Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মেসোপটেমিয়া: ইতিহাসের অনন্য সভ্যতা

কীর্তিগাথা মেসোপটেমীয় সভ্যতা প্রাচীন বিশ্বের এক অপার বিস্ময়। পৃথিবীর সকল সু-প্রাচীন সভ্যতার তালিকা তৈরি করলে, এ সভ্যতা শীর্ষে স্থান দখল করে নেবে। এ যেন সভ্যতার মোড়কে ঘনীভূত এক ইতিহাস, জীব-জীবনের জানা-অজানা কথা, মানব ইতিহাসের উত্থান-পতনের এক মহাকাব্য। বিভিন্ন কারণেই সভ্যতাটির কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়েছে ইতিহাসের পাতায়। আজো তা নিয়ে মানুষের অনুসন্ধিৎসু মনের জানার আগ্রহতে একটুও ভাঁটা পড়েনি। আজকের এ লেখায় আলাপ হবে এ সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে। 

নামকরণ ও পর্যায়

মেসোপটেমিয়া শব্দটি এসেছে মূলত গ্রিকদের কাছ থেকে। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় ‘meso’ শব্দের অর্থ ছিল ‘মধ্য’ বা ‘মধ্যে’ আর ‘potamos’ শব্দের অর্থ ‘নদী’। Mesopotamos শব্দ থেকেই মূলত ‘Mesopotamia’ শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থ হলো ‘নদীর মধ্যে অবস্থিত’। ইউফ্রেতিস ও টাইগ্রিস নামক বৃহৎ দুই নদীর মধ্যবর্তী উর্বর উপত্যকাই ছিল তৎকালীন মেসোপটেমিয়া। প্রাচীনকালে একে বলা হতো ‘দ্বি-নদমধ্যা দেশ’। মেসোপটেমীয় সভ্যতার পর্যায় ছিল মোট চারটি; সুমেরীয়, ব্যবিলনীয়, অ্যাসিরীয় এবং ক্যালডীয়।

প্রথম অধিবাসী

টাউরাস ও জাগরেস পর্বতের পাদদেশে লোকজন প্রথমে বসবাস শুরু করলেও, খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৯০০০ অব্দের দিকে তারা মেসোপটেমিয়ার দক্ষিণ দিকে স্থানান্তরিত হয়। এই দিক কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে প্রথম জনবসতি। সেখানে কোনো পাথর বা ধাতুর অস্তিত্ব ছিল না। তবে নদীর অববাহিকায় থাকার সুবাদে মাটি ছিল অস্বাভাবিক রকমের উর্বর। তাই তৎকালীন অধিবাসীরা মেসোপটেমিয়ার দক্ষিণাঞ্চলকে কৃষিকাজের জন্য বেছে নেয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৭-৬ সহস্রাব্দের দিকে মেসোপটেমীয়রা গরু-ছাগল, ভেড়া পালনের পাশাপাশি কৃষিকাজেও জড়িত ছিল। আশ্রয়স্থল হিসেবে তাদের ভরসা ছিল নিজ হাতে বানানো কুঁড়েঘর। সেই কুঁড়েঘর তৈরির কাঁচামাল ছিল জলাভূমির পাশে জন্মানো গাছগাছালি, আগাছা ও নদীর উর্বর মাটি।

বার বার বন্যার কবলে পড়ে বাসস্থান, গৃহপালিত পশু-পাখি হারিয়ে নিঃস্ব হতে হতো তাদের। সিংহ এবং বুনো শুয়োরের আক্রমণেও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতো। তবুও তারা হার মানেনি। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, সংঘবদ্ধ হয়ে বাঁধের মাধ্যমে ঠেকানোর চেষ্টা করেছে সর্বনাশা বন্যা, জলসেঁচ দিয়েছে ক্ষেতে, সুরক্ষার জন্য তৈরি করেছে উঁচু পাঁচিল। এভাবেই সংগ্রাম করে তারা প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থেকেছে।

প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার কৃষিকাজ; Image Source: imgur.com

অর্থনৈতিক অবস্থা

খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় সহস্রাব্দের দিকে মেসোপটেমিয়ার অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছিল কৃষিকাজ, পশুপালন, ও বস্ত্রশিল্প। তখন প্রধান ফল-বৃক্ষ হিসেবে খেজুর গাছকেই গণ্য করা হতো। খেজুর গাছকে তারা বলত ‘প্রাণ-বৃক্ষ’। খেজুর গাছের বিবিধ ব্যবহার ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। খেজুর থেকে তৈরি করা হতো ময়দা আর রুটি, খেজুরের আঁটি ব্যবহার করা হতো জ্বালানি হিসেবে, খেজুর গাছের ছাল থেকে বানানো হতো ঝুড়ি আর দড়ি। আর তখনকার খেজুর গাছের ফলনকে একেবারে ‘বাম্পার ফলন’ বলা যায়।

একেকটি খেজুর গাছে সংবৎসরে খেজুর ধরত প্রায় ৫০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত। দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার কাপড়ের গুণগত মান এতটাই ভাল ছিল যে, তা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও সুখ্যাতি অর্জন করেছিল। অধিবাসীরা তাদের প্রতিবেশী জনগণ থেকে খাদ্যশস্য, খেজুর ও পশমের বিনিময়ে সংগ্রহ করত ধাতু, কাঠ ও পাথর। এঁটেল মাটি দিয়ে তারা বালতি, বাক্স, নল ইত্যাদি দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় তৈজসপত্রের চাহিদা মিটিয়ে ফেলত। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে কারিগরেরা প্রথমে সোনা ও তামার ব্যবহার আয়ত্ত করার পর ব্রোঞ্জের দিকে হাত বাড়ায়। ইতিহাস মতে, সুমেরীয়রাই প্রথম শহরকেন্দ্রিক বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলে।

ইউফ্রেটিস নদী তীরবর্তী খেজুর বাগান; Image Source: agricoolaboo.com

সর্ববৃহৎ শহর উড়ুক

খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৩,০০০ অব্দের দিকে সুমেরীয়রা পুরো মেসোপটেমিয়ায় তাদের প্রভাব বিস্তার করে নেয়। ইরিদু, নিপ্পুর, লাগাশ, উড়ুক, কিশ শহরগুলো নিয়ে তাদের রাজ্য গঠিত হলেও সেখানে ছিল না কোনো কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা। সকল শহর সমান ক্ষমতা ও সুযোগ সুবিধা ভোগ করত। তৎকালীন নগরায়ন ও শহর ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত উড়ুক শহর। ৬,০০০ বর্গমিটার জায়গা নিয়ে বিস্তৃত উড়ুক শহর ছিল তৎকালীন মেসোপটেমিয়া তথা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শহর। শুধু আয়তনেই নয়, এর জনসংখ্যাও ছিল প্রায় ৬০,০০০-৮০,০০০ এর কাছাকাছি। কৃষিপণ্য রপ্তানি করেই তারা নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করেছিল। প্রাচীন মহাকাব্য গিলগামেশ ও বাইবেলে এ শহরের উল্লেখ পাওয়া যায়। মেসোপটেমিয়ার সাথে এ প্রাচীন শহরটিও সভ্যতার অংশ হয়ে রয়েছে।

উড়ুক শহরের ধ্বংসাবশেষ; Image Source: twitter.com

শ্রেণিবিন্যাস

মেসোপটেমিয়ার সমাজচিত্রে স্পষ্ট শ্রেণিবিন্যাসের বর্ণনা পাওয়া যায়। সম্ভ্রান্ত পরিবার ও পুরোহিতরাই সিংহভাগ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। তাদের সেবা করার জন্য ছিল অনেক দাস-দাসী। তাদের অন্যতম প্রিয় শখ ছিল অর্থের বিনিময়ে রৌপ্য সংগ্রহ করা। সবচেয়ে করুণ অবস্থা ছিল দাসদের। তারা এতটাই ভয়ে থাকত যে, মনিবের দিকে তাকাবার সাহস পর্যন্ত ছিল না তাদের। সম্ভ্রান্ত পরিবার ও মন্দিরে তাদের প্রচুর খাটানো হতো। যারা যুদ্ধবন্দী হতো, তাদেরকেই মূলত দাসে পরিণত করা হতো।

চড়া সুদের প্রচলন তখন থেকেই বিদ্যমান ছিল। ধনীরা সবসময় চাষি ও কারিগরদের ঋণের জালে ফাঁসিয়ে রাখত। গরিবদের তখন দুর্দশার অন্ত ছিল না। কেউ কেউ ঋণের বোঝা সারাজীবন টেনে নিয়ে যেত। ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে মহাজনের কাছে তার পুরো পরিবারকে দাস হয়ে থাকতে হতো। যাদের জমি ছিল না, তারা ধনীদের জমি ইজারা নিতো। বিনিময়ে জমির মালিককে উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক এবং ফলবাগানের দুই-তৃতীয়াংশ দিতে হতো। এভাবেই কৃষিকাজ পশুপালন ও বস্ত্র শিল্পের উন্নতির সাথে সাথে সমাজে শ্রেণিবিন্যাস তৈরি হয়েছিল।

প্রাচীনতম রাষ্ট্র

শ্রেণিসমাজের উদ্ভব ঘটার পরপরই মেসোপটেমিয়ায় রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়। প্রায় প্রত্যেক শহরই ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্র। সেখানে প্রহরী, আমলা, জল্লাদ প্রভৃতি নিযুক্ত ছিল। তারা নিরীহ জনগণের ওপর অত্যাচার চালাত। নগর-রাষ্ট্রের রাজারা একে অন্যের সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহে মত্ত থাকত। যুদ্ধে জয়ী হলে বিজিত নগরী দখল করে নিত বা ধ্বংস করে দিত। আর শহরের বাসিন্দাদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে ধরে নিয়ে বানানো হতো দাস।

শিল্পীর কল্পনায় মেসোপটেমিয়ার যুদ্ধ; Image Source: medium.com

এ সময় ব্যাবিলন খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। জনপ্রিয়তার মূল কারণ ছিল, নগরটির ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিসের সহাবস্থানে থাকা। ব্যাবিলন মূলত এর ভৌগোলিক অবস্থান ব্যবহার করে ফায়দা লুটেছিল। নদীপথে বণিকেরা যাতায়াত করার সময় ব্যাবিলনে নেমে সওদা বিনিময় করত। মেসোপটেমিয়ার সর্বপ্রথম স্থলপথ ব্যাবিলনের উপর দিয়ে যাওয়ায়, দলে দলে কাফেলা, ভারে-ভারে পণ্যদ্রব্য চাপিয়ে যাতায়াত করত। ধীরে ধীরে ব্যাবিলন পরিণত হলো মেসোপটেমিয়ার বাণিজ্য নগরীতে, হয়ে দাঁড়ালো একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের রাজধানীতে।

শাসনব্যবস্থা

মেসোপটেমিয়ার শাসনব্যবস্থায় যে নামটি নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে, তা হলো ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের সম্রাট হাম্মুরাবি। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৯২-১৭৫০ পর্যন্ত দীর্ঘ ৪২ বছর ক্ষমতায় বহাল ছিলেন। ব্যাবিলনের প্রচুর ধন-সম্পদকে কাজে লাগিয়ে তিনি গড়ে তোলেন বিশাল এক সৈন্যবাহিনী। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের রাজাদের মধ্যে বিদ্যমান কলহ তিনি সুকৌশলে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন। কূটবুদ্ধিতে হাম্মুরাবির জুড়ি মেলা ভার ছিল। কলহপূর্ণ বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে থেকে শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাথে জোট বেঁধে অন্যান্য নগর রাষ্ট্র দখল করতেন তিনি। তারপর সুযোগ বুঝে নিজের মিত্রপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বস্ব লুটে নিতেন।

এরপর বিরোধিতা করার মতো আর কেউ থাকত না। এভাবে চিকন বুদ্ধি ও নিপাট কৌশলের আশ্রয়ে পুরো মেসোপটেমিয়াকে পদানত করলেন সম্রাট হাম্মুরাবি। বিস্তৃত করলেন নিজের সাম্রাজ্য ও অনুশাসন। সম্রাট হাম্মুরাবির আমলে আইন-কানুনের অনুশাসনও তৈরি করা হয়েছিল, যা ইতিহাসে ‘হাম্মুরাবি কোড’ নামে পরিচিত।

সম্রাট হাম্মুরাবির মূর্তি; Image Source: keywordbasket.com

এই হাম্মুরাবি কোডে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অন্যায়ের জন্য নির্দিষ্ট শাস্তি বরাদ্দ ছিল। ব্যাবিলন ও তার ক্ষুদ্র রাষ্ট্র-সমূহের প্রত্যেক নাগরিককেই মেনে চলতে হতো প্রণীত সেই নীতিমালা। এ নীতিমালাকে স্থায়ী দলিল হিসেবে রূপ দিতে তা খোদাই করা হয়েছিল পাথরে। এগুলোর মধ্যে কিছু আইন ছিল এরকম,

  • যদি কোনো ব্যক্তি মন্দির বা সম্রাটের সম্পত্তি চুরি করে, তবে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। চুরির মাল যার কাছে পাওয়া যাবে, তার জন্যও একই শাস্তি বরাদ্দ।
  • কোনো ব্যক্তি কারও দাসী হরণ করলে, তাকে প্রাণদণ্ড দেয়া হবে।
  • পলাতক দাসকে কেউ আশ্রয় দিলে, তার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
  • যদি কেউ কোনো ব্যক্তির কাছে ঋণজালে আবদ্ধ থাকে, তাহলে তার স্ত্রী, পুত্র, বা কন্যা ওই ব্যক্তির কাছে তিন বছর দাস-জীবন যাপন করতে বাধ্য থাকবে।

এরকম প্রায় ২৮২টি আইন লিপিবদ্ধ করে রাজার কাছে পেশ করেন সভাসদেরা। চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই ও কাটছাঁটের পর আইনগুলোকে অনুমোদন দেয়া হলে ব্যাবিলন জুড়ে কার্যকর হয় ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন আইন ‘হাম্মুরাবি কোড’।

হাম্মুরাবি কোড; Image Source: blogs.lse.ac.uk

লিপিকথন

মেসোপটেমিয়ায় লিপির আবির্ভাব হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ সহস্রাব্দে। এখানে প্রাচীন মিসরের মতো প্যাপিরাসের প্রাচুর্য ছিল না বিধায়, লেখালিখি করতে হয়েছে মৃত্তিকা-ফলকে। লিপিকারেরা সেক্ষেত্রে এঁটেল মাটির তালের সাহায্য নিতেন। মাটির তাল থেকে যত্নসহকারে ছোট ছোট স্লেট বা মৃত্তিকা-ফলক বানানো হতো। সেই মৃত্তিকা-ফলকে দৃঢ়তা আনার জন্য তা রোদে ভালোমতো শুকানো হতো বা পোড়ানো হতো আগুনে। লিপি আবির্ভাবের একদম শুরুর দিকে মেসোপটেমিয়ায় লেখা হতো ছবি এঁকে এঁকে। তখন প্রায় হাজারখানেক সংকেতচিহ্নের প্রচলন ছিল। সূঁচালো কাঠি দিয়ে মাটি কেটে তার উপর লেপ্টে দেয়া অক্ষরগুলো দেখতে ছিল গোঁজ বা কীলকের মতো। প্রতিটি অক্ষর কয়েকটি কীলকাকার সংকেত চিহ্নের সমন্বয়ে গড়ে উঠত। সেই অক্ষর প্রকাশ করত সম্পূর্ণ একটি শব্দ, বা একটি শব্দাংশ। এগুলোকে কিউনিফর্ম বা কীলকলিপি বলা হয়।

পরবর্তীকালে বিশেষজ্ঞগণ এই কীলকলিপির পাঠোদ্ধার করে মেসোপটেমিয়া সভ্যতা সম্পর্কিত অনেক অজানা তথ্যের সন্ধান পেয়েছেন। পাথর খোদাই করা হাম্মুরাবি শাসনের নীতিমালাও রচিত হয়েছিল এই কীলকলিপিতে। তবে লেনদেন বা ব্যবহারিক কাজে প্রয়োগের জন্য চিত্রলিপি বা কীলকলিপি ছিল বেশ জটিল।

এ সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ বের করেছিল ফিনিশিয়রা, ২২টি ব্যঞ্জনবর্ণ আবিষ্কারের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে তারা কাজে লাগিয়েছিল মিশরীয় লিপি অভিজ্ঞতাকে। কারণ, মিশরীয়দের ব্যবহৃত চিত্র-লিপি-চিহ্ন শুধু শব্দই বোঝাত না, আলাদা আলাদা ধ্বনিও নির্দেশ করত। বর্ণগুলো আবিষ্কার থেকে বিকাশ- পুরো লরিটাই টেনে নিয়েছিল ফিনিশিয়রা। এর ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা হয়ে উঠেছিল আরও সহজ।

সুমেরীয় কিউনিফর্ম; Image Source: smarthistory.org

জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা

জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় মেসোপটেমিয়া প্রভূত উন্নতি সাধন করেছিল। এক্ষেত্রে সামসময়িক সভ্যতা থেকে তারা ছিল বহুগুণ এগিয়ে। ব্যাবিলনের পুরোহিতেরা উঁচু মিনার থেকে জ্যোতির্মণ্ডল পর্যবেক্ষণ করতেন। তৎকালীন গণিতবিদরা হিসেব কষে সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের সঠিক সময় বলে দিতে পারতেন। সর্বপ্রথম পঞ্জিকা প্রচলন ঘটে ব্যাবিলনীয় সভ্যতায়। ৩৬০° কোণ আবিষ্কার করেছিল অ্যাসিরীয়রা।

পৃথিবীকে অক্ষাংশ বা দ্রাঘিমাংশে ভাগ বা সাত দিনে সপ্তাহ গণন, এসব আবিষ্কারের কৃতিত্বটা শুধু মেসোপটেমীয়দের। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যে খুঁজে পাওয়া গেছে স্কুল-পাঠ্য গণিতের অনুশীলনী পুস্তক। সেখানে বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যার উল্লেখ পাওয়া গেছে। যেমন- বিভিন্ন আয়তনের ক্ষেত্রে উৎপন্ন ফসলের হিসাব, সুদ-কষার গাণিতিক সমস্যা, পাহাড়ের ঢালুতে বিভিন্ন গভীরতা সম্পন্ন চারটি জলাধার নির্মাণ করতে কতজন লোকের কতদিন সময় লাগতে পারে- ইত্যাদি।

আক্কাদিয়ান ভাষায় লিখিত গাণিতিক উদাহরণ ও সমস্যা; Image Source: pinterest.com

আজকের যুগের পাটিগণিত সে যুগেও বহুল প্রচলিত ছিল। তাদের গণিতশাস্ত্রে পাটিগণিতের প্রাধান্য লক্ষ করা গেছে। খালকাটা, শস্যাগার নির্মাণ ও অন্যান্য সরকারি কাজকর্মে পাটিগণিত ও জ্যামিতির প্রভূত ব্যবহারের কথা জানা গেছে। এছাড়াও তারা বর্গমূল, ঘনমূল, ঘন-সংখ্যা, বর্গ-সংখ্যা, বিপরীত সংখ্যা, দ্বিঘাত সমীকরণ ব্যবহারের নিয়মও জানত।

ব্যাবিলনীয় সভ্যতার গাণিতিক সমস্যা; Image Source: sciencemag.org

প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যায় মেসোপটেমিয়ার অবদান অনস্বীকার্য। তাদের আহরিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই গ্রিকরা নিজ সভ্যতার উন্নয়ন চাকা সচল রেখেছে। চাঁদ, সূর্য বা বিভিন্ন গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধি নির্ণয়ে গণিতের ব্যবহার তারাই প্রথম শুরু করেছিল। এটি জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্রের বিকাশ ঘটাতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল। গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি লক্ষ করে তৈরি করা হয়েছিল পঞ্জিকা।

বছরের দৈর্ঘ্য মাপা ও ঋতু নির্ণয়ের মাধ্যমে শস্য রোপণকাল চিহ্নিতকরণ- দুটোই করা হতো মানমন্দিরগুলোতে। চ্যাপ্টা পৃথিবীর রূপকল্প থেকে বের হয়ে তারাই প্রথম ভাবতে শুরু করে, ‘পৃথিবী গোলাকার’। আজকের যুগের রাশিচক্র বা জলঘড়ি, দুটো আবিষ্কারের কৃতিত্বও মেসোপটেমীয়দের।

পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম আকরিক থেকে নিষ্কাশিত ধাতু ছিল তামা। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৫,০০০ অব্দের দিকে সুমেরীয়রা এ পদ্ধতির প্রচলন ঘটায়। উন্নতিসাধন করে, এর সাথে টিন মিশিয়ে তৈরি করা হয় ব্রোঞ্জ। পৃথিবীতে প্রথম চাকা আবিষ্কার করেছিল মেসোপটেমীয়রা। তবে সে চাকা যাতায়াত কার্যে ব্যবহার করার জন্য নয়, তৈরি করা হয়েছিল সেঁচ ব্যবস্থা, খাল খনন, দালান নির্মাণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো আরও সহজে ও কম সময়ে সম্পাদনের জন্য।

সাহিত্য

কিংবদন্তি মহাকাব্যিক কবি হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসি মহাকাব্যের প্রায় হাজার বছর আগেই মেসোপটেমীয়রা তাদের নিজস্ব ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছিল। সাহিত্য রচনার জন্য তারা যে ভাষা ব্যবহার করত, এর নাম ছিল ‘হেমেটিক’। পৃথিবীর প্রাচীনতম মহাকাব্য ‘গিলগামেশ’ মহাকাব্য এ ভাষাতেই রচিত। এর কাহিনী আবর্তিত হয়েছে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার উড়ুক শহরের রাজা গিলগামেশ ও তার বন্ধু এনকিদুকে ঘিরে। মৃত্যুকে হারানো ও মানুষের অমরত্বের ইচ্ছা নিয়ে গড়ে উঠেছিল গিলগামেশ মহাকাব্য।

মহাকাব্যের মূল গাঁথুনি স্বর্গ, মর্ত্য, নরক, দেবতা ও অমরত্বের সন্ধান। সর্বোপরি এতে মেসোপটেমিয়ার নগর জীবন, বাণিজ্য, ও সাহিত্যের অভ্যন্তরীণ সম্পর্কও উঠে এসেছে। সেসময় যে লোকজন কল্পনা ও অলৌকিকতাকেই প্রাধান্য দিত বেশি, তা গিলগামেশ পড়লেই আঁচ করা যায়। গিলগামেশ ছাড়াও মেসোপটেমিয়ায় সন্ধান পাওয়া গেছে কিছু ধর্মীয় সাহিত্য, যার মূল উপজীব্য পরলৌকিক চিন্তা-চেতনা।

রাজা গিলগামেশ; Image Source: wsj.com

স্থাপত্যশিল্প

মেসোপটেমিয়া সভ্যতার প্রথম গোড়াপত্তন করেছিল সুমেরীয়রা। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর তীরে সভ্যতা গড়ে ওঠায়, তারা কাদামাটির সুযোগ কাজে লাগিয়েছিল। অ্যাসিরীয় সম্রাটদের আমলে রাজপ্রাসাদ তৈরির জন্য শহরের উঁচু জায়গা বেছে নেয়া হতো। প্রাসাদের চারদিক ঘিরে বেষ্টিত থাকত দূর্গপ্রাচীর। প্রাচীর প্রবেশদ্বারের সামনে এলেই দৃষ্টিগোচর হতো বিশালাকার প্রস্তর মূর্তি। মূর্তিগুলোর আকৃতিও ছিল একটু অদ্ভুত প্রকৃতির। মানুষের মাথা, ষাঁড়ের দেহ ও পিঠে চাপানো বিশাল ডানা। যেন, মানুষ, ষাঁড় ও পক্ষীর সংমিশ্রণে সৃষ্টি করা এক জীব। দেয়ালের প্রস্তরফলকে স্থান পেত পাথর কেটে কেটে তৈরি করা ছবি, যাকে বলা হতো রিলিফ। রিলিফে খোদাই করা ভাস্কর্য ফুটিয়ে তুলত যুদ্ধ সম্পর্কিত বীরগাথা বা দেবদেবীর আখ্যান। সে সময়েই সম্রাটরা তাদের বীরত্বের কাহিনীও প্রস্তরফলকে দৃশ্যমান করতে চাইতেন।

রিলিফে খোদাই করা অ্যাসিরীয় রাজার সিংহবধের ছবি; Image Source: factsanddetails.com

প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার শ্রেষ্ঠ নিদর্শনগুলোর মধ্যে জিগুরাত ছিল অন্যতম। এটি মূলত পিরামিড সদৃশ সুউচ্চ ধর্মীয় স্থাপনা। সমাজের শাসকশ্রেণি পুরোহিতদের চেয়ে নিজেদের অধিক ধর্ম-নিবেদিত প্রমাণ করতে এ স্থাপনা গড়ে তুলেছিলেন। তাদের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় মেসোপটেমিয়ার সকল প্রধান শহরেই জিগুরাত স্থাপন করা হয়। সুমেরীয় শাসকদের হাত ধরে ‘জিগুরাত’ নামক স্থাপনার উদ্ভব ঘটলেও তা অনুসরণ করেছে ব্যাবিলন ও অ্যাসিরীয় সম্রাটেরা। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৩০০ অব্দের দিকে প্রথম জিগুরাত নির্মিত হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। একে ‘স্বর্গ-মর্ত্যের সংযোগস্থল’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

ইরাকে এখনো টিকে আছে জিগুরাত; Image Source: realismjournal.com

ইশতার তোরণ ছিল ব্যাবিলন শহরের প্রধান প্রবেশদ্বার। ফটকটিকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করার উদ্দেশ্যে সেটি সাজিয়ে তোলা হয়েছিল ষাঁড়, ড্রাগন ও সিংহের চিত্র সংবলিত উজ্জ্বল নীলরঙা ইট দিয়ে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার উর্বরতা, শক্তি, প্রেম, যুদ্ধ ও যৌনতার দেবী ইশতারকে উৎসর্গ করেই সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচাঁদনেজারের আমলে এটি নির্মাণ করা হয়। ফটকের ড্রাগন ও ষাঁড় মূলত আরদুক ও আদাদকে নির্দেশ করে। এর ছাদ ও দরজা মূলত সেডার গাছ দিয়ে নির্মিত।

ইশতার তোরণ; Image Source: mozfiles.com

ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান বা ঝুলন্ত উদ্যান ছিল প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের একটি। ধারণা করা হয়, রাজা নেবুচাঁদনেজার তার সম্রাজ্ঞীর একাকিত্ব কাটানোর জন্য ইউফ্রেতিস নদীর অববাহিকায় খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ সালে নির্মাণ করেন এই মহা-স্থাপত্য। সর্ববৃহৎ এই পুষ্প-কাননের নির্মাণকাজে হাত লাগিয়েছিল প্রায় হাজার চারেক শ্রমিক। তবে উদ্যানটি শূন্যে ভাসমান ছিল না মোটেই। এর মধ্যে নিহিত ছিল প্রযুক্তিগত সুকৌশল। বাগানটি নির্মাণ করা হয়েছিল, মরুভূমিতে মাটি ফেলে তৈরি কৃত্রিম এক পাহাড়ের উপর। বাগানটির পুরো শৈল্পিক কার্যেই ছিল অত্যধিক সুপরিকল্পিত বিজ্ঞান ও গণিতের ছোঁয়া। তবে এ ঝুলন্ত উদ্যান নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, এটি স্রেফ কল্পনা। আবার অনেকের মতে, এর অস্তিত্ব ছিল ঠিকই, কিন্তু ব্যাবিলনে নয়। ছিল অ্যাসিরিয়ার নগর নিনেভাতে।

শিল্পীর তুলিতে ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান; Image Source: blog.stylewe.com

ধর্মবিশ্বাস

মেসোপটেমীয়রা ধর্মের অত্যন্ত অনুরাগী ছিল। ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে একই দেবদেবীর পূজা করা হয়েছে, কিন্তু তা ভিন্ন নামে। যেমন, ইশতার দেবী সুমেরীয়দের মাঝে ‘ইনানা’ নামে পরিচিত ছিলেন। তারা বিশ্বাস করত, ভিন্ন ভিন্ন দেব-দেবী ভিন্ন ভিন্ন জিনিস পরিচালনার দায়িত্বে। যেমন পাতালপুরীর শাসক এরেশকিগাল বা ইরকালা, শস্য ও সহানুভূতির দেবী শালা, উর্বরতার দেবী গেশতিনামা, পৃথিবীর নিয়ন্ত্রক কিশার প্রভৃতি।

প্রাচীনকালের এই মেসোপটেমীয় সভ্যতা কীভাবে বহুকাল আগ থেকেই গণতন্ত্র, বিজ্ঞান ও স্থাপত্যের রুচিশীল চিন্তা-চেতনার লালন করে আসছে, তা ভাবলে আজ অবাকই হতে হয়। তারাই প্রথম গড়ে তোলে সংঘবদ্ধ গণতন্ত্র ও আইন-প্রয়োগের যথাযথ ব্যবহার। সেইসাথে তারা পৃথিবীকে দিয়ে গেছে বিজ্ঞান ও স্থাপত্যশিল্পের রসদ। বর্তমান যুগের বিষয়াদিকে উন্নত ধারার ক্ষেত্রে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার যে অবদান রয়েছে, তা অনস্বীকার্য।

Related Articles