২০১৪ সালের ইসরায়েল-গাজা সংঘর্ষকে কেউ বলে ‘অপারেশন প্রোটেকটিভ এজ’, কেউ বলে ‘অপারেশন স্ট্রং ক্লিফ’, কেউ বা একে শুধু ২০১৪ সালের গাজা যুদ্ধ বলেই ডাকে। সামরিক এই অপারেশন নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ জমতে জমতে পাহাড় সমান হয়ে গেছে বিধায় বিতৃষ্ণায় এ ব্যাপারে পারতপক্ষে এখন আর কেউ কিছু বলে না। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সম্পর্কের টানাপোড়েনকে আরও উসকে দিতে এবং জাতিসংঘ থেকে শুরু করে প্রতিটি সচেতন মানুষের মনে ইসরায়েল বিদ্বেষী মনোভাব গড়ে তুলতে অনবদ্য ভূমিকা রাখে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী পরিচালিত ‘অপারেশন প্রোটেকটিভ এজ’।
শুরুটা হয়েছিল ২০১৪ সালের জুলাই মাসের ৮ তারিখে। হামাস অধ্যুষিত গাজার দক্ষিণ এলাকায় হামলা চালায় ইসরায়েল। ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তারা যেকোনো সময় রকেট আক্রমণ করে বসতে পারে। তাছাড়া ইসরায়েলি শিশু-কিশোরদের হত্যা ও অপহরণ করার অভিযোগও ছিল হামাস সদস্যদের ঘিরে। কাজেই হামাসসহ সামগ্রিকভাবে ফিলিস্তিনিদের একটা শিক্ষা দিতে হাজার হাজার মানুষকে খুন করাই ছিল তাদের কাছে ‘সহজ তরিকা’। এখন পর্যন্ত একে ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় সাফল্য বলে মনে করা হয়। জাতিসংঘের মতে, গাজা উপত্যকা নিয়ে ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েল আর ফিলিস্তিনের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব চলছে, তাতে সবচেয়ে বড় কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে থাকবে ২০১৪ সালের ঐ ৫০ দিন।
প্রায় প্রতি বছরই ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধলেও সেবারের মতো এত বেশি ক্ষয়ক্ষতি আর কখনো হয়নি। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু অবশ্য এই অপারেশনের জন্য ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও শিন বেতকে (ইসরায়েলের নিরাপত্তা সংস্থা) অভিনন্দন জানিয়েছেন। হামাসের পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে তেমন কোনো প্রতিরোধ দেখা যায়নি। হামাসের দুজন সদস্য তিনজন ইসরায়েল কিশোরকে অপহরণ করে খুন করেছে, এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৪ সালের ১২ জুন হামাসের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইসরায়েল।
এদিকে হামাসের সদস্যরা ইসরায়েলি কিশোরদের অপহরণ করেছিল, এ কথা সত্যি। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইসরায়েলের উপর চাপ সৃষ্টি করে গাজা উপত্যকা থেকে তাদের অবরোধ উঠিয়ে নেয়া, ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটিয়ে জেলবন্দী ফিলিস্তিনিদের মুক্তি দেয়া এবং দুই দেশের মধ্যকার সমগ্র যুদ্ধ বন্ধ করা। বিবিসির প্রতিবেদনে জানা যায়, এই লক্ষ্য বাস্তবায়িত করতে গাজা উপত্যকা থেকে রকেট উৎক্ষেপণ করে হামাস সদস্যরা, যার জবাবে গাজার আকাশে বিমানযোগে আক্রমণ (এয়ার রেইড) চালায় ইসরায়েল।
জুলাই মাসের ১৬ তারিখে হামাস এবং ইসলামিক জিহাদ তাদের দাবিদাওয়া ইসরায়েলি সরকারের কাছে পেশ করে। জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে পরদিন, অর্থাৎ ১৭ জুলাই পাঁচ ঘণ্টার জন্য যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়। যুদ্ধবিরতির সময় আইডিএফের (ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস) চোখে পড়ে ১৩ জন সশস্ত্র হামাস সদস্য একটি টানেলের মধ্য দিয়ে গাজার ফিলিস্তিনি অংশ থেকে সীমান্ত পার হয়ে ইসরায়েলে ঢুকছে। আইডিএফ টানেলের অপর প্রান্ত ধ্বংস করে দিয়ে হামাস সদস্যদের দেশে প্রবেশের রাস্তা বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে ২০ জুলাই গাজার পার্শ্ববর্তী এক শহর দিয়ে ফিলিস্তিনে ঢুকে তীব্র লড়াই শুরু করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।
ইসরায়েলের এই অনাহূত আক্রমণের প্রতিবাদে গাজার পশ্চিম উপকূলে জড়ো হয় প্রায় ১০,০০০ ফিলিস্তিনি। ইসরায়েলি সৈন্যদের আক্রমণে সেখানে নিহত হয় প্রতিবাদে অংশ নেয়া দুই ব্যক্তি। তারপরও থেমে থাকেনি ফিলিস্তিনিরা। এদিকে ইসরায়েলের তোপের মুখে আইডিএফের কাছে আত্মসমর্পণ করে প্রায় ১৫০ হামাস সৈন্য, তাদের কাছে হামাস অপারেশন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সেখান থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২৫ জুলাই ইসরায়েল বিমান হামলা চালিয়ে হত্যা করে ইসলামিক জিহাদের মিলিটারি শাখার প্রধান সালাহ আবু হাসনাইনকে।
২৬ জুলাই আবারও দুই দেশ ১২ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। ইসরায়েল এই বিরতি আরও ২৪ ঘণ্টার জন্য বর্ধিত করতে চাইলেও সম্মত হয়নি হামাস। ততদিনে গাজা উপত্যকায় নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা হাজারের ঘর ছাড়িয়েছে। পহেলা আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র আর জাতিসংঘ জানায়, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন ৭২ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে। এই যুদ্ধবিরতি নিয়ে অবশ্য নানা মতভেদ আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মতে, যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে শর্ত ছিল এই সময়ের মধ্যে ইসরায়েল তাদের এলাকায় ঢোকার যাবতীয় গুপ্ত সুড়ঙ্গ ধ্বংস করে দেবে। কিন্তু হামাস জানায়, এমন কোনো শর্তের কথা কোথাও উল্লেখ করা ছিল না। আর ইসরায়েল যখন-তখন তাদের উপর চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে, এমন সময় এসব সুড়ঙ্গ বন্ধ করে দেয়া বরং ফিলিস্তিনের জন্য ক্ষতিকর হবে। এসব বাকবিতণ্ডায় যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার যুদ্ধ লেগে যায়।
এই যুদ্ধের জন্য এবার হামাসকে দায়ী করে ইসরায়েল। যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার সাড়ে ৮ মিনিটের মাথায় প্রথম হামলা চালায় হামাস। টানেল ভাঙার নাম করে রাফা এলাকায় ইসরায়েলিরা পরবর্তী আক্রমণের পরিকল্পনা করছে টের পেয়ে ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি এক সেনানিবাসে আঘাত হানে, যার ফলে হাদার গোল্ডিং নামক এক ইসরায়েলি অফিসার নিহত হয়। ফিলিস্তিনিদের মতে, যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর প্রথম হামলা চালায় ইসরায়েল। সুড়ঙ্গ ভাঙার নাম করে তারা ফিলিস্তিন অধ্যুষিত অংশের ১৯টি বিল্ডিং ধ্বংস করে ফেলে। হামাসের আত্মঘাতী বোমা হামলায় সেবার আরও ২ ইসরায়েলি সৈন্য নিহত হয়।
আগস্ট মাসের ৩ তারিখে হামাস এবং তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোর তৈরি ৩২টি গুপ্তসুড়ঙ্গ ধ্বংস করে আইডিএফ তাদের বেশিরভাগ সৈন্য গাজা উপত্যকা থেকে সরিয়ে নেয়। ৫ আগস্ট ইসরায়েল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয় ইসরায়েলি তিন কিশোরকে অপহরণ করে খুন করার দায়ে হামাস সদস্য হোসাম কাওয়াজমিকে গ্রেপ্তার করেছে তারা। কাওয়াজমি আদালতে স্বীকার করে, এই কাজের জন্য অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহে জড়িত ছিল হামাস। ১০ আগস্ট মিশরের হস্তক্ষেপে আবারও ৭২ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়, ১৩ আগস্ট যা আরও ১২০ ঘণ্টার জন্য বর্ধিত হয়।
যুদ্ধ যখন প্রায় শেষ হয়ে যাবে বলে সবাই অনুমান করে নিচ্ছিল এমন সময় ১৯ আগস্ট ২০ মিনিটের মধ্যে ২৯টি রকেট হামলা চালায় হামাস। তার জবাবে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী বিমান হামলা চালিয়ে খুন করে ৯ জন ফিলিস্তিনিকে। গাজার ২১ আগস্ট দক্ষিণ রাফায় আরেক বিমান হামলায় মোহাম্মদ আবু শাম্মালা, রায়েদ আল আত্তার এবং মোহাম্মদ বারহৌম নামের তিন হামাস কমান্ডারকে হত্যা করা হয়। শুধুমাত্র ২২ থেকে ২৬ আগস্টে ৭ শতাধিক রকেট এবং মর্টার শেল হামলা চালানো হয় ইসরায়েলে, যার পরিপ্রেক্ষিতে নিহত হয় ৩ জন ইসরায়েলি। ২৬ আগস্ট আবার যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় ইসরায়েল এবং হামাস। এর মধ্যে দিয়েই শেষ হয় ৭ সপ্তাহ ব্যাপী রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ।
কিন্তু ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের যুদ্ধ যেন রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প। শেষ হইয়াও হইলো না শেষের রেশ টানতেই যেন ১৬ সেপ্টেম্বর যুদ্ধবিরতি চলাকালীন সময়ে ইসরায়েলে মর্টার শেল নিক্ষেপ করা হয়। গাজার অধিবাসীরা তখন ভয়ে ভয়ে দিন গুনছে, এই সংঘর্ষ নতুন বছর পর্যন্ত গড়ালে তাদের বাঁচার আশা এমনিও আর থাকবে না। ২০ সেপ্টেম্বর ইসরায়েল ও গাজার মধ্যে একটি সমঝোতা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় কায়রোতে। এরপরও ইসরায়েলি সৈন্যরা ১ অক্টোবর গাজায় ঢুকে কৃষকদের ওপর অবাধে গুলি চালায় বলে অভিযোগ করে ফিলিস্তিনিরা। তবে এই ঘটনায় হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
অপারেশন প্রোটেকটিভ এজে ক্ষয়ক্ষতির একটি তালিকা দিয়েছে জাতিসংঘ। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, অপারেশন প্রোটেকটিভ এজের ফলে নিহত হয়েছে ২,৩১৪ জন ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছে আরও প্রায় ১৭,১২৫ জন। নিহতদের মধ্যে গাজার অধিবাসী ছিলেন প্রায় ২,২০০ জন, যাদের মধ্যে ১,৪৯২ জন ছিলেন বেসামরিক সাধারণ নাগরিক, ৬০৫ জন ছিলেন সামরিক সদস্য এবং বাকি ১২৩ জনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। জাতিসংঘের ‘কোঅর্ডিনেশন অফ হিউম্যানিটারিয়ান’ এর আগের বছরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের আক্রমণে ২০১৩ সালে ৩৯ জন নিহত এবং ৩,৯৬৪ জন ফিলিস্তিনি আহত হয়েছিল।
সবমিলিয়ে ঐ ৫০ দিনে ফিলিস্তিনে প্রায় ১১,০০০ মানুষ আহত হয় এবং ৫ লক্ষ মানুষের জীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ। গৃহহীন হয়ে পড়ে লক্ষাধিক মানুষ। কোয়াসেম ব্রিগেডের, হামাসের জঙ্গি বিভাগ, তিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয় এই অপারেশনে। ইসরায়েলেও ক্ষয়ক্ষতি কম হয়নি। ৬৪ জন সৈন্য সহ ৬ জন সাধারণ নাগরিককে হারিয়েছে তারা। ক্ষমতার লড়াই যে কেবল ধ্বংসই বয়ে আনে গাজার এই যুদ্ধ তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।