যুদ্ধ বা সামরিক অভিযানের সময় বোমা হামলা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। সম্মুখযুদ্ধের তুলনায় বোমাবর্ষণের মাধ্যমে প্রতিপক্ষ শিবিরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম ও ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি করা বেশি সহজ। বর্তমানে দ্রুতগতির বোমারু বিমানের কল্যাণে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শত্রুপক্ষের উপর বোমাবর্ষণ করে আবার নিরাপদে নিজের সীমানার ভেতরে চলে আসে।
আধুনিক সময়ে সব যুদ্ধেই বোমাবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু যদি সবচেয়ে বেশি বোমাবর্ষণের ঘটনা সামনে আসে, তাহলে নিঃসন্দেহে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ‘লাওস’ এর কথা আসবে। লাওস কী পরিমাণ বোমাবর্ষণের শিকার হয়েছিল– তা একটি তুলনার মাধ্যমে বোঝানো যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রায় পুরো ইউরোপ যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। এর পাশাপাশি এশিয়া এবং আফ্রিকারও বিস্তীর্ণ অঞ্চল পরিণত হয়েছিল রণক্ষেত্রে। দু’পক্ষই একে অপরের উপর বোমাবর্ষণ করেছিল। কিন্তু পুরো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যত বোমাবর্ষণ হয়েছিল, তার চেয়েও বেশি বোমাবর্ষণের শিকার হয়েছিল এশিয়ার ছোট দেশ লাওস।
লাওসের ইতিহাসের দিকে যাওয়া যাক। দেশটি প্রাচীনকাল থেকেই ছিল বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। এরপর আঠারো ও উনিশ শতকে এশিয়া ঔপনিবেশিক যুগে প্রবেশ করে। এই ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ছিল নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। লাওসে অনেক আগে থেকেই প্রতিবেশী দেশগুলোর হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটছিল। ১৮৯৩ সালে ফ্রান্স তাদের ইন্দোচীন উপনিবেশের অংশ হিসেবে লাওসকে অন্তর্ভুক্ত করে। ফরাসিদের কাছে লাওস ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ উপনিবেশ, কারণ এখান থেকেই মেকং নদী নিয়ন্ত্রণ করা যেত। মেকং নদী ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসিদের হাত থেকে উচ্চাভিলাষী জাপানিদের হাতে লাওসের কর্তৃত্ব চলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিরা পরাজিত হলে কিছুদিন লাওস স্বাধীন দেশ হিসেবে মানচিত্রে স্থান পেয়েছিল। কিন্তু পরে আবার ফরাসিরা লাওসের কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। এরপর ১৯৫৪ সালে ফরাসিদের বিতাড়িত করে তারা ভিয়েতনামের পাশাপাশি স্বাধীনতা অর্জন করে।
ভিয়েতনামের হো চি মিনের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট সাথে যখন ফরাসিদের তীব্র সংঘর্ষ চলছিল, তখন ভিয়েত মিনের মূল কার্যালয়ে ‘প্যাথেট লাও’ নামে একটি বিপ্লবী দল গঠিত হয়। ফরাসিদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার পর ভিয়েতনামে খুব দ্রুত এই দলটির জনপ্রিয়তা বাড়ছিল। তবে এই দলটি অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট সরকারের সাহায্যের উপর। দলটির নেতা ছিল প্রিন্স সৌফানৌভোং, যাকে ডাকা হতো ‘রেড প্রিন্স’ নামে। ভিয়েতনামে পড়াশোনা করার সময় তিনি হো চি মিনের কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রতি অনুরক্ত হন এবং প্যাথেট লিও প্রতিষ্ঠায় প্রধান ভূমিকা পালন করেন। ভিয়েতনামের মতো তিনিও পশ্চিমাসমর্থিত সরকারকে উৎখাত করে কমিউনিস্ট ভাবধারার সরকার প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিলেন। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্যাথেট লাও তৎকালীন পশ্চিমাসমর্থিত সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে সীমান্ত অঞ্চলে সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে যায়। তাদেরকে সমর্থন দিতে থাকে ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টি। আমেরিকা লাওসের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল।
আমেরিকার আশঙ্কা ছিল যদি লাওসে কোনোভাবে কমিউনিস্টরা বিজয়ী হতে পারে, তাহলে এই বিজয়ের ডোমিনো ইফেক্টের কারণে পূর্ব এশিয়ার আরও বেশ কিছু দেশে কমিউনিজম ছড়িয়ে পড়তে পারে। এজন্য তারা বাইরে থেকে নিরপেক্ষতা প্রকাশ করলেও ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। লাওসের সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর জেনারেল ভাং পাওয়ের দ্বারস্থ হয় মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনীর কর্মকতারা। মেজর জেনারেল ভাং পাও ছিলেন ছিলেন ‘মোং’ নামে একটি ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সদস্য। তার জনগোষ্ঠীর সাথে সমতল ভূমির সংখ্যাগরিষ্ঠ লাও জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক বিরোধ ছিল। আমেরিকা লাওসের এই নৃতাত্ত্বিক বিভেদকে তাদের কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তারা মেজর জেনারেল ভাং পাওয়ের মোং জনগোষ্ঠীকে কমিউনিস্ট প্যাথেট লাও দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য গোপনে পাহাড়ি অঞ্চলে সামরিক প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। অর্থাৎ আমেরিকা এখানে রেড প্রিন্সের প্যাথেট লাওয়ের সাথে একটি প্রক্সি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।
এবার লাওসের সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য বিভিন্ন পক্ষের একটি পরিস্কার চিত্র পাওয়া যাক। একদিকে ছিল আমেরিকার গোয়েন্দা বাহিনী সিআইএ-র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মোং ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং রয়্যাল লাওস সরকার, যারা ছিল কমিউনিস্টবিরোধী। অপরদিকে ছিল প্যাথেট লাও, যাদের মূল সমর্থনদাতা ছিল চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভিয়েতনাম। অর্থাৎ লাওস স্নায়ুযুদ্ধের দুই পক্ষের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। কমিউনিস্ট প্যাথেট লাওয়ের মূল সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা আসছিল ভিয়েতনামের কাছ থেকে। লাওসের সীমার ভেতর দিয়ে একটি সরবরাহকারী পথ তৈরি করা হয়েছিল। এই পথকে বলা হতো ‘হো চি মিন ট্রেইল’। এই পথের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল উত্তর ভিয়েতনামি সেনাবাহিনী। বলে রাখা ভালো, উত্তর ভিয়েতনামের সেনাবাহিনীর একটি অংশ লাওসে পশ্চিমাসমর্থিত সরকার উৎখাতের জন্য সামরিকভাবে প্যাথেট লাওকে সহায়তা করছিল। আবার দক্ষিণ ভিয়েতনামের সেনাবাহিনী বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অনেকসময় লাওসের সীমান্তবর্তী অঞ্চল ব্যবহার করছিল উত্তর ভিয়েতনামি কমিউনিস্টরা।
লাওসের আবহাওয়া এবং ভৌগলিক পরিস্থিতি এমন, যেখানে স্থলবাহিনীর মাধ্যমে যুদ্ধ করা শুধু কঠিনই নয়, অসম্ভব বলা চলে। দেশটির প্রায় সত্তর ভাগ এলাকা উঁচু-নিচু পাহাড় ও টিলায় পরিপূর্ণ। প্রচুর নদী এঁকেবেকে প্রবাহিত হয়েছে পুরো দেশে। স্থলবাহিনীর মাধ্যমে যদি আক্রমণ করা হয়, তবে অল্প দূরত্ব পর পর নদী, অন্যান্য জলাশয় এবং পাহাড়ি এলাকা অতিক্রম করতে হবে, যেটা একটি যুদ্ধরত সেনাবাহিনীর জন্য খুবই কষ্টসাধ্য। প্রকৃতি এখানে অনেক বড় প্রতিপক্ষ। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি লিখেছিলেন, “সামরিক ক্যাম্পেইন শুরু করার জন্য লাওস হচ্ছে সবচেয়ে প্রতিকূল জায়গা।“ তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, হো চি মিন ট্রেইল বোমাবর্ষণের মাধ্যমে ধ্বংস করার পর প্যাথেট লাও এবং উত্তর ভিয়েতনামের কমিউনিস্টদের সামরিক ও অর্থনৈতিক সরবরাহ বন্ধ করতে হবে। ভিয়েতনামি সহায়তা না পেলে যে লাওসের কমিউনিস্টরা যুদ্ধে টিকে থাকতে পারবে না, এটা অনুধাবন করেছিল মার্কিনিরা।
১৯৬৪ সালের দিকে মার্কিন সেনাবাহিনী বোমাবর্ষণের গোপন অভিযান শুরু করে। এসি-১৩০ এবং বি-৫২, এই দুটি বোমারু বিমান দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে ক্লাস্টার বোমা বর্ষণ করা হয়। হামলা পরিচালনার ঘাঁটি হিসেবে পার্শ্ববর্তী থাইল্যান্ডের সামরিক ঘাঁটিগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল। হো চি মিন ট্রেইল এবং শেপোন নামের একটি গ্রামকে আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছিল। এর মধ্যে শেপোন গ্রামটিতে উত্তর ভিয়েতনামি বাহিনী এবং প্যাথেট লাওয়ের কমিউনিস্টরা মার্কিন বোমা হামলার বিরুদ্ধে তীর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন। ডেভ বার্নস নামের একজন মার্কিন পাইলট লাওসের বোমা হামলার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বেশ কিছু কথা বলেছিলেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, মার্কিন পাইলটরা যেকোনো মূল্যে শেপোন গ্রাম এড়াতে চাইতো। এখানে বিমান ধ্বংসের সবধরনের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সুসজ্জিত হয়ে থাকতো কমিউনিস্টরা। এই গ্রামের উপর দিয়ে যাওয়ার অর্থ ছিল বিমানবিধ্বংসী গোলার নিশ্চিত আঘাত পাওয়া।
লাওসের গৃহযুদ্ধ শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। কিন্তু আমেরিকার নির্মম বোমা হামলায় প্রাণ হারায় দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় এক-দশমাংশ। বোমা হামলায় মৃত ব্যক্তিদের ৯৮ শতাংশ ছিল বেসামরিক ব্যক্তি। প্রায় সাড়ে সাত লাখ মানুষ বোমাবর্ষণে আহত হয়েছিল, যারা পরবর্তী জীবনে বোমা হামলার দুঃসহ স্মৃতি সঙ্গী করে বেঁচে ছিলেন। চার ভাগের এক ভাগ মানুষ শরণার্থী হয়েছিলেন এই বোমা হামলার কবল থেকে বাঁচতে।
আনুমানিক দুই মিলিয়ন টন বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল এই অভিযানে। নিক্ষেপকৃত বোমার একটি বড় অংশ অবিস্ফোরিত থেকে গিয়েছিল প্রাথমিকভাবে। সেসব বোমার কবলে পড়ে পরবর্তীতে বিশ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। সিআইএ আকাশপথে প্রায় পাঁচ লাখ আশি হাজার বার অভিযান পরিচালনা করেছিল। আল জাজিরার হিসাবমতে, নয় বছর ধরে প্রতিদিন গড়ে প্রতি আট মিনিট পর পর বোমা হামলা চালানো হয়েছিল দেশটিতে। সিআইএ-র অধীকৃত বিমান ব্যবস্থা ‘এয়ার আমেরিকা’ মার্কিনিদের সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ, ও খাবার সরবরাহের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল।
লাওসের মার্কিন বোমা হামলা একটি স্থায়ী ক্ষত তৈরি করে দিয়েছে দেশটির বুকে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই বোমা হামলার ক্ষয়ক্ষতি বয়ে বেড়াচ্ছে। এখনও লাওসের বিভিন্ন এলাকায় অবিস্ফোরিত বোমার পাওয়া যায়, যেগুলো উদ্ধারের জন্য অভিযান চলছে যুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রায় পঞ্চাশ বছর পরেও। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে লাওস সফরে যান। সেখানে তিনি অবিস্ফোরিত বোমা উদ্ধার অভিযানের জন্য ইতোপূর্বে বরাদ্দ দেয়া একশো মিলিয়নের পাশাপাশি আরও নব্বই মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেয়ার অঙ্গীকার করেন। স্নায়ুযুদ্ধের দুই প্রধান শক্তির রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়া দেশটির জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।