Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভাইকিংদের নিয়ে জনপ্রিয় সাতটি ভুল ধারণা

‘ভাইকিং এজ’ বলতে যে সময়ের কথা আমরা শুনে থাকি, তা মোটামুটি নবম থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সময়ে ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা, এমনকি আমেরিকাতেও বিস্তর প্রভাব ফেলেছিল ভাইকিং সংস্কৃতি। অথচ নানাবিধ কারণে এই ভাইকিংদের সম্পর্কে আমাদের ভুল ধারণার অন্ত নেই।

আজকের লেখায় আমরা ভাইকিংদের নিয়ে প্রচলিত তেমনই সাতটি ভুল ধারণার পাশাপাশি প্রকৃত সত্যটাও তুলে ধরবো রোর বাংলার পাঠকদের জন্য।

১. ভাইকিংরা শিংযুক্ত হেলমেট ব্যবহার করতো

ভাইকিংদের কথা মনে আসলেই প্রথমে তাদের যে প্রতিকৃতি আমাদের চোখে ভেসে ওঠে, সেখানে তাদের মাথায় থাকে একটি হেলমেট, যাতে আবার দু’পাশে থাকে দুটি শিংয়ের মতো অংশ। তবে বাস্তবতা হলো, ভাইকিংরা আসলে কোনোদিনই এমন শিংযুক্ত হেলমেট ব্যবহার করেনি। তাদের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও জনপ্রিয় এই ধারণার বিপক্ষেই কথা বলে। তারা হেলমেট ব্যবহার করতো ঠিকই, তবে সেগুলো ছিল আর আট-দশটা হেলমেটের মতোই সাধারণ, যার উদ্দেশ্য ছিল কেবলমাত্র পরিধানকারীর মাথার সুরক্ষা নিশ্চিত করা। প্রতিপক্ষ যদি মুগুর, কুঠার কিংবা ধারালো তলোয়ার নিয়ে আঘাত হানতে আসতো, তাহলে দক্ষতা ছাড়া শুধুমাত্র হেলমেটের উপরের শিং দিয়ে কী এমনই বা করা সম্ভব!

ভাইকিং হেলমেট; Image Source: Seattle Weekly

তাহলে ভাইকিংদের এমন শিংযুক্ত হেলমেটের ধারণা মানুষের মাথায় আসলো কী করে? আসলে, বিচিত্র ডিজাইনের এই হেলমেটের ধারণা মানুষের মনে ঠাই পেয়েছে উনিশ শতকে এসে, রিচার্ড ওয়াগনারের ‘দ্য রিং সাইকেল’ (জার্মান কম্পোজারের চারটি অপেরার এ সম্মিলনটি নর্স বীরকাহিনীর বিভিন্ন চরিত্রকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল) এর মাধ্যমে। কস্টিউম ডিজাইনার কার্ল এমিল ডোপলার ১৮৭০ এর দশকে ভাইকিং চরিত্রগুলোর জন্য যেসব হেলমেট ডিজাইন করতেন, সেখানেও দর্শকদের মনে ভীতিজাগানিয়া আবহ সৃষ্টি করতে তিনি শিং জুড়ে দিতেন। এভাবেই বাস্তবে না থাকলেও শিল্পের কল্যাণে হেলমেটে শিং পেয়ে যায় ভাইকিংরা। পরবর্তীতে কার্টুনিস্ট, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চিত্রশিল্পীদের হাত ধরে এই শিংগুলো আজও তাদের জায়গা ধরে রেখেছে।

২. ভাইকিংরা ছিলো বেশ নৃশংস এক জাতি

এ কথা ঠিক যে, ভাইকিংরা অতীতে বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ ভালোই ত্রাসের সঞ্চার করেছিল। খ্রিস্টান অধ্যুষিত সেসব এলাকার জনগণ লেখাপড়া জানার কারণে সেসব ঘটনা লিপিবদ্ধ করা ছিল, কখনো কখনো যা আবার ছিল অতিরঞ্জিত। আলকুইন অফ ইয়র্ক বিশপ হিগবাল্ডের কাছে এই ভাইকিংদের নৃশংসতা বর্ণনা করেই লিখেছিলেন,

এই মূর্তিপূজক জাতি পুরো ব্রিটেন জুড়ে যে ত্রাসের সঞ্চার করেছে, এমনটা আগে কখনো হয়নি… এই বর্বরগুলো বেদীর চারপাশ যাজকদের রক্তে রঞ্জিত করেছে। শুধু তা-ই না, ওরা গির্জায় যাজকদের মৃতদেহগুলো এমনভাবে পদদলিত করেছে, যেমনটা আমরা রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা বিষ্ঠার বেলায় করে থাকি।

Image Source: Culture Trip

ব্রিটেনে ভাইকিংরা আসলেই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। এই কথা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। এমনকি তাদের হাতে নিহত এমন অনেকের কঙ্কালও পাওয়া গিয়েছে যাদের হাড়ে তখনও হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রটি আটকে ছিল। নর্থ হার্টফোর্ডশায়ার মিউজিয়ামে একটি কঙ্কাল আছে, যার গলা এফোঁড়-ওফোঁড় করে গিয়েছে ভাইকিংদেরই একটি বর্শা। বেশ কিছু ভাইকিং সদস্য ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলেও তাদের অধিকাংশই কৃষিকাজ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করতো।

তবে, এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তখনকার সময়টাই আসলে এমন ছিল। প্রতিদ্বন্দ্বী অনেকেই ক্ষমতা ও নৃশংসতার দিক দিয়ে ভাইকিংদের সমকক্ষ ছিলো কিংবা তাদেরকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মধ্যযুগের শুরুর দিককার জনপ্রিয় এক নাম ছিলো সম্রাট শার্লেম্যাগনে। ৭৮২ সালে তার বাহিনী স্যাক্সনিতে প্রায় সাড়ে চার হাজার লোককে হত্যা করেছিল, ইতিহাসে যা ‘ম্যাসাকার অফ ভার্ডেন’ নামে পরিচিত। কিন্তু খ্রিস্টধর্মাবলম্বী শার্লেম্যাগনের একজন খ্রিস্টান জীবনীকার ছিলেন, যিনি তার অন্নদাতার ভালো কথাগুলোই কেবল লিখে গিয়েছেন, তাকে উল্লেখ করেছেন বিধর্মীদের (মূর্তিপূজকদের) হন্তারক হিসেবে, ফুটিয়ে তুলেছেন ‘ফাদার অফ দ্য চার্চ’ হিসেবে। এর ফলশ্রুতিতে তার নিষ্ঠুরতা অতটা প্রচার পায়নি, যতটা পেয়েছিল ভাইকিংদের বেলায়।

৩. ইচ্ছামতো লুটপাট শেষে নৌকায় করে চলে যেত তারা

স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সাক্ষ্য দেয় যে, তৎকালে ভাইকিংরা বিভিন্ন অঞ্চলে লুটপাট চালাতো, জ্ঞাত পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ থেকে ধনরত্ন এনে ভরিয়ে তুলতো তাদের অর্থভাণ্ডার। কিন্তু তাই বলে তাদের সবাই কিন্তু এমন ছিলো না। অনেকেই নতুন পা রাখা/বিজিত অঞ্চলসমূহে থেকে গিয়ে সেখানের প্রভূত উন্নতিতে দীর্ঘস্থায়ী অবদান রেখেছে।

Image Source: Quillette

৮৪১ খ্রিস্টাব্দে গড়ে ওঠা ডাবলিন হলো ভাইকিংদের হাতে তৈরি একেবারে প্রথম দিককার একটি স্থাপনা। ধীরে ধীরে পণ্য উৎপাদনের দিক দিয়েও বেশ গুরুত্বপূর্ণ শহর হয়ে ওঠে এটি। এখানে গড়ে ওঠে একটি বন্দর, এমনকি টাকশালও। ডাবলিনের পাশাপাশি ইয়র্কের জরভিক শহরের উত্থানের পেছনেও আছে এই ভাইকিংদের অবদান। আইসল্যান্ডকে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকতে হবে ইনগল্ফ্র আর্নান্সনের প্রতি, যার তত্ত্বাবধানে একে একে সেখানকার স্থাপনাগুলো দেখছিলো আলোর মুখ।

নরম্যান্ডিও ভাইকিংদের গঠনমূলক মনোভাবের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। ভবিষ্যতে ভাইকিং আক্রমণ যাতে না হয় সেজন্য রাজা তৃতীয় চার্লস ফ্রান্সের উত্তরে তাদের থাকার ব্যবস্থা পর্যন্ত করে দেন। এমনকি নিজের মেয়েকে তিনি বিয়ে দেন নরওয়েজীয় নেতা রলোর সাথে। এর মধ্য দিয়েই ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধীরে ধীরে আপন করে নিতে শুরু করে ভাইকিংরা।

৪. ভাইকিংরা ছিল মূর্তিপূজক এবং নাস্তিক

ইতিহাসের ব্যাপারে খুব প্রচলিত একটি কথা হলো, ‘বিজয়ী’দের হাতেই এটি সবসময় তৈরি হয়ে থাকে। তবে ভাইকিংদের বেলায় এখানে প্রভাব রেখেছে ধর্ম, আরো ভালো করে বললে খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ইতিহাসবিদগণ। তারাই ভাইকিংদেরকে মূর্তিপূজক এবং নাস্তিক বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দলিলপত্র বলছে ভিন্ন কথা।

Image Source: ThoughtCo

ভাইকিংদের ধর্ম ছিলো বেশ সাজানোগোছানো। এই ধর্মের অনুসারীদের জন্য কতগুলো নিয়মকানুন উল্লেখ করে দেয়া ছিলো, যাতে করে তারা সুন্দর একটি জীবনপথের সন্ধান পায়। নির্দিষ্ট কোনো ধর্মগ্রন্থ অবশ্য তাদের ছিলো না। তবে ধর্মীয় নানা উপকথা প্রজন্মান্তরে লোকমুখে চলে এসেছিলো।

আজকের দিনের প্রধান ধর্মগুলোতে যেমন বিভিন্ন উপাসনালয়ে গিয়ে ধর্মচর্চা করতে দেখা যায়, ভাইকিংদের বেলায় এমনটা ছিলো না। বরং প্রাচীন সেল্টদের মতো তারা বাস্তব জগতের বিভিন্ন জিনিসকে পবিত্রজ্ঞান করতো, যেমন- গাছপালা ও নদী। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলো পালনের কাজটি দেখভাল করতেন যাজকগণ। সাধারণত পরিবারের কর্তাব্যক্তিরাই এই পদটি অলঙ্কৃত করতেন।

৫. ভাইকিংরা ছিলো মূর্খ ও বর্বর

তৎকালীন খ্রিস্টধর্মাবলম্বী লেখকেরা ভাইকিংদের মূর্খ ও বর্বর বলেই মনে করতেন। কিন্তু, বাস্তবতা হলো এ কথাটিও সত্য না। বেশ জটিল এক হস্তলিপির বিকাশ ঘটেছিল এই ভাইকিংদের হাত ধরে, যা ‘রুন’ নামে পরিচিত। প্রতীকে ভরপুর এই রুনিক বর্ণমালার প্রতিটি বর্ণই আবার আলাদা আলাদা শব্দের সাথেও সম্পর্কিত ছিলো। যেমন- রুন ‘এফ’কে তারা বলতো ‘ফেওহ্‌’, যার অর্থ ধনসম্পদ বা গবাদিপশু। আধ্যাত্মিক বিভিন্ন অর্থও বহন করতে পারতো রুনিক বর্ণগুলো। শুরুর দিকে পাথরে খোঁদাই করা হলেও কালক্রমে চিরুনি ও অস্ত্রের মতো ব্যক্তিগত নানা জিনিসেও এই রুন খোঁদাই করা হতো।

Image Source: Wallpaper Safari

ভাইকিংদের অসভ্য, বর্বর, মূর্খ বলার উপায় তো নেই-ই, বরং মানবজাতির ইতিহাসের অন্যতম সেরা নৌ-প্রকৌশলী ও ভ্রমণকারী বলা হয়ে থাকে তাদের। তৎকালীন বিভিন্ন শিল্পকর্ম থেকে তাদের সমাজে নৌকার গুরুত্ব সহজেই উপলব্ধি করা যায়। নবম শতাব্দী নাগাদ তারা সময়ের সাপেক্ষে এতটাই উন্নত জাহাজ তৈরিতে সক্ষম হয়েছিল যে, সেগুলোর অনায়াসে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের দুর্গম পথ পাড়ি দিতে সক্ষম ছিলো। আধুনিক যুগের আগে কোনো জাতিই তাদের মতো এতটা দূরদূরান্তে ভ্রমণ করেনি। আর সেসব ভ্রমণে তারা যে মাত্রার দূঃসাহসিকতার পরিচয় দিতো, সেটাও ছিলো অকল্পনীয়।

৬. নারীদের সাথে পশুর ন্যায় আচরণ করতো ভাইকিংরা

এতক্ষণ ধরে আলোচনা করা পাঁচটি বিষয়ের মতো এ বিষয়টিকেও পুরোপুরিই উড়িয়ে দিতে হয়। কারণ ভাইকিং সমাজে নারীদের ভূমিকা ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন পরিবারের পুরুষ সদস্যরা নানাবিধ কাজে দিনের পর দিন ঘরের বাইরে কাটাতো, তখন পরিবার সামলানো, ঘরবাড়ি ও সম্পত্তির দেখাশোনার যাবতীয় দায়িত্ব এসে পড়তো নারীদের কাঁধেই। বেশ কিছু নারীর সামরিক দক্ষতার দরুন তাদেরকে সামরিক বাহিনীর নেতৃস্থানীয় পদ দেয়ার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল।

Image Source: Genetic Literacy Project

সমাজে নারীদের বেশ সম্মানের চোখে দেখা হতো। সমাজের প্রয়োজনে আধ্যাত্মিক নানা ভূমিকা পালনেও পিছপা হতেন না নারীরা। অনেক নারীর কবরে পাওয়া জাদুদণ্ড এ বিষয়েরই সাক্ষ্য দেয়। যদি স্বামী অসম্মানজনক আচরণ করতেন কিংবা গায়ে হাত তুলতেন, তবে তাকে তালাক দেয়ার অধিকারও ছিলো একজন ভাইকিং নারীর।

৭. বেশ উষ্কখুষ্ক এবং অপরিপাটি ছিলো ভাইকিংরা

বিভিন্ন সময়ই ভাইকিংদের এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেন তারা বেশ বড় বড় চুল-দাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আবার তাদের জীবনটাও বেশ অগোছালো। তবে প্রকৃত সত্যের সাথে এরও রয়েছে বিস্তর ফারাক।

Image Source: Wallpapers

ভাইকিংদের ব্যবহার্য অসংখ্য চিরুনি ও রেজরের সন্ধান আমাদের এটাই জানান দেয় যে, নিজেদের সাজসজ্জার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে তারা মোটেও বেখেয়ালী ছিলো না। তাদের বাসস্থানগুলো মোটেই অন্ধকারাচ্ছন্ন, অপরিষ্কার কুঁড়েঘরের মতো ছিলো না। বরং সেগুলো হতো বেশ বড়সড়, আকর্ষণীয় হলের মতোই।

খাবারদাবারের বেলায় বেশ সচেতন ছিলো তারা, বিশেষ করে প্রচুর পরিমাণে মাছ থাকতো তাদের খাদ্যতালিকায়। অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের বাসস্থানগুলো সমুদ্রের তীরে হওয়ায় এতে আসলে অবাক হবার মতো কিছু নেই। তাদের মলমূত্র ত্যাগের স্থানগুলো পরীক্ষা করে জানা গেছে- এল্ক (বৃহদাকৃতির হরিণ), ভালুক, পাফিন (দীর্ঘ ঠোঁটের সামুদ্রিক পাখিবিশেষ), স্যামন ও ট্রাউট মাছ নিয়মিত থাকতো তাদের খাদ্যতালিকায়।

This Bangla article focuses on discussing some of the most known misconceptions about the Vikings. Necessary references have been hyperlinked.

Feature Image: ahmad619saeed.wordpress.com

Related Articles