষের নিকট সহজে পৌঁছাত না। শুধু তা-ই নয়, সে সময়ের মানুষ শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতনের মাঝে থেকেও গণতন্ত্র নিয়ে কখনোই ভাবতো না। কিন্তু মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পর সাধারণ মানুষ বিভিন্ন মতবাদ, বইপুস্তক খুব সহজেই হাতের কাছে পেয়ে যেত। এতে করে সে সময়ের প্রজন্মের মাঝে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা অল্প অল্প করে তীব্রতর হয়। ষোল শতাব্দীর আগে এবং পরে ইউরোপ এবং আমেরিকায় উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিলো। ফরাসি বিপ্লবের পূর্বে লুইস সেবাস্তিন মার্সিয়ার লেখেন, “মুদ্রণযন্ত্র স্বর্গীয় সৃষ্টি। এটি অল্প কিছুদিন আগে আবিষ্কৃত হয়েও খুব তাড়াতাড়ি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আর এভাবেই এটি বিশ্বকে বদলে দেবে। তাই অত্যাচারী শাসকেরা কাঁপতে থাকুন, গুণী লেখকদের সামনে কাঁপতে থাকুন!”
এখন অনেকেই ভাবতে পারেন তখনকার সময়ের গণতন্ত্রবাদী লেখকদের লেখাগুলো শুধুমাত্র শিক্ষিত সমাজেই বেশি প্রতিফলিত হয়েছিলো। কিন্তু এমন ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। নিরক্ষর লোকেরাও সে সময়ের মতবাদগুলো সহজেই জেনে নিয়েছিলো। কারণ শিক্ষিতরা দল ভারী করার জন্য তাদেরকে বোঝাতো। এতে করে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তাদের মাঝেও মারাত্মকভাবে বিকাশ লাভ করে। ১৭৭৬ সালে টমাস পেইন যখন তার বিখ্যাত বই ‘কমন সেন্স’ প্রকাশ করেছিলেন তখনও আমেরিকায় সাক্ষরতার হার ছিলো মাত্র ১৫%। তবুও উপনিবেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় বিপ্লবীদের হার ছিলো উল্লেখযোগ্য। তাই বলা যায়, মুদ্রণযন্ত্র তখনকার সময়ে গুণী লেখকদের মতবাদগুলো সহজেই সাধারণ মানুষের নিকট পৌঁছে দিয়েছিলো বলেই মানুষের মাঝে গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতার ইচ্ছা তীব্রতা লাভ করেছিলো।
মুদ্রণযন্ত্র লেখা কারিগরদের কাজ কমিয়ে দেয়
আঠারো শতকে তখনও ইউরোপে শিল্পবিপ্লব পুরোদমে শুরু হয়নি। তবুও গুটেনবার্গের মুদ্রণযন্ত্র ইউরোপীয়দের যন্ত্রপাতি সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা দিয়েছিলো। অথচ এটি আবিষ্কারের পূর্বে অভিজাত লোকেরা অভিজ্ঞ লোক নিয়োগ করে অনুলিপি এবং পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করতেন। বই তৈরির কারিগররা সেসময়ে ২০-৫০ জন অভিজ্ঞ লেখক নিয়োগ করে দিন-রাত খাটিয়ে বই লিপিবদ্ধ করাতেন।
কিন্তু মুদ্রণযন্ত্র খুব কম সময়ে অভিজ্ঞ সে সব লেখকদের কাজ বঞ্চিত করে। কারণ কম অর্থ ব্যয় করেই মানুষ শত শত বই কিনতে পারছিলেন। পরবর্তীতে মুদ্রণশিল্পে সবথেকে বড় বিপ্লব সৃষ্টি করেন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। তার প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র বই, সংবাদপত্র ছাপানোতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং এই শিল্পের প্রয়োজনীয় সকল সামগ্রী বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করেছিলো তারা। তবে এই কথা স্বীকার্য যে, গুটেনবার্গের আবিষ্কৃত মুদ্রণযন্ত্রের আধুনিকায়নে তার পরে সবথেকে বেশি অবদান রেখেছিলেন এই বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন।