Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জনপ্রিয় সাপ-লুডু খেলা আবিষ্কারের কাহিনী

ঘরে বসে খেলতে হয় সাপ-লুডু। ছোটবেলায় লুডু খেলা খেলেনি এমন বাঙালি পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। বাড়ির বয়স্ক মহিলাদের সাথে ছোটরাও মজে যেতো এই লুডু খেলায়। তবে লুডু বোর্ডের পরের পাতাটিই থাকতো সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সাপ আর মইয়ের এই খেলা ছিল দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ। মই দিয়ে উপরের ধাপে উঠে যাওয়া, আবার অমনি সাপের মুখে পড়ে নিচে নেমে আসা- এমনই উত্তেজনা থাকতো এই খেলায়, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে খেলাটি কিন্তু আজকের নয়, ইতিহাসের অনেক পথ ঘুরে এই খেলাটি আজকের রূপ পেয়েছে। সাপ-লুডুর সেই অজানা ইতিহাস নিয়েই আজকের আয়োজন।

১৯৭৭ সালে দীপক সিংখাদা নামের এক যুবক শিকাগো শহরের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে বসে নেপাল এবং তিব্বতের বিভিন্ন ছবির সংগ্রহ তালিকা প্রস্তুত করছিলেন। এ সময় মিউজিয়ামের এক কোনে পড়ে থাকা এক অদ্ভুত ছবির ওপর তার দৃষ্টি চলে যায়। জাদুঘরের রেজিস্টারে ছবিটি নিয়ে শুধু বলা হয়েছে, ‘রিলিজিয়াস ওয়ার্ক’। 

ছবিটি এক ভারতীয় আর্ট ডিলারের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল বলে জানা যায়। ছবিটি দেখে দীপক বেশ অবাকই হয়। কারণ ছবির মধ্যে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহাদেবের উপস্থিতি। আর জাদুঘরে এ ধরনের বিষয় নিয়ে আর কোন ছবিই চোখে পড়েনি। নানা পুথিপত্র পড়ে দীপকের কাছে বিষয়টি কেবল ধর্মীয় বিষয় বলে মনে হলো না, কেবলই তার মনে হতে লাগলো এর সাথে অন্য কোনো বিষয় জড়িয়ে আছে। তিনি বুঝতে পারলেন, ছবিটি উত্তর ভারত থেকে সংগ্রহ করা হলেও এর মূল লুকিয়ে আছে নেপালে। তার এক পরিচিত অধ্যাপক দীপককে জানালেন, এ ধরণের একটি ছবি তিনি নেপালের জাদুঘরে দেখেছেন।

এই ছবির রহস্য উন্মোচনের জন্য দীপক রওনা হলেন নেপালে। নেপালে পৌঁছেই উপস্থিত হলেন নেপালের ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। মিউজিয়ামের রেজিস্টার ঘাঁটতে শুরু করলেন যদি এই বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়। রেজিস্টারে শিকাগো মিউজিয়ামে দেখা এমনই এক ছবির কথা বলা আছে। জাদুঘর থেকে সে চিত্রকর্মটি বের করা হলো। নেপালের ন্যাশনাল মিউজিয়ামে পাওয়া এই চিত্রপটের নাম ‘নাগপাশ’।

এই চিত্রকর্ম সম্পর্কে পড়াশোনা করতে গিয়ে দীপক দেখেন এটি কোনো ধর্মীয় বিষয় নয়। এটি একটি খেলার ছক। নেপালিরা শুদ্ধ করে এ খেলাকে ‘নাগপাশ’ বললেও মুখে তারা বলেন ‘বৈকুন্ঠ খেল’। আসলে এটি আমাদের অতি পরিচিত এক খেলা ‘সাপ লুডু’।

নেপালে পাওয়া নাগপাশের ছকেও রয়েছে এই সাপ। তবে নাগপাশে দুই ধরনের সাপ দেখতে পাওয়া যায়। লাল সাপ আর কালো সাপ। লাল শুভ-লাভ এবং সৌভাগ্যের প্রতীক। কালো সাপ অশুভ এবং দুর্ভাগ্যের প্রতীক। নেপালি নাগপাশে লাল-সাপের লেজে গুটি পৌঁছতে পারলে খেলোয়াড়কে তা অনেক উঁচু জায়গায় পৌঁছে দেয়। আর কালো সাপের মাথায় গুটি পড়লে একেবারে লেজের শেষে নেমে যেতে হয়।

আমরা যে সাপ-লুডু খেলি, তাতেও সাপের ব্যবহার আছে। এখানেও গুটি সাপের মাথায় পড়লে সাপের লেজের শেষে নেমে যেতে হয়। তবে এখানে উপরে উঠার জন্য লাল সাপের পরিবর্তে মই ব্যবহার করা হয়। আর তাই লাল সাপগুলো এখানে অনুপস্থিত। তবে এখনকার সাপ-লুডুতে কোথাও মই, কোথাও তীর আবার কোথাও রকেটও ব্যবহার করা হচ্ছে।

শুধু মজা পাওয়ার জন্য আমরা যেমন সাপ-লুডু খেলি, নাগপাশ খেলার উদ্দেশ্য ছিল তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।  নাগপাশ খেলার উদ্দেশ্য ছিল অনেক গভীর এবং তার সাথে কিছুটা ধর্মেরও যোগাযোগ আছে। প্রাচীনকালে এই খেলার মাধ্যমে একজন খেলোয়াড় তার কর্মফল পরিমাপ করতেন। ভালো কাজের ফল পুণ্য, মন্দ কাজের ফল পাপ। সেকালের মানুষরা বিশ্বাস করতো, মানুষের এই পাপ-পুণ্য বা শুভাশুভ ফল ভবিষ্যৎ জীবন এবং পরজন্মের জন্য সঞ্চিত হয়ে থাকে। তারা বিশ্বাস করতো, ভালো কাজ করলে স্বর্গ আর খারাপ কাজ করলে নরক ভোগ করতে হয়।

জীবিত অবস্থায় একজন মানুষ ভাল কাজ করছে না মন্দ কাজ করছে, তা নিয়ে একটা সন্দেহ তখনকার দিনের মানুষদের মধ্যে প্রবলভাবে ছিল। এই কর্মফলে বিশ্বাসী মানুষের ভাবনা থেকেই নাগপাশ খেলার জন্ম নেয়। আর সে সময়ের মানুষদের কাছে নাগপাশ হলো কর্মফল পরিমাপ করার এক মজার উপায়।

নেপালি নাগপাশের যে দুটি চিত্রপট পাওয়া যায়, তা দুটিই শক্তপোক্ত কাপড়ের তৈরি ছক। নীচ থেকে ওপর পর্যন্ত খোপ আছে ৭২টি। তাতে লাল-কালো মিলিয়ে সাপ আছে ১৫টি। খোপগুলি নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত আটটি সারির বেশিরভাগ সারিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সৃষ্টি থেকে শুরু করে মানুষের আত্মজ্ঞান লাভের অভিব্যক্তি প্রকাশ করা এমন কিছু মানুষের ছবি। নীচের সারিগুলোতে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহে জর্জরিত মানুষের ছবি তুলে ধরা হয়েছে। একেবারে ওপরের সারিতে জ্ঞান, চেতনা এবং আত্মোপলব্ধি। আর একেবারে ছকের ওপরে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহাদেবের ছবি।

শিকাগো মিউজিয়ামে পাওয়া নেপালি নাগপাশের একটি চিত্রকর্ম; Image Source: britishmuseum.org

খেলোয়াড়রা ১-২-৩- ইত্যাদি সংখ্যাবিশিষ্ট একটি ঘুঁটি চালিয়ে খেলা শুরু করতেন। যে দান উঠবে, সে অনুযায়ী তত ঘর যাওয়া যাবে। এই যাওয়ার পথে দান কোথাও লাল সাপের পায়ে পড়বে, আবার কোথাও কালো সাপের ফাঁদে পড়বে। কালো সাপের বাধা পড়লে নিচে নামতে হবে আর লাল সাপ তাকে উন্নত জায়গায় উঠিয়ে দেবে। গুটি কালো সাপের মুখে পড়লে বুঝতে হবে পূর্বের বা এই জন্মের কোন পাপের ফলে কালো সাপ আক্রমণ করেছে এবং এর ফলে তা খোলায়াড়কে নিচের কর্মভূমিতে নামিয়ে দেয়। এর মধ্য দিয়ে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় এখন থেকে ভাল কাজ করলেই মুক্তি লাভ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বার বার কালো ও লাল সাপের এই ওঠা-নামা জন্মান্তরচক্রের কথা বলে। 

নেপালি নাগপাশের আদলে তৈরী চিত্রকর্ম; Image Source: christies.com

নাগাপাশ খেলার এই যে বিস্তৃতি, তা কিন্তু শিকাগো মিউজিয়ামে পাওয়া চিত্রপটে নেই। সেটা অনেক সহজ ও সরল। মূলত এই খেলাটি নেপালে পাওয়া গেলেও তা কিন্তু ভারতবর্ষের মূল ভূখন্ডে অনেক আগে থেকেই চালু ছিল বলে বিভিন্ন পণ্ডিতদের অভিমত।

১৯৭৫ সালে হরিশ জোহারি নামের এক পণ্ডিতের লেখা বইতে দেখা যায়, নেপালের নাগপাশ খেলার প্রচলন দশম শতকে হলেও তার বহু আগে থেকেই ভারতেবর্ষে এই খেলার চল ছিল। ভারতের দিকে এর খেলার নাম ছিল ‘জ্ঞান-চৌপার’ বা ‘মোক্ষ-পতমু’, অনেকে সংক্ষেপে বলেন মোক্ষপট। আর তখন ভারত বা নেপাল বলে আলাদা কোনো দেশ ছিল না। তবে কীভাবে এই খেলা ভারত থেকে নেপালে গেল, সে সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। জ্ঞান-চৌপারের খেলার উদ্দেশ্যও নাগপাশের মতোই। এখানেও ৭২টি খোপ। তবে এখানে লাল সাপের পরিবর্তে তীর বা বাণ ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীকালে যা মই বা সিঁড়ির চেহারা নিয়েছে। সাপ-লুডুর মধ্যে যে কর্মফল, আত্মজ্ঞানের কথা রয়েছে, সেসব প্রতীকি বিষয়গুলো হারিয়ে গিয়ে আজ তা নিছক খেলায় পরিণত হয়েছে। 

সাপ ও মইয়ের তৈরি খেলা জ্ঞান-চৌপার ; Image Source: himalayanacademy.com

তবে আধুনিক সাপ লুডুতে সে সাপ ও মইয়ের ব্যবহার দেখা যায়, তা এই জ্ঞান-চৌপার থেকেই এসেছে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু খেলা শুরুর প্রক্রিয়া এসেছে নেপালি নাগপাশ থেকে। কারণ নেপালি নাগপাশ এবং ভারতীয় জ্ঞান-চৌপার দুটিতেই ৭২টি খোপ আছে। জ্ঞান-চৌপারে খেলা শুরু হতো ৬৮ নম্বর ঘর থেকে। খেলোয়াড় বেশিক্ষণ এখানে থাকতে পারতেন না। দান চালার পর এগোতে-এগোতে তাকে সাপের মুখে পড়তে হয়। আর এভাবে খেলতে-খেলতে তাকে আবার ফিরে আসতে হয় ৬৮ নম্বর ঘরেই। উদ্দেশ্যটা এমন যে, পরম আনন্দে তোমার জন্ম আর ফিরেও যেতে হবে সেই আনন্দে।

উনিশ শতকের দিকে জৈন ধর্মের ভক্তদের মাঝে ব্যবহৃত সাপ-লুডো খেলার পরিবর্তিত রূপ; Image Source: medium.com

আর নেপালি নাগপাশ শুরু হতো ১ নম্বর ঘর থেকেই। জীবনের পথচলার মতোই শৈশব, যৌবন, জরার পথ ধরে খেলোয়াড়কে এগোতে হয় যা নিয়ন্ত্রণ করে লাল ও কালো সাপ। ৭২ ঘর অতিক্রম করতে পারলেই মোক্ষলাভ সম্পন্ন।

পরবর্তীকালে এই নাগপাশ ও জ্ঞান-চৌপারে খোপের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১০০ হয়, যা আজও অনুসরণ করা হচ্ছে। কিন্তু শুরুতে সব খেলায় ৭২টি ঘর ছিল। তার কারণ হচ্ছে সংসার চক্রের যে বিভিন্ন স্তর রয়েছে, তার সংখ্যা ৭২। আর সে কারণেই ৭২ নম্বর ঘরটি পূর্ণ করতে পারলেই জীবনচক্রের পরিসমাপ্তি ঘটে বলে সে সময়ের মানুষেরা মনে করতেন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন ধর্মেও সাপ-লুডু খেলার প্রচলন শুরু হতে থাকে। তবে সেখানে নিজ নিজ ধর্মের নীতিকথাই প্রাধান্য পেতে থাকে। 

ব্রিটিশদের তৈরি সাপ-লুডু; Image Source: healthy.uwaterloo.ca

ইংরেজরা ভারতবর্ষ দখল করার পর এ খেলাটির প্রতি তারাও বেশ আকর্ষিত হয়ে পড়ে। এ খেলার চিন্তা-ভাবনা তাদেরকে বেশ মুগ্ধ করে। ১৯ শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশরা এই খেলাটিকে তাদের নিজেদের উপযোগী করে তৈরি করে নেয়। সাপ-লুডোর মূল থিম ঠিক রেখে নিজেদের ধর্মীয় আদর্শ এবং নানা উপদেশমূলক বাণী এতে সংযুক্ত হয়। ইংরেজদের তৈরি সাপ-লুডু খেলাটি সে সময় ইউরোপ, আমেরিকায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

বর্তমান যুগের মোবাইল ও কম্পিউটার গেমস হিসেবে সাপ-লুডো খেলার জনপ্রিয়তা আজও কমেনি; Image Source: apk-dl.com

বিংশ শতাব্দীতে এসে সাপ-লুডু খেলাটি কোন নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারিদের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে তা সার্বজনীনতার রূপ পায়। ফলে খেলাটি বিভিন্ন বয়সী মানুষদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠে। বর্তমান সময়ে এসে ভিডিও গেমসের কল্যাণে এই ঐতিহাসিক ও জনপ্রিয় খেলাটি অনেকের মোবাইল ও কম্পিউটারে স্থান করে নিয়েছে। তাই কালের বিবর্তনে খেলাটিতে নানা পরিবর্তন আসলেও এর জনপ্রিয়তা আজও অমলিন।

ফিচার ইমেজ- medium.com

তথ্যসূত্র:

১. সাপ-লুডোর উৎস সন্ধানে – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

 

Related Articles