গণহত্যা কিংবা আত্মহত্যা– উভয় কাজেই নাৎসিদের কাছে সায়ানাইড ছিল বেশ জনপ্রিয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন গণহত্যায় সায়ানাইডের বহুল ব্যবহার শিউরে উঠার মতো। নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে ইহুদী গণহত্যায় সায়ানাইডসহ অন্যান্য বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে সায়ানাইড সমৃদ্ধ কীটনাশক যাকোলিন-বি, যা একটি নির্দিষ্ট ঘরে বন্দীদের উপর স্প্রে করে দেওয়া হতো। গোসলের পানির সাথে এ কীটনাশক মিশিয়ে দেওয়া হতো। অনেক সময় নাৎসিরা গোসলখানায় পানির বদলে এই কীটনাশক সরাসরি মানুষের উপর স্প্রে করে হত্যা করতো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বহু জার্মান অফিসার বন্দী হওয়ার মূহুর্তে বা নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে সায়ানাইড ক্যাপসুল খেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। মিত্র বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার ভয়েই যে শুধু তারা আত্মহত্যা করতো এমন নয়। হিটলারের বিরাগভাজন হলে পরবর্তী নির্যাতনের ভয়েও অনেকে আত্মহত্যা করেছিল।
হেরম্যান গোরিং
হেরম্যান গোরিং ছিলেন কুখ্যাত গেস্টাপো বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা। জার্মানিতে নাৎসি উত্থানের শুরু থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষপর্যন্ত গোরিং ছিলেন এক জীবন্ত বিভীষিকার নাম। ১৯৩৪ সালে হিটলার তার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এমন নেতাদের সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। গোরিং তার কুখ্যাত গেস্টাপো বাহিনীর মাধ্যমে মাত্র তিনদিনে ৮৫ জন সম্ভাব্য উদীয়মান নেতাকে হত্যা করেন। নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোর গঠন কেমন হবে সে পরিকল্পনাও তার মাথা থেকে বেরিয়েছিল।
যুদ্ধ শেষে গোরিং বন্দী হন এবং ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে তার বিচার শুরু হয়। বিচারে গোরিংকে ফাঁসীর হুকুম দেওয়া হলে তিনি আদালতের কাছে ফাঁসীর বদলে গুলি করে হত্যা করার আবেদন করেন। আদালত তার আবেদন গ্রহণ না করায় ফাঁসীর দিনের পূর্বরাতে জেলে নিজ কক্ষে সায়ানাইডের ক্যাপসুল খেয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন।
ওদিলো গ্লোবনিক
ওদিলো গ্লোবনিক নাৎসি নেতা হিসেবে স্বল্প পরিচিত। অথচ পুরো ইউরোপ জুড়ে ইহুদী নিধনের যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তার প্রায় প্রতিটি ধাপের সাথে জড়িত ছিলেন তিনি। গ্লোবনিক ছিলেন অস্ট্রিয়ান নাগরিক। হিটলার অস্ট্রিয়া দখলের আগে তিনি সেখানে নাৎসি পার্টি সংগঠিত করার কাজে অত্যন্ত তৎপর ছিলেন। গ্লোবনিক মনে-প্রাণে নাৎসিবাদে বিশ্বাস করতেন। দশ লাখের অধিক পোলিশ নাগরিককে হত্যার সাথে তিনি সরাসরি জড়িত। ১৯৪৫ সালের ৩১ মে, গ্লোবনিক অস্ট্রিয়াতে মিত্রবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার এড়ানোর জন্য সায়ানাইড ক্যাপসুল খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
জোসেফ গোয়েবল ও তার পরিবার
১৯৪৫ সালের ১লা মে; সোভিয়েত বাহিনী বার্লিনের দিকে এগিয়ে আসছে। হিটলার ও তার সঙ্গিনী ইভা ব্রাউন ততক্ষণে আত্মহত্যা করেছেন। নাৎসি যে সাম্রাজ্যের স্বপ্ন তারা দেখেছিল, তা ধ্বংসস্তুপের নিচে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। নাৎসি বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্য সোভিয়েতদের হাতে ধরা পড়লে কী হতে পারে সেই ভাবনায় আতংকিত হয়ে পড়েছিল। নাৎসি বড় বড় নেতাদের অনেকেই মাটির নিচের সুরক্ষিত বাংকারে লুকিয়ে পড়ে, যার মধ্যে মন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলও ছিলেন। তার সাথে ছিল তার ৬ সন্তান।
হিটলারের মৃত্যুর পর গোয়েবল অগ্রসরমান সোভিয়েত বাহিনীকে জানান, হিটলার মৃত্যুবরণ করেছেন এবং অস্ত্র বিরতির প্রস্তাব দেন। সোভিয়েতরা এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করলে গোয়েবল সপরিবারে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। তার নির্দেশে তার ৬ শিশু সন্তানকে সায়ানাইড প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়। এ কাজে প্রথম হেলমুট কুর্জ নামক এক ডেন্টিস্টকে পাঠানো হয়েছিল, যিনি নিষ্পাপ ছয়টি শিশুকে মরফিন দিয়ে অজ্ঞান করে ফেললেও তাদের হত্যা করতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে লুডউইগ স্ট্যামফেগার নামের অপর এক চিকিৎসক শিশুদের দাঁতের ফাঁকে সায়ানাইড ক্যাপসুল দিয়ে মুখটা শক্ত করে চেপে ধরলে সায়ানাইড শিশুদের মুখের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের মৃত্যু হয়। গোয়েবল তার স্ত্রীসহ পরবর্তীতে আত্মহত্যা করেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়, তাদের আত্মহত্যায় সায়ানাইড ও গুলির ব্যবহার পাওয়া যায়।
রিচার্ড গ্লকস
মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রায় ভীত হয়ে কাপুরুষের মতো আত্মহত্যাকারী জার্মান নাৎসি অফিসারদের তালিকা বেশ বড়। তারা সবাই নিজেদের অপরাধ সর্ম্পকে সচেতন ছিলেন। তারা কি অনুশোচনা থেকে আত্মহত্যা করেছেন, নাকি লজ্জা ও ভয় থেকে বাঁচতে এ পথ বেছে নিয়েছিলেন তা কখনোই জানা যাবে না। রিচার্ড গ্লকস তেমনি একজন নাৎসি, যিনি যুদ্ধের শেষের দিকে আত্মহত্যা করেছিলেন।
হিটলার ক্ষমতা গ্রহণের আগে গ্লকস ছিলেন একজন সাধারণ সৈন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোর ইন্সপেক্টর। তিনি বিভিন্ন ক্যাম্প নিয়মিত পরিদর্শন করতেন এবং ঠিক করতেন কোন ক্যাম্পের কতজনকে, কবে, কোথায় হত্যা করা হবে। ইহুদী ও যুদ্ধবন্দীদের হত্যার সাথে গ্লকস ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধের শেষ দিকে তিনি এক হাসপাতালে আশ্রয় নেন এবং পটাশিয়াম সায়ানাইড ব্যবহার করে আত্মহত্যা করেন। তবে কিছু কিছু সূত্রমতে, তিনি ইহুদীদের হাতে নিহত হয়েছিল।
হ্যানস গর্গ ভন ফ্রিডবার্গ
হ্যানস গর্গ ভন ফ্রিডবার্গ ঠিক নাৎসি যুদ্ধাপরাধী ছিলেন না। তিনি ছিলেন নাৎসি নৌবাহিনী ক্রিগমেরিনের এডমিরাল। একইসাথে জার্মান সাবমেরিন অর্থাৎ ইউ বোটগুলোর অভিযানও তিনি পরিচালনা করতেন। তার বাহিনী সমুদ্রে মিত্রবাহিনীর যাতায়াতকে ভীষণ বিপদজনক করে তুলেছিল। হ্যানস ছিলেন একজন পেশাদার সৈনিক। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের কোনো অভিযোগ ছিল না। তিনি জার্মানির আত্মসর্মপণের দলিল তৈরিতে মিত্রবাহিনীকে সহায়তাও করেছিলেন। তবে তিনি শুনেছিলেন, তার পদের কারণে তাকেও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। ১৯৪৫ সালের ২৩ মে এডমিরাল হ্যানস গর্গ ভন ফ্রিডবার্গ সায়ানাইড ক্যাপসুলের সাহায্যে আত্মহত্যা করেন।
মার্টিন বোরম্যান
নাৎসি পার্টির হেড অব চ্যান্সেলারি মার্টিন বোরম্যান এক রহস্যময় চরিত্র। হিটলারের সাথে নিবিড় যোগাযোগ ও একত্রে কাজ করার সুবাদে হিটলারের উপর তার বেশ প্রভাব ছিল। তিনি হিটলারের বহু সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে যুদ্ধের অনেক ঘটনায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনিই বন্দীদের দাস হিসেবে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করার প্রথা চালু করেন। যুদ্ধ শেষে তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। তখন ধারণা করা হয়, বোরম্যান দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দেশে পালিয়ে গেছেন। যুদ্ধ শেষে ডাক বিভাগের এক কর্মচারী দাবী করেছিলেন, তিনি বোরম্যান ও লুডউইগ স্ট্যামফেগার (যে ডাক্তার গোয়েবলের সন্তানদের সায়ানাইড প্রয়োগ করে হত্যা করেছিলেন) এর মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছেন। ১৯৯৮ সালে এক ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে সেই ডাক কর্মচারীর দাবীর সত্যতা প্রমানিত হয়। ১৯৪৫ সালের ২রা মে বোরম্যান ও লুডউইগ সায়ানাইড দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।
রবার্ট রিটার ভন গ্রিম
লন্ডনের উপর যে বিমান হামলায় পুরো ইংল্যান্ড কেঁপে উঠেছিল তার প্রধান পরিকল্পনাকরী ছিলেন ভন গ্রিম। বিখ্যাত ব্যাটল অব ইংল্যান্ডের পরিকল্পনাকারী হিসেবে যেমন তিনি ছিলেন, তেমনি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে পরিচালিত অপারেশন বারবারোসার পরিকল্পনার সাথেও তিনি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। শুরুতে ভন গ্রিম ছিলেন একজন এয়ারম্যান। পরবর্তীতে তিনি ফিল্ড মার্শাল পর্যন্ত পদোন্নতি পান এবং পুরো বিশ্বযুদ্ধ জুড়ে মিত্র বাহিনীর মনে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। ১৯৪৫ সালের ৮ মে ভন গ্রিম অস্ট্রিয়াতে আমেরিকান সেনাদের হাতে বন্দী হন। বন্দী থাকা অবস্থায় তিনি ২৪ মে সায়ানাইড ক্যাপসুল দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
হিমলার
নাৎসিদের কুখ্যাত নামের তালিকায় প্রথমদিকেই থাকবে হিমলারের নাম। তিনি ১৯২৩ সালে নাৎসী পার্টিতে যোগ দেন এবং দ্রুতই দলের প্রথমসারিতে চলে আসেন।
হিমলার কুখ্যাত এসএস বাহিনীর স্রষ্টা। অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীরা ইহুদী নিধনের বিভিন্ন কাজে সরাসরি অংশ নেওয়ার কারণে অপরাধী। আর ইহুদী নিধন করার মূল পরিকল্পনাকারী হলেন এই হেনরিখ হিমলার। ১৯৪৩ সালে হিমলারকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আর্শ্চযের ব্যাপার হলো, সেই বছরই তাকে নাৎসি বাহিনী থেকে বহিষ্কার করা হয়, যদিও হিটলার তাকে হত্যা করেননি। যুদ্ধের শেষের দিকে হিমলার পালিয়ে যাওয়ার পথে মিত্রবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। ন্যুরেমবার্গে যুদ্ধাপরাধের বিচার এড়ানোর জন্য ১৯৪৫ সালের ২৩ মে তিনি সায়ানাইড ক্যাপসুল খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
অ্যাডলফ হিটলার
হিটলারের মৃত্যু সর্ম্পকে সার্বজনীন একক কোনো বর্ণনা আজও পাওয়া যায়নি। বেশিরভাগ বর্ণনামতে, মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন হিটলার। কিন্তু সায়ানাইড যার প্রিয় মারণাস্ত্র, তার মৃত্যুর সাথে সায়ানাইডের ব্যবহার না থাকাটা কেমন জানি বেমানান দেখায়। ১৯৬৮ সালে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থার এক সাবেক কর্মচারী তার বইতে দাবী করেন, সোভিয়েত রেড আর্মির সেনারা হিটলারের মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছিল এবং মৃতদেহের ময়নাতদন্তে তার দেহে সায়ানাইডের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
ইতিহাসবিদদের একটি অংশ মনে করে, হিটলার ইভা ব্রাউনের সাথে সায়ানাইড ক্যাপসুল গ্রহণ করার পর নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন। ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল ঠিক কীভাবে হিটলার মৃত্যুবরণ করেছিলেন সেই বর্ণনা সম্পর্কিত ধোঁয়াশা কোনোদিনই হয়তো আর পরিষ্কার হবে না। তবে নাৎসি সমরনায়কদের গণহত্যা ও আত্মহত্যায় সায়ানাইডের প্রতি বিশেষ পক্ষপাতীত্ব থাকায় হিটলারের আত্মহত্যায় সায়ানাইড ক্যাপসুলের কোনো বিশেষ ভূমিকা না থাকলে সেটাই হবে বিস্ময়কর ঘটনা।