মাথায় তার টুপি। প্যান্টালুনখানা প্রায় বুকের উপর তোলা। হাঁটে হেলেদুলে, মুখে ভাঙা ইংরেজি। পুরু তার ঠোঁট, গায়ের রঙ মিশমিশে কালো।
সে নির্বোধ, সে মূর্খ, সে হাসির পাত্র।
সে একজন কৃষ্ণাঙ্গ। শুধু সে একা নয়, পৃথিবীর তাবৎ কৃষ্ণাঙ্গই এমন।
বিশ্বাস হয়? নিশ্চয়ই না, অথচ এভাবেই প্রায় শতবছর ধরে আমেরিকার থিয়েটারের মঞ্চে একটি জাতিকে উপস্থাপন করে এসেছে একধরনের ‘শিল্পকর্ম’। এর নাম ‘মিনস্ট্রেল শো’।
কী ছিল মিনস্ট্রেল শো?
মিনস্ট্রেল শো বা মিনস্ট্রেলসির শুরুটা হয় উনিশ শতকে, আমেরিকায়। প্রতিটি শো ছিল বিনোদনের হরেকরকম উপাদান নিয়ে আয়োজিত। এর মধ্যে ছিল রম্য নাটক, নাচ, গান ইত্যাদি। আর এর মূল বিষয় ছিল আফ্রিকান আমেরিকান মানুষ ও তাদের জীবনযাত্রা। অন্তত, মিনস্ট্রেল শিল্পীরা সেটাই দাবি করতো। কিন্তু মিনস্ট্রেল শোগুলো ছিল প্রকৃতপক্ষে প্রচন্ডরকম বর্ণবাদী আর কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে দেখানোর অপচেষ্টা মাত্র।
একটি দেশের গোটা জনগণের সামনে একটি জনগোষ্ঠীকে নিচু করে উপস্থাপনের মাধ্যমে আদতে তারা কৃষ্ণাঙ্গ সম্পর্কে একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করতো এবং অনেকাংশে সফলও হয়েছিল। মিনস্ট্রেল শোগুলো ছিল ভীষণ জনপ্রিয়। মঞ্চে প্রদর্শিত কৃষ্ণাঙ্গ চরিত্রদের উপর ভিত্তি করে বাস্তবজগতের কৃষ্ণাঙ্গদের সম্পর্কে মনগড়া ভুল ধারণা বিশ্বাস করে বসে সাধারণ শ্বেতাঙ্গ মানুষ। তাই আমেরিকায় দাসপ্রথার সমর্থন এবং বর্ণবাদী চিন্তাধারার প্রচার ও প্রসারে মিনস্ট্রেল শো ছিল অনেকাংশেই দায়ী।
বলা বাহুল্য, মিনস্ট্রেল শো’র জন্ম হয়েছিল শ্বেতাঙ্গদের হাতে। এমনকি, এর শিল্পীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। কৃষ্ণাঙ্গ চরিত্রে অভিনয় করার জন্য তারা ব্যবহার করতো নানা মেক আপ। গায়ের চামড়ার রঙ কালো করতে মুখে কালি লাগানো তথা ব্ল্যাকফেইস ছিল এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ব্ল্যাকফেইস তৈরি করতে ব্যবহার করা হতো পোড়ানো কর্ক, আলকাতরা, এমনকি জুতার কালিও। ব্ল্যাকফেইস ছাড়াও এ চরিত্রের জন্য অন্যান্য সাজসজ্জা ব্যবহার করা হত। মূলত ঠোঁট, চোখ আর চুলে প্রাধান্য দেয়া হত। ব্ল্যাকফেইসের পাশাপাশি বেঢপ রকমের পুরু ঠোঁট ছিল মিনস্ট্রেল শো’র অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
জন্ম, “ড্যাডি” রাইস ও জিম ক্রো
মিনস্ট্রেল শো’র জন্ম হয়েছিল “ড্যাডি” টি.ডি রাইসের (“Daddy” T.D Rice) হাতে। টি. ডি. রাইস, পুরো নাম থমাস ডার্টমাউথ রাইস (Thomas Dartmouth Rice), ছিলেন নিউ ইয়র্কের একজন অভিনেতা। মুখে ব্ল্যাকফেইস নিয়ে গান এবং নাচের জন্য পরিচিতি পাওয়া এই ব্যক্তি নিজেকে একজন ইথিওপিয়ান ডিলিনেটর (Etheopian Delineator) হিসেবে দাবি করতেন।
১৮৩০ সালের দিকে তার লেখা এবং গাওয়া “জাম্প জিম ক্রো” গানটি তাকে তুমুল জনপ্রিয়তা দেয়। গান গাওয়ার সাথে সাথে ‘জিম ক্রো’ চরিত্রে অভিনয় এবং নাচতেনও রাইস। কথিত আছে, জিম ক্রোর জন্ম হয়েছিল শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী এক আফ্রিকান-আমেরিকান দাসের উপর ভিত্তি করে। রাইস সেই ব্যক্তিকে অনুকরণ করে নিজের পা বাঁকিয়ে নাচতেন এবং স্টাম্প স্পিচের মাধ্যমে মঞ্চে উপস্থাপন করতেন।
জিম ক্রো মিন্সট্রেলসির ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র। তার গান, হাস্যকর অঙ্গভঙ্গি অর্থাৎ তার জন্মই হয়েছিল আফ্রিকান-আমেরিকানদের এক ক্যারিকেচার হিসেবে।
উনিশ শতকের পরবর্তী সময়ে পাস হওয়া বর্ণবাদী ও বিদ্বেষমূলক পৃথকীকরণ আইনটি ‘জিম ক্রো আইন’ হিসেবে পরিচিত। এই আইনানুযায়ী কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের জন্য পৃথক যানবাহন, স্কুল, রেস্তোরাঁ, থিয়েটার ইত্যাদির বাধ্যতামূলক ব্যবহারের কথা উল্লেখ ছিল। আইনটি সর্বক্ষেত্রেই আফ্রিকান-আমেরিকানদের উপর শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্যের স্থান দেয়া হয়েছিল। তবে বিষয়টি এমন না যে, ড্যাডি রাইস ব্ল্যাকফেইস ব্যবহার করে অভিনয় করা প্রথম ব্যক্তি ছিলেন। বরং ইতিহাস তাকে ব্ল্যাকফেইস ব্যবহার করে বিখ্যাত হওয়া প্রথম ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে।
কীভাবে মঞ্চস্থ হত একটি মিনস্ট্রেল শো?
প্রথমদিকে মঞ্চে রাইসের পারফর্মেন্স ছিল একক উপস্থাপন, ধীরে ধীরে মিনস্ট্রেলসি দলীয় ও পরবর্তীতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। একটি সাধারণ মিনস্ট্রেল শো’র মঞ্চায়নটা ছিল অনেকটা এরকম-
প্রথম দৃশ্য বা অ্যাক্টে মঞ্চে গোল হয়ে বসে একটি দল। তারা সবাই আসতো একেকজন চরিত্র হিসেবে। তাদের একদিকে বসতো ট্যাম্বো (Tambo), যে তাম্বুরা বা ট্যাম্বোরিন (Tambourine) বাজাতো, অপরপাশে বসতো বোন্স (Bones), যে হাড়ের তৈরি ক্যাস্টানেট (Bone castanet) বাজাতো। উল্লেখ্য, তারা সবাই ব্ল্যাকফেইস মুখে উপস্থাপন করতো। তাদের মাঝে এসে বসতো কয়েকজন ইন্টারলকিউটর (Interlocutor)। তারা ছিল অনেকটা উপস্থাপকের মতো। তারা অভিনয় করতো, গান গাইতো। এই গানগুলোর কিছু ছিল তাদের নিজেদের লেখা, কিছু ছিল লোকসঙ্গীত থেকে অনুপ্রাণিত। তাদের অনেকগুলো এখনও টিকে আছে, যেমন- “ওহ! সুসানা” (“Oh! Susanna”); যদিও তাদের গানের কথায় যথেষ্ট পরিবর্তন আনা হয়েছে।
শো’র দ্বিতীয় দৃশ্য বা অ্যাক্ট ওলিও-তে (Olio) নানা ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল আঞ্চলিক ভাষায় অর্থহীন কথার ভাষণ, স্টাম্প স্পিচ আর সার্কাস খেলা।
তৃতীয় দৃশ্য বা অ্যাক্ট আফটার পিস (Afterpiece) ছিল একটি নাটক। এই নাটক ছিল সাধারণত কোনো বিখ্যাত বই বা নাটকের প্যারোডি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ নাটকগুলো ছিল দাসপ্রথার সমর্থন আর বর্ণবাদী বক্তব্যে ভরপুর।
এর অনেকগুলোই ছিল ভীষণ কুরুচিপূর্ণ এবং ভয়াবহ। আবার অনেকগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত মার্জিত। অনেক নাটকে আবার সাদা-কালো নির্বিশেষে সকল জনতাকে ধনীদের শোষণের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে আহবান জানানো হত, তবে এগুলোর সংখ্যা ছিল খুবই অল্প।
মিনস্ট্রেল নাটকের একটি পরিচিত দৃশ্য অনেকটা এরকম- দক্ষিণ আমেরিকার কোনো এক ধনকুবেরের একটি তুলার বাগান, তার অধীনে রয়েছে গোটা পঞ্চাশজন দাস। কৃষ্ণাঙ্গ দাস। মনিবের কথায় তাদের জীবন চলে, তার চাবুকের নীচেই তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। মনিবের জন্য তারা তাদের জীবন দিতে প্রস্তুত।
বাগানে তারা সারা জীবন বিনা পারিশ্রমিকে তুলা চাষ করে করে সুখেই আছে, আর যারা এর বাইরে বের হতে চায় তারা নির্বুদ্ধিতার শাস্তি পায়। কেননা বাইরের জগতে টিকে থাকার মতো জ্ঞান বা বুদ্ধি তাদের নেই। তারা শিশুসুলভ, জগত সম্পর্কে তাদের জ্ঞান খুব কম, শরীরের বল ছাড়া যে তাদের আর তেমন কিছু নেই!
এর মাঝে ঘনিয়ে আসে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ। উল্লেখ্য, এর মূলেও ছিল দাসপ্রথা বিতর্ক। সেজন্য দক্ষিণ আমেরিকা, যেখানে তুলার বাগান এবং দাসপ্রথার চল ছিল সবচেয়ে বেশি, সেখানে দাসপ্রথার সমর্থনে মিনস্ট্রেল শোর মাত্রাও বেড়ে যায়।
আঙ্কল টম, মিনস্ট্রেলসি এবং দাসপ্রথা
তখন ১৮৫২ সাল।
আমেরিকায় প্রকাশিত এক উপন্যাসের কারণে শুরু হয়েছিল তুমুল আলোড়ন। গল্পের মূল চরিত্র একজন কৃষ্ণাঙ্গ দাস, আর তাদেরকে কি না দেখানো হয়েছে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে! দাসপ্রথা বিরোধী এই উপন্যাসের নাম অনেকেই শুনে থাকবেন। হ্যারিয়েট বিচার স্টো রচিত ‘আঙ্কল টমস কেবিন’ (Uncle Tom’s Cabin)।
উপন্যাসে দাসপ্রথার ভয়াবহতা এবং আফ্রিকান-আমেরিকানদের প্রতি সহমর্মিতা খুব স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়। উপন্যাসটি নিয়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা-বিতর্ক। আর এর জনপ্রিয়তার কারণে এর উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয় নানা নাটক। মঞ্চায়িত এই নাটকের অনেকগুলো স্টোর উপন্যাসের দাসপ্রথা বিরোধী বক্তব্য তুলে ধরেছিল।
আবার দাসপ্রথা বিরোধী এই উপন্যাসের গল্পকে বিকৃত করে দাসপ্রথার পক্ষে লেখা নাটকের সংখ্যাও কম নয়। অধিকাংশ মিনস্ট্রেল নাটক ছিল এরুপ। শুধু তা-ই নয়, আঙ্কল টমকেও তারা মিনস্ট্রেলসির ক্যারিকেচারে রূপান্তরিত করে। এদের নাটকগুলোর নাম ছিল এরূপ- ‘হ্যাপি আঙ্কল টম’ (Happy Uncle Tom), ‘আঙ্কল ড্যাডস ক্যাবিন’ (Uncle Dad’s Cabin) ইত্যাদি। এই ঘরানার নাটকের একটি নামও দেয়া হতো- ‘টম শো’।
মিনস্ট্রেল শো’র চরিত্ররা
আগেই বলা হয়েছে, মিনস্ট্রেল শোতে আফ্রিকান-আমেরিকানদের অত্যন্ত সংকীর্ণ, নির্বোধ, হাস্যকর হিসেবে দেখানো হত। কিছু গৎবাঁধা চরিত্র হিসেবেই গোটা জাতিকে উপস্থাপন করা হত।
এরা হলো-
- জিম ক্রো – ড্যাডি রাইসের অভিনীত সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র।
- জিপ কুন – ১৮৩৪ সালে জর্জ ডিক্সন প্রথম এই চরিত্রে অভিনয় করেন। মূলত দাসত্ব থেকে মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের ব্যঙ্গ করে এ চরিত্র। জিপ কুন অহংকারী, শহুরে, মিথ্যাবাদী এবং নিজেকে জ্ঞানী হিসেবে জাহির করার জন্য সবসময় ব্যস্ত থাকে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়।
- ম্যামি – বয়স্ক মাতৃসুলভ এক নারী। সে-ও বেশ জনপ্রিয় ছিল।
- আঙ্কল টম – স্টোর উপন্যাসের চরিত্রের ক্যারিকেচার।
- বাক – অহংকারী, বিপদজনক এবং শ্বেতাঙ্গ নারীদের প্রতি আকৃষ্ট।
- মুলাটো – মিশ্র রক্তের ব্যক্তি। এরা সাধারণত নিজেদের শ্বেতাঙ্গ হিসেবেই চালিয়ে দিতে চায়, কিন্তু পরে তাদের নিগ্রো রক্ত ধরা পড়ে।
- জেজেবেল – সুন্দরী, লাস্যময়ী, পুরুষকে ফাঁদে ফেলতে ব্যস্ত। এরা সাধারণত নারী মুলাটো ছিল।
- পিকানেনি – কালো শিশু। বড় চোখ, উষ্কখুষ্ক চুল, বড় মুখ বিশিষ্ট।
কৃষ্ণাঙ্গদের মিনস্ট্রেলসি
উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে মিনস্ট্রেল শো-তে কৃষ্ণাঙ্গদের উপস্থিতি দেখা যায়। গায়ের চামড়া কালো হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে মুখে ব্ল্যাকফেইস নিতে হত।
কেন? কারণ দর্শক সেটাই চাইতো। এতদিন ধরে ক্যারিকেচার হিসেবে দেখাতে তাদেরকে আর মানুষ হিসেবে দেখার ইচ্ছা থাকেনি শ্বেতাঙ্গ দর্শকদের। তাই মুখে কালি, রঙ দিয়ে ঠোঁট এঁকেই মঞ্চে উঠতে হত কৃষ্ণাঙ্গদের।
কেন তারা স্বেচ্ছায় এই পেশায় যেত ভাবছেন? কারণ এটা ছাড়া তাদের শিল্পজগতে ঢোকার কোনো সুযোগ ছিল না। তাই নিজেদের হেয় করে, ফ্রেডরিক ডগলাসের মতে “শ্বেতাঙ্গ সমাজের বিকৃত রুচিকে তৃপ্ত করতে” হত। এখান থেকেই মূলধারার বিনোদন জগতে আসতে থাকে তারা।
তবে উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে মিনস্ট্রেল শো তাদের জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে এবং বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে এর প্রভাব থেকেই যায়।
ব্ল্যাকফেইস তারপরও সঙ্গীত শিল্পীরা পারফর্ম করে, চলচ্চিত্রে, এমনকি কার্টুনেও থেকে যায় ব্ল্যাকফেইস। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বিবিসির ‘দ্য ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট মিনস্ট্রেল শো’র সম্প্রচার অব্যহত থাকে।
মিনস্ট্রেল শো আমেরিকার বিনোদনের ইতিহাসের একটি তিমিরাচ্ছন্ন অধ্যায়। যদিও বর্ণবাদ থেকে এ জগত অনেকটাই এগিয়ে এসেছে, কিন্তু যেতে হবে বহুদূর। অতীতকে ভুলে কখনো এগোনো যাবে না, তাই ভোলা যাবে না মিনস্ট্রেল শো’র কথাও।