ইন্দোনেশিয়া কর্তৃক পূর্ব তিমুর দখল বিংশ শতাব্দীর এবং স্নায়ুযুদ্ধের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বস্তুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে এশিয়া ও আফ্রিকায় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যগুলোর পতন ঘটে এবং বহু সংখ্যক নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। এই উত্তর–ঔপনিবেশিক (post-colonial) রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব–সংঘাত কোনো নতুন ঘটনা নয়। ভারতীয়–পাকিস্তানি দ্বন্দ্ব, ভিয়েতনামি–কম্বোডীয় দ্বন্দ্ব বা মরোক্কান–আলজেরীয় দ্বন্দ্ব এ ধরনের ঘটনার কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। কিন্তু একটি উত্তর–ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র অপর একটি উত্তর–ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকে দখল ও অঙ্গীভূত করে নিয়েছে– এ রকম ঘটনাকে বিরল বললে অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু ঠিক এই ঘটনাটিই ঘটেছিল ১৯৭৫ সালে ইন্দোনেশিয়া ও পূর্ব তিমুরের ক্ষেত্রে।
‘ইন্দোনেশিয়া প্রজাতন্ত্র’ দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত একটি বৃহৎ দ্বীপরাষ্ট্র। জনসংখ্যার দিক থেকে বর্তমান বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম এই রাষ্ট্রটি ১৯৪৯ সালে নেদারল্যান্ডসের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। অন্যদিকে, ‘পূর্ব তিমুর গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার তিমুর দ্বীপের পূর্বাংশে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। ১৫,০০৭ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট এই রাষ্ট্রটি ১৯৭৫ সালে পর্তুগালের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। অর্থাৎ, ইন্দোনেশিয়া ও পূর্ব তিমুর উভয়েই উত্তর–ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র। উল্লেখ্য, তিমুর দ্বীপের পশ্চিমাংশ বা পশ্চিম তিমুর (১৪,৭৩২ বর্গ কি.মি.) ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব নুসা তেঙ্গারা প্রদেশের অংশ। অর্থাৎ, তিমুর দ্বীপটি ইন্দোনেশিয়া ও পূর্ব তিমুরের মধ্যে বিভক্ত।
১৭০২ সালে পর্তুগিজরা পূর্ব তিমুরের উপনিবেশ স্থাপন করে, অন্যদিকে একই সময়ে ডাচরা বর্তমান ইন্দোনেশিয়া জুড়ে উপনিবেশ স্থাপন করতে শুরু করে। তিমুর দ্বীপের কর্তৃত্ব নিয়ে পর্তুগিজ ও ডাচদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল, কিন্তু ১৯১৩ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি অনুযায়ী দ্বীপটির পূর্বাংশ পর্তুগালের ও পশ্চিমাংশ নেদারল্যান্ডসের অধীনস্থ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান তিমুর দ্বীপ দখল করে নেয়, কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ শেষে দ্বীপটির পূর্বাংশে পর্তুগালের কর্তৃত্ব পুনঃস্থাপিত হয় এবং পশ্চিমাংশ স্বাধীন ইন্দোনেশিয়ার হস্তগত হয়। ১৯৬০–এর দশকে পূর্ব তিমুরে স্বাধীনতা আন্দোলনের সৃষ্টি হয়, কিন্তু পর্তুগালের অন্যান্য উপনিবেশ (যেমন: অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক ও গিনিবিসাউ)-এর মতো এখানে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়নি।
১৯৭৪ সালের এপ্রিলে পর্তুগিজ সশস্ত্রবাহিনীর বামপন্থী অংশ একটি বিপ্লব/অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশটির ডানপন্থী ও উপনিবেশবাদী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং নতুন পর্তুগিজ সরকার পর্তুগিজ উপনিবেশগুলোকে স্বাধীনতা প্রদানের ঘোষণা দেয়। এ সময় পূর্ব তিমুরে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটে– ‘তিমুরিজ গণতান্ত্রিক আন্দোলন’ (পর্তুগিজ: União Democrática Timorense, ‘UDT’), ‘পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতার বিপ্লবী ফ্রন্ট’ (পর্তুগিজ: Frente Revolucionária de Timor-Leste Independente, ‘Fretilin’) এবং ‘তিমুরিজ জনগণতান্ত্রিক সংস্থা’ (পর্তুগিজ: Associação Popular Democratica Timorense, ‘APODETI’)। ইউডিটি ছিল একটি রক্ষণশীল দল, ফ্রেটিলিন ছিল মধ্য বামপন্থী ও স্বাধীনতাকামী এবং প্রায় জনসমর্থনহীন AOPDETI ছিল ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে পূর্ব তিমুরকে অঙ্গীভূত করার পক্ষপাতী।
১৯৭৪ সালে পর্তুগালে সংঘটিত বিপ্লব/অভ্যুত্থানের পর থেকেই ইন্দোনেশিয়া পূর্ব তিমুরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল। ইন্দোনেশীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদাম মালিক পূর্ব তিমুরকে স্বাধীন হতে দেয়ার পক্ষপাতী ছিল। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার ক্ষমতাসীন ‘নিউ অর্ডার’ (ইন্দোনেশীয়: Orde Baru) পূর্ব তিমুরকে দখল করে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে অঙ্গীভূত করে নিতে আগ্রহী ছিল। উল্লেখ্য, ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৬৫–১৯৬৬ সালে সংঘটিত কমিউনিস্টবিরোধী গণহত্যা চলাকালে ইন্দোনেশীয় সেনাপ্রধান জেনারেল সুহার্তো ইন্দোনেশিয়ার শাসনক্ষমতা হস্তগত করেন এবং একটি কট্টর কমিউনিস্টবিরোধী, ডানপন্থী ও পশ্চিমাপন্থী সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই ‘নিউ অর্ডার’ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে।
১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি নাগাদ ইন্দোনেশীয় ‘রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সমন্বয় সংস্থা’ (ইন্দোনেশীয়: Badan Koordinasi Intelijen Negara, ‘Bakin’) পূর্ব তিমুরে আক্রমণ পরিচালনার বিশদ পরিকল্পনা প্রস্তুত করে। ইন্দোনেশীয় সেনাবাহিনীর বিশেষ অপারেশন্স ইউনিট ‘ওপসুস’–এর প্রধান মেজর জেনারেল আলী মুর্তোপো, ‘নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার অপারেশনাল কমান্ড’ বা ‘কোপকামতিব’–এর (ইন্দোনেশীয়: Komando Operasi Pemulihan Keamanan dan Ketertiban, ‘Kopkamtib’) প্রধান অ্যাডমিরাল সুদোমো, কোপকামতিবের ইন্টেলিজেন্স অপারেশন্স প্রধান মেজর জেনারেল বেনি মুরদানি এবং সুহার্তোর ঘনিষ্ঠ বন্ধু লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়োগা সুগামা ছিলেন সুহার্তোর নিউ অর্ডারের মূল ব্যক্তিত্ব এবং পূর্ব তিমুর আক্রমণের মূল উদ্যোক্তা। সুহার্তো প্রথমে পূর্ব তিমুর আক্রমণে উৎসাহী ছিলেন না, কিন্তু পরবর্তীতে নিউ অর্ডারের চাপে তিনি তার মত পরিবর্তন করেন।
এদিকে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে পূর্ব তিমুরের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ইউডিটি ও ফ্রেটিলিন একটি জোট সরকার গঠন করে। ফ্রেটিলিনে এ সময় ক্রমশ মধ্য বামপন্থী ও উগ্র বামপন্থী দুইটি ধারার আবির্ভাব ঘটে। এদিকে ইন্দোনেশীয় গুপ্তচররা ফ্রেটিলিনকে ‘কমিউনিস্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করে পূর্ব তিমুরে ব্যাপক ফ্রেটিলিনবিরোধী প্রচারণা চালাতে শুরু করে। তারা ইউডিটির নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে এবং ফ্রেটিলিনের সঙ্গে জোট ভেঙে দিয়ে এককভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য তাদেরকে প্ররোচিত করে। ১৯৭৫ সালের আগস্টে ইউডিটি জোট ভেঙে দেয় এবং একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একক ক্ষমতা অর্জনের প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু পূর্ব তিমুরে মোতায়েনকৃত ক্ষুদ্র পর্তুগিজ সৈন্যদলের তিমুরিজ সৈন্যদের সিংহভাগ ফ্রেটিলিনের পক্ষে যোগদান করে।
এমতাবস্থায় পূর্ব তিমুরে কার্যত গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এই গোলযোগের মধ্যে পূর্ব তিমুরের পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক প্রশাসন এ অঞ্চলটি ত্যাগ করে এবং এর মধ্য দিয়ে পূর্ব তিমুর কার্যত স্বাধীন হয়ে পড়ে। ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে গৃহযুদ্ধে ফ্রেটিলিন বিজয়ী হয় এবং পূর্ব তিমুরের সিংহভাগ ভূমির ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হয়। ইউডিটির নেতারা পালিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় আশ্রয় নেন। ১৯৭৫ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইন্দোনেশীয় সৈন্যরা পূর্ব তিমুরের অভ্যন্তরে আক্রমণ পরিচালনা করতে শুরু করে, কিন্তু ইন্দোনেশিয়া এটিকে অস্বীকার করে। এই পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের ২৮ নভেম্বর ফ্রেটিলিন আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জন করা।
কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয় এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পূর্ব তিমুরের ঘটনাবলিতে বিশেষ আগ্রহ প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকে। ১৯৭৫ সালের ৭ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব তিমুরের উপর পূর্ণ শক্তিতে আক্রমণ শুরু করে। ‘অপারেশন লোটাস’ (ইন্দোনেশীয়: Operasi Seroja, ‘অপারাসি সেরোজা’) বা ‘অপারেশন কমোডো’ (ইন্দোনেশীয়: Operasi Komodo, ‘অপারাসি কমোডো’) সাঙ্কেতিক নামবিশিষ্ট এই সামরিক অভিযানটি ছিল স্বাধীন ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ সামরিক অভিযান। প্রায় ৩৫,০০০ ইন্দোনেশীয় সৈন্য এই অভিযানে অংশগ্রহণ করে। জনবল ও অস্ত্রবলের দিক থেকে ইন্দোনেশিয়া ছিল পূর্ব তিমুরের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী এবং এজন্য ফ্রেটিলিনের পক্ষে ইন্দোনেশীয়দেরকে পরাজিত করা সম্ভব ছিল না।
১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়া পূর্ব তিমুরে ইউডিটি ও APODETI-র সমন্বয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্থাপন করে। ফ্রেটিলিন গেরিলা পদ্ধতিতে ইন্দোনেশীয় সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকে, এবং এর ফলে ইন্দোনেশীয় সৈন্যদের পক্ষে সহজে পূর্ব তিমুরের সম্পূর্ণ অংশ অধিকার করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই ইন্দোনেশিয়া পূর্ব তিমুরকে তাদের ২৭তম প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করে, কিন্তু যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। ১৯৭৭ সালের প্রথম দিকে ইন্দোনেশিয়া ফ্রেটিলিনকে দমন করার জন্য ‘পরিবেষ্টন ও নিশ্চিহ্নকরণ’ (encirclement and annihilation) নীতি গ্রহণ করে। যুদ্ধের প্রথম দুই বছরে প্রায় ২,০০০ ইন্দোনেশীয় সৈন্য নিহত হয়, এবং অন্যদিকে ইন্দোনেশীয় সৈন্যদের হাতে ৫০,০০০ থেকে ৮০,০০০ তিমুরিজ নাগরিক প্রাণ হারায়।
১৯৭৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পূর্ব তিমুরের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও ফ্রেটিলিনের সুদক্ষ কমান্ডার নিকোলাউ লোবাতো ইন্দোনেশীয় সৈন্যদের হাতে নিহত হন, এবং ১৯৮০ সাল নাগাদ ফ্রেটিলিনের মূল বাহিনীটি পরাজিত হয়। অবশ্য ১৯৮০ ও ১৯৯০–এর দশক জুড়ে ফ্রেটিলিন ইন্দোনেশীয় দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। অবশেষে ১৯৯৮ সালে ইন্দোনেশীয় রাষ্ট্রপতি সুহার্তো ও তার নিউ অর্ডারের পতন ঘটে, এবং ১৯৯৯ সালের ২৫ অক্টোবর জাতিসংঘ পূর্ব তিমুরের শাসনভার গ্রহণ করে। জাতিসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত একটি গণভোটে পূর্ব তিমুরের সিংহভাগ অধিবাসী স্বাধীনতার পক্ষে রায় প্রদান করে, এবং ২০০২ সালের ২০ মে পূর্ব তিমুর পুনরায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
বস্তুত পর্তুগিজ উপনিবেশবাদের ফলে পূর্ব তিমুরে ইন্দোনেশিয়া থেকে স্বতন্ত্র একটি জাতিসত্তার সৃষ্টি হয়েছিল এবং জাতিগত, ধর্মগত ও ভাষাগত দিক থেকে পূর্ব তিমুরের অধিবাসীরা ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য অধিবাসীদের থেকে আলাদা ছিল। ১৯৭৫ সালে ইন্দোনেশীয় আক্রমণের প্রাক্কালে পূর্ব তিমুরের জনসাধারণের অধিকাংশ স্বাধীনতার পক্ষে ছিল এবং ইন্দোনেশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিরোধী ছিল। পূর্ব তিমুরকে অধিকার করা যতটা সহজ হবে বলে ইন্দোনেশিয়া ভেবেছিল, বাস্তবে সেটি তত সহজ হয়নি এবং পূর্ব তিমুরে দখলদারিত্ব বজায় রাখতে গিয়ে ইন্দোনেশিয়াকে প্রচুর সম্পদ ব্যয় করতে হয়েছিল। তদুপরি, পূর্ব তিমুরের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য ইন্দোনেশীয় সৈন্যরা সেখানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় ১,৮০,০০০ থেকে ৩,০০,০০০ মানুষকে (অর্থাৎ পূর্ব তিমুরের ১৯৭৫–পূর্ব জনসংখ্যার এক–তৃতীয়াংশ) হত্যা করেছিল।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে, ইন্দোনেশিয়া কেন পূর্ব তিমুর দখল করেছিল? ঠিক কী কারণে ক্ষুদ্র ও পশ্চাৎপদ উত্তর–ঔপনিবেশিক এই রাষ্ট্রটি অধিকারের জন্য ইন্দোনেশিয়া এত অর্থ, সময় ও শ্রম ব্যয় করেছিল? বস্তুত ইন্দোনেশিয়া কর্তৃক পূর্ব তিমুর দখলের বেশ কয়েকটি কারণ ছিল।
প্রথমত, ইন্দোনেশীয় সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী, ফ্রেটিলিন ছিল কার্যত একটি ‘কমিউনিস্ট’ দল এবং তাদের নেতৃত্বে পূর্ব তিমুরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে সেটি কমিউনিস্ট ব্লকের একটি ঘাঁটিতে পরিণত হতো। এর ফলে ইন্দোনেশিয়া ‘কমিউনিস্ট হুমকি’র সম্মুখীন হতো এবং কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলো পূর্ব তিমুরকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে ইন্দোনেশিয়ায় কমিউনিজমের বিস্তার ঘটানোর সুযোগ পেত। তদুপরি, পূর্ব তিমুরে একটি কমিউনিস্ট–নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র স্থাপিত হলে এতদঞ্চলে মার্কিন পারমাণবিক সাবমেরিনগুলোর যাতায়াতে বিঘ্ন সৃষ্টি হতো এবং এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি কৌশলগত সমস্যা হয়ে দাঁড়াত। ইন্দোনেশীয় সরকারের মতে, পূর্ব তিমুরে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা রোধ করার উদ্দেশ্যে তারা রাষ্ট্রটি আক্রমণ ও দখল করেছিল।
এটি সত্যি যে, ফ্রেটিলিনের একটি অংশ ছিল উগ্র বামপন্থী, কিন্তু তারা ফ্রেটিলিনের মূল ক্ষমতার অধিকারী ছিল না এবং পূর্ব তিমুরের জনসাধারণের কাছেও কমিউনিজম তখন সেরকম গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেনি। কিন্তু ইন্দোনেশীয় সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে ফ্রেটিলিনকে কমিউনিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করে এবং পূর্ব তিমুরের ওপর পরিচালিত আক্রমণকে একটি কমিউনিজমবিরোধী যুদ্ধ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে। তাদের ধারণা ছিল, স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তাদের সৃষ্ট এই বিবরণ পশ্চিমা বিশ্ব গ্রহণ করবে এবং পূর্ব তিমুরে ইন্দোনেশীয় কার্যকলাপের বিরোধিতা করা থেকে বিরত থাকবে। একই উদ্দেশ্য তারা পূর্ব তিমুরে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত হলে মার্কিন সাবমেরিনগুলোর চলাচল নিয়ে সম্ভাব্য সমস্যার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছিল।
সহজ ভাষায়, ফ্রেটিলিন কমিউনিস্ট দল ছিল না এবং পূর্ব তিমুরও একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল না। কিন্তু কমিউনিজমের ভয়ে ভীত পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে ইন্দোনেশিয়া কর্তৃক পূর্ব তিমুর দখলের প্রতি সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে ইন্দোনেশীয় সরকার এই আক্রমণের কারণ হিসেবে ফ্রেটিলিনের ‘কমিউনিস্ট’ হওয়াকে চিহ্নিত করেছিল।
দ্বিতীয়ত, ইন্দোনেশিয়া কর্তৃক পূর্ব তিমুর আক্রমণের প্রধান কারণ ছিল পূর্ব তিমুরের দক্ষিণে অবস্থিত তিমুর সাগরে খনিজ তেলের মজুদ আবিষ্কার। এই আবিষ্কারের ভিত্তিতে ইন্দোনেশীয় সরকারের ধারণা হয়েছিল, পূর্ব তিমুরের সমুদ্রসীমার অভ্যন্তরে বিপুল পরিমাণ খনিজ তেল পাওয়া যাবে। ইন্দোনেশিয়া সেসময় একটি তেল রপ্তানিকারক রাষ্ট্র ছিল এবং নতুন ও বৃহৎ একটি তেলের ভাণ্ডার ইন্দোনেশিয়ার হস্তগত হলে তাদের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেত। ইন্দোনেশীয় রাষ্ট্র ও ক্ষমতাসীন সশস্ত্রবাহিনী উভয়ের জন্যই এটি ছিল একটি লাভজনক সম্ভাবনা। এজন্য ইন্দোনেশিয়া পূর্ব তিমুর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
অবশ্য পরবর্তীতে পূর্ব তিমুরের জলসীমায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে খনিজ তেলের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এর ফলে রাষ্ট্রটি দখলের মধ্য দিয়ে ইন্দোনেশিয়া অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার যে আশা করছিল, সেটি বহুলাংশে অপূর্ণই থেকে গেছে।
তৃতীয়ত, ইন্দোনেশিয়া কর্তৃক পূর্ব তিমুর আক্রমণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল ইন্দোনেশিয়ার ভৌগোলিক অখণ্ডতা নিয়ে ইন্দোনেশীয় সরকারের উদ্বেগ। ইন্দোনেশীয় নীতিনির্ধারকরা আশঙ্কা করছিলেন, পূর্ব তিমুরের মতো ক্ষুদ্র একটি অঞ্চল যদি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকে, সেক্ষেত্রে বহুজাতিক ও বহুভাষী ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় ঐক্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল/প্রদেশ অধিকতর স্বায়ত্তশাসন দাবি করতে পারে অথবা সরাসরি স্বাধীনতাও চেয়ে বসতে পারে।
সুহার্তোর শাসনাধীন ইন্দোনেশিয়া ছিল একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র এবং জাভা দ্বীপ ছিল এর কেন্দ্রস্থল। ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা জাভা দ্বীপেই অবস্থিত এবং সুহার্তোর অধীনে জাভানিজ অভিজাত সম্প্রদায় কার্যত ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য প্রান্তিক প্রদেশগুলোকে শোষণ করত। এমতাবস্থায় ক্ষুদ্র পূর্ব তিমুর স্বাধীন ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলে ইন্দোনেশিয়ার খনিজ–সমৃদ্ধ পশ্চিম পাপুয়া, আচেহ, রিয়াউ ও কালিমান্তানের মতো অঞ্চলগুলোও যে স্বাধীনতা/স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করবে না, এ রকম কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। এজন্য ইন্দোনেশীয় সামরিক শাসকশ্রেণি পূর্ব তিমুরের স্বাধীন অস্তিত্বকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিতে চেয়েছিল এবং এটিকে ইন্দোনেশিয়ার অঙ্গীভূত করতে চেয়েছিল।
চতুর্থত, পূর্ব তিমুর আক্রমণ ও দখলের মধ্য দিয়ে ইন্দোনেশীয় সামরিক শাসকশ্রেণি তাদের জনসমর্থন বৃদ্ধি করতে ইচ্ছুক ছিল। পূর্ব তিমুর অধিকারের মধ্য দিয়ে নতুন ভূমি ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবে এবং সেখান থেকে প্রচুর সম্পদ পাওয়া যাবে– এই ধারণাটি প্রচারের মধ্য দিয়ে ইন্দোনেশীয় শাসকশ্রেণি জনসাধারণের কাছে নিজেদের শাসনকে কার্যকরী হিসেবে প্রমাণ করতে চেয়েছিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইন্দোনেশীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদরা ইন্দোনেশিয়া থেকে পূর্ব তিমুরের বিচ্ছিন্নতাকে ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে সৃষ্টি ‘কৃত্রিম বিভাজনে’র ফলাফল হিসেবে বিবেচনা করতেন এবং পূর্ব তিমুর ছাড়া ইন্দোনেশিয়ার সামুদ্রিক সীমা অসম্পূর্ণ বলে মনে করতেন। অনুরূপভাবে, মুসলিম–অধ্যুষিত ইন্দোনেশিয়ার ধর্মভিত্তিক দলগুলো পূর্ব তিমুরের জনসাধারণের মধ্যে বিদ্যমান ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে প্রচারণায় লিপ্ত ছিল। এমতাবস্থায় পূর্ব তিমুর দখলের মধ্য দিয়ে ইন্দোনেশীয় সরকার দেশটির জাতীয়তাবাদী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শ্রেণিগুলোর সমর্থন আদায় করতে চেয়েছিল।
পঞ্চমত, পূর্ব তিমুর ছিল একটি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র এবং জনবল ও অস্ত্রবলের দিক থেকে ইন্দোনেশিয়া ছিল তাদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। ইন্দোনেশিয়ার সশস্ত্রবাহিনী ছিল দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী সশস্ত্রবাহিনী এবং তারা অত্যাধুনিক পশ্চিমা–নির্মিত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল। অন্যদিকে, ফ্রেটিলিনের সশস্ত্রবাহিনী ছিল তুলনামূলকভাবে খুবই দুর্বল। সুতরাং, ইন্দোনেশীয় সরকারের ধারণা ছিল, তারা সহজেই পূর্ব তিমুর দখল করে নিতে পারবে এবং অপেক্ষাকৃত কম ব্যয় ও শক্তি ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে বিরাট একটি বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিজয় হস্তগত করতে পারবে।
সর্বোপরি, পূর্ব তিমুরের ওপর ইন্দোনেশীয় আক্রমণ ছিল মূলত ইন্দোনেশীয় সশস্ত্রবাহিনীর নিজস্ব প্রকল্প। এ সময় দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন এসেছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চল থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিচ্ছিল এবং এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের পরিবর্তে স্থানীয় ‘প্রক্সি’দের ওপর নির্ভর করার নীতি গ্রহণ করেছিল। ইন্দোনেশীয় সশস্ত্রবাহিনী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘মিত্র’ হতে ইচ্ছুক ছিল।
এজন্য ইন্দোনেশীয় সশস্ত্রবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের সামরিক সামর্থ্য ও কমিউনিজমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের ‘নিষ্ঠা’র প্রমাণ দিতে চেয়েছিল। এই উদ্দেশ্য তারা পূর্ব তিমুরকে সম্ভাব্য ‘কমিউনিস্ট’ ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত করে এবং রাষ্ট্রটির ওপর আক্রমণ চালায়। সহজ ভাষায়, পূর্ব তিমুরের ওপর আক্রমণ পরিচালনার পেছনে ইন্দোনেশীয় সশস্ত্রবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় নিজেদেরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা লাভের ধারা অব্যাহত রাখা।
সামগ্রিকভাবে, এই আক্রমণের ফলাফল ছিল ইন্দোনেশিয়ার জন্য মিশ্র। তারা পূর্ব তিমুর দখল করে নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে অভ্যন্তরীণ জনমতকে সন্তুষ্ট রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের একান্ত মিত্ররাষ্ট্র হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করতেও তারা সমর্থ হয়। কিন্তু পূর্ব তিমুরের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা তাদের জন্য খুবই কঠিন হিসেবে প্রমাণিত হয় এবং কাঙ্ক্ষিত খনিজ তেলের মজুদ লাভের ক্ষেত্রেও তারা ব্যর্থ হয়। ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে, পূর্ব তিমুর দখল ছিল ইন্দোনেশীয় সশস্ত্রবাহিনীর একটি প্রকল্প। এজন্য ১৯৯৮ সালে ইন্দোনেশিয়ায় সামরিক পতনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের এই প্রকল্পেরও সমাপ্তি ঘটে, এবং প্রায় ২৫ বছরব্যাপী ইন্দোনেশীয় দখলদারিত্বের পর জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ২০০২ সালে পূর্ব তিমুর পুনরায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়।