১৯৬১ সালের ১৯ মে ভারতের আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকার তৎকালীন অবিভক্ত কাছাড় জেলার শিলচরে বাংলা ভাষাকে রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলনে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে পুলিশের গুলিতে ১১ জন বাঙালি নিহত হন। ভাষার দাবিতে আত্মোৎসর্গকারী সেই ১১ বাঙালি বীর সন্তানের মাঝে একজন ছিলেন নারী। কমলা ভট্টাচার্য নামে মাত্র ষোল বছর বয়সী একজন নারী বাংলা ভাষাকে আসাম রাজ্যের একটি সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন।
বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত কমলা ভট্টাচার্য ১৯৪৫ সালে অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন শ্রীহট্ট তথা বর্তমান সিলেট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর কমলা ভট্টাচার্যের পরিবার ভারতে না গিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সিলেট অঞ্চলে থেকে যায়। কিন্তু ১৯৫০ সালের দিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হলে তার পরিবার সিলেট ছেড়ে ভারতের আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকার তৎকালীন অবিভক্ত কাছাড় জেলার শিলচরে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করে। বাবা রামরমণ ভট্টাচার্য এবং মা সুপ্রবাসিনী দেবীকে নিয়ে শিলচর পাবলিক স্কুল রোডের একটি ভাড়া বাসায় কমলার পরিবার বসবাস করতে থাকে। শৈশবে বাবাকে হারানো কমলা ছোটেলাল শেঠ ইন্সটিটিউটে ভর্তি হন।
কমলা ভট্টাচার্যের মেজ দিদি প্রতিভা অনেক সংগ্রাম করে একটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তার সামান্য আয়ের উপর পুরো পরিবারকে নির্ভর করতে হত। তারা ছিলেন মোট ছয় ভাই-বোন। সব মিলিয়ে আট সদস্যের পরিবারটির জন্য আর্থিক সচ্ছলতার সাথে বসবাস করা চরম দুরূহ হয়ে পড়ে। সেই সময় কমলার মায়ের পক্ষে সন্তানদের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ কেনার সামর্থ্য ছিল না। সেজন্য প্রচণ্ড মেধাবী কমলাকে সহপাঠীদের কাছ থেকে পাঠ্যপুস্তক ধার নিয়ে পড়াশোনা চালাতে হত। কিন্তু তিনি কখনো হাল ছাড়েননি, এমন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন স্নাতক সম্পন্ন করে নিজের এবং পরিবারের জন্য কিছু করার।
১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর থেকে ভারতের আসাম রাজ্যে বসবাসকারী স্থানীয় অসমিয়া জনগোষ্ঠীর সাথে পূর্ব বাংলা থেকে যাওয়া বাঙালিদের মধ্যে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব তৈরি হতে থাকে। একপর্যায়ে আসামের রাজনীতি, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙালিরা প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করতে থাকলে দুটো জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই দ্বন্দ্ব সংঘাতে রূপ নিতে থাকে। এমনকি বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক ও বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে “বঙাল খেদা” প্রচারাভিযান চালানো হয়। ফলে বাঙালি জনগোষ্ঠীর উপর বিভিন্ন সময় হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে।
এর ফলশ্রুতিতে বিপুল সংখ্যক বাঙালি জনগোষ্ঠীর লোকজন আসাম ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে। বাঙালি ও অসমিয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যকার চলমান এমন একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যেই ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর আসামের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা অসমিয়া ভাষাকে আসামের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তার এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে উত্তর করিমগঞ্জ থেকে নির্বাচিত বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন দাস তীব্র আপত্তি তুলে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। কিন্তু অসমিয় জনপ্রতিনিধিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা করা হয় এবং অন্তবর্তী সময় পর্যন্ত ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের বিধান রেখে সেই বছরের ২৪ অক্টোবর প্রস্তাবটি “Assam (Official) Language Act, 1960” নামে আইন হিসেবে আসামের বিধানসভায় পাস করানো হয়। বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি অধ্যুষিত হাইলাকান্দি, শিলচর ও করিমগঞ্জ এলাকায় মানুষেরা প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে।
এমন একটি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ১৯৬১ সালে কমলা ভট্টাচার্য ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে অন্তর্ভুক্তির দাবিতে সর্বাত্মক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ‘কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ’-এর আহবানে সেই বছরের ১৯ মে হরতাল পালনের ঘোষণা করা হয়। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা শেষ হওয়ার ঠিক পরদিন সকালে কমলা তার মেজ দিদি প্রতিভার স্কুলে যাওয়ার জন্য রাখা শাড়ি আর ব্লাউজ পরেই এগারো বছর বয়সী ছোট বোন মঙ্গলাকে সাথে নিয়ে শিলচর রেল স্টেশনের সেই প্রতিবাদকারীদের সাথে যোগ দেন। তাদের ঘরে কোনো খাবার না থাকায় ক্ষুধার্ত অবস্থায় আন্দোলনে বেরিয়ে পড়েন কমলা। পুলিশের কাঁদানে গ্যাস থেকে রক্ষা পাবার জন্য জন্য তিনি মায়ের কাছ থেকে এক টুকরো কাপড় চেয়ে নিয়েছিলেন।
এরপর বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের স্থানীয় নেত্রী জ্যোৎস্না চন্দের নেতৃত্বে কয়েকজন নারীর সাথে কমলা শিলচর রেলওয়ে স্টেশনের দিকে রওনা হন। সেখানে তখন বাংলাকে আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্তির দাবিতে অবরোধ কর্মসূচি চলছিল। “জান দেবো, তবু জবান দেবো না” এবং “মাতৃভাষা জিন্দাবাদ, বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ” স্লোগানে মুখরিত পুরো শিলচর রেলওয়ে স্টেশন চত্বর। সেদিন দুপুর পর্যন্ত প্রায় শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনকারীদের রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি চলছিল। কিন্তু দুপুরের পর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অতর্কিতভাবে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থানরত শান্তিপূর্ণ অবরোধকারীদের উপর উপর্যুপরি লাঠিচার্জ এবং আটক করতে শুরু করে। পুলিশের কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপে অবরোধকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে ছুটতে আরম্ভ করে।
পুলিশ সদস্যদের লাঠিচার্জে কমলা ভট্টাচার্যের ছোট বোন মঙ্গলা গুরুতর আহত হন। সেই সময় কমলা ছুটে গিয়ে মঙ্গলাকে সাহায্যের চেষ্টা করেন। ইতোমধ্যে পুলিশ সদস্যরা গুলি চালাতে শুরু করে। একটি গুলি এসে কমলার চোখ ভেদ করে বেরিয়ে যায়। সেই সময় আরো অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন, অন্যান্য আহতদের সাথে কমলাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ফলে কমলা ভট্টাচার্য পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মোৎসর্গকারী প্রথম নারী হিসেবে অমর হয়ে থাকবেন।
এই ঘটনার পর আসাম সরকার বাংলাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়। কমলা ভট্টাচার্যের মৃত্যুর পর তার ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়, সেখানে মেধাবী শিক্ষার্থী কমলা ভালোভাবেই পাশ করেন। পরীক্ষার পর তিনি টাইপ রাইটিং শিখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার সেই ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে যায়।
কমলা ভট্টাচার্যের স্মরণে শিলচর পাবলিক স্কুল রোডের নাম করা হয় ‘কমলা ভট্টাচার্য রোড’। এছাড়াও ২০১১ সালে আসামে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সু্বর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে তার স্মৃতিবিজড়িত প্রতিষ্ঠান ছোটেলাল শেঠ ইন্সটিটিউটে কমলা ভট্টাচার্যের একটি আবক্ষ ব্রোঞ্জনির্মিত ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়।