মিশর, বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে এই দেশটি প্রাচীনকাল থেকেই সভ্যতা, সংস্কৃতি, কর্মদক্ষতা ইত্যাদি অনেক কিছুতে এগিয়ে ছিল। মিশরীয় সভ্যতা সময়ের সাথে সাথে উত্তরোত্তর বিকশিত হয়েছে। এমন অনেক কিছুই প্রাচীন মিশরে ছিল যা পরবর্তীতে আমাদের রোজকার জীবনের অংশ হয়ে যায়। অবাক হতে হয় যে, এত বছর পূর্বে সভ্যতায় যখন আধুনিকতার ছোঁয়াও লাগেনি সে সময়ে এত আগাম চিন্তা করেছিল কীভাবে এ জাতি! প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা থেকে প্রভাবিত যে বিষয়গুলো এখন আমাদের আধুনিক জীবনযাপনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। এর মধ্যে কয়েকটি সম্পর্কে এখানে আলোকপাত করা হলো।
গণিত
প্রাচীন মিশরীয়রা নিজেদের জীবনে গণিত ব্যবহার করতো। আজকের আধুনিক জ্যামিতির ভিত্তি এসেছে প্রাচীন মিশর থেকেই। প্রাচীন মিশরের জমি পরিমাপকেরা ছিলেন প্রথম দিককার জ্যামিতিবিদ। গ্রিকরা তাদের বলতো ‘আরপেডোনাপতি (arpedonapti)’ অর্থাৎ ‘যে দড়ি বাঁধে’। আরপেডোনাপতিরা জমি মাপার কাজে দড়ি ব্যবহার করতো বলে তাদের এই নাম দেয়া হয়। আজকাল আমরা খুব সহজেই কাগজের উপর কলম বা পেন্সিল ও কম্পাস দিয়ে বৃত্ত বা বর্গ এঁকে ফেলতে পারি, কিন্তু প্রাচীন মিশরীয় জ্যামিতিবিদরা দড়ি দিয়ে জমির উপর সেই কাজ করতো।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৬৫০ অব্দকালীন সময়ের ‘রাইন্ড প্যাপাইরাস’ নামক একটি গাণিতিক দলিল পাওয়া যায়। এতে মিশরীয়দের গণিত বিষয়ক জ্ঞানের পরিচয় মেলে। এটি মূলত তৎকালীন সময়ের পাটিগণিত ও জ্যামিতিক নির্দেশিকা। এতে গুণ ও ভাগ করার বিস্তারিত পদ্ধতি আলোচিত হয়েছে। এতে প্রাচীন মিশরীয়দের আরো কিছু গাণিতিক জ্ঞানের প্রমাণ মেলে, যেগুলোর মধ্যে ভগ্নাংশ, মৌলিক ও যৌগিক সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।
বোলিং
বর্তমানে খেলা হিসেবে বোলিং বেশ জনপ্রিয়। প্রায় ৫ হাজার বছর আগেই মিশরীয়রা এই খেলার উদ্ভাবন করে। ১৯৩০ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী স্যার ফ্লিন্ডার্স পেট্রি ৩,২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এক মিশরীয় বালকের সমাধি থেকে বোলিং বল এবং পিন সদৃশ কিছু জিনিস আবিষ্কার করেন। এগুলো ছিল পাথরের তৈরি। সেখান থেকে জানা যায় মিশরীয়রা বোলিংয়ের আদিম সংস্করণে খেলাটি খেলতো।
কয়েক বছর আগে এক ইতালীয় পুরাতত্ত্ববিদ এডা ব্রেসিয়ানি ও তার গবেষণা দল কায়রো থেকে ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে একটি প্রাচীন কক্ষ আবিষ্কার করেন। সেখানে আধুনিক বোলিংয়ের মতো সরু পথ তৈরী করা ছিল। সেখানে তারা বিভিন্ন ধরনের বল খুঁজেও পান। সবদিক পর্যবেক্ষণ করে এই ধারণায় উপনীত হন যে ঐ কক্ষটি আধুনিক বোলিং হলের মতো করেই ব্যবহার করা হতো।
বর্ণমালা
বর্তমানে তেমন কেউই মিশরীয় বর্ণমালা ব্যবহার করে না। কিন্তু ফোনেটিক বর্ণমালার ধারণাটি প্রাচীন মিশরীয়দের কাছ থেকেই পাওয়া। ফোনেটিক বর্ণমালাতে একটি প্রতীক বা চিহ্ন সম্পূর্ণ একটি শব্দ প্রকাশ না করে একটি ধ্বনি প্রকাশ করে। মিশরীয় হায়ারোগ্লিফে একটি শব্দের জন্য একটি প্রতীক ব্যবহার করা হতো। হায়ারোগ্লিফে প্রায় ১,০০০ সংকেত ছিল। এগুলো ব্যবহারের জন্য বেশ দক্ষতার প্রয়োজন হতো বিধায় সাধারণ কাজকর্মে এর ব্যবহার কমই ছিল। মিশরে বসবাসকারী সেমেটিকরা হায়ারোগ্লিফের সংকেতগুলোর ভিত্তিতে ২২ অক্ষরের একটি বর্ণমালা তৈরি করে, যা ছিল পুরোপুরিই উচ্চারণ নির্ভর। এতে বর্ণগুলো বড় শব্দ তৈরি করতে ব্যবহৃত হতো, ঠিক যেমনটা আমরা এখন করে থাকি।
কাগজ ও লেখনি
আধুনিক কালে আমরা যে কাগজ ব্যবহার করি তার আবিষ্কার চীনে। কাগজের এরকম ব্যবহার ছিল প্রাচীন মিশরেও। লেখালেখির জন্য মিশরীয়দের প্যাপাইরাসের ব্যবহার মানব সভ্যতাকে পাথরে কুঁদে লেখালেখি থেকে এক ধাপ সামনে নিয়ে এসেছিল। চীনে কাগজ তৈরির বহু আগে থেকেই মিশরে প্যাপাইরাস গাছ থেকে তৈরি একধরনের কাগজ সদৃশ বস্তু ব্যবহৃত হতো। শুধু লেখালেখিই সহজ করে দেয়নি, বরং সহজে বহন করার জন্যও বেশ উপযোগী ছিল এ পদ্ধতি। ধীরে ধীরে একসময় রপ্তানী পণ্য হিসেবে প্যাপাইরাস বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এটি ছিল বেশ দামী। এর তৈরি প্রক্রিয়া কঠোরভাবে সুরক্ষিত ও গোপনীয় থাকতো। প্যাপাইরাস থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েই ইংরেজরা পার্চমেন্ট ও পরে চীনারা কাগজ আবিষ্কার করে। এমনকি কাগজের ইংরেজি শব্দ পেপারের উৎপত্তি প্যাপাইরাস থেকেই।
পরচুলা
প্রাচীন মিশরীয়রা একটি ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগত। প্রখর রোদে তারা মাথাভর্তি চুল নিয়ে বের হতে চাইত না। আবার একদম ন্যাড়া মাথায় সূর্যের প্রবল তাপ সহ্য করাও বেশ পীড়াদায়ক ছিল। পাশাপাশি দেখতে ভালো লাগার ব্যাপারটাও ছিল। তাই তাদের এমন কিছু দরকার ছিল যা তাপ থেকে বাঁচাবে আবার দেখতেও খারাপ দেখাবে না। এ ধারণা থেকেই পরচুলার জন্ম। যারা বেশ ধনী ছিল তারা আসল চুলে তৈরি পরচুলাই ব্যবহার করত। সাধারণত পরচুলাটি মোম দিয়ে মাথার উপর আটকে দেয়া হতো।
নথিভুক্ত ওষুধ ও চিকিৎসা পদ্ধতি
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ ক্ষত সারাতে নানা ধরনের গাছগাছড়া ও জীবজন্তুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু পদ্ধতিগুলো লিখে রাখা ও পরবর্তীতে অন্যদের ব্যবহার করার সুযোগ করে দেয় মিশরীয়রা। নতুন ও সুবিধাজনক লিখন পদ্ধতির কল্যাণে মিশরীয়রা কিছু নথিপত্র তৈরি করতে পেরেছিল। এতে প্রাচীনতম চিকিৎসা প্রণালী ও বিভিন্ন ওষুধ তৈরির পদ্ধতি পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত ওষুধ ও তার ব্যবহার পদ্ধতি সম্বলিত এমন ৯টি প্যাপাইরাস পাওয়া গেছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো ‘এডউইন স্মিথ প্যাপাইরাস’।
এটি প্রাচীনতম অস্ত্রোপচার পদ্ধতির একটি পূর্ণাঙ্গ নির্দেশিকা। এটি সম্ভবত তৎকালীন সামরিক অস্ত্রোপচারের নির্দেশিকা ছিল। এতে আঘাত, ক্ষত, হাড়ভাঙা, হাড়ের স্থানচ্যুতি ও টিউমারের ৪৮টি ঘটনা বর্ণনা করা আছে তাদের চিকিৎসা পদ্ধতি সহ। বর্তমানের অনেক চিকিৎসা পদ্ধতিই সেই পুরাতন পদ্ধতির বিশেষায়িত রূপ।
অস্ত্রোপচার
ওষুধ নথিভুক্ত করার পাশাপাশি অস্ত্রোপচারের যন্ত্র ও পদ্ধতি ব্যবহারকারী সভ্যতার খেতাবও মিশরীয়দের। প্রাসাদের চিকিৎসক ও সম্রাটের গোপনীয়তা রক্ষাকারী হিসেবে পরিচিত কার (Qar)-এর সমাধিতে ব্রোঞ্জের তৈরি অস্ত্রোপচারের বিভিন্ন সরঞ্জামাদি পাওয়া যায়।
মিশরীয়দের লেখা অস্ত্রোপচারের বিভিন্ন বিবরণও নথি আকারে খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও এখনকার মতো এত জটিল সব অস্ত্রোপচার হতো না, কেননা তখন চেতনানাশক কিছু ছিল না। চিকিৎসকরা কেবল গাছগাছড়ায় তৈরি জীবাণুনাশক ব্যবহার করতেন। তাই টিউমার বা সিস্ট অপসারণ জাতীয় অস্ত্রোপচারের বর্ণনাই বেশি পাওয়া যায়, তবুও এত বছর আগে আধুনিক সুবিধা ছাড়াই সেসব পদ্ধতি উদ্ভাবন ও পরিচালন মুগ্ধ করার মতো।
দরজার তালা
দরজায় তালা দেবার পদ্ধতি যদিও এসিরীয়রা আবিষ্কার করেছিল, কিন্তু মিশরীয়রাই সেই পদ্ধতিকে আসল নকশার চেয়ে আরো উন্নত করে তোলে। মিশরীয়দের তালার নকশাগুলো অদ্ভুতভাবে বর্তমানে ব্যবহৃত নকশার সাথে বেশ মিলে যায়। শুধু পার্থক্য তালা তৈরীর উপাদানে, মিশরীয়রা কাঠ বা পিতল ব্যবহার করতো। ধীরে ধীরে ব্যবহারের সুবিধা আশেপাশের অন্যান্য সভ্যতায়ও ব্যবহার হতে শুরু করে। এটি নিরাপত্তা প্রহরী রাখার খরচের চেয়ে সস্তা হওয়ায় এর ব্যবহার জনপ্রিয়তা পায় বেশি গ্রিস ও রোমান সাম্রাজ্যে।
টুথপেস্ট
দাঁত পরিষ্কার রাখার প্রচলন সভ্যতার শুরু থেকেই ছিল। মিশরীয়রাই প্রথম মুখের ভেতরের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য টুথপেস্ট বানানো ও ব্যবহারের সূত্রপাত করে। এমনকি কিছু মিশরীয় সমাধিতে গাছের কচি শাখা সরু করে চিড়ে বানানো কিছু টুথব্রাশও পাওয়া যায়। এগুলো দেখতে মেসওয়াকের মতোই ছিল। প্যাপাইরাসের নথিপত্রে মিশরীয় ধাঁচের টুথপেস্ট বানানোর প্রণালী দেয়া ছিল। প্রণালী অনেকটা এরকম- রক সল্ট এক ড্রাকমা (এক ড্রাকমা হলো এক আউন্সের ১০০ ভাগের ১ ভাগ), পুদিনা পাতা ২ ড্রাকমা, শুকনো আইরিশ ফুল এক ড্রাকমা এবং অল্প মরিচের গুড়ো। হাইঞ্জ নিউম্যান নামে এক দন্ত চিকিৎসক এই প্রণালী ব্যবহার করে টুথপেস্ট তৈরি করে তা ব্যবহার করেন। তিনি জানান এটি ব্যবহারের পর তাঁর মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়ছিল, কিন্তু মুখের ভেতরটা বেশ পরিষ্কার মনে হচ্ছিল।
কাচ
প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট কাচ পৃথিবীতে সবসময়ই পাওয়া যেত। মানুষের তৈরি প্রথম কাচের প্রমাণ পাওয়া যায় ৩,৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, মিশর ও মেসোপটেমিয় সভ্যতায়। সেই সময়ে এটি ছোট ছোট কাচের পুতির আকারেই তৈরি হতো। পরবর্তীতে কাচ দিয়ে আরো বড় জিনিসপত্র বানানো শুরু হয়। ফারাও সম্রাটদের সমাধিতে মিশরীয়দের কাচের তৈরি ফুলদানি পাওয়া যায়।
ফিচার ইমে- Encyclopedia Britannica