১৯৬৯ সালের নভেম্বর মাসের কথা। এক জরুরি মিটিংয়ে ছিলেন গ্লোবাল মেরিন শিপবিল্ডিং কোম্পানির প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা কার্টিস ক্রুক। কোম্পানিটির প্রকৌশল বিভাগ বলতে গেলে তিনিই দেখাশোনা করতেন। মিটিং চলাকালে হুট করে অপরিচিত তিনজন লোক ক্রুকের রুমে ঢুকে পড়লো।
একটু বিরক্ত চোখেই তাদের দিকে তাকালেন তিনি। “কী অদ্ভুত ব্যাপার রে বাবা! মিটিংয়ের মাঝে এরা আবার কী চায়!”, ঠিক এই কথাগুলোই হয়তো মনে মনে সেদিন বলেছিলেন তিনি। তবে তিনি জানতেন না, এই তিনজন লোক আসলে যেন-তেন কেউ না, বরং তারা এসেছে সিআইএ (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি) থেকে।
তো… তারা ক্রুকের কাছে কেন আসলো? সেটাও একটু আগেই বলা হয়েছে। তিনি গ্লোবাল মেরিনের মতো একটি ইনোভেটিভ জাহাজ নির্মাণ কোম্পানির প্রকৌশল বিভাগের কর্তাকর্তা। আর তার অভিজ্ঞতাই এখন দরকার সিআইএ-র।
সেই তিনজনের মাঝে একজন সিআইএ-র উর্ধ্বতন পর্যায়ের কর্মকর্তা, নাম তার জন প্যারাঙ্গস্কি। তিনি সরাসরিই ক্রুককে জানালেন সিআইএ’র চাহিদার কথা- সমুদ্রের কয়েক হাজার ফুট গভীর থেকে একটি ‘জিনিস’ তুলে আনতে হবে। আর এই কাজের জন্য সিআইএ গ্লোবাল মেরিনকেই যোগ্যতম কোম্পানি মনে করছে, ক্রুককে ভাবছে যোগ্যতম ব্যক্তি হিসেবে!
তাদের সাথে আলাপ সেরে নিজের রুমে একাকী বসে রইলেন কার্টিস ক্রুক। “বলে কী মানুষগুলো! এত নিচে থেকে এত ভারি জিনিস তুলে আনা! এ-ও কি সম্ভব!”
এসব ভাবতে ভাবতেই মাথায় কিছু হিসেব করছিলেন জাহাজ নির্মাণশিল্পের অভিজ্ঞ এই মানুষটি। এরপর হাতে তুলে নিলেন একটি বই, পাতা উল্টিয়ে চলে গেলেন সোভিয়েত সাবমেরিনের তথ্য সম্বলিত পৃষ্ঠায়। একটু নজর বুলিয়েই মুখে হাসি আসলো তার। হিসাব মিলে গেছে! সিআইএ-র লোকগুলো যে দাবি নিয়ে এসেছিল তা কোনো মানুষ চিন্তাও করতে পারবে না, কেবল গল্প-সিনেমাতেই এর খোঁজ মিলতে পারে। কিন্তু ক্রুক হিসাব করে বের করেছেন, এটা করা সম্ভব। এই রক্ত-মাংসের মানুষের দ্বারাই করা সম্ভব!
কিন্তু… কী সেটা?
⍟ ⍟ ⍟
এজন্য আমাদের চলে যেতে হবে আরও বছর দুয়েক আগে, ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে। তিনটি ব্যালিস্টিক নিউক্লিয়ার মিসাইলবাহী সোভিয়েত ডিজেল-ইলেকট্রিক সাবমেরিন কে-১২৯ চড়ে বেড়াচ্ছিল উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে। হঠাৎ করেই সাবমেরিন থেকে সকল প্রকার সংকেত আসা বন্ধ হয়ে যায়। একেবারেই নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যাওয়া যাকে বলে! অনেক অনুসন্ধান করেও সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ কে-১২৯ এর কোনো খোঁজই পেল না। ফলে তারা হাল ছেড়ে ফিরে আসে।
সোভিয়েতরা ফিরে আসলেও আমেরিকা কিন্তু ফিরে আসেনি! এখানে আবার আমেরিকার কথা আসছে কেন? কেন আসবে না সেটাই নাহয় বলুন! কারণ, তারাও গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিল, স্নায়ু যুদ্ধের এই সময়টাতে তাদের প্রতিপক্ষ বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটাই হারিয়ে ফেলেছে। আর সেটা যে কে-১২৯ এর মতো কোনো সাবমেরিন, সেটাও তারা ভালভাবেই আন্দাজ করতে পেরেছিল।
সাথে সাথেই শোরগোল পড়ে গেল উপরমহলে। আলোচনা শুরু হলো ওয়াশিংটন ডিসিতে। আমেরিকা কি পারবে এই সাবমেরিনটি খুঁজে বের করতে? খুঁজে পেলে সেটা কি আবার সমুদ্রের তল থেকে তুলে আনা সম্ভব? একবার যদি এই সাবমেরিনটি তুলে আনা যায়, তাহলেই সোভিয়েত ইউনিয়নের এই কে-১২৯ এর নির্মাণকৌশল, তিনটি ব্যালিস্টিক মিসাইল, নিউক্লিয়ার ওয়্যারহেড এবং সর্বাধুনিক ক্রিপ্টোগ্রাফি গিয়ার চলে আসবে আমেরিকার হাতে। তাই এই সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চাইল না কোনোভাবেই।
সোভিয়েত কর্তৃপক্ষকে ফিরে যেতে হয়েছিল, কারণ সাবমেরিনটি খুঁজে বের করতে যে প্রযুক্তির দরকার ছিল সেটা তাদের ছিল না। কিন্তু আমেরিকা আবার এদিকে এগিয়ে ছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রসর দেশটির কাছে ঠিকই সেই প্রযুক্তি ছিল। ইউএসএস হ্যালিবাটের সহায়তায় কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রায় ১,৫০০ মাইল এলাকা জুড়ে অনুসন্ধানের পর সমুদ্রপৃষ্ঠের ৩ মাইল নিচে সন্ধান মেলে সোভিয়েত ইউনিয়নের হারিয়ে যাওয়া সেই সাবমেরিনের।
সন্ধান তো মিললো, এবার দরকার অনুমোদনের। মানব ইতিহাসে এর আগে সমুদ্রের এত গভীর থেকে এত ভারী কোনোকিছুই তুলে আনা হয়নি। এ যেন অসম্ভব, কল্পনাতীত এক মিশন। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সেই মিশনেরই অনুমোদন দিলেন, যার দায়িত্ব গিয়ে বর্তাল সিআইএ-র ঘাড়ে।
প্রথাগত চিন্তা-ভাবনা দিয়ে যে এই কাজটির সমাধান করা সম্ভব না সেটা এতক্ষণে পাঠকেরা বুঝে যাবার কথা। এই ‘আউট অফ দ্য বক্স’ সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব পড়লো সিআইএ-র ইতিহাসে তর্কসাপেক্ষে অন্যতম সেরা প্রোগ্রাম ম্যানেজার জন প্যারাঙ্গস্কির কাঁধে। প্যারাঙ্গস্কি দায়িত্বটি নিলেন। শুরুতে ‘বোট-প্রজেক্ট’ নামে সকলের কাছে পরিচিত এই প্রজেক্টটিই এরপর হয়ে গেল ‘প্রজেক্ট অ্যাজোরিয়ান’। সিআইএ-র সাথে সংশ্লিষ্ট সেরা বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের নিয়ে একটি দল গড়ে তুললেন তিনি, নাম যার ‘থিঙ্ক ট্যাংক’। এই থিঙ্ক ট্যাংকের সদস্যদের অনেক আলাপ-আলোচনার পর শেষপর্যন্ত একটি উপায়ই বেরিয়ে আসলো সাবমেরিনটি তোলার জন্য। এমন একটি জাহাজ নির্মাণ করতে হবে যেটি থেকে বেরিয়ে আসা ডিভাইসের সাহায্যেই সাগরের তলদেশ থেকে তুলে আনা হবে ১৪ লক্ষ কেজি ওজনের সাবমেরিনটি!
বিষয়টি যে কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল তা বোঝার জন্য আরও কিছু তথ্য দেয়াটা জরুরি। তখন পর্যন্ত সাবমেরিন তুলে আনার রেকর্ডটি ছিল সমুদ্রপৃষ্ঠের ৯০ মিটার নিচে থেকে। ওদিকে কে-১২৯ ছিল প্রায় ৫,০০০ মিটার নিচে! সাথে এর ওজন তো ছিলই।
এমন পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়েই সিআইএ দ্বারস্থ হয় গ্লোবাল মেরিনের, তারা সাহায্য চায় কার্টিস ক্রুকের মতো একজন অভিজ্ঞ লোকের কাছ থেকে।
⍟ ⍟ ⍟
সিআইএ-র এই চাহিদার কথা শুনে কাজে নেমে পড়লেন ক্রুক, সাথে নিলেন তার অভিজ্ঞ লোকজন। জন গ্রাহাম ছিলেন এমনই একজন, যিনি তখন কাজ করছিলেন গ্লোবাল মেরিনের শীর্ষস্থানীয় একজন নৌ-স্থপতি হিসেবে। বেশ খাটাখাটনির পর তিনি এমন একটি জাহাজ ও ডিভাইসের নকশা করতে সক্ষম হলেন যার সাহায্যে আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব এই কাজটিই সম্ভব করা যাবে। হিসেব করে দেখা গেল, কেবল নকশায় না, বাস্তবেও এর নির্মাণ সম্ভব। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অন্য জায়গায়। কাজটি করার জন্য প্রশান্ত মহাসাগরের যে জায়গাটিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবমেরিনটি নিখোঁজ হয়েছে, ঠিক সেই জায়গাটিতেই কয়েক সপ্তাহ ধরে অবস্থান করতে হতো নকশাকৃত সেই জাহাজটিকে। এই বিষয়ে কথা উঠলে তারা সংবাদমাধ্যম বা অন্য কোনো রাষ্ট্রকে বুঝ দেবেই বা কী করে?
এজন্য সিআইএ-র দরকার ছিল একটি গল্পের; তবে সেটা যেন-তেন হলে চলবে না, একেবারে বিশ্বাসযোগ্য করেই উপস্থাপন করতে হবে সকলের সামনে। এমন পরিস্থিতিতে আবারও এগিয়ে আসলো প্যারাঙ্গস্কির থিঙ্ক ট্যাংক গ্রুপ। সিদ্ধান্ত হলো, পুরো বিশ্বকে জানানো হবে, এটি একটি খননকারী জাহাজ, যা সাগরতল থেকে ম্যাঙ্গানিজ তুলে আনতে সেখানে অবস্থান করছে। তবে এখানেও একটি ঝামেলা রয়ে গিয়েছিল। ম্যাঙ্গানিজ উত্তোলন হবে ঠিক আছে, কিন্তু সেই জাহাজের মালিকানা তো তাহলে সিআইএ-র থাকা চলবে না। এজন্য এমন একজনকে দরকার ছিল যিনি হবেন সেই জাহাজটির মালিক।
এমন সময় দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটে আমেরিকার প্রখ্যাত ধনী ব্যবসায়ী হাওয়ার্ড হিউজেসের। অর্থ-বিত্তের কোনো কমতি ছিল না তার। শখের বশে বিভিন্ন সময়ই অঢেল অর্থ খরচ করেছেন। অর্থ ঢেলেছেন সরকারি নানা প্রজেক্টেও, যার মাঝে সিআইএ-র কিছু প্রজেক্টও ছিল। হিউজেসের কাছে তাই যখন এবারের প্রজেক্টের প্রস্তাব গেল, তিনি মানা করলেন না, রাজি হলেন একবাক্যেই। প্রজেক্ট অ্যাজোরিয়ানে ব্যবহৃত জাহাজটির নাম তাই রাখা হলো ‘হিউজেস গ্লোমার এক্সপ্লোরার’, যাতে করে এর মালিকানা নিয়ে কারও মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহও দানা বাঁধতে না পারে।
হাওয়ার্ড হিউজেসের এই অন্তর্ভুক্তি বেশ কাজে আসলো। সাংবাদিকেরা তার এই অভিনব উদ্যোগকে ঘিরে ভাল রিপোর্ট করতে থাকল। সিআইএ-ও এই গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা আনয়নের জন্য যা যা করা দরকার তার সব করতে লাগল। ওদিকে প্যারাঙ্গস্কিসহ প্রজেক্ট অ্যাজোরিয়ানের বাকি সদস্যরা লস অ্যাঞ্জেলস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের ওখানে এক গোপন অফিসে জাহাজ সংক্রান্ত কাজ এগিয়ে নিতে থাকল।
⍟ ⍟ ⍟
১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে ক্যালিফোর্নিয়ার লং বিচের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল এক্সপ্লোরার। সেখানে পৌঁছার পর শুরু হলো কে-১২৯ সংক্রান্ত মূল কর্মযজ্ঞ। একে একটি স্পাই শিপে রুপ দেয়া এবং সেই সাথে সাবমেরিনটিকে চুরি করে এর ভেতরে স্থান দেয়ার জন্য যা যা দরকার তার সবই করতে লাগল কর্মীরা।
এক্সপ্লোরার সেখানে আসার আগেই সিআইএ-র পক্ষ থেকে আরেকটি কাজ করে রাখা হয়। তারা কন্টেইনারের ভেতর বেশ কিছু সিক্রেট ল্যাব বানিয়ে রাখে। এর মাঝে ছিল ডার্করুম, নিউক্লিয়ার ম্যাটারিয়াল নিয়ে কাজ করবার জন্য বিভিন্ন জিনিসপত্র, সাবমেরিন থেকে পাওয়া ডকুমেন্টগুলো শুকানো ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা, আবর্জনা ব্যবস্থাপনা ইউনিট এবং একটি মর্গ যেখানে সাবমেরিনের ক্রুদের দেহাবশেষ রাখা হবে।
সবকিছু নাহয় হলো, এখন দরকার প্রশান্ত মহাসাগরের উদ্দেশ্যে অশান্ত এক যাত্রা! কিন্তু বাগড়া বাধল সেখানেই। কারণ যে জায়গাটিতে কে-১২৯ ডুবে যায়, সেই জায়গায় সমুদ্র বেশ উত্তাল। ফলে গ্রীষ্মের মাঝামাঝি ব্যতীত অন্য কোনো সময় গিয়ে সেখানে উদ্ধারকার্য (আসলে কি ‘চৌর্যবৃত্তি’ হবে না?) চালানো সম্ভব না। ফলে ১৯৭৪ সালের জুন মাসেই মিশনটি শুরু করে দিতে হতো। নাহলে অপেক্ষা করতে হতো পুরো একটি বছর।
এখানেও ছিল আরেকটি সমস্যা। কারণ, এতদিন ধরে একটি মিথ্যা গল্পকে ধরে রাখা বেশ কষ্টকর বিষয়ও বটে। ফলে অনন্যোপায় প্যারাঙ্গস্কি ১৯৭৪ সালের ২০ জুনই যাত্রা শুরুর দিন ধার্য করলেন। তখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকমতো চেকও করা হয়নি। জাহাজটিতে থাকা বিভিন্ন পেশা থেকে আগত ১৭৮ জন মানুষ রাত-দিন খাটছিল এক অসম্ভবকে সম্ভব করার মিশন নিয়েই। তাদেরকে সত্য কথাই জানানো হয়, যাতে করে তারা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে কাজের বেলায় কোনো রকম গাফিলতি না দেখায়। জীবনের ঝুঁকি ছিল এই মিশনে আসা সকলেরই। তাই সকলের জন্যই জীবনবীমার ব্যবস্থা করা হয়। তারাও সিআইএ-কে জানিয়ে রাখে জরুরি দরকারে কার সাথে যোগাযোগ করতে হবে সেই ঠিকানা।
কী হতো যদি কে-১২৯ তুলে আনার সময় হুট করে সোভিয়েত কোনো জাহাজ সেখানে চলে আসতো কিংবা আক্রমণ করেই বসতো। এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়ার কোনো উপায়ই ছিল না। তারপরেও এক্সপ্লোরারে কোনো অস্ত্র কিংবা মেরিন সদস্যকে রাখা হয়নি। কারণ তাহলে তারা যে মিথ্যা গল্পটা সবার কাছে বলে এসেছে সেটা ফাস হয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল। তাই সিদ্ধান্ত হলো একেবারে ঢাল-তলোয়ার ছাড়াই যুদ্ধে উপনীত হতে হবে। যদি সোভিয়েত কোনো জাহাজ চলেও আসে, তারপরেও সমস্যা হবে না যদি উদ্ধারকার্যে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি তখন সাগরের তলদেশে লুকনো থাকে।
⍟ ⍟ ⍟
৪ জুলাই গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেল এক্সপ্লোরার। এরপরই শুরু হয়ে গেল সাবমেরিনটি তুলে আনার কাজ। নামিয়ে দেয়া হলো থাবার মতো ডিভাইসটি (যাকে বলা হচ্ছিল ‘ক্লেমেন্টাইন’)। এক পা এগিয়ে যেন দুই পা পিছিয়ে আসা লাগছিল। কেননা, আগে থেকে চেক করার জন্য তেমন সময় পাওয়া যায়নি বলে একটু পরপরই বিভিন্ন ডিভাইসে সমস্যা দেখা দিচ্ছিল। ফলে সেগুলো ঠিক করতে বেশ সময় লেগে যাচ্ছিল।
সাগর যতটা শান্ত থাকবে আশা করা হয়েছিল তেমনটা দেখা গেল না; আবহাওয়াও অনুকূলে না; ওদিকে মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে ১৮ তারিখে দেখা দিল সোভিয়েত জাহাজ চাঝ্মা!
এক্সপ্লোরারের গতিবিধি ও কার্যক্রম মোটেই সুবিধার ঠেকলো না চাঝ্মার ক্যাপ্টেনের কাছে। ফলে এক্সপ্লোরারকে ঘিরে চক্কর দিতে লাগলেন তিনি। উপর থেকে ছবি তোলার জন্য পাঠানো হলো হেলিকপ্টার। তবে ভাগ্য সহায় ছিল এক্সপ্লোরারের। তাদের কাজকর্ম সম্বন্ধে চাঝ্মার ক্যাপ্টেন জানতে চাইলে এক্সপ্লোরারের ক্যাপ্টেন জানালেন সেই মুখস্ত বুলিই, ম্যাঙ্গানিজ খননের কাজে এসেছেন তারা। সেই কথা বিশ্বাস করে বিদায় নিল চাঝ্মা; হাঁপ ছেড়ে বাঁচল এক্সপ্লোরারে থাকা সকলেই।
আরও দুদিন চলে গেল। এক্সপ্লোরারের কাজ এগোচ্ছিল ভালভাবেই। এমন সময় দেখা দিল সোভিয়েত টাগবোট এসবি-১০। নষ্ট করার মতো সময় আর তখন এক্সপ্লোরারের হাতে নেই। তাই ক্যাপ্টেন আলাপ চালিয়ে যেতে লাগলেন এসবি-১০ এর সাথে, আর অন্যরা তাদের কাজ ঠিকই চালাতে লাগলো।
শীঘ্রই সাবমেরিনটি স্পর্শ করলো ক্লেমেন্টাইন। লাইভ সিসিটিভি ফুটেজ, সাইড-স্ক্যান সোনার এবং ছোট থ্রাস্টারের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছিল ক্লেমেন্টাইনটি। সবকিছু খাপে খাপ মিলিয়ে বসে যাবার পর কন্ট্রোল রুম জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো হর্ষধ্বনি। এবার পালা থাবাটি উঠিয়ে আনার। এটাও মুখের কথা না; এতে লেগে যাবে আরও বেশ কয়েকদিন। ওদিকে পানির উপরে এসবি-১০-কেও বুঝিয়ে বিদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন এক্সপ্লোরারের ক্যাপ্টেন। ফলে সব কিছু একেবারে পরিকল্পনামতোই এগোচ্ছিল।
কয়েক দিন চলে গেল। ইতোমধ্যে ক্লেমেন্টাইনের দুই-তৃতীয়াংশ তুলে আনা হয়েছে। ফলে সাবমেরিনটি পেতে আর খুব বেশি সময় বাকি নেই। এমন সময়ই যেন বিপদ আছড়ে পড়লো প্রজেক্ট অ্যাজোরিয়ানের উপর। এই অতিরিক্ত ভার সইতে না পেরে ক্লেমেন্টাইনের বেশ কিছু অংশই ভেঙে পড়লো। ফলে সাবমেরিনটির অধিকাংশ অংশই আবারও তার আগের জায়গায় তলিয়ে গেল!
সব কিছু শুনে প্যারাঙ্গস্কির তো মাথায় হাত। সাথে সাথেই তিনি ছুট লাগালেন সিআইএ হেডকোয়ার্টারে। ওদিকে প্যারাঙ্গস্কির মুখ থেকে এসব শুনে তার বসেরও আক্কেল গুড়ুম হবার দশা। সিআইএ-র তৎকালীন পরিচালক উইলিয়াম কলবি বললেন আরেকবার চেষ্টা করতে, কিন্তু জবাব এলো কেবল একটি শব্দই, “অসম্ভব!”
কে-১২৯ তুলে আনতে যে থাবাটি বানানো হয়েছিল, তা পুরোপুরিই ভেঙে গিয়েছিল। ফলে নতুন করে সাগরের তলদেশ থেকে সাবমেরিনটি তুলে আনার মতো অবস্থায় সেটি আর ছিল না। আনতে গেলেও তা করতে হবে পরের বছর, এই বছর কোনোভাবেই না!
কার্টিস ক্রুক ভেবেছিলেন, এবার না হলেও জাহাজ আর ক্লেমেন্টাইনের সংস্কার ও উন্নতি সাধনের মাধ্যমে পরের বছর ঠিকই তিনি অসমাপ্ত কাজটি সেরে আসবেন। কিন্তু না, তার সেই আশাও পূরণ হয়নি। মানুষজন সিআইএ-র সেই সাজানো গল্প আর বিশ্বাস করেনি। ভেতর থেকেই কেউ মিডিয়ার কাছে সত্যটা জানিয়ে দেয়। ফলে কলবির কথা আর খুব বেশি দিন কেউ আমলে নিল না। ওদিকে সত্যান্বেষী, পুলিৎজার প্রাইজ জয়ী সাংবাদিক জ্যাক অ্যান্ডারসন ১৯৭৫ সালের ১৮ মার্চ বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন প্রজেক্ট অ্যাজোরিয়ানের আদ্যোপান্তই! ফলে গোপন কথাটি আর কিছুতেই গোপন রইল না, জেনে গেল পুরো বিশ্ববাসীই।
⍟ ⍟ ⍟
তো… তাহলে প্রজেক্ট অ্যাজোরিয়ানকে কী বলবেন আপনি? সফল, আংশিক সফল, নাকি একেবারেই ব্যর্থ?
- কে-১২৯ পুরোপুরি তুলে আনা না গেলেও এর অংশবিশেষ ঠিকই এসেছিল সিআইএ-র হাতে, যার ভেতরে ছিল দুটো নিউক্লিয়ার টর্পেডো। আরও কিছু থাকলেও সেগুলো যে কী তা সিআইএ কখনোই প্রকাশ করেনি!
- ২০০৬ সালে আমেরিকান সোসাইটি অফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স এক্সপ্লোরারকে আখ্যায়িত করে ‘হিস্টোরিক মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যান্ডমার্ক’ হিসেবে। মানবনির্মিত ২৩৯-তম অবজেক্ট হিসেবে এই সম্মান অর্জন করে জাহাজটি।
- স্ক্রিপ্স ইনস্টিটিউটের পরিচালক তো এই অল্প সময়ে এক্সপ্লোরারের মতো এমন মহাযজ্ঞ নির্মাণের বিষয়টিকে তুলনা করেছেন খোদ ম্যানহাটন প্রজেক্টের সাথেই, যেখানে তিনি নিজেও তরুণ বয়সে কাজ করেছিলেন।
লেখার শেষে তাই বলায় যায়, মানসিকতা বা দেশভেদে সিআইএ-র এই কাজটি ‘চৌর্যবৃত্তি’ কিংবা ‘উদ্ধারকার্য’ যে নামই পাক না কেন, এটা যে এক অবিশ্বাস্য রকমের কাজ ছিল সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব এক কাজকেই প্রায়-সম্ভব করে ফেলেছিল কার্টিস ক্রুকের দল এবং প্যারাঙ্গস্কির থিঙ্ক ট্যাংক। আরও এক বছর হাতে পেলে হয়তো সম্ভব হয়েও যেত সেটা! তবে এখন আর ‘যদি… তবে…’ জাতীয় আলাপে না যাই। তাহলে শাখা-প্রশাখা গজিয়ে লেখার কলেবর যে কোথায় যাবে তা লেখক নিজেও জানেন না!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমা হামলার শিকার হওয়া এক মেয়ের জীবনের মর্মস্পর্শী গল্প জানতে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে:
১) সাচিকো – নাগাসাকির পারমাণবিক বোমার হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক শিশুর জীবন সংগ্রামের সত্য ঘটনা