দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তিনের ইহুদী সংগঠন হাগানার (Haganah) নির্দেশে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা ইহুদী ব্রিগেডের সৈন্যদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল গুপ্ত সংগঠন গমুল (Gmul), যাদের প্রতিশোধমূলক কর্মকান্ড নিয়ে আমরা আলোচনা করেছিলাম এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বে। গমুলের কাজ ছিল যুদ্ধের সময় ইহুদী গণহত্যায় অংশ নেওয়া জার্মান নাৎসি অফিসারদেরকে খুঁজে বের করা এবং তাদেরকে হত্যা করা। মাত্র তিন মাসেই গমুলের হাতে নিহত হয়েছিল এক থেকে দু’শ সাবেক নাৎসি অফিসার। কিন্তু একের পর এক ইহুদী হত্যায় জড়িত জার্মান অফিসারদের গুম-খুনের ঘটনায় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। ফলে তারা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অধীনে থাকা ইহুদী ব্রিগেডকে বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডসে স্থানান্তর করে।
বাস্তবতা বুঝতে পেরে হাগানার মূল নেতৃবৃন্দও ইউরোপে অবস্থিত জার্মানদেরকে হত্যার ব্যাপারে গমুলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল, ফিলিস্তিনের বুকে ইহুদী রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করার তাদের যে জায়নবাদী পরিকল্পনা, তা বাস্তবায়ন করতে হলে তাদেরকে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। যুদ্ধের পর ইউরোপে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার যে প্রচেষ্টা চলছিল, তাতে বাধার সৃষ্টি করে ইউরোপ-আমেরিকার বিরাগভাজন হয়ে পড়লে বৃহত্তর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। তবে কৌশলগত কারণে ইউরোপে নাৎসি হত্যাকান্ড বন্ধ করলেও বাস্তবে তাদের অন্তর থেকে তখনও প্রতিশোধস্পৃহা দূরীভূত হয়নি। ফলে ইউরোপ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তারা নজর দেয় ফিলিস্তিনে বসবাসরত জার্মানদের দিকে।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই জার্মানির টেম্পলার সম্প্রদায়ের (প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের একটি উপশাখা, Tempelgesellschaft) সদস্যদের একটি বড় অংশের আবাসভূমি ছিল ফিলিস্তিন। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পরপরই তাদের নাগরিকত্ব এবং নাৎসিদের প্রতি তাদের সমর্থনের কারণে তাদেরকে বহিষ্কার করে তৎকালীন ম্যান্ডেটরি ফিলিস্তিনের দায়িত্বে থাকা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ।
বহিষ্কৃত টেম্পলারদের অনেকে জার্মানিতে ফিরে গিয়ে যুদ্ধে যোগদান করে। তাদের কেউ কেউ ইহুদী গণহত্যায়ও অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধ শেষে জার্মানি থেকে পালিয়ে তাদের অনেকে আবার ফিরে আসে ফিলিস্তিনের সারোনা, তেল আবিবসহ বিভিন্ন শহরে অবস্থিত তাদের পুরাতন বাসভূমিতে।
এই ফিরে আসা টেম্পলারদের নেতা ছিলেন গটহিফ ওয়াগনার (Gotthilf Wagner) নামের এক ধনী ব্যবসায়ী, যিনি যুদ্ধের সময় জার্মান সশস্ত্রবাহিনী ওয়্যারমাট (Wehrmacht) এবং গোপন পুলিশ বাহিনী গেস্টাপোকে (Gestapo) সাহায্য করেছিলেন। ফিলিস্তিনে ফিরে আসার পর শ্যালম ফ্রিডম্যান (Shalom Friedman) নামে গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া এক ইহুদী তাকে চিনে ফেলে। ফ্রিডম্যানের বক্তব্য অনুযায়ী, ১৯৪৪ সালে যখন তিনি গণহত্যা থেকে বাঁচার জন্য হাঙ্গেরিয়ান পাদ্রীর ছদ্মবেশে জীবন যাপন করছিলেন, তখন তার সাথে ওয়াগনারের দেখা হয়েছিল। ফ্রিডম্যানের কাছে ওয়াগনার গর্ব করে বলেছিলেন, তিনি দুবার অশউইটজ (Auschwitz) এবং বুখেনওয়াল্ড (Buchenwald) কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ভ্রমণ করেছিলেন।
ফ্রিডম্যানের কাছে করা ওয়াগনারের দাবি অনুযায়ী, অশউইৎজে তার চোখের সামনেই একবার বিপুল সংখ্যক অল্পবয়সী ইহুদীকে ধরে এনে তাদের শরীরে দাহ্য তরল পদার্থ ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে সময় ওয়াগনার ঐ ইহুদীদেরকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ফিলিস্তিনে অবস্থিত তাদের ভাইদের জন্যও একই পরিণতি অপেক্ষা করছে। সুতরাং এই ওয়াগনার যখন যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনে ফিরে এসে বসবাস করতে শুরু করল, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাকে মেনে নেওয়া স্থানীয় ইহুদী নেতৃবৃন্দের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কাজেই হাগানার নেতৃবৃন্দ গোপনে ১৭ সদস্যের একটি স্পেশাল টিম গঠন করলেন ওয়াগনারকে হত্যা করার জন্য।
সে সময় হাগানার চিফ অফ স্টাফ ছিলেন ইৎজাক সাদেহ (Yitzhak Sadeh)। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এটি আর দশটি অপারেশনের মতো সাধারণ কোনো অপারেশন না। তাই স্পেশাল টিমের সদস্যদেরকে অনুপ্রাণিত করার জন্য তিনি তাদেরকে নিজ কার্যালয়ে ডেকে পাঠালেন এবং রাশিয়াতে অবস্থানকালে তিনি নিজে কীভাবে ইহুদীদের উপর আক্রমণকারী এক রাশিয়ানকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন, সেই গল্প তাদেরকে শোনালেন। তার স্মৃতিচারণে অনুপ্রাণিত হয়ে মাঠে নামল হাগানার ১৭ সদস্যের গুপ্তঘাতকের দল, যাদের মধ্যে একজন ছিলেন ১৭ বছর বয়সী তরুণ রাফি এইতান (Rafi Eitan), যিনি পরবর্তীতে দীর্ঘদিন ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ইউরোপীয় শাখার অপারেশন চিফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
দীর্ঘদিন ধরে নজরদারি করে ওয়াগনারের গতিবিধি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়ার পর ১৯৪৬ সালের ২২ মার্চ হাগানার গুপ্তঘাতকের দল আক্রমণ করল ওয়াগনারের উপর। তেল আবিবের মূল রাস্তা থেকে বলপূর্বক তুলে নিয়ে ১২৩ লেভিনস্কি রোডের কাছের একটি পরিত্যক্ত জমিতে তাকে গুলি করে হত্যা করল তারা। পরদিন হাগানার গোপন রেডিও স্টেশন ‘কোল ইসরায়েল’ তথা ‘ভয়েস অফ ইসরায়েল’ থেকে ঘোষণা করা হলো, “ফিলিস্তিনে জার্মান সম্প্রদায়ের নেতা, বিখ্যাত নাৎসি, গটহিফ ওয়াগনার গতকাল হিব্রু গুপ্ত সংগঠনের হাতে নিহত হয়েছে। সবার জেনে রাখা প্রয়োজন, ইসরায়েলি ভূমিতে কোনো নাৎসিকে পা রাখতে দেওয়া হবে না।”
ভয়েস অফ ইসরায়েলের ঘোষণা ফাঁকা বুলি ছিল না। এর কিছুদিনের মধ্যেই হাগানার গুপ্তঘাতকরা গ্যালিলিতে দুজন এবং হাইফাতে আরো দুজন টেম্পলারকে হত্যা করেছিল। রাফি এইতানের ভাষায়, তাৎক্ষণিকভাবেই এই হত্যাকান্ডগুলোর ফলাফল পাওয়া গিয়েছিল। টেম্পলাররা তাদের সকল সম্পত্তিসহ ঘরবাড়ি ফেলে চির জীবনের জন্য ফিলিস্তিন থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। তাদের সকল সম্পত্তি দখল করে নিয়েছিল ইহুদীরা। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর তেল আবিব এবং সারোনার টেম্পলারদের বাড়িঘরগুলোকে পরিণত করা হয়েছিল ইসরায়েলের সশস্ত্র বাহিনী এবং গোয়েন্দা বিভাগের হেডকোয়ার্টারে। আর গুপ্তঘাতক রাফি এইতান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মোসাদের প্রথম টার্গেটেড কিলিং ইউনিট।
টেম্পলারদেরকে হত্যা করা শুধুমাত্র ইউরোপে নাৎসিদের উপর হাগানার প্রতিশোধের ধারাবাহিকতাই ছিল না। বরং একইসাথে এটি ছিল ফিলিস্তিনের ইহুদীদের নীতির একটি বড় পরিবর্তনের নির্দেশক। জায়নবাদী ইহুদীরা শুরু থেকেই ফিলিস্তিনের ভূমিতে নিজেদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদীদের উপর গণহত্যা তাদের সেই পরিকল্পনার পক্ষে আরো জোরালো সমর্থন তৈরি করে দিয়েছিল। হলোকাস্ট থেকে তারা এই শিক্ষাই গ্রহণ করেছিল যে, যতদিন পর্যন্ত না ইহুদীদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে, ততদিন পর্যন্ত তারা নিরাপদ না। কাজেই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই তাদেরকে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করতে হবে, তা যত চরম পদ্ধতিতেই হোক না কেন।
ফিলিস্তিনের ইহুদী সম্প্রদায়ের নেতা ডেভিড বেন গুরিয়ন, যিনি এর আগে অধিকাংশ সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে ছিলেন এবং অনেকগুলো হত্যাকান্ডের প্রস্তাব অনুমোদন না করে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনিও ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি হিসেবে সন্ত্রাসবাদকে আলিঙ্গন করে নেন। তার অনুমতিক্রমে হাগানা একের পর এক গুপ্ত হত্যা, গেরিলা আক্রমণ এবং সন্ত্রাসী হামলা চালাতে শুরু করে, যেগুলো মাত্র কয়েক বছর আগেও শুধুমাত্র হাগানা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অধিকতর উগ্রপন্থী সংগঠন লেহি এবং ইরগুনের সদস্যরাই করত।
এ সময় ইহুদী গুপ্ত সংগঠনগুলো স্থানীয় আরবদের উপর আক্রমণ করার পাশাপাশি ব্রিটিশ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের উপরও আক্রমণ করতে শুরু করে। যেসব ব্রিটিশ সিআইডি অফিসার ইহুদীদের গুপ্ত সংগঠনের সদস্যদেরকে গ্রেপ্তার করার জন্য অভিযান চালাত অথবা তাদের অস্ত্রভান্ডারগুলো বাজেয়াপ্ত করার চেষ্টা করত, তাদেরকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাদের উপর আক্রমণ করার জন্য হাগানা গঠন করে স্পেশাল একটি ইউনিট। এই ইউনিট ইহুদীদের বিরুদ্ধে সক্রিয় ব্রিটিশ গোয়েন্দাবাহিনীর হেডকোয়ার্টার এবং তাদের বিরুদ্ধে রায় দেওয়া আদালতে বোমা হামলাও চালাতে শুরু করে এসময়।
ডেভিড বেন গুরিয়ন বুঝতে পেরেছিলেন, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা হতে আর বেশি দেরি নেই। কিন্তু ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষিত হলেই যে প্রতিবেশী আরব দেশগুলো চারদিক থেকে তাদের উপর আক্রমণ করবে, সেটিও তিনি জানতেন। কাজেই একটি পরিপূর্ণ যুদ্ধের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি তিনি গ্রহণ করতে থাকেন। আর এ প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই তিনি ‘জারজির’ নামে একটি নির্দেশ জারি করেন, যেখানে প্রভাবশালী আরব নেতাদের একটি তালিকা তৈরি করে তাদের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করা হয়।
যে বেন গুরিয়ন কয়েক বছর আগেও জেরুজালেমের মুফতি হাজ আমিন আল-হুসেইনিসহ অন্যান্য আরব নেতাদেরকে হত্যা করার প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছিলেন, এবার তিনি নিজেই হাগানার ঘাতকদের হাতে তাদেরকে হত্যার তালিকা তুলে দিলেন। আর এর মধ্য দিয়েই তিনি নিশ্চিত করতে চাইলেন যে, ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর যখন আরবরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসবে, তখন তাদেরকে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কেউ থাকবে না।
তথ্যসূত্র: Rise and Kill First: The Secret History of Israel’s Targeted Assassinations
এই সিরিজের অন্যান্য পর্বগুলো:
(১) সন্ত্রাসী সংগঠন লেহি’র গুপ্তহত্যা, (২) উগ্র জায়নবাদের উত্থান, (৩) ইহুদীদের নৈশ প্রহরী হাশোমারের ইতিহাস, (৪) আইডিএফের পূর্বসূরি হাগানার উত্থান, (৫) নাৎসিদের উপর ইহুদী ব্রিগেডের প্রতিশোধ, (৭) যে সন্ত্রাসী হামলাগুলোর মাধ্যমে ইসরায়েলের সৃষ্টি
ফিচার ইমেজ: Wikimedia Commons