শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপ (১৯৮৭–৯০): ভারতের ভিয়েতনাম
১৯৮৭ সালের ২৯ জুলাই ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে ‘ভারতীয়–শ্রীলঙ্কান শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয় এবং এই চুক্তির শর্তানুযায়ী ভারত শ্রীলঙ্কায় সৈন্য প্রেরণ করে, যার মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কান গৃহযুদ্ধে ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপ আরম্ভ হয়। বস্তুত ১৯৮৩ সাল থেকে সিংহলি–নিয়ন্ত্রিত শ্রীলঙ্কান সরকার ও বিভিন্ন শ্রীলঙ্কান তামিল মিলিট্যান্ট গ্রুপের মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলে আসছিল, এবং এই যুদ্ধে ভারত শ্রীলঙ্কান তামিল মিলিট্যান্টদের সমর্থন দিচ্ছিল। ১৯৮৭ সালের মে মাসে শ্রীলঙ্কান সশস্ত্রবাহিনী তামিল মিলিট্যান্টদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত জাফনা শহর অবরোধ করলে জুনে ভারতীয় বিমানবাহিনী সেখানে শ্রীলঙ্কান তামিল মিলিট্যান্টদের জন্য রসদপত্র ও অস্ত্রশস্ত্র ‘এয়ারড্রপ’ করে। এমতাবস্থায় শ্রীলঙ্কা ভারতের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে বাধ্য হয় এবং ২৯ জুলাই উভয় পক্ষ ‘ভারতীয়–শ্রীলঙ্কান শান্তিচুক্তি’তে স্বাক্ষর করে।
এই চুক্তি অনুযায়ী শ্রীলঙ্কান সরকার শ্রীলঙ্কান তামিল মিলিট্যান্টদের বেশ কিছু ছাড় দিতে রাজি হয়, এবং বিনিময়ে ভারত শ্রীলঙ্কান তামিল মিলিট্যান্টদের সমর্থন প্রদান বন্ধ করতে সম্মত হয়। চুক্তি অনুযায়ী ভারত শ্রীলঙ্কার উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে ‘ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী’ (Indian Peace Keeping Force, ‘IPKF’) নামক একটি সৈন্যদল মোতায়েন করে। এই সৈন্যদলের দায়িত্ব ছিল শ্রীলঙ্কান তামিল মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলোকে নিরস্ত্র করা এবং শ্রীলঙ্কার উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। উল্লেখ্য, শ্রীলঙ্কান তামিল মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল ‘লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল ইলাম’ (এলটিটিই)। এলটিটিই বা অন্য কোনো তামিল মিলিট্যান্ট গ্রুপ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি, কিন্তু ধারণা করা হচ্ছিল, শ্রীলঙ্কান তামিল মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলোর ওপর প্রভাব খাটিয়ে ভারত তাদেরকে অস্ত্র সমর্পণের ব্যাপারে রাজি করাতে পারবে। শ্রীলঙ্কান তামিল মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলো অস্ত্র সমর্পণে আগ্রহী ছিল না, কিন্তু ভারতের চাপে তারা এই প্রস্তাবে সম্মত হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতীয় সৈন্যদের শ্রীলঙ্কান ভূখণ্ডে বৃহৎ মাত্রার কোনো সামরিক অভিযান পরিচালনার কথা ছিল না। তারা শ্রীলঙ্কান সরকার ও শ্রীলঙ্কান তামিল মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলোর মধ্যে যুদ্ধবিরতি স্থাপন করে এবং তামিল মিলিট্যান্টদের নিরস্ত্রীকরণের প্রক্রিয়া শুরু করে। অধিকাংশ শ্রীলঙ্কান তামিল মিলিট্যান্ট গ্রুপ ভারতীয় সৈন্যদের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে, কিন্তু বিভিন্ন কারণে এলটিটিই–এর সঙ্গে ভারতীয় সৈন্যদের বিরোধ দেখা দেয় এবং এলটিটিই অস্ত্র সমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তখন ভারতীয় সৈন্যরা বলপূর্বক এলটিটিইকে নিরস্ত্র করার প্রচেষ্টা চালায়, এবং এর ফলে ভারতীয় বাহিনী ও এলটিটিই–এর মধ্যে পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। প্রায় তিন বছর এই যুদ্ধ স্থায়ী হয়।
এই যুদ্ধ চলাকালে ভারতীয় সৈন্যরা বেসামরিক শ্রীলঙ্কান তামিলদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড, লুণ্ঠন ও ধর্ষণে লিপ্ত হয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে সিংহলিদের বিরুদ্ধেও হত্যাকাণ্ড চালায়। এর ফলে একদিকে শ্রীলঙ্কান তামিলরা ভারতীয়দের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, অন্যদিকে সিংহলি জাতীয়তাবাদীরাও শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় সামরিক উপস্থিতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় শ্রীলঙ্কান সরকার শ্রীলঙ্কা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য ভারতকে আহ্বান জানায় এবং এলটিটিই–এর সঙ্গে গোপনে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এলটিটিই–এর সঙ্গে যুদ্ধে ভারতীয়দের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে, কিন্তু ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী শ্রীলঙ্কা থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারে অস্বীকৃতি জানান।
এই পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কান সরকার শ্রীলঙ্কা থেকে ভারতীয় সৈন্যদের বিতাড়িত করার জন্য এলটিটিই–র সঙ্গে একটি ‘গোপন ও সাময়িক মৈত্রীত’তে আবদ্ধ হয়। ১৯৮৯ সালে এপ্রিলে শ্রীলঙ্কান সরকারের নির্দেশে শ্রীলঙ্কান সশস্ত্রবাহিনী গোপনে এলটিটিইকে অস্ত্র সরবরাহ করতে শুরু করে এবং এলটিটিই ভারতীয় সৈন্য ও ভারতীয়–নিয়ন্ত্রিত শ্রীলঙ্কান তামিল মিলিট্যান্ট গ্রুপ ‘তামিল ন্যাশনাল আর্মি’র (টিএনএ) বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। তবুও ভারতীয় সরকার শ্রীলঙ্কা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ভারতীয় আইনসভা নির্বাচনে রাজীব গান্ধীর দল পরাজিত হয় এবং বিশ্বনাথ প্রতাপ চৌধুরী ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি শ্রীলঙ্কা থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন এবং ১৯৯০ সালের ২৪ মার্চ সর্বশেষ ভারতীয় সৈন্যদল শ্রীলঙ্কা ত্যাগ করে। এর মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপের অবসান ঘটে।
প্রাক্তন ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্দেজের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, এই যুদ্ধে অন্তত ১,১৬৫ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত এবং অন্তত ৩,০০৯ জন ভারতীয় সৈন্য গুরুতরভাবে আহত হয়। ভারতীয়দের প্রক্সি ‘টিএনএ’র ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তদুপরি, এই যুদ্ধে ভারতের প্রত্যক্ষ ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ১,০৩০ কোটি (বা ১০.৩ বিলিয়ন) ভারতীয় রুপির বেশি। সর্বোপরি, ১৯৯১ সালের মে–জুনে অনুষ্ঠিতব্য আইনসভা নির্বাচনে রাজীব গান্ধীর দল বিজয়ী হলে (ও রাজীব গান্ধী আবার প্রধানমন্ত্রী হলে) ভারত আবার শ্রীলঙ্কায় সৈন্য প্রেরণ করতে পারে, এই আশঙ্কায় এলটিটিই রাজীব গান্ধীকে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৯৯১ সালে ২১ মে ভারতের তামিলনাড়ু প্রদেশের শ্রীপেরুমবুদুরে এলটিটিই মিলিট্যান্টদের আত্মঘাতী বোমা হামলায় রাজীব গান্ধী নিহত হন।
সামরিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই যুদ্ধ ছিল ভারতের জন্য একটি ‘সম্পূর্ণ পরাজয়’। ভারতীয় সৈন্যরা এলটিটিইকে পরাজিত করতে ও অস্ত্র সমর্পণে বাধ্য করতে ব্যর্থ হয়, এবং শেষ পর্যন্ত ক্রমবর্ধমান ক্ষয়ক্ষতির মুখে তারা শ্রীলঙ্কা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। শ্রীলঙ্কায় সৈন্য প্রেরণের পশ্চাতে ভারতের মূল উদ্দেশ্য ছিল শ্রীলঙ্কান গৃহযুদ্ধ বন্ধ করে সেখানে শান্তি স্থাপন করা এবং এর মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কাকে সুদৃঢ়ভাবে ভারতীয় প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত করা। কিন্তু শ্রীলঙ্কায় সৈন্য প্রেরণের পর ভারতীয়দেরকে তাদেরই এককালীন মিত্র/প্রক্সি এলটিটিই–এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয় এবং ভারতীয়দেরকে আমন্ত্রণকারী শ্রীলঙ্কান সরকার তাদেরকে বিতাড়িত করার জন্য গোপনে এলটিটিই–র সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়। বস্তুত এই যুদ্ধের ফলে শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ার পরিবর্তে উল্টো হ্রাস পায় এবং শ্রীলঙ্কান সিংহলি ও তামিল উভয় জাতির মধ্যেই তীব্র ভারতবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ভারত বেশ কয়েকটি বৈদেশিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে এবং এসবের মধ্যে দুটি যুদ্ধে তারা পরাজিত হয়েছে। একটি হচ্ছে ১৯৬২ সালে সংঘটিত চীনা–ভারতীয় যুদ্ধ এবং ১৯৮৭–৯০ সালে সংঘটিত শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপ। চীনা–ভারতীয় যুদ্ধে ভারতের পরাজয় অপ্রত্যাশিত ছিল না, কারণ সেসময় শক্তিমত্তার বিচারে চীন ভারতের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল। কিন্তু শ্রীলঙ্কায় এলটিটিই–র কাছে ভারতের পরাজয় ছিল অপ্রত্যাশিত, কারণ প্রায় এক লক্ষ সৈন্যবিশিষ্ট ভারতীয় বাহিনী শ্রীলঙ্কান সশস্ত্রবাহিনী ও ভারতীয়–নিয়ন্ত্রিত তামিল মিলিট্যান্ট গ্রুপ ‘টিএনএ’র সমর্থন পেয়েও এবং জনবল ও অস্ত্রবলের দিক থেকে এলটিটিই–র চেয়ে বহুগুণ বেশি শক্তিশালী হয়েও তাদেরকে পরাজিত করতে পারেনি। এজন্য বহু সামরিক–রাজনৈতিক বিশ্লেষক শ্রীলঙ্কান গৃহযুদ্ধে ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপকে ‘ভারতীয় ভিয়েতনাম’ (Indian Vietnam) হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
লেবানন যুদ্ধ (১৯৮২–০০): ইসরায়েলের ভিয়েতনাম
১৯৮২ সালের ৬ জুন ইসরায়েল লেবানন আক্রমণ করে এবং এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের প্রলম্বিত ‘লেবানন যুদ্ধ’ আরম্ভ হয়। এই আক্রমণের পশ্চাতে ইসরায়েলের মূল উদ্দেশ্য ছিল লেবানন থেকে ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’কে (পিএলও) বিতাড়িত করা এবং এর মাধ্যমে লেবানিজ সীমান্তবর্তী ইসরায়েলি অঞ্চলগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। উল্লেখ্য, ১৯৬৮ সাল থেকে পিএলও লেবানিজ ভূখণ্ড থেকে ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ পরিচালনা শুরু করে এবং প্রত্যুত্তরে ইসরায়েল সময়ে সময়ে লেবানিজ ভূখণ্ডে আক্রমণ পরিচালনা করতে থাকে। ১৯৬৯ সালে সম্পাদিত ‘কায়রো চুক্তি’ অনুযায়ী পিএলও লেবাননে অবস্থিত ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরগুলোর প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে এবং উক্ত শিবিরগুলো কার্যত লেবাননের অভ্যন্তরে একটি স্বশাসিত মিনি–রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭০ সালে জর্দানীয় গৃহযুদ্ধে জর্দানীয় সরকারের নিকট পিএলও পরাজিত হয় এবং পিএলওর সদর দপ্তর জর্দান থেকে লেবাননে স্থানান্তরিত হয়। বিশেষত দক্ষিণ লেবাননে পিএলওর উপস্থিতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং এর ফলে লেবানিজ–ইসরায়েলি সীমান্তে সংঘর্ষের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
১৯৭৫ সালে লেবাননে একটি অত্যন্ত জটিল ও বহুপাক্ষিক গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং পিএলও এই গৃহযুদ্ধের একটি পক্ষে পরিণত হয়। ১৯৭৬ সাল থেকে ইসরায়েল লেবাননে পিএলওর অবস্থান দুর্বল করার উদ্দেশ্যে ‘লেবানিজ ফোর্সেস’সহ বিভিন্ন পিএলওবিরোধী লেবানিজ ম্যারোনাইট খ্রিস্টান মিলিশিয়াকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করতে শুরু করে। একই সময়ে আরব লীগের সমর্থনপুষ্ট হয়ে সিরিয়া (ইসরায়েলের সবচেয়ে তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী) লেবাননে সৈন্য মোতায়েন করে। ১৯৭৮ সালের মার্চে ইসরায়েল লেবানন আক্রমণ করে, দক্ষিণ লেবানন দখল করে নেয় এবং লেবানিজ খ্রিস্টান মিলিশিয়া ‘সাউথ লেবানন আর্মি’র (এসএলএ) সঙ্গে মিলে পিএলওর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই ইসরায়েল লেবানন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়, কিন্তু সৈন্য প্রত্যাহারের পূর্বে তারা তাদের অবস্থানগুলো এসএলএর কাছে হস্তান্তর করে এবং এসএলএ ইসরায়েলি সমর্থনে পিএলওর বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে।
১৯৮২ সালের ৬ জুন ইসরায়েল লেবাননের ওপর পূর্ণমাত্রায় আক্রমণ শুরু করে এবং এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের মূল ‘লেবানন যুদ্ধ’ শুরু হয়। ইসরায়েলিদের এই আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল লেবানন থেকে পিএলওকে বিতাড়িত করা এবং লেবাননে আধিপত্য বিস্তারের মধ্য দিয়ে লেবানিজ–ইসরায়েলি সীমান্তকে সুরক্ষিত করা। কিন্তু শীঘ্রই ইসরায়েলি সশস্ত্রবাহিনী ও ইসরায়েলি–সমর্থিত বিভিন্ন লেবানিজ খ্রিস্টান মিলিশিয়া একটি অত্যন্ত জটিল প্রকৃতির যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। তাদেরকে পিএলও, সিরিয়া, বিভিন্ন লেবানিজ শিয়া মুসলিম, দ্রুজ ও বামপন্থী মিলিশিয়া এবং আর্মেনীয় ও কুর্দি মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়। তীব্র যুদ্ধের পর মার্কিন মধ্যস্থতায় ও একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনীর তত্ত্বাবধানে পিএলও ১৯৮২ সালের আগস্টে লেবানন ত্যাগ করে। কিন্তু যুদ্ধ অব্যাহত থাকে এবং ইরানি–সমর্থিত লেবানিজ শিয়া মুসলিম মিলিশিয়াগুলো ক্রমশ লেবাননে ইসরায়েলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হয়।
প্রায় তিন বছরব্যাপী যুদ্ধের পর ১৯৮৫ সালের জুন নাগাদ ইসরায়েল লেবাননের সিংহভাগ ভূখণ্ড থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয় এবং দক্ষিণ লেবাননে একটি ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ স্থাপন করে। কিন্তু ইরানি–সমর্থিত ‘হিজবুল্লাহ’ এবং অন্যান্য লেবানিজ ও ফিলিস্তিনি মিলিশিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলি ও ইসরায়েলি–নিয়ন্ত্রিত লেবানিজ খ্রিস্টান মিলিশিয়াগুলোর সংঘর্ষ চলতে থাকে। ১৯৯০ সাল নাগাদ লেবানিজ গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে এবং লেবাননের ওপর পূর্ণ সিরীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ইসরায়েল ও তাদের প্রক্সিরা দক্ষিণ লেবাননে যুদ্ধ অব্যাহত রাখে, কিন্তু তাদের পক্ষে অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা ক্রমশ অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। ২০০০ সালের ২৫ মের মধ্যে ইসরায়েল দক্ষিণ লেবানন থেকে তাদের সমস্ত সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের ‘লেবানন যুদ্ধে’র অবসান ঘটে।
অবশ্য দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরায়েলি সৈন্য প্রত্যাহারের পরেও ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। ২০০৬ সালের জুলাই–আগস্টে ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে পুনরায় লেবাননের ওপর আক্রমণ চালায়, কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয় এবং তাদেরকে লেবানন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে হয়। অবশ্য এখনো ইসরায়েলি–হিজবুল্লাহ সংঘর্ষের অবসান ঘটেনি, এবং এখন পর্যন্ত ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ লেবানন ও সিরিয়ায় পরস্পরের বিরুদ্ধে ‘ছায়া যুদ্ধে’ লিপ্ত।
লেবানন যুদ্ধে ইসরায়েলের সামগ্রিক সামরিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা মুশকিল, কারণ এই যুদ্ধের প্রকৃতি ছিল খুবই জটিল এবং এই যুদ্ধের সঠিক সময়সীমাও নির্ধারণ করা কঠিন। ১৯৭৮ সালে লেবাননের ওপর পরিচালিত ইসরায়েলি আক্রমণের সময় অন্তত ১৮ জন ইসরায়েলি সৈন্য নিহত এবং ১১৩ জন ইসরায়েলি সৈন্য আহত হয়। ১৯৮২–১৯৮৫ সালের লেবানন যুদ্ধ চলাকালে অন্তত ৬৫৪ জন ইসরায়েলি সৈন্য নিহত ও ৪ জন সৈন্য নিখোঁজ হয়, এবং ৩,৮৮৭ জন ইসরায়েলি সৈন্য আহত হয়। তদুপরি, এসময় ১২ জন ইসরায়েলি সৈন্য প্রতিপক্ষের হাতে বন্দি হয়। ১৯৮৫ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে দক্ষিণ লেবাননে চলমান সংঘর্ষে অন্তত ৫৫৯ জন ইসরায়েলি সৈন্য নিহত এবং ৮৪০ জন ইসরায়েলি সৈন্য আহত হয়। তদুপরি, ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধে অন্তত ১২১ জন ইসরায়েলি সৈন্য নিহত এবং ১,২৪৪ জন ইসরায়েলি সৈন্য আহত হয়। এছাড়া এর ফাঁকে ফাঁকে বিক্ষিপ্ত বিভিন্ন সংঘর্ষে আরো বেশ কিছু ইসরায়েলি সৈন্য হতাহত হয়েছে।
এর পাশাপাশি এই প্রলম্বিত যুদ্ধ চলাকালে ইসরায়েলিরা বহু সামরিক সরঞ্জাম হারায় এবং তাদের প্রক্সি লেবানিজ খ্রিস্টান মিলিশিয়াগুলোও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অনুরূপভাবে, ইসরায়েলের প্রতিপক্ষও এই সংঘাতে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা এই যুদ্ধে বিজয়ী হয়। এই যুদ্ধের ফলে লেবাননের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এই যুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে ইসরায়েলি অর্থনীতিও প্রচণ্ড চাপের সম্মুখীন হয়।
বস্তুত লেবাননে ইসরায়েলের প্রলম্বিত যুদ্ধের সঙ্গে ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য রয়েছে। ভিয়েতনামে সৈন্য প্রেরণের সময় মার্কিন সরকার ধারণা করেছিল, এটি একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ হবে, কিন্তু কার্যত এটি একটি প্রলম্বিত, জটিল ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে রূপ নেয়। অনুরূপভাবে, লেবাননে সৈন্য প্রেরণের সময় ইসরায়েলি সরকার ধারণা করেছিল, এটি একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ হবে, কিন্তু কার্যত এটি একটি প্রলম্বিত ও ভিয়েতনামের চেয়েও জটিল যুদ্ধে রূপ নেয়। সামগ্রিকভাবে লেবানন যুদ্ধ ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো রক্তক্ষয়ী ছিল না, কিন্তু লেবাননের আয়তন ও জনসংখ্যার অনুপাতে লেবানিজদের জন্য এই যুদ্ধ ছিল খুবই ধ্বংসাত্মক। মার্কিন সরকার ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পর কার্যত তাদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যায় এবং অনেকটা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই এই যুদ্ধের মাত্রা ব্যাপকভাবে প্রসারিত হতে শুরু করে। অনুরূপভাবে, ইসরায়েলি সরকার লেবানন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পর কার্যত তাদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য (লেবানন থেকে পিএলওর বিতাড়ন) থেকে দূরে সরে যায় এবং যুদ্ধটি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভিয়েতনাম যুদ্ধের সঙ্গে ইসরায়েলের লেবানন যুদ্ধের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য হচ্ছে, ১৯৬০–এর দশকের শেষদিকে যেমন মার্কিন জনসাধারণের মধ্যে ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল, ১৯৯০–এর দশকের শেষদিকে ইসরায়েলি জনসাধারণের মধ্যেও লেবানন যুদ্ধ নিয়ে অনুরূপ অসন্তোষ দেখা দেয় এবং ইসরায়েলি জনসাধারণ লেবাননে ইসরায়েলি সামরিক উপস্থিতির কারণে ইসরায়েলের নিরাপত্তা প্রকৃতপক্ষে নিশ্চিত হচ্ছে কিনা, সেটি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে। যুক্তরাষ্ট্র যেরকমভাবে ভিয়েতনামে মার্কিন সশস্ত্রবাহিনীর ক্রমবর্ধমান ক্ষয়ক্ষতি ও মার্কিন জনসাধারণের চাপের প্রেক্ষাপটে ভিয়েতনাম থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল, ইসরায়েলও অনুরূপভাবে লেবাননে ইসরায়েলি সশস্ত্রবাহিনীর ক্রমবর্ধমান ক্ষয়ক্ষতি ও ইসরায়েলি জনসাধারণের চাপের প্রেক্ষাপটে লেবানন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।
সর্বোপরি, ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পরপরই যেরকমভাবে সেই অঞ্চলে মার্কিন প্রক্সিদের (দক্ষিণ ভিয়েতনামি, লাও ও কম্পুচীয় সরকার) পতন ঘটেছিল, লেবানন থেকে ইসরায়েলি সৈন্য প্রত্যাহারের পরপরই অনুরূপভাবে লেবাননে ইসরায়েলি প্রক্সির (সাউথ লেবানন আর্মি) বিলুপ্তি ঘটে। ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর ভিয়েতনাম স্পষ্টভাবে সোভিয়েত প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে এবং মার্কিন প্রভাব বলয়ের বাইরে চলে যায়। অনুরূপভাবে, লেবানন থেকে ইসরায়েলি সৈন্য প্রত্যাহারের পর লেবাননে ইসরায়েলের প্রতিদ্বন্দ্বী হিজবুল্লাহর প্রভাব–প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায় এবং এখন পর্যন্ত হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের দ্বন্দ্ব অব্যাহত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভিয়েতনাম যুদ্ধের সঙ্গে ইসরায়েলের লেবানন যুদ্ধের এসব সাদৃশ্যের কারণে রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষকরা লেবানন যুদ্ধকে ‘ইসরায়েলি ভিয়েতনাম’ (Israeli Vietnam) হিসেবে অভিহিত করে থাকেন।