পেশোয়া বাজিরাও বল্লাল। ভারতবর্ষের ইতিহাসবিখ্যাত হিন্দু বীরদের মাঝে চিরভাস্বর এক নাম। কালের কাল ফাঁদে ক্রমশ ফিকে, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় সদা জাজ্বল্যমান তিনি; বীরত্বের মূর্ত প্রতীক এক নাম, বাজিরাও। ভারতের ইতিহাসে প্রায় দুইশ বছর ধরে চলা শক্তিশালী মোঘল সাম্রাজ্যকে সমূলে গুঁড়িয়ে দেয়ার এক দুর্ধর্ষ প্রতিজ্ঞা বুকে নিয়ে তার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু। বলা হয়ে থাকে, সমগ্র জীবনে ৪১টিরও বেশি যুদ্ধে লড়েছেন তিনি এবং একটিও হারেন নি। অসাধারণ রণকৌশল, অভাবনীয় কূটনৈতিক বিচক্ষণতা, প্রদীপ্ত সাহস আর লক্ষ্যের প্রতি একাগ্রতা- এই ছিলো তার চরিত্রের সবচাইতে শক্তিশালী দিক। কিন্তু আসলে কে ছিলেন এই বাজিরাও?
১৭০০ সালের ১৮ আগস্ট এক প্রখ্যাত ব্রাহ্মণ বংশীয় ‘ভট্ট’ পরিবারে তার জন্ম। পরিবারে তার ডাকনাম ছিলো ‘রাও’। বাবা বালাজি বিশ্বনাথ, মা রাঁধাবাঈ। বাবা ছিলেন চতুর্থ মারাঠা সম্রাট (ছত্রপতি) সাহুর প্রথম পেশোয়া। তৎকালীন মারাঠা রাজদরবারের প্রধানমন্ত্রীকে পেশোয়া বলা হতো। পেশোয়া হতে হলে একজনকে মাথা আর বাহু দুদিক থেকেই সমান কুশলী হতে হতো। কৈশোরে বাবাকে বিভিন্ন সামরিক অভিযানে সঙ্গদানের মাধ্যমে রাও এর ঝুলিতে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা কম ছিলো না। এমনকি বাবার সাথে কারাবাসের অভিজ্ঞতাও তার ছিলো। ১৭২০ সালে বালাজির মৃত্যুর পর, মাত্র কুড়ি বছর বয়সে বাজিরাও নিজেকে তার বাবার পদটির জন্য উপযুক্ত দাবি করে বসেন। বিচক্ষণ ছত্রপতি সাহু তাকে সূক্ষ্ম নিরীক্ষণের পরে পেশোয়া হিসেবে মনোনীত করেন।
শোনা যায়, রাজসভায় দাঁড়িয়ে ছত্রপতির চোখে চোখ রেখে বুক চিতিয়ে বাজিরাও বলেছিলেন, “আঘাত করুন, মোঘল সাম্রাজ্যের গোড়ায় আঘাত করুন, ডালপালা এমনি খসে পড়বে। আমার পরামর্শ শুনুন, আমি অটোকের (রাওয়ালপিন্ডির নিকটবর্তী একটি এলাকা) দেয়ালের উপরে মারাঠা নিশান লাগিয়ে আসবো।” ছত্রপতি মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, “ঈশ্বর সহায়! তুমি হিমালয়ের চূড়াতেও এই নিশান লাগিয়ে আসবে।” সেই সময় মোঘল সম্রাটগণ মদ, নারী আর প্রাচুর্যের নেশায় চূর হয়ে স্বভাবতঃ অলস হয়ে পড়েছিলেন। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে উত্তর ভারত আক্রমণ করে মুসলিমদের সঞ্চিত বিশাল সম্পদ ভান্ডার হস্তগত করার পরিকল্পনা করেন রাও। তার লক্ষ্য ছিলো বিদেশী মুসলিম শাসকদের ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করে সমগ্র ভারতবর্ষে ‘হিন্দু-পৎ-পদশাহী’ তথা একক হিন্দু রাজত্ব কায়েম করা।
বাজিরাও এর সমগ্র জীবনটাই এক সংঘাতময় ইতিহাস। তার প্রথম সংঘাত বাধে হায়দ্রাবাদের নিজাম-উল-মূলক এর সাথে। মোঘলদের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে এই মোঘল রাজপ্রতিনিধি নিজের অধীনে এক স্বতন্ত্র রাজ্য গড়ে তোলার প্রয়াস চালান। ছত্রপতির নির্দেশে বাজিরাও তার সেনা নিয়ে প্রথমে নিজামের পক্ষ নিয়ে মোঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহর সৈন্যদলের বিরুদ্ধে লড়েন। ১৭২৪ সালে সখেরখেড়ের এই যুদ্ধে জয়লাভ করে নিজাম হায়দ্রাবাদে এক স্বাধীন রাজ্য লাভ করেন। কিন্তু উচ্চাকাঙ্খী নিজাম মারাঠাদের মারাঠা সাম্রাজ্যের গর্ব খর্ব করার লক্ষ্যে সুপরিকল্পিত জোট নিয়ে ১৭২৭ সালে পুনে আক্রমণ করে বসে। বাজিরাও তার চৌকস রণকৌশল কাজে লাগিয়ে পালখেড় নামক স্থানে যুদ্ধে নিজামকে পরাজিত ও পিছু হটতে বাধ্য করেন। এ বিজয়ের ফলে মারাঠা সাম্রাজ্য অনেক বড় ঝুঁকিমুক্ত হয় এবং অধিভুক্ত অঞ্চলগুলোতে মারাঠারা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খাজনা আদায়ের অধিকার লাভ করে।
১৭২৮ সালে বাজিরাও মালওয়াতে মোঘল সৈন্যদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এ সময় বুন্দেলখন্ডের রাজা ছত্রশাল, মোহাম্মদ বাংগাশ কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে তার কাছে সাহায্য চেয়ে বসেন। বাজিরাও তার সেনা নিয়ে জৈতাপুরে বাংগাশের বাহিনীকে ঘিরে ফেলেন ও পর্যুদস্ত করেন। চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বাংগাশ আর কখনো বুন্দেলখন্ডের সাথে ঝামেলা না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লী পালিয়ে যান। এই যুদ্ধে সাহায্যের কৃতজ্ঞতাস্বরুপ রাজা ছত্রশাল বাজিরাওকে তার পালকপুত্র হিসেবে ঘোষণা করে তাকে নিজের রাজত্বের তিনভাগের একভাগ দান করেন। সেইসাথে ছত্রশাল তার মুসলিম পত্নীর মেয়ে মাস্তানিকে বাজিরাও এর সাথে বিবাহ করান। উল্লেখ্য, মাস্তানি ছিলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী। তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন কাশিবাঈ। কাশিবাঈ এর গর্ভে তার দুটি এবং মাস্তানির গর্ভে একটি পুত্রসন্তান জন্মলাভ করে।
মাস্তানি ছিলেন একদিকে রুপে অতুলনীয়া, অন্যদিকে সর্বকলায় পারদর্শী। যতটা ভালো ছিলেন ঘোড়সওয়ারী, তলোয়ার চালনা আর যুদ্ধবিদ্যায়, ঠিক ততোটাই ভালো ছিলেন ধর্মশিক্ষা, কাব্যচর্চা, সঙ্গীত আর নৃত্যে। আর তাই হয়তো যোদ্ধা বাজিরাও এর অনেক বেশি প্রিয় ছিলেন তিনি। পুনেতে মাস্তানির জন্যে তিনি ‘মাস্তানি মহল’ নামে একটি মহলও তৈরি করান। তাদের অনবদ্য রসায়ন নিয়ে সাম্প্রতিককালে বলিউডে নির্মিত ‘বাজিরাও-মাস্তানি’ সিনেমাটিও অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছে।
পরবর্তীকালে ইতিহাসের অনেক উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ে বাজিরাও বীরত্বের সাথে নেতৃত্ব দেন এবং জয়লাভ করেন। ভারতবর্ষের মানচিত্রে মোঘল সাম্রাজ্যের নকশা বদলে দেন তিনি। তবে সংঘাত শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, সংঘাত তার পারিবারিক জীবন জুড়েও ছিলো। সংঘাত জীবনভর তার জীবনসঙ্গী ছিলো। রাও এর মা রাধাবাঈ ও ভাই চিমাজী আপ্পা কখনোই তার মুসলিম বিবাহ মেনে নিতে পারেন নি। বিভিন্ন সময়ে মাস্তানিকে জীবনঝুঁকির মুখে পড়তে হয়। পরিবার ও সমাজের অস্বীকৃতির মুখে বাজিরাও মাস্তানির পুত্রকে মুসলিম হিসেবেই মানুষ করেন। পরবর্তীতে এই পুত্র, শমশের বাহাদুর ১৭৬১ সালে পানিপথের যুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়ে নিহত হন।
বাজিরাও ছিলেন স্বাধীনচেতা এবং সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামিমুক্ত। মুসলিমদের শাসনের বিরুদ্ধে তার লড়াই ছিলো, ধর্মের বিরুদ্ধে নয়। আর তাই হিন্দু ব্রাহ্মণদের অসন্তোষের মুখে বুক ফুলিয়ে নিজের মুসলিম বংশের গোড়াপত্তন করেছিলেন তিনি। এই দিক থেকে দেখতে গেলে শুধু রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ক্ষেত্রেও বাজিরাও ছিলেন একজন সংস্কারক। বাহিনীর সকল সৈনিকের কাছে আস্থা আর ভালোবাসার পরম পাত্র ছিলেন রাও। ছত্রপতি শিবাজির পরে মারাঠা সাম্রাজ্য বিস্তারে তার অবদানই সবচেয়ে বেশি বলে মনে করা হয়। তার যুদ্ধের প্রধান কৌশল ছিলো শত্রুর দুর্বলতম দিক খুঁজে বের করা আর সেখানে সঠিক সময়মতো আঘাত করা। জটিলতম ভূমি অবস্থানে শত্রুকে আটকে ফেলে পরাজয়ে বাধ্য করা, শত্রুর মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়া অথবা যুদ্ধক্ষেত্র তার নিজের ইচ্ছামতো নির্ধারণে বাধ্য করা তার স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট ছিলো। ফিল্ড মার্শাল বার্নার্ড মন্টগোমারী তার ‘হিস্টোরী অব ওয়ারফেয়ার’ বইয়ে বাজিরাও এর যুদ্ধকৌশলের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
বাজিরাও এর মৃত্যু নিয়ে অনেকের মতামত রয়েছে। অনেকের ধারণা ১৭৪০ সালে নিজামপুত্র নাসির জঙের বিরুদ্ধে তার শেষ অভিযানে তিনি আহত হন এবং আঘাতের তীব্রতায় পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেন। তবে বেশিরভাগের ধারণা তিনি খরগাও জেলায় নিজের জায়গীর পরিদর্শনকালে আকস্মিকভাবে জ্বরে পড়েন এবং মৃত্যুবরণ করেন। ১৭৪০ সালের ২৮ এপ্রিল তার মৃত্যুর পরে রাওয়ারখেড়ীতে নর্মদা নদীর পাড়ে তার শবদাহ করা হয়।
বাজিরাও পেরেছিলেন তার প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী অটোক দখল করে সেখানে মারাঠা নিশান উড়াতে। পেরেছিলেন স্বাধীন ভারতের স্বপ্নটাকে অনেকদূর এগিয়ে দিতে। পুনেতে বাজিরাও এর পারিবারিক বাসভবন শনিবারবাড়াতে বর্তমানে রোজ হাজারো পর্যটক ভীড় করেন, এখানকার দেয়ালে দেয়ালে গাথা এক দুরন্ত বীরের গল্প কান পেতে শুনতে। প্রাসাদের সামনে চিরকালের অভ্যাসে যুদ্ধরত ভঙ্গিতে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাজিরাও এর প্রতিমূর্তিটি।