তার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল কায়রো শহর এবং আল-আযহার মসজিদ যা পরে রুপ নেয় আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি জওহর আল সিকিলি। পুরো নাম অাবুল হোসাইন জওহর ইবনে আব্দুল্লাহ। ইতিহাসে তার উত্থান অনেকটা রোমাঞ্চকর। একজন সাধারণ দাস থেকে হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিরোধ্য সেনাপতি। ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন দীর্ঘকাল ধরে। ফাতিমীয় শাসনামলের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাধ্যক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাকেই। তার অসামান্য বীরত্ব ও প্রজ্ঞা শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড়াতে সাহায্য করেছিল ফাতিমীয় খেলাফতকে।
প্রাথমিক জীবন
জওহরের জন্ম ও প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত ইতিহাসে পাওয়া যায় না। দশম শতাব্দীর শুরুর দিকে কোনো এক সালে তার জন্ম হয়েছিল ইতালির সিকিলিতে। তার নামের শেষাংশ সিকিলি এসেছে সিকিলি শহরের নাম থেকেই। এ কারণে তাকে ‘সিকিলান’ নামেও ডাকা হতো। তবে আরো বেশ কিছু নামে পরিচিত ছিলেন তিনি যেমন আল রুমি, আল সাকলাবি, আল কাতিব ও আল কায়েদ। সেসময় সিকিলি ছিল বাইজান্টাইন সাম্রাজের অংশ। মুসলিমরা ২১২ হিজরী সনের আগে বেশ কয়েকবার সিকিলি জয় করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তা বিফল হয়। শেষ পর্যন্তু আব্বাসীয় খলিফা মামুন-অর-রশিদের শাসনামলে ২১২ হিজরি সনে সিকিলি মুসলিমদের হস্তগত হয়েছিল।
যা-ই হোক, দস্যুদের হাতে পড়ে জওহর একজন দাস হিসেবে কেরায়ানে আনীত হন। কেরায়ান তখন ছিল উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকায় ফাতিমীয়দের রাজধানী। এটি স্পষ্ট নয় যে, জওহর মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন না পরে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। তার পিতার নাম আব্দুল্লাহ থেকে ধারণা করা হয়, তিনি সম্ভবত মুসলিম পরিবারেই জন্মগ্রহণ করেছেন অথবা তার পরিবার একসাথেই মুসলিম হয়েছিল।
ফাতিমীয় খলিফা আল মনসুরের শাসনামলে জওহর একজন দাস হিসেবে খলিফা মনসুরের দরবারে কাজ শুরু করেন। পরে নিজ প্রতিভায় মনসুরের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। তবে খলিফা মনসুরের পর তার ছেলে আল মুইজ জওহরকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন। তবে তিনি খলিফা মুইজের সাথেই থাকেন এবং দরবারে বিশেষ স্থান লাভ করেন।
৩৪১ হিজরি সনে খলিফা মুইজ তাকে খতিব হিসেবে নিয়োগ করেন। খলিফা মুইজ তার প্রতিভা সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং জওহর নিজেও খলিফা মুইজের অনেক বিশ্বস্ত হয়ে উঠেন। যার কারণে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। খলিফা মুইজ জওহরের সামরিক ও রাজনৈতিক প্রতিভার মূল্যায়ন করেছিলেন যার ফলে তিনি তাকে উজির এবং ক্রমান্বয়ে সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ করেন। এবং তিনি তাকে ‘আবুল হোসাইন’ নামে ভূষিত করেন।
উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা অভিযান
ফাতেমীয় খলিফা মুইজ ৩৪৭ হিজরি সনে জওহরকে পশ্চিম আফ্রিকার বাকী অঞ্চলগুলো জয় করার জন্য পাঠান। পশ্চিমের অঞ্চলগুলোকে তখন ডাকা হতো মাগরেব নামে। জওহর একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে সেদিকে অগ্রসর হন। তার সেনাবাহিনীতে পশ্চিমের অনেক সৈনিক ছিল যার কারণে তিনি বিশেষ সুবিধা পান। তিনি সাফল্যের সাথে তেহরত ও ফেজ, সিজিলমাসা প্রভৃতি জয় করেন পশ্চিমে তার জয়যাত্রা অব্যাহত রাখেন।
আটলান্টিকের তীরে পৌঁছা পর্যন্ত তার যাত্রা অব্যাহত থাকে। সমুদ্র উপকূলে পৌঁছার পর, জওহর সেখান থেকে একটি পাত্রে কিছু জীবিত মাছ তুলে পাঠান আল মুইজের কাছে, এটা জানাতে তিনি সমুদ্রের তীর পর্যন্ত সকল নগর জয় করেছেন। তিনি এরপর এখানেই অবস্থান করেন এবং ফাতিমীয় সাম্রাজ্যের শক্ত অবস্থান গড়ে তোলেন। এর বেশ কিছুদিন পর খলিফা মুইজ মিশর আক্রমণ করার মনস্থ করলে জওহর রাজধানীতে ফিরে আসেন এবং কায়েদ হিসেবে দায়িত্ব পান।
মিশর জয়
খলিফা মুইজের নির্দেশ মোতাবেক জওহর ৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে মিশর জয়ের উদ্দেশ্যে বের হন। তখন মিশরের শাসনভার ছিল ইখশিদি রাজবংশের হাতে। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুহাম্মদ ইবনে তুগজ আল ইখশিদ। ইখশিদি রাজবংশ আব্বাসীয়দের অধীনে ৯৩৫ থেকে মিশর শাসন করে আসছিল। জওহরের অভিযানের সময় মিসরের শাসনকর্তা ছিলেন আবুল ফাওয়ারিস আহমদ ইবনে আলী ইবন আল ইকশিদ। সেসময় অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও নানা কারণে ইকশিদি বংশের দুঃসময় যাচ্ছিল আর আব্বাসীয়রদের শাসনও তখন পতনের দিকে। তাই জওহরকে মিশর অভিযানে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। জওহর প্রথমে আলেকজান্দ্রিয়া অধিকার করেন। সামান্য বাধা পেলেও তা তিনি সহজেই উতরে যান।
তিনি তার সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে তারা হত্যা, লুন্ঠনে জড়িত না হয়। সৈনিকরা তার নির্দেশ পালন করায় তাদের উপহার দিয়ে সম্মানীত করেছিলেন। আলেকজান্দ্রিয়ার পতনের খবর ফুসতাতে পৌঁছালে শহরময় উৎকন্ঠা ছড়িয়ে পড়ে। ৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে জওহর ফুসতাতে পৌঁছান এবং প্রায় বিনা বাধায় ফুসতাত দখল করেন।
মিশরের শাসনকর্তা আবুল ফাওয়ারিস আহমদ ইবনে আলী ইবন আল ইকশিদকে বন্দী করা হয়। এর মাধ্যমে মুইজের অত্যন্ত আরাধ্য মিশর, ফাতেমীয় সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে যায়। জওহর এখানেই অবস্থান করেন এবং প্রসাশনিক দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেন। তিনি আল মুইজের মিসরে আসার আগ পর্যন্ত মূলত একজন শাসক হিসেবেই তিনি দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।
কায়রো শহরের প্রতিষ্ঠা
খলিফা মুইজের নির্দেশে জওহর ফুসতাতের নিকটেই নতুন শহর নির্মাণের কাজ শুরু করেন। প্রায় চার বছর ধরে চলে নির্মাণ কাজ। প্রথমে নতুন শহরটির নাম দেওয়া হয় আল মনসুরিয়া। ৯৭৩ সালের দিকে খলিফা মুইজ উত্তর আফ্রিকার শাসনভার বুলকিনের উপর ন্যস্ত করে তার পুরাতন রাজধানী ত্যাগ করে কায়রো আসেন। কায়রোই তখন থেকে হয়ে যায় ফাতেমীয়দের নতুন রাজধানী। তিনি শহরটির নতুন নাম রাখেন আল কাহিরা।
কাহিরা অর্থ বিজয়িনী। তার অসামান্য বিজয় স্মরণীয় করে রাখতেই এ নাম বাছাই করেন। যা থেকেই কায়রো নামের উৎপত্তি। মুইজ মিসরে আসার পর জওহরকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেন। তবে নতুন রাজধানীতে আসার সামান্য কিছুদিন পর, ৯৭৫ সালে মুইজ মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে আল আজিজ ফাতিমীয় সাম্রাজের হাল ধরেন। আল আজিজ পুনরায় জওহরকে স্ব-পদে বহাল করেন।
আল আযহার মসজিদের প্রতিষ্ঠা
জওহর মিসর বিজয়ের অব্যবহিত পরেই নতুন নির্মাণাধীন শহরে শিয়া ইসমাইলীয় ভাবধারার মসজিদ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। প্রাথমিক অবস্থায় মসজিদটির নাম দেওয়া হয়েছিল জামিয়া আল কাহিরা। পরবর্তীতে এটি আল আযহার নামে পরিচিত হয়। যদিও ঠিক কখন এই নাম পরিবর্তিত হয়েছিল তা স্পষ্ট নয় তবে মনে করা হয়, আল আযহার নামটি এসেছে হযরত ফাতিমা (রা) এর উপাধি ‘জাহরা’ থেকে। এই মসজিদটির কাজ শুরু করা হয়েছিল ৯৭০ সালে আর তা শেষ হতে সময় লাগে প্রায় তিন বছর।
খলিফা অাল মুইজ এর প্রথম জুম্মায় অংশ নেন ও খুতবা পড়েন। প্রাথমিক সময়ে এটি শুধু মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও ৯৮৮ সালে খলিফা আজিজ ৩৫ জন শিক্ষক নিয়োগ করে এটিকে শুধুমাত্র মসজিদ থেকে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রুপান্তরিত করেন। ঈসমাইলীয় শিয়া ভাবধারার প্রচার ও প্রসার ছিল এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য। পরবর্তীতে খ্রিস্টিয় ১২ শতকে সালাউদ্দিন আইয়ুবির হাত ধরে ফাতিমীয় খেলাফতের সমাপ্তি ঘটলে আল আযহার সুন্নী ভাবধারার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
শেষজীবন
শেষের দিকে জওহর ফাতেমীয় খলিফা আল আজিজের সময় সিরিয়ায় আফ্রাকিন, কারামাতীয় ও অন্যন্য বিরোধী পক্ষের সাথে সাফল্যের সাথে লড়াই করেন। তিনি তার অসামান্য রণকৌশল ও অদম্য লড়াইয়ের মাধ্যমে তাদেরকে পরাজিত করেন। এবং এই লড়াইয়ের পর তিনি মিশরে ফিরে আসেন এবং অবসর গ্রহণ করেন। অতঃপর ৯৯২ সালের ফ্রেব্রুয়ারির ১ তারিখে ফাতেমীয় খেলাফতের দুর্দান্ত এই সেনাপতি মিশরেই মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর কয়েক শত বছর পরও তার কীর্তির সাক্ষ্য দিয়ে চলছে মিশরের কায়রো, আল আযহার।