ইতিহাসে যেকোনো যুদ্ধের ক্ষেত্রে একটি বিষয় সবসময়ই ধ্রুবক ছিল। এটি হচ্ছে ‘ক্ষতি’৷ যুদ্ধ এবং ক্ষতি যেন একে অপরের পরিপূরক। ইতিহাসে আজ পর্যন্ত যতগুলো ক্ষতি হয়েছে সবগুলোতেই হয় একপক্ষ হেরেছে এবং অপর পক্ষ জিতেছে। কিন্তু দু’পক্ষেরই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যুদ্ধে জয়লাভ করতে যুদ্ধকৌশল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসে দেখা গিয়েছে, সংখ্যায় বেশি ও অস্ত্রশস্ত্রে উন্নত হওয়ার পরও ভুল যুদ্ধকৌশল অবলম্বন করার ফলে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। আবার উল্টো দিকে, সংখ্যায় কম এবং অস্ত্রশস্ত্রে পিছিয়ে থাকার পরও সঠিক যুদ্ধকৌশল অবলম্বন করায় জয়লাভ করেছে, এরকম উদাহরণ আছে অনেক। ইতিহাসের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে, তার সবগুলোতেই বিভিন্ন রকমের যুদ্ধকৌশল প্রয়োগ করেছে বিভিন্ন পক্ষ। এর মধ্যে সবচেয়ে নির্মম যুদ্ধকৌশলগুলোর একটি হচ্ছে ‘হিউম্যান ওয়েভ’।
সাদ্দাম হুসেইনের ইরাক ১৯৮০ সালের দিকে প্রতিবেশি ইরানের উপর হামলা চালিয়ে বসে। শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। এই যুদ্ধের স্পষ্ট কারণ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতবিভেদ রয়েছে। ইরানে হামলার শুরুর দিকে ইরাক বেশ সফলতা লাভ করছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ইরান পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। ১৯৮২ সালের জুলাই মাসে ইরানের সেনাবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবক বাসিজ বাহিনী ‘অপারেশন রমাদান’ নামে পাল্টা আক্রমণের এক সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। এই অভিযানে প্রায় এক লাখ পদাতিক সৈন্য সারি বেধে অস্ত্র হাতে ইরাকের সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে আক্রমণ চালিয়েছিল। ইরাকের সৈন্যরা যেখানে সরাসরি বিভিন্ন পরিখায় আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সুসজ্জিত হয়ে ছিল, সেখানে ইরানি সেনাবাহিনীর তেমন কিছুই ছিল না। অন্যান্য সামরিক শাখাগুলো থেকে তেমন কোনো সহযোগিতাও আসেনি। ফলে ইরাকি সেনাবাহিনীর কামানের গোলা ও মেশিনগানের গুলির আঘাতে হাজার হাজার আক্রমণরত ইরানি সৈন্য প্রাণ হারায়। পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধে এভাবেই প্রয়োগ করা হয়েছিল ‘হিউম্যান ওয়েভ কৌশল’।
১৯৫০ সাল। কোরীয় উপদ্বীপে বেজে উঠেছে যুদ্ধের দামামা। একদিকে উত্তর কোরিয়া এবং তার মিত্র দুই বিশ্বশক্তি চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। অপরদিকে দক্ষিণ কোরিয়া ও তার মিত্র আমেরিকা, জাপান ও জাতিসংঘের যৌথবাহিনী। নিজের মিত্র উত্তর কোরিয়াকে যুদ্ধে জয়ী করতে চীন তার সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশ পাঠিয়ে দিয়েছিল রণক্ষেত্রে। চীনা সৈন্যরা এক অভিনব পদ্ধতিতে ‘হিউম্যান ওয়েভ’ কৌশল ব্যবহার করেছিল এই যুদ্ধে। প্রথমে অল্প কিছু চীনা সৈন্য প্রতিপক্ষের কাছে গিয়ে দুর্বল দিকগুলো খুঁজে বের করতো। প্রতিপক্ষ টের পেলে এরপর শুরু হতো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। এই সুযোগে বড় আকারে মূল বাহিনী আক্রমণ করে বসতো। বলাবাহুল্য, শুরুতে যে ছোট দলটি চুপিসারে প্রতিপক্ষের কাছে যেত, তারাই বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতো। তাদের উপর প্রতিপক্ষ চড়াও হতো সবচেয়ে বেশি। চীনারা এই কৌশল ব্যবহার করে বেশ সাফল্য পেয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। জার্মান নাৎসি বাহিনি ‘অপারেশন বারবারোসা’ নামে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান পরিচালনা করছে সোভিয়েত ইউনিয়নে। লক্ষ্য একটাই, সুবিশাল সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাজিত করে নিজেদের অধীনে নিয়ে আসা, একটি রণাঙ্গন কমিয়ে ফেলা। শুরুতে মনে হচ্ছিল নাৎসিদের জয় কেবল সময়ের ব্যাপার। এই যুদ্ধে জার্মানরা ছিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে পরিপূর্ণ, অপরদিকে সোভিয়েত সৈন্যরা সংখ্যায় অনেক বেশি হলেও অস্ত্রশস্ত্র তাদের তেমন ছিল না। তাই সোভিয়েত নেতারা নাৎসিদের অগ্রযাত্রা রুখতে হিউম্যান ওয়েভ কৌশলের আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। সুসজ্জিত নাৎসিদের সামনে রুশদের ক্ষয়ক্ষতি ছিল অত্যধিক। শুধু স্টালিনগ্রাদের যুদ্ধেই প্রায় এগারো লাখ সৈন্য মৃত্যুবরণ করেছিলেন! জাপানিরাও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষের উপর এই কৌশল ব্যবহার করেছিল।
হিউম্যান ওয়েভের তিনটি উদাহরণ দেখা গেল উপরে, যেটি থেকে এই যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া সম্ভব। এটি হচ্ছে এমন একটি যুদ্ধের কৌশল, যেখানে নিজের সৈন্যদের অস্ত্রে সজ্জিত করে সরাসরি পদাতিক আক্রমণের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই আক্রমণের একটি বড় দিক হচ্ছে, প্রতিপক্ষের চেয়ে নিজের আক্রমণকারী সেনাদলকে সংখ্যায় অনেক বেশি হতে হবে। প্রতিপক্ষও এমন আক্রমণ ঠেকানোর জন্য সাধারণত আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিখায় পর্যাপ্ত অস্ত্র নিয়ে তারা বিপরীত পক্ষের পদাতিক সৈন্যদের কাছে ঘেষার আগেই দূর থেকে স্তব্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনা হাতে নেয়। কারণ হাতাহাতি লড়াইয়ে হিউম্যান ওয়েভ বেশ কার্যকরি হয়ে উঠতে পারে। প্রাচীনকালে হিউম্যান ওয়েভ কৌশলের সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ হয়েছে, কারণ শত্রুপক্ষ থেকে দূরের অবস্থান করে যুদ্ধ করার জন্য যেসব সামরিক সরঞ্জাম দরকার, সেগুলো তখনও উদ্ভাবিত হয়নি।
আধুনিক সময়ে হিউম্যান ওয়েভ কৌশল ব্যবহার করা হয় না বললেই চলে। কারণ এটি এমন একটি কৌশল, যেখানে প্রচন্ড ক্ষয়ক্ষতির শিকার হওয়া অনিবার্য। বর্তমানে প্রায় সব সেনাবাহিনীর হাতেই এমন অস্ত্র রয়েছে, যেগুলোর দূর থেকে শত্রুপক্ষের অগ্রসরমান সেনাকে থামিয়ে দিতে পারে৷ তাই কোনো সেনাবাহিনীই বিপুল পরিমাণ সৈন্য হারানোর আশঙ্কায় এই কৌশলের আশ্রয় নেবে না। তবে সেনাবাহিনীর অন্যান্য শাখার পর্যাপ্ত সহায়তা পেলে আধুনিক সময়েও হিউম্যান ওয়েভ ব্যবহার করে সফলতা লাভ করা সম্ভব। চলমান রুশ-ইউক্রেন সংঘাতে রাশিয়ার মার্সেনারি বাহিনী ওয়াগনার এই কৌশল ব্যবহার করে সফলতা লাভ করেছে। যুদ্ধ মানে ধ্বংস অনিবার্য হলেও যেকোনো পক্ষ নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ করে।