আফগান যুদ্ধ (১৯৭৯–৮৯): সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিয়েতনাম
১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারের অনুরোধে রাষ্ট্রটিতে চলমান গৃহযুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ করে এবং এর মধ্য দিয়ে সোভিয়েত রাষ্ট্রের জন্য ‘আফগান যুদ্ধ’ শুরু হয়। ১৯৭৫ সাল থেকে আফগানিস্তানে আফগান সরকার ও পাকিস্তানি–সমর্থিত আফগান মিলিট্যান্টদের মধ্যে নিম্ন মাত্রার গৃহযুদ্ধ চলে আসছিল এবং ১৯৭৮ সালে আফগান কমিউনিস্টরা একটি বিপ্লব/সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আফগানিস্তানের শাসনক্ষমতা দখল করার পর এই গৃহযুদ্ধ তীব্র রূপ ধারণ করে। পাকিস্তানের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মার্কিন–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘ন্যাটো’, চীন, ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, ইসরায়েল ও অন্যান্য রাষ্ট্র আফগান কমিউনিস্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যে আফগান মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলোকে বিস্তৃত সহায়তা প্রদান করতে শুরু করে, এবং আফগান সরকার ক্রমশ আফগানিস্তানের সিংহভাগ অঞ্চলের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
এই পরিস্থিতিতে ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর আফগান সরকারের অনুরোধে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে সৈন্য মোতায়েন করে এবং পরবর্তী প্রায় ৯ বছর সোভিয়েত ও আফগান সৈন্যরা বিভিন্ন আফগান মিলিট্যান্ট গ্রুপের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। কিন্তু তারা আফগান মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলোকে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে নতুন সোভিয়েত সরকার বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে সরে আসে। ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সোভিয়েতরা আফগানিস্তান থেকে তাদের সমস্ত সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। সোভিয়েত–সমর্থিত আফগান সরকার আরো প্রায় তিন বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯২ সালের এপ্রিলে আফগান মিলিট্যান্টরা কাবুল দখল করে নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে আফগান কমিউনিস্ট সরকারের পতন ঘটে।
আফগান যুদ্ধে অন্তত ১৫,০৩১ জন সোভিয়েত সৈন্য নিহত এবং ৫৩,৭৫৩ জন সোভিয়েত সৈন্য আহত হয়। তদুপরি, এই যুদ্ধ চলাকালে সোভিয়েতরা ১১৮টি সামরিক বিমান, ৩৩৩টি হেলিকপ্টার, ১৪৭টি ট্যাঙ্ক, ১,৩১৪টি আর্মার্ড ভেহিকল, ৫১০টি ইঞ্জিনিয়ারিং ভেহিকল, ৪৩৩টি কামান ও মর্টার এবং ১১,৩৬৯টি ট্রাক হারায়। এর পাশাপাশি এই যুদ্ধে অন্তত ১৮,০০০ আফগান সৈন্য নিহত এবং প্রায় ৭৭,০০০ আফগান সৈন্য আহত হয়। এছাড়া, এই যুদ্ধে আফগানরাও বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম হারায়, কিন্তু এই বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে, আফগান যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তদুপরি, এই যুদ্ধের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতি বছর ৩০০ কোটি (বা ৩ বিলিয়ন) থেকে ৮২০ কোটি (বা ৮.২ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হয়। এই যুদ্ধে সোভিয়েতরা বিশুদ্ধ সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরাজিত হয়নি, কিন্তু তাদের মূল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয় এবং তাদেরকে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে হয়। অবশ্য ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় যেরকম মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মার্কিন–সমর্থিত দক্ষিণ ভিয়েতনামি সরকারের পতন ঘটেছিল, আফগান যুদ্ধের ক্ষেত্রে সেরকম ঘটেনি। বস্তুত আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের পর সোভিয়েত–সমর্থিত আফগান সরকার আরো প্রায় তিন বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। তদুপরি, ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণের তুলনায় আফগান যুদ্ধে সোভিয়েত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল বহুলাংশে কম।
কিন্তু তা সত্ত্বেও আফগান যুদ্ধ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী বৈদেশিক যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধে তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী তাদের অন্যান্য বৈদেশিক যুদ্ধের তুলনায় অনেক বেশি। এজন্য পশ্চিমা সামরিক–রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এবং বহু সোভিয়েত/রুশ বিশ্লেষক আফগান যুদ্ধকে ‘সোভিয়েত ভিয়েতনাম’ (Soviet Vietnam) হিসেবে অভিহিত করেছেন।
অন্যদিকে, আফগান যুদ্ধ চলাকালে সোভিয়েত ও আফগান সৈন্যদের হাতে ৭৫,০০০ থেকে ৯০,০০০ আফগান ও বিদেশি মিলিট্যান্ট নিহত হয় এবং প্রায় সমসংখ্যক মিলিট্যান্ট গুরুতরভাবে আহত হয়। তদুপরি, এই যুদ্ধ চলাকালে সোভিয়েত ও আফগানদের দ্বারা পরিচালিত বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ এবং সোভিয়েত ও আফগান গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কর্তৃক পরিচালিত অন্তর্ঘাতের ফলে অন্তত ৫,৭৭৫ জন পাকিস্তানি নিহত এবং অন্তত ৬,৮০৪ জন পাকিস্তানি আহত হয়। হতাহত পাকিস্তানিদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য। সর্বোপরি, এই যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান অন্তত ১টি যুদ্ধবিমান এবং ইরান অন্তত ২টি হেলিকপ্টার হারায়।
আফগান যুদ্ধে নিহত বেসামরিক আফগান নাগরিকের সংখ্যা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি, কিন্তু বিভিন্ন সূত্রে এই সংখ্যা ৫,৬২,০০০ থেকে ২০ লক্ষ পর্যন্ত বর্ণনা করা হয়েছে। তদুপরি, এই যুদ্ধের ফলে প্রায় ২০ লক্ষ বেসামরিক আফগান আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয় এবং প্রায় ৫০ লক্ষ বেসামরিক আফগান শরণার্থীতে পরিণত হয়। অর্থাৎ, ‘সোভিয়েত ভিয়েতনামে’র ফলে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় ‘মার্কিন ভিয়েতনামে’র ফলে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না।
প্রথম চেচেন যুদ্ধ (১৯৯৪–৯৬): রাশিয়ার ভিয়েতনাম
১৯৯৪ সালের ১১ ডিসেম্বর রুশ সৈন্যরা নবগঠিত রুশ ফেডারেশনের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রজাতন্ত্র চেচনিয়ায় প্রবেশ করে এবং এর মধ্য দিয়ে রুশদের জন্য ‘প্রথম চেচেন যুদ্ধ’ (১৯৯৪–১৯৯৬) শুরু হয়। ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বরে সোভিয়েত বিমানবাহিনীর প্রাক্তন মেজর জেনারেল জওহর দুদায়েভের নেতৃত্বাধীন ‘অল–ন্যাশনাল কংগ্রেস অফ দ্য চেচেন পিপল ন্যাশনাল গার্ড’ মিলিট্যান্টরা একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত চেচনিয়ার শাসনক্ষমতা দখল করে এবং ‘ইচকেরিয়া চেচেন প্রজাতন্ত্র’ নামে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে, কিন্তু অন্য কোনো রাষ্ট্র ইচকেরিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। ১৯৯২ সাল নাগাদ প্রজাতন্ত্রটিতে কার্যত দুদায়েভ ও তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং রুশরা দুদায়েভের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সহায়তা করতে থাকে। দুদায়েভের প্রতিদ্বন্দ্বীরা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চেচনিয়ার ক্ষমতা দখলের জন্য বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু তাদের প্রচেষ্টাগুলো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
এমতাবস্থায় ১৯৯৪ সালের ১১ ডিসেম্বর রুশ কেন্দ্রীয় সরকার ‘ইচকেরিয়া চেচেন প্রজাতন্ত্রে’ চলমান গৃহযুদ্ধে দুদায়েভের প্রতিদ্বন্দ্বীদের পক্ষে সামরিক হস্তক্ষেপ করে এবং প্রজাতন্ত্রটিকে রুশ নিয়ন্ত্রণাধীনে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালায়। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর রুশ সৈন্যরা চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনি দখল করতে সক্ষম হয়, সেখানে নিজেদের পছন্দনীয় একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করে এবং রুশ বিমান হামলায় দুদায়েভ নিহত হন। কিন্তু ইচকেরীয় সৈন্যরা রুশদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ অব্যাহত রাখে এবং এই যুদ্ধে রুশদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৯৯৬ সালের আগস্টে ইচকেরীয় সৈন্যরা একটি ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে গ্রোজনিসহ চেচনিয়ার অন্যান্য বড় শহরে মোতায়েনকৃত রুশ সৈন্যদের ঘিরে ফেলে। এই পরিস্থিতিতে ৩১ আগস্ট রাশিয়া ও ইচকেরিয়ার মধ্যে ‘খাসাভ–ইয়ুর্ত চুক্তি’ সম্পাদিত হয় এবং চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া ১৯৯৭ সালের জানুয়ারি নাগাদ তাদের সমস্ত সৈন্যকে ‘ইচকেরিয়া চেচেন প্রজাতন্ত্র’ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়।
রুশ সশস্ত্রবাহিনীর প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রথম চেচেন যুদ্ধে অন্তত ৫,০৪২ জন রুশ সৈন্য নিহত, অন্তত ৬৯০ জন রুশ সৈন্য নিখোঁজ এবং ১৭,৮৯২ জন রুশ সৈন্য আহত হয়। তদুপরি, এই যুদ্ধ চলাকালে রুশরা অন্তত ৯টি যুদ্ধবিমান ও ২১ থেকে ২২টি হেলিকপ্টার হারায়, এবং এর পাশাপাশি তারা বহুসংখ্যক অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামও হারায়। সেসময় রাশিয়া অর্থনৈতিক সঙ্কটে ভুগছিল (কার্যত এই সময়ের রুশ অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে কিছু কিছু বিশ্লেষক ‘অর্থনৈতিক গণহত্যা’ নামে আখ্যায়িত করেছেন) এবং অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত রাশিয়ার জন্য প্রথম চেচেন যুদ্ধের ব্যয় ছিল মারাত্মক এক বোঝাস্বরূপ। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি ছিল রাশিয়ার জন্য একটি ‘পরিপূর্ণ পরাজয়’।
সাধারণভাবে আফগান যুদ্ধকে ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন/রাশিয়ার ভিয়েতনাম’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু কার্যত ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যেরকম সামরিকভাবে সম্পূর্ণ পরাজিত হয়েছিল, আফগান যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন সেরকমভাবে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরাজিত হয়নি। সেই তুলনায় প্রথম চেচেন যুদ্ধে রাশিয়া সামরিকভাবে সম্পূর্ণ পরাজিত হয় এবং এজন্য প্রথম চেচেন যুদ্ধকে প্রকৃত ‘রুশ ভিয়েতনাম’ (Russian Vietnam) হিসেবে আখ্যা দেয়া যেতে পারে।
কৌতূহলের বিষয় এই যে, আফগানিস্তানে ‘সোভিয়েত ভিয়েতনাম’ অর্জনের মাত্র ৫ বছর পরেই মস্কো চেচনিয়ায় আরেকটি (এবং আরো পরিপূর্ণ) ‘ভিয়েতনাম’ অর্জন করে ফেলে! এরচেয়েও কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, সোভিয়েত বিমানবাহিনীর মেজর জেনারেল হিসেবে দুদায়েভ আফগান যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এবং আফগান মিলিট্যান্টদের ওপর কৌশলগত বোমাবর্ষণে তার ইউনিট বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল। এভাবে ভাগ্যের পরিহাসে ‘সোভিয়েত ভিয়েতনামে’ অংশগ্রহণকারী একজন সোভিয়েত সামরিক কর্মকর্তা রুশদের জন্য চেচনিয়ায় একটি নতুন ‘ভিয়েতনাম’ সৃষ্টি করে ফেলেন।
ইচকেরীয় সূত্রসমূহ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রথম চেচেন যুদ্ধ চলাকালে ‘ইচকেরিয়া চেচেন প্রজাতন্ত্রে’র ২,৫০০ থেকে ৩,০০০ সৈন্য নিহত হয় এবং আরো বহুসংখ্যক সৈন্য আহত ও নিখোঁজ হয়। প্রথম চেচেন যুদ্ধকে ‘রুশ ভিয়েতনাম’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয় বটে, কিন্তু উত্তর ভিয়েতনামি সৈন্য বা ভিয়েত কং ও আফগান মিলিট্যান্টদের তুলনায় ইচকেরিয়ার সামরিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল বহুলাংশে কম। অবশ্য চেচনিয়ার জনসাধারণের জন্য এই যুদ্ধ ‘মার্কিন ভিয়েতনাম’ বা ‘সোভিয়েত ভিয়েতনাম’ থেকে কোনো অংশে কম বিপর্যয়কর ছিল না, কারণ এই যুদ্ধ চলাকালে চেচনিয়ার অন্তত ৩০,০০০ থেকে ৫০,০০০ বেসামরিক অধিবাসী নিহত হয় এবং হাজার হাজার বেসামরিক ব্যক্তি উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়।
উত্তর ইয়েমেনি গৃহযুদ্ধ (১৯৬২–৭০): মিসরের ভিয়েতনাম
১৯৬২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তদানীন্তন উত্তর ইয়েমেনে সংঘটিত একটি মিসরীয়–সমর্থিত বিপ্লব/সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে রাষ্ট্রটির ‘ইমাম’ মুহাম্মাদ আল–বদর ক্ষমতাচ্যুত হন। বিপ্লবীরা উত্তর ইয়েমেনে রাজতন্ত্রকে বিলুপ্ত করে এবং রাষ্ট্রটিকে ‘ইয়েমেন আরব প্রজাতন্ত্র’ নামকরণ করে। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রটিতে প্রজাতন্ত্রী সরকার ও রাজতন্ত্রীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মিসর এই যুদ্ধে প্রজাতন্ত্রী সরকারের পক্ষ অবলম্বন করে এবং তাদেরকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে উত্তর ইয়েমেনে সৈন্য প্রেরণ করে। অন্যদিকে, ব্রিটেন, সৌদি আরব, জর্দান ও ইসরায়েল এই যুদ্ধে রাজতন্ত্রীদের পক্ষ অবলম্বন করে এবং সৌদি সৈন্য ও ব্রিটিশ–নিয়ন্ত্রিত মার্সেনারিরা সরাসরি রাজতন্ত্রীদের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এই যুদ্ধ চলাকালে মিসর উত্তর ইয়েমেনে বিপুল সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন করে এবং ১৯৬৭ সাল নাগাদ উত্তর ইয়েমেনে অন্তত ৭০,০০০ মিসরীয় সৈন্য মোতায়েন ছিল। অবশ্য কিছু কিছু সূত্রের মতে, উত্তর ইয়েমেনে মোতায়েনকৃত মিসরীয় সৈন্যের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ১ লক্ষ ৩০ হাজারে পৌঁছেছিল!
কিন্তু উত্তর ইয়েমেনে মিসরের বিপুল সংখ্যক সৈন্য মোতায়েনের পরেও যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি মিসরীয়–সমর্থিত প্রজাতন্ত্রী সরকারের পক্ষে যায়নি। যুদ্ধটি কার্যত একটি অচলাবস্থায় রূপ নেয়, অর্থাৎ কোনো পক্ষেরই অপর পক্ষকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করার সামর্থ্য ছিল না। যুদ্ধের পাশাপাশি উভয় পক্ষের মধ্যে শান্তি আলোচনাও চলছিল, কিন্তু যুদ্ধ বা কূটনীতি কোনোটিই ফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হচ্ছিল না। অবশেষে ১৯৭০ সালে সম্পাদিত একটি শান্তিচুক্তি অনুযায়ী সৌদি আরব ‘ইয়েমেন আরব প্রজাতন্ত্র’কে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং উত্তর ইয়েমেনি সরকারে রাজতন্ত্রীদের অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান করা হয়। এর মধ্য দিয়ে উত্তর ইয়েমেনি গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে এবং মিসর উত্তর ইয়েমেন থেকে সমস্ত সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়।
মিসরীয় ইতিহাসবিদদের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, উত্তর ইয়েমেনি গৃহযুদ্ধে অন্তত ২৬,০০০ মিসরীয় সৈন্য নিহত হয়। বস্তুত ১৯২২ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর অন্য কোনো যুদ্ধে মিসর এত বিপুল সামরিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি। উল্লেখ্য, মিসর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ৪টি ঘোষিত যুদ্ধ ও ১টি ‘অঘোষিত যুদ্ধে’ অংশগ্রহণ করেছে এবং কার্যত প্রতিটি যুদ্ধেই মিসর সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইসরায়েলের নিকট পরাজিত হয়েছে। কিন্তু এমনকি ইসরায়েলিদের সঙ্গে যুদ্ধেও মিসরীয়রা এত বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি, যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি তাদের উত্তর ইয়েমেনে হয়েছিল।
অবশ্য উত্তর ইয়েমেনি গৃহযুদ্ধে মিসরের সামরিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক হলেও কার্যত এই যুদ্ধে তারা সামরিক বা রাজনৈতিক কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে পরাজিত হয়নি। তাদের সমর্থিত প্রজাতন্ত্রী সরকারই শেষ পর্যন্ত উত্তর ইয়েমেনি গৃহযুদ্ধে বিজয়ী হয় এবং রাজতন্ত্রীরা পরাজিত হয়, যদিও প্রজাতন্ত্রীরা রাজতন্ত্রীদেরকে তাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান করে। কিন্তু একইসঙ্গে মিসর এই যুদ্ধে বিজয়ীও হতে পারেনি এবং বিপুল পরিমাণ সামরিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি এই যুদ্ধের ফলে মিসরীয় অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুধু তাই নয়, উত্তর ইয়েমেনি গৃহযুদ্ধে মিসরের ব্যাপকভাবে জড়িত থাকার ফলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ১৯৬৭ সালের আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধে ইসরায়েলের নিকট মিসরের শোচনীয় পরাজয়ের পশ্চাতে উত্তর ইয়েমেনে মিসরের মাত্রাতিরিক্ত সামরিক উপস্থিতিকে একটি অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এই প্রেক্ষাপটে মিসরীয় সামরিক ইতিহাসবিদরা উত্তর ইয়েমেনি গৃহযুদ্ধকে ‘মিসরীয় ভিয়েতনাম’ (Egyptian Vietnam) হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। বস্তুত উত্তর ইয়েমেনি গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপের ফলে মিসরের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এতটাই ব্যাপক ছিল যে ইসরায়েলি লেখক ও কূটনীতিক (এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রাক্তন ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত) মাইকেল ওরেন মনে করেন, উত্তর ইয়েমেনি গৃহযুদ্ধকে ‘মিসরের ভিয়েতনাম’ নয়, বরং ভিয়েতনাম যুদ্ধকেই অনায়াসে ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েমেন’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারতো।
উত্তর ইয়েমেনি গৃহযুদ্ধ চলাকালে সামরিক–বেসামরিক মিলিয়ে উভয় পক্ষের প্রায় ২ লক্ষ মানুষ নিহত হয়, এবং উত্তর ইয়েমেনি জনসাধারণের জন্য এই বিপর্যয়ের তীব্রতা বহুলাংশে ভিয়েতনামি, আফগান ও চেচেন জনসাধারণের পরিস্থিতির অনুরূপ ছিল। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, সৌদি সৈন্যরা এই যুদ্ধ চলাকালে উত্তর ইয়েমেনি রাজতন্ত্রীদের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং এই যুদ্ধে তাদের প্রায় ১,০০০ সৈন্য নিহত হয়। সৌদি আরবও এই যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারেনি এবং তাদেরকে শেষ পর্যন্ত উত্তর ইয়েমেনের প্রজাতন্ত্রী সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করতে হয়। কিন্তু তাদের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ছিল মিসরের তুলনায় অনেক কম এবং এজন্য এই যুদ্ধ তাদের জন্য ভিয়েতনাম হয়ে ওঠেনি। অবশ্য একবিংশ শতাব্দীতে এসে সৌদি আরব ইয়েমেনের ভূখণ্ডে নতুন একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে এবং যুদ্ধটির বর্তমান গতিপ্রকৃতির ভিত্তিতে কিছু কিছু বিশ্লেষক ধারণা করছেন যে, এই যুদ্ধটি সৌদি আরবের ভিয়েতনামে রূপ নিতে পারে।