বর্তমানে বিশ্বের মোট ৬৭টি দেশের সরকারী ভাষা ইংরেজি। আর ইংরেজি ভাষার সর্বপ্রথম অভিধানটি লেখা হয়েছিল ১৭৫৫ সালে। অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধানের দ্বিতীয় সংস্করণে মোট ১,৭১,৪৭৬টি প্রচলিত ইংরেজি শব্দ ও ৪৭,১৫৬টি অপ্রচলিত শব্দ রয়েছে। আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এই ইংরেজি ভাষার সর্বপ্রথম শব্দটি কী ছিল?
যেহেতু কোনো শব্দ উচ্চারণ করার সাথে সাথেই শব্দটি বাতাসে মিলিয়ে যায়, তাই একটি ভাষার উৎপত্তি ঠিক কবে হয়েছিল তা একবারে সঠিকভাবে বলা কঠিন। তবে শব্দকে কোনো কিছুতে লিখে রাখা হলে সেটি থেকে কিন্তু সেই ভাষাটি কবে শুরু হয়েছিল তার ধারণা পাওয়া যায়। তেমনিভাবে, এখনো পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে পুরনো লিখিত ইংরেজি শব্দের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল ১৯৩০ সালের শুরুর দিকে ইংল্যান্ডের নরউইচে চালানো এক প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানে। এই শব্দটি লেখা হয়েছিল প্রাচীন রুনিক হরফে, একটি হরিণের হাড়ের উপর খোদাই করে। সেখানে লেখা ছিল মাত্র একটি শব্দ, আর তা হলো ‘raihan’। কিন্তু এই শব্দের অর্থ কী? কী বোঝানো হয়েছে এটি দিয়ে? চলুন আজকে জানা যাক তা সম্পর্কে।
অজানা শব্দের রহস্য
আমরা আগেই জেনেছি, কোনো ভাষার উৎপত্তি সঠিকভাবে নির্ণয় করা কঠিন। এর পেছনে আরেকটি কারণ রয়েছে। আর সেটি হলো যখন কোনো একটি নতুন ভাষার উৎপত্তি হয় তখন তা কিন্তু একেবারে শূন্য থেকে হয় না। ইতিমধ্যে প্রচলিত ভাষাগুলোর সংমিশ্রণ কিংবা পরিবর্তন হয়েই কিন্তু নতুন একটি ভাষার উৎপত্তি ঘটে। তাই ইংরেজি ভাষার উৎপত্তি জানতে হলে আমাদের জানতে হবে ঠিক কবে এটি এর পূর্বপুরুষ জার্মানিক ভাষা হতে পরিবর্তিত হয়ে ইংরেজি রূপ নিয়েছে? আর প্রথম ইংরেজি শব্দ খুঁজতে হলে তাই আমাদের জানতে হবে ঠিক কবে আর কীভাবে একটি জার্মানিক ভাষা এমন একটি স্থানে পৌঁছলো যেখানে এসে এটি ইংরেজি ভাষায় পরিণত হতে পারে।
এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত হওয়া প্রথম ইংরেজি শব্দ ‘রাইহান’ লেখা হাড়টি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল কাইস্টর সেইন্ট এডমান্ড গ্রামের এক সমাধিক্ষেত্রে। সেখানের একটি শবদাহের ছাই সংরক্ষণ করার পাত্রের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল এই হাড়টি। প্রত্নতত্ত্ববিদরা তাই এই হাড়টির নাম রেখেছেন ‘কাইস্টর এস্ট্রাগালাস’ (এস্ট্রাগালাস হলো গোড়ালির হাড়ের নাম)।
কার্বন ডেটিং পদ্ধতির মাধ্যমে দেখা গেছে, এই হাড়টি পঞ্চম শতাব্দীর প্রথম দিককার। অর্থাৎ আনুমানিক ৪২০ খ্রিস্টাব্দের। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ঠিক এই সময়েই ইংরেজি ভাষার ইতিহাস মোড় নিয়েছিল এক ভিন্ন দিকে। এ সময়েই ব্রিটেনে প্রথম অ্যাংলো-স্যাক্সনদের আগমন ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৯ অব্দে অ্যাংলো-স্যাক্সনদের আগমনের পূর্বে সেখানের মানুষ একধরনের ল্যাটিন ও কেল্টিক ভাষার মিশ্রণে কথা বলতো। অ্যাংলো-স্যাক্সনরা এখানে আসার সময় সাথে করে তাদের জার্মানিক ভাষাকে নিয়ে আসে, আর এই জার্মানিক ভাষাই পরবর্তী কয়েকশ বছরে পরিবর্তিত হয়ে ‘ওল্ড ইংলিশ’ হিসেবে ঐ এলাকার প্রধান ভাষায় পরিণত হয়।
আবিষ্কৃত হওয়া হাড়টি বয়সের দিক দিয়ে অ্যাংলো-স্যাক্সন সময়কালকেও ছাড়িয়ে যায়। তবে গবেষণায় দেখা যায় হাড়টির লেখাটি আসলে একধরনের জার্মানিক ভাষায় লেখা। এখন প্রশ্ন হলো, কে বা কারা এই লেখাটি লিখেছিল? রোমানদের হয়ে কাজ করা জার্মানিক গোত্রের কোনো সদস্য? কোনো ভাড়াটে যোদ্ধা? নাকি কোনো লেখক? এ প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। তবে এই ‘রাইহান’ই হলো ইংরেজি ভাষার সূচনার প্রথম দলিল। এখন চলুন জানা যাক, এই ‘রাইহান’ শব্দটির মানে আসলে কী।
অর্থটা কী?
আবিষ্কৃত হাড়ের উপর লেখা এই ‘raihan’ শব্দটির অর্থ কী সেটি এখনো রহস্যে ঢাকা। শব্দটির শেষের ‘n’ হরফটি তৎকালীন জার্মানিক ভাষায় ব্যবহৃত হওয়া সম্বন্ধসূচক বিভক্তির মতো দেখায়। হতে পারে শব্দটির অর্থ আসলে ‘Raiha’s’, অর্থাৎ “এটি রাইহার’। আবার হতে পারে শব্দটি এর মূল ‘rei’ এর সাথে সম্পর্কিত, যার দুটি অর্থ হয়: ‘কর্তন করা’ নয়তো ‘রঙ করা’। আবার শব্দটি এগুলো না বুঝিয়ে যে ব্যক্তি সেই হাড়টি পালিশ করে ব্যবহারযোগ্য করেছিলেন তার নামও হতে পারে।
তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাটি হলো, এই শব্দের অর্থ আসলে হাড়টি যে প্রাণীর দেহ থেকে এসেছে সেই প্রাণীর নাম। পুরনো ইংরেজি ভাষায় এই ধরনের হরিণকে বলা হয় ‘Roe’ যা এসেছে ‘raha’ বা ‘raa’ থেকে। এ শব্দ দুটির তুলনায় ‘Raihan’ শব্দটি ভিন্ন। তবে কালের বিবর্তনে ‘raihan’ শব্দটি পরিবর্তিত হয়ে ‘raha’ হয়ে যেতেই পারে। ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক ডেভিড ক্রিস্টালের মতে, এমনটি হয়তো ঘটেছিল সেসময়। এ তো জানা গেলো শব্দটির অর্থ, এখন চলুন জেনে নিই কেন লেখা হয়েছিল শব্দটি।
কেন হয়েছিল লেখা?
শব্দটির অর্থ বের করার পেছনে আরেকটি সূত্র রয়েছে, আর সেটি হলো এই হাড়টি আসলে কী কাজে ব্যবহৃত হতো সেটি খুঁজে বের করা। সেসময় মৃতদেহ সৎকার করে পুড়িয়ে ফেলার পর তার ছাই একটি নির্দিষ্ট পাত্রে রাখা হতো। এই হাড়টি তেমনই এক পাত্রের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার হলো, ঐ পাত্রের মধ্যে শুধু এই হরিণের হাড়টি নয়, বরং ভেড়া কিংবা ছাগলের এমন আরো অনেকগুলো ক্ষুদ্র হাড় পাওয়া গিয়েছিল। প্রাচীনকালে একটি জনপ্রিয় খেলা ছিল যাকে বলা হতো ‘নাকলবোনস’। এই খেলায় সাধারণত পাঁচটি কিংবা দশটি ভেড়ার গোড়ালির ক্ষুদ্র এস্ট্রাগালাস হাড়কে গুটি বা ‘জ্যাক’ হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
আবিষ্কৃত হওয়া সেই পাত্রের হাড়গুলো গুণে দেখলে দেখা যায়, তা সেই ‘নাকলবোনস’ খেলার এক সেট গুটির সমান। ক্ষুদ্র হাড়গুলো দেখতেও ঠিক সেই খেলার গুটির মতোই ছিল। ফলে গবেষকদের মতো পাত্রের মধ্যের সেই ক্ষুদ্র হাড়গুলো আসলে ‘নাকলবোনস’ খেলার গুটি। তবে হরিণের সেই হাড়টি কিন্তু এই ক্ষুদ্র হাড়গুলো থেকে আলাদা। এটি ছিল তুলনামূলক বড়, পালিশ করা ও আমাদের আলোচ্য শব্দটি খোদাই করা।
গবেষকদের মতে, এটি আসলে ছিল সেই খেলার বড় গুটি। ঠিক যেমন দাবা খেলায় রাজার গুটি, তেমনি এই খেলার শেষ গুটি হলো এই হাড়টি। আর যে ব্যক্তি খেলার জন্য এই হাড়গুলো তৈরি করেছিলেন তিনি কোন প্রাণী থেকে হাড়গুলো নেয়া হয়েছে তার নাম এই শেষ বড় গুটিটিতে লিখে রাখতে চেয়েছিলেন। আর এর ফলেই এই হাড়টির গায়ে লেখা হয়েছিল ‘raihan’। ভাষাতত্ত্ববিদ ডেভিড ক্রিস্টাল জানান, সেসময় কোনো বস্তুর গায়ে তার প্রস্তুতকারক কিংবা যে উৎস থেকে বস্তুটি এসেছে তার নাম খোদাই করে লিখে রাখার প্রচলন ছিল।
তবে এ ধারণাটিই যে সত্য তা কিন্তু কখনোই পুরোপুরি নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে কয়েক হাজার বছর আগে যিনি এই হাড়টির গায়ে ‘Raihan’ শব্দটি লিখেছিলেন তিনি হয়তো ভাবতেও পারেননি এত হাজার বছর পরে কোনো মানুষ তার খোদাই করা সেই লেখাটি পড়বে, সেটি নিয়ে গবেষণা করবে। তবে যেভাবে হাড়টি সংরক্ষণ করা হয়েছিল তা দেখে অবাক হতেই হয়। এত বছর পরও হাড়টির সেই লেখা মোটামুটি অক্ষত অবস্থায় রয়ে গেছে, আর আমাদের জানান দিচ্ছে বিশ্বের প্রাচীনতম ইংরেজি শব্দ সম্পর্কে।