১৭৮৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর। হিজ ম্যাজেস্টিস শিপ বাউন্টি রওনা হলো দক্ষিণ সাগরীয় দ্বীপ তাহিতির পথে। কয়েক দিনের মধ্যেই অসন্তোষের বীজ রোপিত হল নাবিকদের মনে। জাহাজ যত এগিয়ে চলল ততই বাড়তে লাগল অসন্তোষ। ফিরতি পথে সেটা চূড়ান্ত রূপ নিলো। কয়েকজন নাবিকের সহায়তায় বিদ্রোহ করে জাহাজ দখল করে নিল মেট ফ্লেচার ক্রিশ্চিয়ান। ক্যাপ্টেন উইলিয়াম ব্লাইকে আঠারোজন সঙ্গীসহ ছোট একটা নৌকায় ভাসিয়ে দেয়া হলো খোলা সাগরে। তারপর?
চার্লস নর্ডহফ ও জেমস নরম্যান হল রচিত দ্য বাউন্টি ট্রিলজির তিন খণ্ড অর্থাৎ মিউটিনি অন দ্য বাউন্টি, ম্যান অ্যাগেইন্সট দ্য সি এবং পিটক্যাইম’স আইল্যান্ড বই তিনটিতে উঠে এসেছে ইতিহাস বিখ্যাত বাউন্টি বিদ্রোহের আদ্যোপান্ত। সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত সেই উপন্যাসের পেছনের কাহিনীটি নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
১৭৮৭ সালে ব্রিটিশ রয়েল নেভি কর্তৃক ছোট একটি বাণিজ্য জাহাজ কেনা হয়, নাম তার ‘এইচ এম এস বাউন্টি‘। নাবিক ও অফিসার মিলে সেখানে মত লোকসংখ্যা ছিল ৪৬ জন, জাহাজের দৈর্ঘ্য ছিল ২৭.৭ মিটার আর ওজন ছিল প্রায় ২১৫ টন। রয়েল নেভির হাতে পড়ে বাণিজ্য জাহাজ পরিণত হয় সশস্ত্র যুদ্ধজাহাজের কাছাকাছি পর্যায়ে। রাজকীয় জাহাজটিকে ডাকা হতো ‘হিজ ম্যাজেস্টিস শিপ বাউন্টি’ বলে। ১৭৮৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ইংল্যান্ড থেকে তাহিতির উদ্দেশ্যে যাত্রা করে বাউন্টি। ৩৩ বছর বয়সী ক্যাপ্টেন উইলিয়াম ব্লাইের তত্ত্বাবধায়নে ৪৪ জন ব্রিটিশ রয়েল নেভির সদস্য ও ২ জন উদ্ভিদ বিজ্ঞানীকে নিয়ে রওনা হয় বাউন্টি।
সে সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বীপগুলোতে খাদ্য সরবরাহ করার দায়িত্ব ছিল ব্রিটিশদের উপর। বেশ কষ্টসাধ্য এই কাজটি সমাধা করার উপায় বাতলে দেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী স্যার জোসেফ ব্যাঙ্ক। তার পরামর্শে তাহিতি দ্বীপ থেকে রুটি ফলের চারা সংগ্রহ করতে বাউন্টিকে নিয়ে এক অভিযানের আয়োজন করে ব্রিটিশ রয়েল সোসাইটি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের তৎকালীন ক্রীতদাসদের জন্য স্বল্পমূল্যে খাদ্যের যোগান দিতে এর চেয়ে ভালো বুদ্ধি আর হতে পারে না।
যথাসময়ে তাহিতিতে পৌঁছে গেল বাউন্টি, রুটি ফলের চারাও পরিকল্পনা মাফিক সংগ্রহ করা হলো, ফিরতি পথে যাত্রার প্রস্তুতি নিল সবাই। কিন্তু ১৭৮৯ সালের ২৮ এপ্রিলের প্রথম প্রহরে পাল্টে যায় সব হিসাব-নিকাশ। তাহিতি থেকে বেরিয়ে আসার দুই সপ্তাহ পরে ক্যাপ্টেন ব্লাইের ঘুম ভাঙে বুকের উপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা এক জোড়া হাতের চাপে। চোখ খুলে দেখতে পেলেন তার ঘরে দাঁড়িয়ে আছে সশস্ত্র একদল নাবিক, যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে ২৩ বছর বয়সী মাস্টার মেট ফ্লেচার ক্রিশ্চিয়ান।
টেনে-হিঁচড়ে ব্লাইকে নিয়ে যাওয়া হলো জাহাজের ডেকে, মাস্কেট পয়েন্টের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে তিনি দেখতে পেলেন বিদ্রোহীরা জাহাজের সব লোকজনকে দু’ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। এক দলে রয়েছে ব্লাইের অনুগত রয়েল নেভির সদস্যরা, অন্যদিকে ক্রিশ্চিয়ানের অনুসারীরা। ক্রিশ্চিয়ানের অধীনে বিদ্রোহ ঘোষণাকারীরা ব্লাইের পক্ষের মোট ১৮ জনকে সোজা জাহাজ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় একটি নৌকায়। উত্তাল সাগরের বুকে ২৩ ফুট লম্বা সেই নৌকায় শুরু হয় ব্লাইদের নতুন অভিযান।
বিদ্রোহীদের কাছে অনেক অনুনয়-বিনয় করে ১৯ জনের জন্য প্রায় ৫ দিনের খাদ্য ও পানীয়ের রসদ যোগাড় করে নির্বাসিতরা। ছোট্ট সে নৌকায় না ছিল কোনো মানচিত্র, না ছিল চার্ট। ক্যাপ্টেন ব্লাইের কাছে অবশ্য ভাঙাচোরা একটা কম্পাস। এই সামান্য সম্বল নিয়েই দু’ভাগ হলে গেল বাউন্টির পুরো দল। খুশিতে ডগমগ হয়ে ওঠে বিপ্লবীরা। এই সামান্য রসদ নিয়ে ব্লাইরা যে আর কোনোদিন ইংল্যান্ডে ফিরতে পারবে না, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না তাদের মনে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক। শত-সহস্র বিপদ মোকাবিলা করে প্রতিকূলতাকে জয় করেন ব্লাই ও তার সঙ্গীরা। ৩,৬১৮ নটিক্যাল মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের তাইমোরে পৌঁছে যায় দলটি। সম্প্রতি বাউন্টির ইতিহাস মাথায় রেখে চ্যানেল ৪ এর একটি শোতে নয়জন নাবিক মিলে এই রাস্তা পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করেন।
সব অভিযান নিয়েই তো গল্প হয় না, সব অভিযান এতটা খ্যাতি অর্জন করে না। বাউন্টির অভিযান নিয়ে এত শোরগোল হওয়ার পিছনে অন্যতম প্রধান কারণ ক্যাপ্টেন ব্লাই নিজে। মাত্র ৭ বছর বয়সে রয়েল নেভিতে যোগ দেয়া উইলিয়াম ব্লাই বাউন্টি অভিযানের সময় লেফটেন্যান্ট পদধারী হলেও তাকে সবাই ক্যাপ্টেন বলেই ডাকতো। বদমেজাজি, একরোখা আর বিচক্ষণ ব্লাইের রগচটা স্বভাবের জন্যই ঘটে এই বিদ্রোহ, আবার তার এই স্বভাবের কারণেই ১৭৯০ সালে শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের দেখা পায় নির্বাসিত ক্রুরা। ৫ দিনের খাবার অল্প অল্প করে ভাগ করে বেশ কয়েকদিন চালিয়ে নেন ব্লাই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ করে কী এমন ঘটল যে মাস্টার মেট ফ্লেচার ক্রিশ্চিয়ান ব্লাইের উপর এত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল? জানতে হলে ফিরে তাকাতে হবে পেছনের দিকে। যাত্রার শুরুর দিকেও কিন্তু ব্লাই আর ক্রিশ্চিয়ানের সম্পর্ক বেশ ভালো ছিল। বাউন্টির অধিকাংশ সদস্যকে ব্লাই নিজে বাছাই করে নিয়েছিলেন। ব্লাইের কাছে জাহাজের শৃঙ্খলার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই ছিল না। কাজেই তিনি সবাইকে একটি নিয়মের বেড়াজালের মধ্যে আটকে রাখতেন বলা যায়। বিষয়টি নিয়ে প্রথম প্রথম কেউ কোনো আপত্তি করেনি। কিন্তু বিপত্তি ঘটল তাহিতি দ্বীপে পৌঁছানোর পরে। ওখানে প্রায় ৫ মাস অবস্থানকালে জাহাজের সদস্যদের উপরে কর্তৃত্ব কমতে থাকে ব্লাইের। সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পিছপা হয়না ক্রিশ্চিয়ানও। স্থানীয় সর্দার কন্যা মাওয়াতুয়ার সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে সে।
ঘটনাটি ব্লাইের কানে আসতে খুব বেশি সময় লাগে না। নাচ, গান, মদ আর ফুর্তিতে মত্ত থাকা নাবিকদের বারংবার নিষেধ করার পরও তারা ব্লাইের কথা খুব একটা আমলে নেয় না। এতদিনে পানিতে ভেসে ভেসে ডাঙার স্বাদ ভুলতে থাকা নাবিকরা গা ভাসিয়ে দেয় ক্ষণিকের এই আনন্দে। ব্যাপারটা মানতেই পারছিলেন না ব্লাই। তিনি নাবিকদের হুমকি দিতে থাকেন, ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে সবার নামে রিপোর্ট করবেন তিনি। এবার বেশ ভয় পেয়ে যায় ক্রিশ্চিয়ানসহ আনন্দে মেতে থাকা নাবিকদের কয়েকজন। সত্যি সত্যি যদি ব্লাই তাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করে, তাহলে চাকরি তো তাদের থাকবেই না, উপরন্তু দেশের বাইরে গিয়ে এহেন আচরণ করার কারণে কোর্ট মার্শাল পর্যন্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
এ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে কী করা যায় ভাবছিল ক্রিশ্চিয়ান আর তার দল। সব সমস্যার সহজ একটি সমাধান ছিল ব্লাইের ইংল্যান্ড ফেরার রাস্তা চিরতরে বন্ধ করে দেয়া। ক্রিশ্চিয়ানের সাথে ব্লাইের পূর্ব সুসম্পর্কের জের ধরে তাকে আর নিজ হাতে খুন করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি মাস্টার ক্রিশ্চিয়ান। তাই বিকল্প হিসেবে ব্লাই ও তার পক্ষে কথা বলতে পারে এমন সদস্যদের নিরস্ত্র অবস্থায় খোলা সাগরে ছেড়ে দেয়াটাকেই ভালো মনে করে তারা। তাহিতি ছেড়ে আসার তিন সপ্তাহ পর পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত করার উদ্যোগ নেয় ক্রিশ্চিয়ান।
ব্লাইকে জাহাজ থেকে নির্বাসিত করা হচ্ছে শুনে নিরপেক্ষদের অনেকেই তার সাথে চলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ২৩ ফুটের নৌকায় স্থান সংকুলান না হওয়ায় থেকে যেতে হয় তাদের। তাইমোরে পৌঁছে স্ত্রী আর রয়েল নেভিকে নিজের অবস্থানের কথা চিঠি লিখে জানান ব্লাই। ব্লাই বেঁচে ফিরতে পারবে সে কথা না ভাবলেও দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ বাউন্টিকে খুঁজতে কেউ না কেউ অবশ্যই আসবে এ কথা জানত ক্রিশ্চিয়ান। ওদিকে বান্ধবী মাওয়াতুয়ার কাছে ফিরে যাওয়ার একটা তাগিদও কাজ করছিল তার মধ্যে। কিন্তু তাহিতিতে ফিরে যাওয়া যে নির্ঘাত বোকামি হবে, সেটা বোঝার মতো বুদ্ধি ক্রিশ্চিয়ানের ছিল।
কাজেই তাহিতি থেকে প্রায় ৪৫০ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থিত তুবাই দ্বীপকে তারা নিজেদের ঘাঁটি বানানোর লক্ষ্যে এগিয়ে চলে। ১৭৮৯ সালের ২৮ মে তারা তুবাই দ্বীপে পৌঁছে। এখানে এসেও কলহপ্রিয় ক্রিশ্চিয়ানরা খুব একটা ভালো থাকতে পারল না। স্থানীয়দের সাথে সংঘর্ষ বাঁধিয়ে গোটা দ্বীপটিকেই দখল করে নেয় তারা। এবার নিশ্চিন্তমনে প্রেয়সীর কাছ থেকে একবার ঘুরে আসার সিদ্ধান্ত নেয় ক্রিশ্চিয়ান। কিন্তু একবার দ্বীপ ছেড়ে চলে গেলে পরবর্তীতে ক্ষমতা বেদখল হয়ে যেতে পারে মনে করে শেষ পর্যন্ত ক্রিশ্চিয়ান আর তাহিতি ফিরে যায় না। তবে দলের প্রায় ১৬ জন সদস্য তাহিতিতে চলে যায় আর ক্রিশ্চিয়ানের সাথে রয়ে যায় ৮ জন সদস্য।
১৭৮৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদ্রোহীরা যেখানে নিজেদের থিতু করার জন্য এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে, তার কিছুদিন পর অর্থাৎ ১৭৯০ সালের ১৪ মার্চ ইংল্যান্ডে পৌঁছে যান ব্লাই। তার কাছ থেকে পুরো ঘটনা শুনে রয়েল নেভি ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে বিদ্রোহীদের ধরে উপযুক্ত শাস্তি দিতে। তাহিতিতে আশ্রয় নেয়া ১৬ বিদ্রোহী ধরা পড়ে সে বছরের নভেম্বর মাসে পরিচালিত এক অভিযানে। কিন্তু পালের গোদাকে খুঁজে পাওয়া আর সম্ভব হয়নি, উদ্ধার করা যায়নি বাউন্টিকেও। এই ১৬ জনকে তাহিতিতে নামিয়ে দিয়ে ক্রিশ্চিয়ানের অনুচররা খুব সম্ভবত পিটকেয়ারন আইল্যান্ড নামক একটি দ্বীপে আশ্রয় নেয়।
পরবর্তীতে গ্রেপ্তার করা ১৬ নাবিকের বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শাল জারি করে রয়েল নেভি। বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হয় তাদের। এদিকে ক্যাপ্টেন ব্লাই ক্রিশ্চিয়ান ও তার সহযোগীদের বাকি অংশকে খুঁজতে থাকেন অবিরত। শেষমেশ বাউন্টির খোঁজ পাওয়া যায় পিটকেয়ারন আইল্যান্ডে, ১৮০৮ সালে। কিন্তু সেখান থেকে কোনো জীবিত মানুষকে আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বিদ্রোহ করে ক্যাপ্টেন ব্লাইকে শিক্ষা দিতে গিয়ে নিজেই কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেল ক্রিশ্চিয়ান। শিশুতোষ গল্প হিসেবে এই বিদ্রোহের কাহিনীটি ইংল্যান্ডে খুব জনপ্রিয়।
ফিচার ইমেজ- wikimedia.org