১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ত্রিশ কোটি ভারতীয়কে শাসনের দায়িত্বভার চলে যায় ব্রিটিশ রাজের হাতে। রানী ভিক্টোরিয়া ভারতবাসীর শাসনকর্তার দায়িত্ব নেন। তার পছন্দের প্রতিনিধিরাই একে একে ভাইসরয় বা বড়লাট হিসেবে ভারতের মানুষের ভালোমন্দ নির্ধারণের দায়িত্ব পায়।
ভারতবর্ষের ব্যাপারে এক অদ্ভুত রোমান্টিসিজম ছড়িয়ে ছিল ব্রিটেনে। রানী ভিক্টোরিয়া ভারতের দায়িত্ব নেওয়ার ফলে ব্রিটিশদের রক্তে ভারত শাসনের রোমাঞ্চ যেন আরেকটু জেঁকে বসলো। বিশাল দেশ ভারতবর্ষ, বর্তমান ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের পুরোটা জুড়েই ছিলো ব্রিটিশ রাজত্ব। এই বিশাল রাজত্বে ভাইসরয়কে সহায়তার জন্য দরকার কর্মমূখী, শিক্ষিত, রোমাঞ্চপ্রিয় তরুণদ। ১৮৫৮ সালের Government of India Act থেকে সৃষ্টি করা হলো ইম্পেরিয়াল সিভিল সার্ভিস। যেটি কালক্রমে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস কিংবা আইসিএস নামেও পরিচিত ছিল।
এই আইন অনুযায়ী শুধুমাত্র ২১ থেকে ২৪ বছর বয়সী ব্রিটিশ নাগরিক আইসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা রাখে। প্রতি বছর আগস্ট মাসে লন্ডনে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো। তবে পরবর্তীতে এই আইনের অনেক ধারাই সংশোধন করা হয়েছিল। ভারতীয়দের নিয়োগ দেওয়া থেকে শুরু করে ভারতের এলাহাবাদে পরীক্ষা কেন্দ্রও স্থাপন করা হয়েছিল।
তবে ব্রিটিশ তরুণদের মাঝে যারা এখানে আইসিএস অফিসার হিসেবে যোগ দিতেন তাদের কাছে এই দেশে আসা ছিলো রীতিমতো এডভেঞ্চার। ২১ থেকে ২৪ বছরের শত শত ব্রিটিশ তরুণের স্বপ্নের রাজ্য ছিল ভারত। লন্ডনের কঠিন পরীক্ষার বাঁধা উত্তীর্ণ হয়ে তারা যোগ দিতেন এক বছরের প্রশিক্ষণকালীন কোর্সে। ভারতে তাদের কী দায়িত্ব পালন করতে হবে এর উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হতো তাদেরকে। কেউ বসতেন অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারত বিষয়ক ক্লাসে। কেউ আবার লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টাল স্টাডিজের ক্লাসে কেউ ট্রিনিটি কলেজে, কাউকে গড়ে তোলা হতো আইন বিশারদরূপে। পাশাপাশি ঘোড়া থেকে শুরু করে বন্দুক চালনা, তলোয়ার লড়াই আর নানা ধরনের খেলাধুলাও শিক্ষা দেওয়া হতো এসব তরুণ অফিসারদেরকে।
জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে ‘গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া’র দিকে তাকিয়েই গর্বে বুক ভরে উঠতো এই তরুণদের। রাজা পঞ্চম জর্জ আর রানী মেরির ভারতবর্ষে আসার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এই স্মারককে দেখে নিজেকেও তাদের উত্তরাধিকারের সাথে যুক্ত করে নিতেন এই যুবকেরা। বোম্বাইয়ের জাহাজঘাট থেকে শুরু করে রেলওয়ে স্টেশনের চত্ত্বর, সবখানে ভারতীয়দের আচার আচরণ শুরুতে বেশ অদ্ভুত ঠেকতো এই যুবকদের। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হত এদের শাসন করতেই তো এ দেশে তাকে পাঠানো হয়েছে তাদের। এখানের সবাই তার অধস্তন। স্টেশনের কোলাহল আর ভারতীয় ঠাসা কামরা থেকে দূরে, একই ট্রেনে সুসজ্জিত কামরায় চড়তেন নব্য আইসিএস অফিসাররা।
শুরুতেই তাদের শিক্ষানবিস হিসেবে পাঠানো হতো ভারতের দুর্গম কোনো এলাকায়। ৩৪ বছর বয়সী তরুণ জেলা অফিসারের হাতে হয়তো দায়িত্ব দেওয়া হতো ৪ হাজার বর্গ কিলোমিটারের বিশাল এলাকা, কম করে হলেও এই তরুণ দশ লক্ষ লোকের শাসনকর্তা হয়ে উঠতেন নিমিষেই। এই পরিমাণ এলাকা স্কটল্যান্ডের চেয়েও বিশাল।
নিজেদের ভোগ বিলাসের সাম্রাজ্যে তারা ডুবে যেতেন। দেশ পরিচালনায় যে যত কঠোর সে ততো সফল, এই ধারণাটা তাদের মস্তিষ্কে খুব ভালভাবেই ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। খুব সামান্য অপরাধে তাই বিশাল সাজা দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতো না এই তরুণ অফিসারেরা। ল্যারি কলিন্স এবং দোমিনিক ল্যাপিয়ের রচিত ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট বইয়ে ব্রিটিশদের ভারত শাসনকে তুলনা করা হয়েছে বেত হাতে স্কুলের শিক্ষক যেমন চরম অবাধ্য ছাত্রকে শাসন করেন, অনেকটা তেমন। হাজার বছরের ভারতীয় রীতিনীতির বাইরে এসে ভারতীয়দের যখন ইউরোপীয়রা নিজেদের মানদণ্ডে বিচার করতে শুরু করে তখন তাদেরকে অসভ্য আর অবাধ্যই মনে হয়েছিল। তাই ভারতীয়দের ভালোমন্দ, ন্যায়-অন্যায় এমনকি ভারতীয়দের স্বার্থ বিবেচনার কর্তা নিযুক্ত হয়েছিলেন ইউরোপে বেড়ে উঠা মানুষেরা। ব্রিটিশ শাসনের একটি বড় সময়জুড়ে ভারতীয়দের মতামতের কোনো দাম আছে বলেও বিবেচনা করা হতো না।
সাধারণ ভারতীয়দের সাথে শুরু থেকেই ব্রিটিশ শাসকশ্রেণির ছিল যোজন যোজন দূরত্ব। ভারতে শুরু থেকেই তারা নিজেদের বসবাসের জন্য নিজেদের স্বর্গরাজ্য নির্মাণে ব্যস্ত থাকতেন। কলকাতার বেঙ্গল ক্লাবের সবুজ মাঠে ক্রিকেট খেলতে খেলতে তারা ইংল্যান্ডের কথাই স্মরণ করতেন। অনেকেই আবার রাজস্থানের শুকনো মাঠে পোলো খেলার মাঠে মগ্ন। কেউ আসামের গহীন বনে বাঘ শিকার করছেন কেউ আবার সিমলার শীতল পরিবেশে পিকনিক করছেন। তরুণ আইসিএস অফিসারদের জন্য ভারতীয়দের ভালোমন্দ বিষয়ে চিন্তা করার ফুসরত খুব কমই ছিল। ব্রিটিশ দার্শনিক জেমস স্টুয়ার্ট মিল একবার বলেছিলেন,
ভারতবর্ষ কার্যত ব্রিটেনের উচ্চবিত্তশ্রেণির মানুষের মুক্তবায়ুর খেলাধুলা আর অবকাশ যাপনের এক বিশাল ক্ষেত্র হিসেবেই পরিচিত ছিল।[১]
তবে দুর্গম এলাকায় শিক্ষানবিসের দায়িত্ব পালনের বছর দুয়েকের মধ্যেই তরুণ আইসিএস অফিসাররা প্রমোশন পেতেন। বড় শহরগুলোতে আরো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিযুক্ত করা হতো তাদের। কিন্তু সময় পেলেই তারা রোমাঞ্চের নেশায় বেরিয়ে পড়তেন। নিউ ইয়র্কে গলফ খেলা চালু হওয়ার ত্রিশ বছর আগেই ভারতে গলফ খেলা চালু করে ইংরেজরা। সিমলায় এগারো হাজার ফুট উঁচু গলফ ক্লাব নির্মাণ করা হয়েছিল এই ব্রিটিশদের রোমাঞ্চের খাতিরেই। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এমন বিলাসবহুল স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছিল যেগুলোকে এখন অনেকেই চিহ্নিত করে থাকেন Islands of Englishness নামে।
তবে দুঃসাহসিক কাজের মূল্য অনেকেই চুকিয়েছেন প্রাণের বিনিময়ে। অনেকেই ভারতের বিচিত্র আবহাওয়ায় মানিয়ে নিতে পারেননি। এ দেশের মানুষদের থেকে দূরে থাকলেও আবহাওয়া আর রোগব্যাধি থেকে বেঁচে থাকা অনেকটাই দুঃসাধ্য ছিল। ম্যালেরিয়া আর কালাজ্বরের প্রাদুর্ভাবে অনেকেই মারা গেছেন। ১৮৯৭ সালে টমাস হেনরী বাটলার নামক এক ইংরেজ কর্মকর্তাকে মানুষখেকো বাঘ আস্ত খেয়ে ফেলেছিল। তবে এতে করে ব্রিটিশ শিকারীদের উৎসাহে বিন্দুমাত্র ভাঁটা পড়েনি।
ব্রিটিশ আইসিএস অফিসারদের রোমাঞ্চের জীবনে খানিকটা রাশ টানতো তাদের ইউরোপিয়ান বধুরা। স্বামীদের এডভেঞ্চারকে সীমাবদ্ধ করতে পার্টির আয়োজন করা হতো নিয়মিতই। ভোজসভা আর পান উৎসবের আয়োজনে তারা ছিলেন সিদ্ধহস্ত। অনেক গবেষকের মতে ভিক্টোরিয়ান আমলে ভারতবর্ষে ইংরেজ আর ভারতীয়দের বিচ্ছেদ, ভেদাভেদের কুশীলব ছিলেন এই ইংরেজ মেমসাহেবরা। স্বামীদেরকে ভারতীয় নারীদের থেকে দূরে রাখতেই তারা জন্ম দিয়েছিলেন নানা কুসংস্কারেরও।[২]
ব্রিটিশ শাসনের সবচেয়ে বড় দিকটি ছিল শাসক আর শাসিতের দূরত্ব। শুরুতে এই দূরত্ব ছিল প্রকট। পরবর্তীতে ইংরেজ শাসকেরা নিজেদের প্রয়োজনেই এই দূরত্ব ঘুচিয়ে ভারতীয়দের বিভিন্ন কাজে নিয়োগ দেওয়া শুরু করে। পরবর্তীতে ইংরেজী ভাষা আর শিক্ষার ফলে তৈরি হওয়া এই মধ্যবিত্ত ভারতীয় শিক্ষিত সমাজ ভারতের স্বাধীনতায় সবচেয়ে সুদুরপ্রসারী ভূমিকা পালন করেছিল।
আইসিএস অফিসারদের দীর্ঘ কর্মজীবন শেষে ব্রিটেনে ফিরে যাওয়ার সময় অনেকেই টের পেতেন এই দেশের মায়ার বাঁধনে বাঁধা পড়েছেন তারা। স্যার ডেভিড গিলমোরের বইয়ে এমনই একটি কাহিনী উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা উইলিয়াম স্ট্রেচি ব্রিটেনে গিয়েও তার ঘড়িতে কলকাতার সময়টি দিয়ে রেখেছিলেন।
আইসিএসে ভারতীয়দের নিয়োগ দেওয়া হলেও তাদের প্রতি ছিলো ব্যাপক আকারের বৈষম্য। দীর্ঘদিন চাকরি করেও প্রমোশন কিংবা গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হতো না ভারতীয়দের। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিপুল পরিমাণ ইংরেজ তরুণ প্রাণ হারায়। ইংরেজ তরুণদের অনেকেই যাবার ব্যাপারে অনাগ্রহী হয়ে উঠে। এই অভাব পূরণে ভারতীয়দের মধ্য থেকেই নিয়োগ দেওয়া হতে থাকে আইসিএস অফিসারদেরকে।
১৯১৮ সালে থেকেই কার্যত ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে ব্রিটিশদের নিয়োগ প্রায় শূন্যের কাছাকাছি চলে আসে, শিক্ষিত ভারতীয়দের ক্রমবর্ধমান দাবির মূখে প্রতিবার আইসিএস নিয়োগে তাদেরকে প্রাধান্য না দিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার আর উপায় ছিল না। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার বছরে মাত্র এক হাজার ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৪৭ সালেই পতন ঘটে ব্রিটিশ উপনিবেশের।
তথ্যসূত্র
১. ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট; দোমিনিক লাপিয়েররী, ল্যারি কলিন্স (অনুবাদঃ রবিশেখর সেনগুপ্ত); পৃষ্ঠা ১৩
২. পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৫
ফিচার ছবি- PinsDaddy