১২০৬ সাল থেকে শুরু করে ১৫২৬ সাল পর্যন্ত মোট ৩২২ বছর হিন্দুস্তান একক কোনো মুসলিম রাজবংশের দ্বারা পরিচালিত হয় নি। বরং একাধিক মুসলিম রাজবংশ এই দীর্ঘ সময় হিন্দুস্তানকে শাসন করেছে। ১২০৬-১৫২৬ সাল পর্যন্ত হিন্দুস্তান নিয়ন্ত্রণকারী এই একাধিক তুর্কী আর আফগান মুসলিম রাজবংশের শাসনকে একত্রে ‘দিল্লি সালতানাত‘ বা ‘দিল্লির সুলতানশাহী’ নামে অভিহিত করা হয়। সাম্রাজ্যগুলো হলো মামলুক সালতানাত, খিলজী সালতানাত, তুঘলক সালতানাত, সৈয়দ রাজবংশ আর লোদী রাজবংশীয় শাসন।
মামলুক সালতানাত হিন্দুস্তান নিয়ন্ত্রণ করত ১২০৬-৯০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। খিজলী শাসনামল ১২৯০-১৩২০ সাল পর্যন্ত বজায় ছিল। তুঘলক রাজবংশ হিন্দুস্তানের উপর আধিপত্য বজায় রাখতে পারে ১৩২০-১৪১৩ সাল পর্যন্ত। সৈয়দ রাজবংশ শাসন করে ১৪১৩-৫১ সাল পর্যন্ত। আর লোদি শাসনামল ১৪৫১-১৫২৬ সাল পর্যন্ত বজায় ছিলো।
গজনীর শাসনকর্তা মুইজউদ্দীন মুহাম্মদ শিহাবুদ্দীন ঘুরি সবসময়ই হিন্দুস্তানের ভূখন্ডে মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন। তাই তিনি ১১৭৫ সালে ‘মুলতান’ আর ‘উচ’-এ অভিযান পরিচালনা করেন। তারপর পাঞ্জাব, পেশওয়ার আর লাহোর তার পদানত হয়। ১১৯১ সালে পৃথ্বীরাজ চৌহানের শ্বশুর, রাজা জয়চন্দ্রের আমন্ত্রণে আবারও হিন্দুস্তানে আক্রমণ পরিচালনা করে। কিন্তু থানেশ্বরের কাছে তরাইনের প্রথম যুদ্ধে তিনি শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেন। পরের বছর অর্থাৎ ১১৯২ সালে পুনরায় পৃথ্বীরাজকে আক্রমণ করে বিজয়ী হন। বিজয় অর্জনের পর তিনি হিন্দুস্তান ত্যাগ করে গজনি ফিরে যান। হিন্দুস্তানে নিজের অধিকৃত অঞ্চলের নিরাপত্তা বজায় রাখতে পেছনে রেখে যান তারই বিশ্বস্ত আর অনুগত এক সেনাপতি কুতুবুদ্দীন আইবেককে।
সুলতান মুইজ উদ্দীন মুহাম্মদ শিহাউদ্দীন ঘুরি নিঃসন্তান ছিলেন। কথিত আছে, মৃত্যুর পর তার কোনো উত্তরাধিকারী থাকবে না বলে দরবারের কেউ একজন আফসোস করেছিলেন। তা শুনে সুলতান মন্তব্য করেন, অন্যান্য শাসকদের সন্তান থাকে একজন বা দুইজন। কিন্তু আমার সন্তান আছে হাজার হাজার। তারাই আমার সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হবে। সত্যিকার অর্থেই মুহাম্মদ ঘুরি তার তুর্কী দাসদের সন্তানতুল্য মনে করতেন। তাদের খুব উন্নতমানের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। যোগ্যতার ভিত্তিতে অনেক তুর্কী দাসই পরবর্তীতে সেনাবাহনী ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ অর্জন করেছিলেন।
সে যা-ই হোক, সুলতান মুহাম্মদ ঘুরির অনুমান সত্য প্রমাণিত হয়। ১২০৬ সালের ১৫ মার্চ মাগরিবের নামাজ আদায়রত অবস্থায় খোকাররা শিহাবুদ্দীন মুহাম্মদ ঘুরিকে হত্যা করে। মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য বিশ্বস্ত সেনাপতিদের মাঝে ভাগ হয়ে যায়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চার সেনাপতি সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ চারটি অংশ পান।
তাজ উদ্দীন ইলদিজ হন গজনির শাসক। ১২১০ সালে নাসির উদ্দীন কাবাচার ভাগে পড়ে মুলতান। কুতুবুদ্দীন আইবেক ১২০৬ সালেই দিল্লীর সিংহাসনে একজন স্বাধীন নৃপতি হিসেবে আরোহণ করেন। আর ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি দায়িত্ব পান বাংলার।
প্রথম জীবনে কুতুবুদ্দীন আইবেক মুহাম্মদ ঘুরির একজন ক্রীতদাস ছিলেন। পর্যায়ক্রমে নিজের যোগ্যতা প্রদর্শন করে সেনাবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেন। তিনি নিজে প্রাথমিক জীবনে দাস থাকার কারণে তার প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যকে দাস সাম্রাজ্য নামে অভিহিত করা হয়। এই দাস শাসনামল ১২০৬-৯০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিলো।
সুলতান কুতুবুদ্দীন আইবেক অত্যন্ত ধার্মিক আর ন্যায়বিচারক ছিলেন। তিনি তার হিন্দু আর মুসলিম প্রজাদের মাঝে পার্থক্য না করে সবসময় ন্যায়বিচার করতেন। তবে কুতুবুদ্দীন আইবেক দীর্ঘদিন হিন্দুস্তান শাসন করতে পারেন নি। সিংহাসনে বসার মাত্র ৪ বছর পর, ১২১০ সালে, লাহোরে পোলো খেলার সময় ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে মারা যান তিনি। তাকে লাহোরেই সমাহিত করা হয়।
কুতুবুদ্দীন আইবেকের শাসনকাল খুবই সংক্ষিপ্ত ছিলো। আর তার শাসনামলের প্রায় পুরোটাই তাকে যুদ্ধবিগ্রহ করে কাটাতে হয়েছিলো। দিল্লি ছাড়াও একে একে মিরাট, রণথম্বোর, গুজরাট আর বুন্দেলখন্ড পদানত করেন। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি ছিলেন তার একজন গুরুত্বপূর্ণ সেনাপতি। খলজি ১২০৩ সালে বিহার জয় করেন। ১২০৫-০৬ সালের মধ্যে তিনি বাংলা জয় করেন। নিজ শাসনামলের বেশিরভাগ সময়েই যুদ্ধে নিয়োজিত থাকার কারণে শাসনকাজে তিনি তেমন মনোযোগী হতে পারেন নি। দিল্লীর বিখ্যাত কুতুবমিনারের নির্মাণকাজ তার সময়েই শুরু হয়।
১২১০ সালে কুতুবুদ্দীন আইবেক মৃত্যুবরণ করলে আরাম শাহ দিল্লীর সিংহাসনে বসেন। আরাম শাহ ও কুতুবুদ্দীন আইবেকের মাঝে কী সম্পর্ক ছিলো তা নিয়ে বিতর্ক আছে। মুঘল রাজদরবারের আবুল ফজল বলেন, আরাম শাহ ছিলেন কুতুবুদ্দীন আইবেকের ভাই। আর ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজ বলেছেন, কুতুবুদ্দীন আইবেকের কোনো পুত্র সন্তান ছিলো না। কুতুবুদ্দীন আইবেকের মৃত্যুকালে সিংহাসনের দাবীদার কেউ না থাকায় আরাম শাহকে সিংহাসনে বসানো হয়েছিলো।
তবে তার অযোগ্যতার জন্য রাজদরবার খুব শীঘ্রই আরাম শাহ এর বিরোধী হয়ে উঠে। তারা ইলতুতমিশকে দিল্লীর সিংহাসন গ্রহণ করতে আমন্ত্রণ জানান। ইলতুতমিশ দিল্লীর দিকে এগিয়ে আসেন। দিল্লীর নিকটবর্তী জুদ নামক এলাকায় আরাম শাহ তাকে বাধা প্রদান করেন। কিন্তু যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন।
সুলতান ইলতুতমিশের প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে তেমন স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। তবে শুরুতে তিনি দাস ছিলেন না। তাকে বুখারার দাস ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিলো। পরে তাকে দিল্লী নিয়ে আসা হয়। দিল্লী থেকে কুতুবুদ্দীন আইবেক তাকে ক্রয় করে ‘সার-জান্দার’ বা ‘প্রধান প্রহরী’ হিসেবে নিয়োগ দেন। কিন্তু শীঘ্রই কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা তিনি তার যোগ্যতা দেখাতে থাকেন। পরবর্তীতে তিনি গোয়ালিয়রের আমির পদেও নিয়োগ পান। ইলিতুতলিশের যোগ্যতা দেখে কুতুবুদ্দীন আইবেক তার সাথে নিজ কন্যাকে বিয়ে দেন। অর্থাৎ সম্পর্কের দিক দিয়ে ইলতুতমিশ ছিলেন কুতুবুদ্দীন আইবেকের জামাতা। কুতুবুদ্দীন আইবেক তাকে পরবর্তীতে বাদাউনের শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োজিত করেন।
ইলতুতমিশ ১২১১-৩৬ সাল পর্যন্ত দিল্লীর সুলতান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রথমেই তার রাজধানী লাহোর থেকে দিল্লীতে স্থানান্তর করেন। তার শাসনামলে হঠাৎ করেই হিন্দুস্তান বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। আঞ্চলিক বিদ্রোহীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মুলতানের নাসিরুদ্দীন কাবাচা আর গজনীর তাজউদ্দীনও আগ্রাসী হয়ে ওঠে।
তাজউদ্দীন ইলদিজ গজনীতে নিজের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। নাসির উদ্দিন কুবাচাহ মুলতানের স্বাধীনতা ঘোষণা করে উচ আর লাহোর দখল করে নেন। ইলতুতমিশ তাদের দুজনকেই কঠোর হস্তে দমন করেন। ১২২৫ সালে বাংলা তার পদানত হয়। ১২৩২ সালে তিনি গোয়ালিয়র দখল করেন।
পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বর ব্যক্তিদের তালিকা করতে গেলে চেঙ্গিস খানের নাম উপরের দিকেই থাকবে। সুলতান কুতুবুদ্দীন আইবেক যে বছর সিংহাসনে বসেন, সেই বছরেই অর্থাৎ ১২০৬ সালে চেঙ্গিস খান সমগ্র মঙ্গোলিয়ার একক অধিপতি রুপে আবির্ভূত হন। তাকে ‘চেঙ্গিস খান’ উপাধি দেয়া হয়। ইতিহাস সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা আছে, এমন ব্যক্তি মাত্রই এই মঙ্গোলিয়ান আগ্রাসনের কথা জানেন।
মধ্য এবং উত্তর এশিয়ার ধূ ধূ প্রান্তর থেকে উঠে আসা যাযাবর এই গোষ্ঠীগুলোই এই সময়ে পরিণত হয়েছিলো পৃথিবীর দুঃস্বপ্নে। হত্যা থেকে শুরু করে লুন্ঠন, ধর্ষণ, গণহত্যা- এমন কোনো অপরাধ নেই যে এই বর্বর মঙ্গোলরা করে নি। এক চেঙ্গিস খানের অন্যায় আগ্রাসনে পৃথিবীতে থেকে বিদায় নিয়েছিলেন প্রায় ৪ কোটি মানুষ। শুধুমাত্র গণহত্যা, বর্বরতা আর নৃশংসতার মাধ্যমে হঠাৎ তারা বিশাল এক ভূখন্ড দখল করে ফেললো।
সুলতান ইলতুতমিশের সমসাময়িক আরেক বিখ্যাত যোদ্ধা জেনারেল ছিলেন জালাল উদ্দীন খোয়ারিজমী। চেঙ্গিস খানের সাথে তার বিরোধ বেঁধে যায়। কিন্তু যুদ্ধে চেঙ্গিস খানের কাছে পরাজিত হন। পরাজিত হয়ে তিনি ইলতুতমিশের কাছে আশ্রয় চান। ইলতুতমিশ ভালোই বুঝতে পেরেছিলেন তার সাম্রাজ্যের এই অশান্ত অবস্থায় জালাল উদ্দিনকে আশ্রয় দেয়ার ভিন্ন মানে হচ্ছে চেঙ্গিস খানের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু তিনি হিন্দুস্তানকে তখনই চেঙ্গিস খানের বর্বর থাবার শিকারে পরিণত হতে দিতে চান নি। এতে জালাল উদ্দীন নিরাশ হন।
১২২৯ সালে বাগদাদ কেন্দ্রিক আব্বাসীয় খলিফা আল মুন্তাসির তাকে ‘সুলতান-উল-হিন্দ’ উপাধি দান করেন। ১২৩৬ সালের এপ্রিল মাসে সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুতমিশ মৃত্যুবরণ করেন। ইলতুতমিশের মৃত্যুর পর তার কন্যা রাজিয়া দিল্লির সিংহাসনে বসেন।
সুলতানা রাজিয়ার জন্ম ১২০৫ সালে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন প্রচন্ড মেধাবী, পরিশ্রমী আর বুদ্ধিমতী। রাজনীতি আর যুদ্ধের প্রতিও আগ্রহ ছিলো প্রবল। পিতা ইলতুতমিশ নিজে তাকে যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল শিখিয়েছিলেন, সাথে রাজনীতিও। মৃত্যুর পূর্বে ইলতুতমিশ তার উত্তরাধিকারী হিসেবে কন্যা রাজিয়াকে মনোনীত করে যান। কিন্তু তার মৃত্যুর পর দরবারের অভিজাতরা একজন নারীর শাসন মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ইলতুতমিশের ছোট পুত্র, রাজিয়ার সৎ ভাই রোকনউদ্দীন ফিরোজকে ক্ষমতায় বসান।
ক্ষমতায় বসানোর পরেই রোকনউদ্দীন ফিরোজের অযোগ্যতা টের পাওয়া যায়। ক্ষমতার স্বাদ পেয়েই তিনি ভোগ-বিলাসে ব্যস্ত হয়ে গেলেন, রাজ্য চালনার চেয়ে গায়িকা আর নর্তকীদের সাথে সময় কাটাতেই তিনি বেশি পছন্দ করতেন। ১২৩৬ সালের ৯ নভেম্বর ৪০ জন অভিজাতদের কাউন্সিল ‘চিহালগানি’ রোকনউদ্দীন ফিরোজকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে। রোকনউদ্দীন চিহালগানির হাতেই নিহত হন। সুলতানা রাজিয়া এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন। সুযোগ পেয়ে তিনি দিল্লীর জনগণের সহায়তায় সিংহাসনে আরোহণ করেন। অন্য কোনো উপায় না থাকায় চিহালগানি তাকে সে সময়ের জন্য সমর্থন করতে বাধ্য হয়।
তবে ক্ষমতায় বসেই রাজিয়া বেশ ভালো বুঝতে পেরেছিলেন চিহালগানি তাকে প্রতিটি পদে বাঁধা দিবে, তার বিরুদ্ধাচরণ করবে। আর তাই সিংহাসনে বসেই তিনি সভাসদদের কাউন্সিল চিহালগানির ক্ষমতার হ্রাস করার চেষ্টা করেন। ফলে তিনি আবারো চিহালগানির রোষের মুখে পড়ে যান। এছাড়াও দরবারের অনেক অভিজাত আর গুরুত্বপূর্ণ আমিরই একজন মহিলার শাসনে থাকতে পছন্দ করছিলো না, ফলে ভেতরে-বাইরে সব জায়গাতেই অসন্তোষ দানা বাঁধছিল।
আবার এদিকে নতুন আরেক সমস্যা বাঁধে সুলতানা রাজিয়ার ব্যক্তিগত আবিসিনীয় উপদেষ্টা সিদি জামাল ইয়াকুতকে নিয়ে। ইয়াকুতকে তিনি খুব বিশ্বাস করতেন। ইয়াকুতের প্রতি রাজিয়ার এই প্রবল বিশ্বাস দেখে অনেকেই ঈর্ষান্বিত হয়। আবিসিনীয় হওয়ায় ইয়াকুতের তুলনায় দরবারের অনেকেই নিজেদের বঞ্চিত ভাবতে শুরু করেছিলো। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তারা রাজিয়ার সাথে ইয়াকুতের অবৈধ প্রণয় আছে বলে গুজবও রটিয়ে দেয়।
শীঘ্রই গোটা রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে শুরু করে। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রাদেশিক শাসকরা বিদ্রোহ করতে থাকেন। প্রথমেই লাহোরের গভর্নর বিদ্রোহ করলে সুলতানা রাজিয়া এই বিদ্রোহ শক্তভাবে দমন করতে সক্ষম হন। অন্যদিকে বাথিন্দার গভর্নর মালিক ইখতিয়ারুদ্দীন আলতুনিয়া রাজিয়ার ছোটবেলার খেলার সাথী ছিলেন। মনে মনে তিনি রাজিয়াকে পছন্দও করতেন। কিন্তু রাজিয়ার সম্পর্কে এই গুজব শুনে তিনিও রেগে রাজিয়ার কর্তৃত্ব অস্বীকার করে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। একইসাথে দিল্লীর কর্তৃত্বাধীন অন্যান্য অঞ্চলগুলোর বিদ্রোহ ঘোষণা করে দিল্লীর কাজীর শরণাপন্ন হন।
কাজী সুলতানা রাজিয়াকে পদচ্যুত করেন। চিহালগানি আলতুনিয়াকে তার স্থলাভিষিক্ত করেন। কিছুদিনের জন্য রাজিয়া চলে যান ক্ষমতার পর্দার আড়ালে। তবে তিনি আবারও সুযোগের আশায় ছিলেন। আর শীঘ্রই তিনি সুযোগ পেয়েও যান। আলতুনিয়ার বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে যুদ্ধে পরাজিত হন। যুদ্ধে সিদি জামাল উদ্দীন ইয়াকুত নিহত হন আর সুলতানা রাজিয়া বন্দী হন। মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে সুলতানা রাজিয়া আলতুনিয়াকে বিয়ে করতে সম্মত হন। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা সংশয় থেকে যায়। একজন বীর যোদ্ধা শুধুমাত্র তার জীবন রক্ষার জন্য শত্রুর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবেন না। এই বিয়ের মাধ্যমে রাজিয়ার মূল লক্ষ্য ছিল দিল্লী অধিকার করা। কারণ ইতোমধ্যেই ১২৩৬ সালের এপ্রিলের দিকে চিহালগানি আলতুনিয়াকে পদচ্যুত করে রাজিয়ার ভাই মুয়িজুদ্দীন বাহরাম শাহকে মসনদে বসায়। রাজিয়া যে শুধুমাত্র জীবন রক্ষার জন্য আলতুনিয়াকে বিয়ে করেননি, তা সহজেই বোঝা যায়। কারণ শীঘ্রই তিনি আলতুনিয়াকে দিল্লী আক্রমণের জন্য প্ররোচনা দিয়ে সফল হন।
১২৪০ সালে আলতুনিয়া আর রাজিয়ার সম্মিলিত শক্তি মুয়িজুদ্দীনকে আক্রমণ করে। কিন্তু যুদ্ধে তারা উভয়ই চরমভাবে পরাজিত হন। পরাজিত হয়ে রাজিয়া ভারতের উত্তর দিকে পালিয়ে যান। সেখানে আবারো সংগঠিত হওয়া ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের কাইঠালে দিল্লীর সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এবারও পরাজিত হন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাজিয়া এক কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নেন। খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি ঘুমালে কৃষক তার শরীরে রাজকীয় পোশাক দেখতে পায়। পোশাকে প্রচুর রত্ন লাগানো ছিলো। কৃষক সহজেই বুঝে যায় তার সামনে ঘুমিয়ে থাকা নারী সাধারণ কেউ নন।
কৃষকটি ধন-সম্পদের লোভে পড়ে ঘুমন্ত রাজিয়াকে হত্যা করে এবং রত্ন নিয়ে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে এসব রাজকীয় রত্ন বাজারে বিক্রি করতে গেলে সে ধরা পড়ে। আর একইসাথে চূড়ান্তভাবে পতন ঘটে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম নারী শাসক সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানার। তবে সুলতানা রাজিয়ার মৃত্যু সংক্রান্ত একাধিক মত প্রচলিত আছে।
শাসক হিসেবে কেমন ছিলেন রাজিয়া? এ প্রশ্নের উত্তরে দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, তিনি একাধারে একজন দক্ষ প্রশাসক আর সেনাপতি হিসেবে নিজের গুরুত্ব তুলে ধরতে পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন মেধাবী, বুদ্ধিমতী, রূপবতী এবং পরিশ্রমী। পিতা ইলতুতমিশ যখন যুদ্ধের জন্য রাজধানী ত্যাগ করতেন, তখন মূলত রাজ্য পরিচালনা করতেন তার কন্যা রাজিয়াই। সত্যিকার অর্থে রাজপরিবারে সেই সময় রাজিয়ার চেয়ে যোগ্য আর দক্ষ কেউ ছিলেন না। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রেও নিজের সাহসিকতা প্রদর্শন করতে পেরেছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে হাতির পিঠে চড়ে একেবারে সামনে থেকে তিনি যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতেন।
সুলতানা রাজিয়া সিংহাসনে বসতেন পুরুষদের অনুকরণে আলখাল্লা পরে, মাথায় পরতেন পাগড়ি। তিনি তাকে ‘সুলতানা’ সম্বোধন করাটাও পছন্দ করতেন না। কারণ তার মতে ‘সুলতানা’ হচ্ছে ‘সুলতান’ অর্থাৎ শাসকের স্ত্রীর উপাধি। তিনি তো আর শাসকের স্ত্রী না, বরং তিনিই স্বয়ং শাসক।
রাজিয়া সুলতানা সবক্ষেত্রে বেশ উদার ছিলেন, বিশেষত ধর্মের ক্ষেত্রে। মুসলিম আর হিন্দুদের মাঝে তিনি কোনো ভেদাভেদ করতেন না। সবাইকে সমানভাবে সুযোগ-সুবিধা দিতেন। প্রশাসনে তিনি স্থানীয় লোকদের থেকে বেছে বেছে যোগ্যদের নিয়োগ দিতেন। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন শিক্ষাখাত নিয়ে। সে সময় তিনি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন স্কুল, কলেজ আর গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা সেই সময়ের বিবেচনায় কল্পনাই করা যেত না। প্রজাদের সাথেও বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি, যার প্রমাণ মেলে দিল্লীর জনগণের সহায়তায় তার সিংহাসনে আরোহণের ঘটনা থেকে। তিনি সবসময় তার প্রজাদের সুখ-দুঃখে তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করতেন।
যা-ই হোক, সুলতানা রাজিয়ার মৃত্যুর পর ১২৪২ সালে চিহালগানির অন্তর্দ্বন্দ্বে পড়ে মুয়িজুদ্দীন বাহরাম নিহত হন। এরপর আলাউদ্দীন মাসুদ সিংহাসনে বসেন। তিনিও চিহালগানির হাতের পুতুল ছাড়া কিছু ছিলেন না। ১২৪৬ সালে তারা ইলতুতমিশের আরেক পুত্র নাসিরুদ্দীন মাহমুদকে মসনদে বসায়। তিনি বেশ কিছুদিন শাসন করতে পেরেছিলেন। তার শাসনক্ষমতা ১২৪৬-৬৬ সাল পর্যন্ত ছিলো। নাসিরুদ্দীন মাহমুদ সুলতান হিসেবে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। অত্যন্ত ধার্মিক এই সুলতান গরীব-দুঃখীদের অকাতরে দান করতেন।
তার শাসনামলের অধিকাংশ সময়ই তিনি ধর্মকর্মে ব্যস্ত থাকতেন। আর গিয়াসউদ্দীন বলবন নামে তার অনুগত এক সহকারী রাজ্য পরিচালনা করতেন। নাসিরুদ্দীন মাহমুদের পর এই গিয়াসউদ্দীন বলবনই সিংহাসনে বসেন। তিনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন, স্বাভাবিকভাবে রাজ্য পরিচালনার মূল অন্তরায় হচ্ছে এই কুটিল চিহালগানি। আর তাই তিনি তাদের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চিহালগানি ভেঙে দিয়ে স্বাধীনভাবে শাসন করতে শুরু করেন। আর এভাবেই অবশেষে পতন ঘটে ষড়যন্ত্রকারী চিহালগানির।
প্রাথমিক জীবনে গিয়াস উদ্দীন বলবন একজন দাস ছিলেন। মোঙ্গলদের হাতে বন্দী হলে তাকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়। ১২৩২ সালে তাকে দিল্লীর বাজারে বিক্রি করার জন্য আনা হলে শামসুদ্দীন ইলতুতমিশ তাকে কিনে নেন। তাকে যথাযথ শিক্ষা প্রদান করার পর রাষ্ট্রীয় উঁচু পদে নিয়োগ দেয়া হয়।
১২৬৬ সালে সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদের মৃত্যুর পর তিনি সিংহাসনে বসেন। প্রাথমিক জীবনে তিনি অনেক আরামপ্রিয় আর মদ্যপায়ী ছিলেন। কিন্তু সিংহাসনে আরোহণ করার পর তার ভেতরে বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটে। একসময় যিনি নিজে মদ্যপান করতেন, অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে তিনি পরবর্তীতে মদ্যপায়ীদের নাম তার সামনে উচ্চারণ করা হলে রেগে যেতেন।
তার সিংহাসনে আরোহণের পর বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক বিদ্রোহ হয়েছিলো। তিনি সেসব দমন করেন। বিদ্রোহীদের ব্যাপারে তিনি বেশ কঠোর ছিলেন। বিদ্রোহীদের জনসম্মুখে হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট করে, শূলে চড়িয়ে কিংবা জীবিত অবস্থায় চামড়া ছাড়িয়ে শাস্তি দেয়া হতো। মোঙ্গলদের স্বর্ণযুগ চলাকালীন সময়ে মোঙ্গল দস্যুরা হিন্দুস্তানের ভূখন্ডে আক্রমণ চালাতো। তিনি দক্ষতার সাথে তাদের আক্রমণ ব্যাহত করতেন। তার সীমানার উত্তর-পশ্চিমে প্রতিরক্ষা বুহ্য বরাবর তিনি বেশ কয়েকটি নিরাপত্তা দুর্গ নির্মাণ করেন।
১২৮৭ সাল পর্যন্ত মোট ২২ বছর তিনি হিন্দুস্তান শাসন করেন। ১২৮৭ সালে তিনি স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন।
তার মৃত্যুর পর সিংহাসন নিয়ে আবারো জটিলতা সৃষ্টি হয়। তার বড় ছেলে মুহাম্মদ খান আগেই মোঙ্গলদের সাথে যুদ্ধে নিহত হন। অন্য পুত্র বুগরা খান বাংলা শাসনের ব্যাপারে মনস্থির করেন। তাই তার মৃত্যুর পর বুগরা খানের ছেলে মুইজ উদ্দীন মুহাম্মদ কায়কোবাদ সিংহাসনে বসেন। তবে তিনি অল্পবয়স্ক হওয়ায় রাজকার্য এড়িয়ে যেতে চাইতেন। ১২৯০ সালে মাত্র ৪ বছর শাসন করার পর তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্থ হন। একই বছর এক আফগান খিলজী প্রধানের হাতে তিনি নিহত হন। তার মৃত্যুর পরেই চূড়ান্তভাবে পতন হয় দাস শাসনামলের। হিন্দুস্তান এখন অন্য আরেকটি রাজবংশের দ্বারা শাসিত হওয়ার জন্য সম্পূর্ণ রুপে প্রস্তুত!
তথ্যসূত্র
১. মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়- সাহাদত হোসেন খান
২. ইতিহাসের ইতিহাস- গোলাম আহমেদ মোর্তজা
৩. ভারতবর্ষের ইতিহাস- কোকা আন্তোনোভা, গ্রিগোরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি
৪. বিশ্বসভ্যতা- এ. কে. এম. শাহনাওয়াজ
ফিচার ইমেজ: pixabay.com