“আমি জাভেদ ইকবাল, ১০০টা শিশুর হত্যাকারী। আমি এই পৃথিবীকে ঘৃণা করি। আমি আমার কৃতকর্মের জন্য একদমই লজ্জিত নই। আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। আমার কোনো আফসোস নেই। আমি ১০০টি শিশুকে হত্যা করেছি।”
এগুলোই ছিল পাকিস্তানের লাহোর শহরের মধ্যবয়সী মুকরির বলা শেষ কথা। মুকরির প্রকৃত নাম জাভেদ ইকবাল। তার আরো একটি বড় পরিচয় হলো, সে পাকিস্তানের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর সিরিয়াল কিলার। তাছাড়া শুধু পাকিস্তান কেন, গোটা বিশ্বের ইতিহাস ঘেঁটেও এমন বিকৃতমনস্ক খুনির সন্ধান খুব কমই পাওয়া যাবে।
১০০ মাকে কাঁদানোর অঙ্গীকার
মুকরির শুরুর জীবনটা বেশ সাদামাটাই ছিল। আর দশটা সাধারণ মানুষের জীবন যেমন হয়ে থাকে আর কী। অবশ্য তার বাবা ছিলেন খুবই ধনাঢ্য একজন ব্যক্তি। স্টক মার্কেটের ট্রেডার ছিলেন তিনি। তাই মুকরির প্রাথমিক জীবনটা সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যেই কেটেছিল। কিন্তু এরপর কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হয় সে। সেসব ঘটনার জের ধরেই একপর্যায়ে তার মাথায় খুনের নেশা চাপে, এবং সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় “১০০ জন মাকে কাঁদাতে।” এবং সেই কাজে সে পুরোপুরি সফলও হয়েছিল।
চাইলে মুকরি আরো অনেক মায়ের চোখের জলের কারণ হতে পারত। কিন্তু সে ছিল “এককথার মানুষ,” তাই ১০০ জন মাকে কাঁদিয়েই সে খুশি ছিল।
“আমি চাইলে ৫০০ জনকে মারতে পারতাম। সেটা কোনো সমস্যাই ছিল না। টাকাও কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু আমি অঙ্গীকার করেছিলাম ১০০ শিশুকে মারার। সেই অঙ্গীকার আমি কখনোই ভাঙতে চাইনি।”
যেভাবে টোপ পেলে বালকদের ধর্ষণ করত
মুকরির মূল উদ্দেশ্য ছিল ৬ থেকে ১৬ বছর বয়সী বালকরা। ২০০১ সালে ডেইলি ডন পত্রিকায় প্রকাশিত তার নিজস্ব জবানবন্দি থেকে জানা যায়, কীভাবে অপরাধগুলো করত সে।
বালকদের আকৃষ্ট করতে একটি ভিডিও গেমস শপ চালু করেছিল সে। শাদবাগ এলাকায় সেটিই ছিল প্রথম এমন কোনো গেমস শপ। আর সেখানে খুব কম দামে গেমস খেলার টোকেন দেয়া হতো। অনেককে আবার বিনামূল্যে খেলতে দেয়াও হতো। তাই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ওই এলাকার বালকমহলে নামডাক ছড়িয়ে পড়েছিল গেমস শপটির। সব বালকেরই পরম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পরিণত হয়েছিল সেটি।
এরপর আরেকটি ফন্দি করেছিল মুকরি। মাঝেমধ্যে ইচ্ছা করেই মেঝেতে ১০০ রুপির নোট ফেলে রাখত সে। তারপর নজর রাখত, কে সেটি উঠিয়ে নেয়। এর কিছুক্ষণ পর সে ঘোষণা করত, তার ১০০ রুপি চুরি হয়েছে, তাই সবাইকে তল্লাশি করা হবে। এভাবে খুব সহজেই ‘চোর’-কে পাকড়াও করা হতো, এবং তারপর পাশের একটি ঘরে তাকে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হতো। কখনো কখনো ধর্ষণের পর ধর্ষিত বালককে ওই ১০০ রুপি দিয়ে দেয়াও হতো।
তবে ভিডিও গেমস শপ দিয়ে খুব বেশিদিন কাজ চালানো সম্ভব হয়নি মুকরির পক্ষে। কারণ কিছুদিন পরই ওই এলাকার অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের ভিডিও গেমস শপে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু তার যেহেতু অর্থের কোনো অভাব ছিল না, তাই পরবর্তীতে সে একটি মাছের অ্যাকুরিয়াম, এবং তারপর একটি জিমও খুলে ফেলেছিল।
যেভাবে এতগুলো অপরাধ করেও সবার চোখে ধুলো দিতে পেরেছিল
মুরকি মূলত সেসব গরিব, রাস্তায় রাত কাটানো বালকদেরকে তার লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিত, যাদের পক্ষে পরিবার ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া খুবই সম্ভব। এছাড়া সে অনেক বালকের সাথে পত্রিকা মারফত পত্রমিতালিও করত। কমবয়েসি বালকদের সাথে চিঠির মাধ্যমে বন্ধুত্ব গড়ে তুলত সে। এরপর বিভিন্ন দামি উপহার সামগ্রী পাঠিয়ে তাদের মন জয় করত। পরে সে যখন সেসব বালকদেরকে বলত তার কাছে ছবি পাঠাতে, তারা সরল মনে তাদের ছবি পাঠিয়ে দিত। সেখান থেকে যেসব বালকদের তার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হতো, ফাঁদ ফেলে তাদেরকেও অপহরণ করত সে।
বালকদের অপহরণ করে সে তার শাদবাগের বাসায় নিয়ে যেত। সেখানে নিয়ে গিয়ে প্রথমে সে ওই বালকদের ধর্ষণ করত, এবং তারপর তাদেরকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করত। কিন্তু শুধু ধর্ষণ ও হত্যা করেই থামত না সে, এরপর সে মৃতদেহগুলোকে কেটে টুকরো টুকরো করত। তারপর অবশিষ্ট অংশগুলো সে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড দিয়ে দ্রবীভূত করে ফেলত, যাতে মৃত বালকদের সমস্ত চিহ্ন পৃথিবীর বুক থেকে উধাও হয়ে যায়।
এরপর আর যা কিছু বাকি থাকত, সেগুলো সব মুকরি নদীতে ফেলে দিয়ে আসত। তার বাসার দেয়ালে পুলিশ ও সাংবাদিকরা রক্তের দাগ দেখতে পেয়েছিল। আর মেঝেতে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল একটি চেইন, যেটি দিয়ে সে বালকদেরকে হত্যার পর কেটে টুকরো করত। এছাড়া একটি প্লাস্টিকের ব্যাগও পাওয়া গিয়েছিল, যেটির ভিতর তার শিকারদের ছবি রাখা ছিল। আর দুটি বিশাল অ্যাসিডের ড্রামের ভিতর পাওয়া গিয়েছিল কয়েকজন বালকের দেহাবশেষ তথা হাড়গোড় ইত্যাদি। বালকদের জামাকাপড়ের স্তুপও সযত্নে রাখা ছিল তার বাসায়।
কী কারণে মুকরি উদ্বুদ্ধ হয়েছিল এমন বীভৎস সিরিয়াল কিলিংয়ে?
মুকরির বয়স তখন সবে বিশের কোঠায় পড়েছে। তখন একবার ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিল সে। তার নিজের ভাষ্যমতে, আসলে সে ধর্ষণের সাথে জড়িত ছিল না, পুলিশ তাকে জোরপূর্বক ফাঁসিয়ে দিয়েছিল। মুকরির মা মুকরিকে খুবই ভালোবাসতেন, এবং তিনি সম্ভাব্য সবকিছু করেছিলেন ছেলেকে জেল থেকে বের করতে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি।
অবশেষে মুকরি যখন জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিল, ততদিনে পুত্রশোকে তার মা মারা গিয়েছেন। মায়ের মৃত্যু সংবাদে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠেছিল মুকরির মনে। পৃথিবীর প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে গিয়েছিল। সে ঠিক করেছিল, তার মাকে যে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে, সেই যন্ত্রণা যেন আরো ১০০জন মা-ও ভোগ করে, এবং তারা উপলব্ধি করতে পারে তার মায়ের কতটা কষ্ট হয়েছিল। এরপরই নিজের পরিকল্পনা মোতাবেক অপহরণ, ধর্ষণ ও ১০০ জন বালককে হত্যা করে সে।
যেভাবে ধরা দেয়
পুলিশ নিজেরা কিন্তু মুকরিকে ধরতে পারেনি। ১৯৯৯ সালের শেষ দিকে সে নিজেই তার অপরাধের কথা স্বীকার করে একটি পত্রিকায় চিঠি পাঠিয়েছিল। সেই চিঠির সূত্র ধরে তাকে খুঁজে বের করতে বিশাল বড় ম্যানহান্টিংয়ের ব্যবস্থা করেছিল পাকিস্তানের পুলিশ। তারা এমনকি ডজনখানেক ব্যক্তিকে মুকরি সন্দেহে গ্রেফতারও করেছিল। কিন্তু প্রকৃত মুকরি দিব্যি পুলিশের চোখ এড়িয়ে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত এই ইঁদুর-বিড়াল খেলার অবসান ঘটিয়েছিল সে নিজেই।
মাসখানেক পর, ১৯৯৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর ধরা দিয়েছিল সে। কিন্তু সরাসরি পুলিশ স্টেশনে না গিয়ে, সে উপস্থিত হয়েছিল উর্দু সংবাদপত্র ডেইলি জাঙ-এর অফিসে। সেখানে গিয়ে নির্লিপ্তভাবে সে বলেছিল, “আমি জাভেদ ইকবাল, ১০০টি বাচ্চার হত্যাকারী।”
এছাড়া পত্রিকার অফিসের লোকদের হাতে মুকরি একটি ৩২ পাতার ডায়েরিও তুলে দিয়েছিল, যেখানে সে সবিস্তারে তুলে ধরেছিল কীভাবে বালকদের ধর্ষণ ও হত্যা করেছে সে। সেই সাথে তার কাছে সেই বালকদের ছবিও ছিল।
দেশব্যাপী বিক্ষোভ
মৃত বালকদের মায়েরা তাদের সন্তানের জামাকাপড় হাতে নিয়ে কাঁদছেন, টিভির পর্দায় এই দৃশ্য স্তব্ধ করে দেয় গোটা পাকিস্তানকে। মুকরির কর্মকান্ডের বিবরণ যখন একে একে প্রকাশ হতে থাকে, তখন রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায় চারিদিকে।
অবশ্য পুলিশের কাছে ধরা দেয়ার কিছুদিন পরই নিজের দোষ অস্বীকার করে মুকরি। নিজের পূর্বোক্ত জবানবন্দি ফিরিয়ে নেয় সে, এবং দাবি করে, সে নাকি নিছকই একটি কাহিনী বানিয়েছিল, যাতে করে পাকিস্তানি সমাজে শিশুদের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টিতে আলোকপাত করা যায়।
কিন্তু ততদিনে কারো আর বুঝতে বাকি নেই, মুকরি ঠিক কতটা মস্তিষ্কবিকৃত একজন মানুষ। এতগুলো হত্যার পরও তার মধ্যে ন্যূনতম অপরাধবোধ নেই, বরং সে এখন নিজের দোষ ঢাকতে আকাশ-কুসুম গল্প ফাঁদছে। তাই সকলে আরো বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল তার উপর। সকলের মুখে একটাই কথা, তাকেও ঠিক একই রকম কষ্ট দিয়ে মারতে হবে, যেভাবে সে নিরীহ-নিষ্পাপ বালকদেরকে মেরেছে।
এক অদ্ভূত শাস্তির রায়
বাস্তবিকই, ১৬ মার্চ, ২০০০ তারিখে বিচারপতি আল্লাহ বকশের প্রাথমিক রায়ে জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন ঘটেছিল। তিনি বলেছিলেন,
“জাভেদ ইকবাল ১০০ খুনের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। তার শাস্তি হলো, তাকে ১০০ বার শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হবে। এরপর তার শরীরকে ১০০ খন্ডে খন্ডিত করা হবে, এবং সেগুলো অ্যাসিডে দ্রবীভূত করা হবে, ঠিক যেমনটা সে তার শিকারদের সাথে করেছে।”
বিচারপতি আরো নির্দেশ দিয়েছিলেন, মুকরির শাস্তি কার্যকর করা হবে ইসলামি শরিয়াহ আইন অনুযায়ী প্রকাশ্য দিবালোকে। এজন্য তিনি বেছে নেন জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ, মিনার-ই-পাকিস্তানের পাশের বড় পার্কটিকে।
অবশ্য পাকিস্তানের সুশীল সমাজ এমন নৃশংস রায় মেনে নিতে পারেনি। পাকিস্তানের তৎকালীন ইন্টেরিয়র মিনিস্টার মইনুদ্দীন হায়দারও এই রায়ের সমালোচনা করে বলেছিলেন, “এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হবে। আমাদের দেশে এমন শাস্তি প্রক্রিয়া গ্রহণযোগ্য নয়।”
সমাপ্তি
সকল আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্কের পর এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল যে, কোনো অদ্ভূত শাস্তি নয়, মুকরি তথা জাভেদ ইকবালকে চিরাচরিত পদ্ধতিতে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হবে। সেরকমই সব ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু তা আর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার আগেই, মুকরি তার সাগরেদ সাজিদ আহমেদকে সাথে নিয়ে জেলের ভেতরেই আত্মহত্যা করে বসে। এভাবেই, পাকিস্তানের ইতিহাসের ভয়াবহতম সিরিয়াল কিলারটির জীবন অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/