থিয়েটার বন্ধ করে তারা ১৯৪০ সালে শুরু করলেন রেস্টুরেন্টের ব্যবসা। তারা তাদের বাবা প্যাট্রিক ম্যাকডোনাল্ডের ‘দ্য এয়ারডোম’ রেস্টুরেন্টকে মনরোভিয়া থেকে সান বারনারডিনোতে নিয়ে আসেন এবং নতুন নাম দেন ‘ম্যাকডোনাল্ডস’। আর এই ম্যাকডনাল্ডস দিয়েই অবশেষে সফলতার মুখ দেখলেন দুই ভাই। হ্যাঁ, এটিই আজকের ম্যাকডোনাল্ডস, যেটি বিশ্বব্যাপী ফাস্ট ফুড খাবারের ব্র্যান্ড হিসেবে সুপরিচিত। বর্তমানে এখানে বার্গার, চিকেন স্যান্ডউইচ, সালাদ, ডেজার্ট ও বেভারেজসহ অনেক রকম খাবার বিক্রি হয়। ম্যাকডোনাল্ডস শুরু করা সহোদর দুজন হচ্ছেন রিচার্ড ম্যাকডোনাল্ড এবং মরিস ম্যাকডোনাল্ড।
তখন রেস্টুরেন্ট বলতে পারিবারিকভাবে খাবারের দোকান দেয়াকেই বোঝাতো। বাড়িতে রান্না করা খাবার দোকানে নিয়ে যাওয়া হতো আর সুন্দরী ওয়েট্রেসদের দিয়ে খাবার পরিবেশন করানো হতো। কিন্তু এভাবে খাবার পরিবেশন করতে অনেক সময় লেগে যেত এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল অর্ডার হয়ে যেত। ম্যাকডোনাল্ডসও তার ব্যতিক্রম ছিল না। তাদের বিক্রি ভালোই চলছিল। কিন্তু ম্যাকডোনাল্ডস ভ্রাতৃদ্বয় মনে করলেন, তাদের আরো ভালো ব্যবসা করা সম্ভব। তারা চাইলেন খাবার বিক্রির প্রক্রিয়াকে কীভাবে আরো দ্রুত করা যায় সেটা বের করতে। এমন ভাবনা থেকেই ১৯৪৮ সালে তিন মাসের জন্য ম্যাকডোনাল্ডস বন্ধ রাখলেন তারা। তিন মাস পর সবকিছু সম্পূর্ণ নতুনভাবে সাজালেন তারা।
তারা দেখলেন, খাবারের মেন্যুগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় হ্যামবার্গার। খাবারের আইটেম তখন ২৫ থেকে ৯ এ নামিয়ে আনলেন তারা। রাখলেন শুধু হ্যামবার্গার, চিজবার্গার, কোমল পানীয়, দুধ, কফি, আলুর চিপস এবং পাই। পরবর্তীতে আলুর চিপসের জায়গায় ফ্রেঞ্চ ফ্রাই নিয়ে আসা হয়। খাবার বিক্রির ধরনেও নিয়ে আসা হয় নতুনত্ব। চালু করা হয় ‘সেলফ সার্ভিস’ সিস্টেম। এখানে ক্রেতারা খাবার কেনার জন্য লাইন ধরে দাঁড়াতেন, তারপর তাদেরকে কাগজের প্যাকেটে মুড়ে খাবারগুলো দেয়া হতো। এটা ছিল সেই সময়ে একেবারেই নতুন, যা এখন অনেক খাবারের ব্র্যান্ডেই দেখা যায়। বার্গারের দামও রাখা হয় মাত্র ১৫ সেন্ট।
দোকানের চেহারাতে নিয়ে আসা হয় আভিজাত্যের ছাপ। স্ট্যানলি ক্লার্ক মেস্টনকে দেয়া হয় ডিজাইনের দায়িত্ব। দোকানের ছাদে সোনালী রঙের বলয় দেয়া হয়, যা এর সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দেয়। এ সবকিছুই ম্যাকডোনাল্ডসকে এনে দেয় তুমুল জনপ্রিয়তা। দারুণ এক পারিবারিক বিনোদনের জায়গা হয়ে ওঠে ম্যাকডোনাল্ডস।
ম্যাকডোনাল্ডস ভাইদের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়তেই থাকলো। বছরে তখন ৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার রেভিনিউ চলে আসে। তখন তারা ব্যবসা লাভজনক হচ্ছে দেখে ধীরে ধীরে আমেরিকা জুড়ে আরো ২০টি শাখা খুললেন। কিন্তু মূল শাখার মতো কোনোটিতেই ভালো ব্যবসা হলোনা। মানের পার্থক্য আর ম্যাকডোনাল্ডস ভাইদের উদাসীনতাই ছিল অন্যান্য শাখাগুলোর ব্যর্থতার কারণ। এমন সময় ১৯৫৪ সালে একদিন দুই ভাইয়ের সাথে দেখা করতে আসেন রে ক্রক নামের এক ভদ্রলোক। সেদিন তার আগমনই বদলে দেয় ম্যাকডোনাল্ডসের ভাগ্য।
রে ক্রক ছিলেন ইলিনয়ের বাসিন্দা। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মাত্র ১৫ বছর বয়সে রেড ক্রসের অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার হিসেবে কাজ করেন। যুদ্ধের পর তিনি পিয়ানো বাদক, মিউজিক ডিরেক্টর, সেলসম্যান ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার কাজ করেন। শেষপর্যন্ত লিলি টিউলিপ কাপ কোম্পানির সেলসম্যান হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন কাজ করেন। এ সময় আর্ল প্রিন্স নামক এক আইসক্রিমের দোকান মালিকের সাথে তার পরিচয় হয়। প্রিন্স একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যেটা একইসাথে পাঁচরকম মিল্কশেক তৈরি করতে পারতো। এর নাম ছিল ‘মাল্টিমিক্সার’। তিনি তখন লিলি টিউলিপের কাজ ছেড়ে সমগ্র আমেরিকা জুড়ে এই মাল্টিমিক্সার বিক্রি বাড়ানোর জন্য সেলসম্যান হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। এমনই এক সময় ম্যাকডোনাল্ডস থেকে ডাক পান মাল্টিমিক্সার বিক্রির জন্য।
রে ক্রক মাল্টিমিক্সারের মেশিন খুব একটা বিক্রি করতে পারছিলেন না। কিন্তু ম্যাকডোনাল্ডস থেকে তিনি আটটি মেশিনের অর্ডার পান। তিনি ভাবেন, একটি রেস্টুরেন্ট কতটা লাভজনক হলে এতগুলো মেশিন অর্ডার করতে পারে! তাই তিনি মেশিন নিয়ে যখন যান, তখন মূলত দুই ভাইয়ের ব্যবসার অবস্থা বোঝার জন্যই গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখলেন, এখানে আছে বিপুল পরিমাণ সম্ভাবনা, যেটা ম্যাকডোনাল্ডস ভাইয়েরা বুঝতে পারছিলেন না। তিনি চাইলেন ম্যাকডোনাল্ডসকে একটি ফ্র্যাঞ্চাইজিতে পরিণত করে সমগ্র আমেরিকায় ছড়িয়ে দিতে। তাই ভাইদেরকে প্রস্তাব দিলেন, তিনি ম্যাকডোনাল্ডসের হয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজ এজেন্ট হিসেবে কাজ করবেন। মূল শাখার মতো অন্যান্যগুলো ভালো চলছিলো না। তাই দুই সহোদর রে ক্রককে একটি সুযোগ দিলেন। দায়িত্ব নিয়েই ক্রক তার পরিকল্পনানুযায়ী কাজ করা শুরু করেন আর ইতিহাসের অংশ হয়ে যান।
রে ক্রক ১৯৫৫ সালে তার প্রথম ম্যাকডোনাল্ডস রেস্টুরেন্ট চালু করেন ইলিনয়ের ডেস প্লেইনসে। ১৯৫৯ সালের মধ্যে ১০০ তম রেস্টুরেন্টটিও খুলে ফেলেন। কিন্তু তার খুব বেশি লাভ হচ্ছিলো না। কারণ ম্যাকডোনাল্ডস ভাইয়েরা মূলত তাদের মূল শাখাকেই বেশি গুরুত্ব দিত। বাকিগুলো সব তার একাই দেখতে হতো। কিন্তু সবগুলোর লভ্যাংশের ভাগ দুই ভাইকে দিতে হতো। তাই তিনি কিছুটা চাতুরি করেই ১৯৬১ সালে ২.৭ মিলিয়ন ডলার দিয়ে দুই ভাইয়ের কাছ থেকে ম্যাকডোনাল্ডস কিনে নেন। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
প্রচারণার জন্য রে ক্রক ১৯৬৩ সালে প্রথমবারের মতো রোনাল্ড ম্যাকডোনাল্ড নামে একটি ক্লাউনকে সবার কাছে পরিচয় করিয়ে দেন।১৯৬৬ সালে একে টিভি বিজ্ঞাপনে নিয়ে আসেন, যা দর্শকদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়। ১৯৬৮ সালের মধ্যে ম্যাকডোনাল্ডসের শাখার সংখ্যা ১,০০০ ছাড়িয়ে যায়। এ সময় দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রাখে ম্যাকডোনাল্ডস। ১৯৬৭ সালে প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে ক্রক কানাডায় শাখা চালু করেন এই ব্র্যান্ডের।
ম্যাকডোনাল্ডসকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে রে ক্রক ১৯৭৭ সালে অবসর গ্রহণ করেন। শেষপর্যন্ত ১৯৮৪ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাকে নিয়ে ২০১৬ সালে ‘দ্য ফাউন্ডার’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, যাতে রে ক্রকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মাইকেল কিটন। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ১০০টিরও বেশি দেশে এর ৩৭,২৪১টি শাখা আছে। ২০১০ সালে ২৮,০০০ এরও বেশি দোকানে ফ্রি ওয়াইফাই সেবা চালু করে।
ম্যাকডোনাল্ডসের সাফল্যের পাশাপাশি একে নিয়ে অনেক সমালোচনাও হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে ক্রেতাদের স্থূলতা বাড়ানোর জন্য। এ কারণে তারা খাবারের মধ্যে স্বাস্থ্যকর উপাদান যোগ করা শুরু করে। ফ্যাট আর তেলের পরিমাণও কমানো শুরু করে। কিন্তু তা খুব কমই উপকার করেছে। তাছাড়া কর্মীদের কম বেতন দেয়ার অভিযোগও আছে তাদের বিরুদ্ধে। ম্যাকডোনাল্ডস দাতব্যকাজেও অনেক অবদান রেখেছে। ১৯৮৭ সাল থেকে ‘দ্য রোনাল্ড ম্যাকডোনাল্ড হাউজ চ্যারিটিজ’ বিভিন্ন দাতব্য কাজে সহযোগিতা করে আসছে।
ম্যাকডোনাল্ডস নিয়ে কিছু চমকপ্রদ তথ্য
- ম্যাকডোনাল্ডস জনপ্রিয় ব্র্যান্ড হলেও এটি বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় স্থানে আছে। প্রথম স্থানে আছে স্যান্ডউইচ কোম্পানি ‘সাবওয়ে’। বিশ্বব্যাপী এর ৪৩,৯১২টি দোকান আছে।
- বর্তমানের অনেক সেলিব্রেটি আছেন, যারা একসময় ম্যাকডোনাল্ডসে কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে আছেন গায়ক ও অভিনেতা জাস্টিন টিম্বারলেক, হলিউড অভিনেত্রী রেচেল ম্যাকঅ্যাডামস, এমনকি আমাজনের সিইও জেফ বেজোসও।
- হ্যামবার্গার ইউনিভার্সিটি নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে ম্যাকডোনাল্ডসের, যেটি ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি থেকে ব্যাচেলর অফ হ্যামবারগারলজি ডিগ্রি দেয়া হয়।মূল ক্যাম্পাসের সাথে টোকিও, মিউনিখ, সাংহাইসহ সাতটি ক্যাম্পাস আছে বিশ্বজুড়ে। এখন পর্যন্ত ২,৭৫,০০০ শিক্ষার্থী গ্রাজুয়েশন করেছেন এখান থেকে। সাংহাই ক্যাম্পাসে আবেদনকারীদের মধ্যে ১% এরও কম শিক্ষার্থী সুযোগ পান, যা হার্ভার্ড থেকেও কম (৫.৯%)।
- ১৯৯২ সালে স্টিলা লিবেক নামে এক বৃদ্ধা ম্যাকডোনাল্ডসের বিরুদ্ধে মামলা করে ২.৯ মিলিয়ন ডলার পান। কারণ সেখানের গরম কফি পান করে তার জিহ্বা পুড়ে গিয়েছিল।
- হংকংয়ে ম্যাকডোনাল্ডসের ভেন্যুগুলো বিয়ের আয়োজনও করেছে।
- ২০১৭ সালে ম্যাকডোনাল্ডসের নেট রেভিনিউ ছিল অস্ট্রেলিয়ার জিডিপির চারগুণেরও বেশি।