অস্ট্রিয়া আর ফ্রান্স যখন স্প্যানিশ সিংহাসনের দখল নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে তখন রাশিয়া আর সুইডেনের মধ্যে দানা বাঁধছিল উত্তেজনা। কাজেই ক্ষমতা হাতে নিয়েই ফ্রেডেরিক উইলিয়াম জড়িয়ে পড়েন রাশিয়া আর সুইডেনের সংঘর্ষে, যাকে দ্য গ্রেট নর্দার্ন ওয়ার নামেও অভিহিত করা হয়। রাশিয়ার জার প্রথম পিটার (পিটার দ্য গ্রেট) চাইছেন রাশিয়াকে শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবে গড়ে তুলতে। তার সাথে টক্কর লেগে গেল তৎকালীন পরাশক্তি সুইডেনের। এতে জড়িয়ে পড়ে ডেনমার্ক, নরওয়ে এবং প্রুশিয়াসহ জার্মানির রাষ্ট্রগুলো।
যদিও প্রুশিয়ার প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা অন্যান্য পক্ষের থেকে তুলনামূলকভাবে কম ছিল, তবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই যুদ্ধ ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের সামরিক সংস্কারকে ত্বরান্বিত করে। এর পেছনে ছিল নর্দার্ন ওয়ারের ফলে সুইডিশ সাম্রাজ্যের শক্তি নিঃশেষিত হয়ে যাওয়া, যা এই অঞ্চলে তৈরি করে ক্ষমতার শূন্যতা। ফ্রেডেরিক একে কাজে লাগিয়ে সামরিক শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে সেই শূন্যতা পূরণ করতে চাইছিলেন। তবে তিনি পরাশক্তি হিসেবে প্রুশিয়ার উত্থান দেখে যেতে না পারলেও তার ছেলে বাবার আশা পূর্ণ করেন। সুতরাং প্রুশিয়ার ইতিহাসে নর্দার্ন ওয়ারের গুরুত্ব যথেষ্ট। তাই সংক্ষেপে এর ঘটনাবলী তুলে না ধরলে প্রুশিয়ার ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
পটভূমি
ষোড়শ আর সপ্তদশ শতাব্দীতে সুইডিশ সাম্রাজ্য ছিল প্রায় অপ্রতিরোধ্য। তাদের শক্তিশালী আর সুদক্ষ সেনাবাহিনীর আগ্রাসন সুইডেনের বলয়ে যোগ করেছিল নতুন নতুন ভূখণ্ড। কারেলিয়া, ইনগ্রিয়া, এস্থোনিয়া আর লিভোনিয়া নিয়ন্ত্রণে রেখে রাশিয়াকে তারা বাল্টিক সাগর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে সুইডিশ প্রদেশ ছিল ডেনমার্ক আর নরওয়ের মাথাব্যথার কারণ। ওদিকে স্লেশউইগ আর হোলস্টেইন ডাচি (Schleswig and Holstein) ডেনমার্ক চিরকালই নিজের বলে দাবি করত। কিন্তু সুইডেনের সমর্থনপুষ্ট হোলস্টেইন-গটর্প (Holstein-Gottorp) পরিবার ডাচি শাসন করত ডেনমার্কের প্রতি কর্ণপাত না করেই। জার্মানির গাত্রদাহের কারণ ছিল হলি রোমান এম্পায়ারে সুইডেনের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা। এর সাথে প্রুশিয়ার নজর ছিল পোমেরানিয়ার সুইডিশ অংশের দিকে। ব্র্যান্ডেনবার্গ-প্রুশিয়ার প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই কয়েকবার এখানকার শাসকেরা পোমেরানিয়া হস্তগত করার চেষ্টা করেছেন, ফলশ্রুতিতে পোমেরানিয়া দুই ভাগ হয়ে গেছে প্রুশিয়া আর সুইডেনের মধ্যে। কিন্তু প্রুশিয়ার চাই পুরোটাই। কাজেই সুইডেনের বিপক্ষে অসন্তোষ থেকে বড় একটি বিরোধী জোটের ক্ষেত্র তৈরি করাই ছিল।
১৬৯৭ সালে সুইডিশ রাজা একাদশ চার্লস মারা গেলে ক্ষমতায় বসলেন তার চোদ্দ বছর বয়স্ক পুত্র। কাঁচা বয়সের দ্বাদশ চার্লসকে জোট সহজ প্রতিপক্ষ মনে করে আক্রমণ করতে স্থির করল। ডেনমার্ক আর নরওয়ে এখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। রাশিয়া, পোল্যান্ড, স্যাক্সোনি তাদের সাথে যোগ দেয়। প্রুশিয়া আর হ্যানোভার এই পর্যায়ে কোন পক্ষকে সমর্থন করা থেকে বিরত থাকে। জোটের প্ল্যান ছিল কয়েক মাসের ব্যবধানে সুইডিশ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে আঘাত হানা। সেইমত সিদ্ধান্ত হল ১৭০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে পোলিশ রাজা দ্বিতীয় অগাস্টাস লিভোনিয়া, মার্চে ডেনমার্ক-নরওয়ের রাজা চতুর্থ ফ্রেডেরিক স্লেশউইগ-হোলস্টেইন এবং রাশিয়ান জার পিটার অক্টোবরে এস্থোনিয়ার বন্দরনগরী নার্ভাতে (Narva) হামলা চালাবেন। সূচনা হল সহিংসতার, দ্য গ্রেট নর্দার্ন ওয়ার।
দ্বাদশ চার্লস
শত্রুরা দ্বাদশ চার্লসকে ছোট করে দেখেছিল। কিশোর বয়সী রাজা ছিলেন সমসাময়িকদের থেকে বহু পরিণত। তিনি একদিকে ছিলেন যেমন কুশলী সেনানায়ক, অন্যদিকে কূটনৈতিক খেলাতেও তার দক্ষতা ছিল ঈর্ষণীয়। তার হাতে শক্তিশালী সেনা আর নৌবাহিনী, কোষাগারে অর্থেরও কোনো অভাব নেই। ভবিষ্যতে বহুবার এই ব্যক্তি স্বল্প সংখ্যক সেনা নিয়ে বারেবারে অধিক সংখ্যক শত্রুকে পরাজিত করবেন। ভলতেয়ারের চোখে দ্বাদশ চার্লস ছিলেন ক্ষণজন্মা এক সম্রাট।
সুইডিশ প্রতি-আক্রমণ
চার্লস ফয়সালা করলেন জোটের প্রত্যেক রাষ্ট্রকে আলাদা আলাদাভাবে দাঁতভাঙা জবাব দেবার। প্রথম দুর্ভাগা ছিল ডেনমার্ক। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে অগাস্ট মাসে গোপনে চার্লস তার সেনাদের নিয়ে জাহাজে করে কোপেনহেগেনের অনতিদূরে জেইল্যান্ড (Sjaelland) দ্বীপে এসে পৌঁছেন। ড্যানিশরা হতভম্ব হয়ে গেল। চার্লস স্লেশউইগ-হোলস্টেইনের দিকে না এসে উল্টো সরাসরি ডেনমার্কের প্রাণভোমরা কোপেনহেগেনে কীভাবে এলেন ভাবতে ভাবতে তাদের মাথা গরম হয়ে যায়। ক্ষমতা বাঁচাতে চতুর্থ ফ্রেডেরিক তাড়াহুড়ো করে কোপেনহেগেনের দিকে ফেরত এলেন। দোরগোড়ায় সুইডিশ সেনাবাহিনীর হুমকিতে ডেনমার্ক মাস ফুরানোর আগেই লড়াই থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে।
ডেনমার্কের বিষয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে চার্লস এবার বাল্টিকের দিকে অভিযান চালাতে মনস্থ করলেন। সেদিকে পিটার নার্ভা অবরোধ করেছেন। ১০,০০০ সুইডিশ সৈন্য এস্থোনিয়ার পার্নুতে (Pärnu) অবতরণ করে। এখান থেকে পূর্বে পিটারের ২৩,০০০ সৈন্য নার্ভা ঘিরে রেখেছিল। নভেম্বর মাসের ৩০ তারিখ তুষারঝড়ের মাঝে চার্লস রাশিয়ান শিবিরে প্রচণ্ড আঘাত হানেন। জার পিটার লড়াইয়ে আহত হন, তিনি পরাজয় আসন্ন বুঝে পিছিয়ে যান।তিনি অনুধাবন করলেন চার্লসকে কাবু করতে হলে তার সেনাদলের সংস্কার দরকার। রাশিয়া যুদ্ধ থেকে বিরতি নিয়ে সেদিকে মনোযোগ দেয়। কৌশলগত কারণে এই সময় তারা গালফ অফ ফিনল্যান্ডে একটি নৌঘাঁটিও স্থাপন করে।
রাশিয়া আর ডেনমার্ক নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ায় চার্লস এবার সম্পূর্ণ মনোযোগ দিলেন পোল্যান্ডের দিকে। সুইডিশ সেনাবাহিনীর অব্যাহত আক্রমণে পোল্যান্ড অস্থির হয়ে পড়ে। ১৭০২ সালের মে মাসে সুইডিশ সেনাবাহিনী ওয়ারশতে প্রবেশ করে। দুই মাস পরে ক্লিসফে’র (Kliszow) কাছে তিনি অগাস্টাসকে পরাস্ত করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল অগাস্টাসকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা। ১৭০৪ সালে তিনি সফল হন। তার প্ররোচনাতে ১৭০৪ সালে অগাস্টাসকে ক্ষমতাচ্যুত করে পোলিশরা ক্ষমতায় বসাল চার্লসের পছন্দের প্রার্থী প্রথম স্ট্যানিস্লকে। পোল্যান্ড থেকে বিতাড়িত হলেও অগাস্টাস স্যাক্সোনির ইলেক্টর ছিলেন। কিন্তু ১৭০৬ সালে চার্লস সেখানেও ঢুকে পড়েন।বিজিত অগাস্টাসের উপর চাপিয়ে দেয়া হয় আইটানস্টেডট (Altranstädt) চুক্তি, যার দ্বারা তৎকালীন স্যাক্সোনিতে অত্যাচারিত প্রোটেস্ট্যান্টদের ধর্মীয় অধিকার স্বীকৃত হয়।
রাশিয়ার সাথে নতুন সংঘর্ষ
ডেনমার্ক, স্যাক্সোনি আর পোল্যান্ড হার মানলেও রাশিয়াতে জার পিটার কিন্তু সেনাবাহিনী গোছাচ্ছিলেন। চার্লস নিজেও জানতেন তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এখন রাশিয়াই। চার্লস যখন পোল্যান্ডে ব্যস্ত, সেই অবসরে পিটার ১৭০৪ সালে নার্ভা আর ইনগ্রিয়া কব্জা করেছেন। ১৭০৩ সালে তিনি বাল্টিকের কোল ঘেঁষে বানিয়েছেন নয়নাভিরাম নগরী সেন্ট পিটার্সবার্গ। ১৭০৫ সালে রাশিয়ান সেনা নিয়ে স্কটিশ এক জেনারেল অগিলভি (Ogilvie) পোল্যান্ডের পুটস্ক (Pultusk) শহরের কাছে এসে হাজির হলো। শহরের সুইডিশ কন্টিনজেন্টের প্রধান লিয়েভেনহপ্ট (Lewenhaupt) রিগার দিকে সরে গেলেন। শীত চলে এলে অগিলভি পোল্যান্ড-লিথুয়ানিয়ার সীমান্তবর্তী গ্রডনো নগরীতে শিবির ফেললেন। চার্লস তাকে শায়েস্তা করতে অগ্রসর হন। সুযোগ বুঝে তখন অগাস্টাস স্যাক্সোনির সেনাদের নিয়ে তার বাহিনীর পশ্চাৎ অংশে হামলা করতে গিয়ে রিয়েনখেল্টের (Rehnskiold) হাতে নাকাল হন। এরপর অগিলভ পোল্যান্ড থেকে সরে যান, চার্লস চলে যান স্যাক্সোনির দিকে অগাস্টাসের বিহিত করার জন্য।কিন্তু তার মাথায় ছিল যে বাল্টিক এলাকাতে সুইডিশ অখণ্ডতা রক্ষা করতে হলে রাশিয়াকে যে করেই হোক বশীভূত করতে হবে।
স্যাক্সোনিতে অগাস্টাসকে শায়েস্তা করে চল্লিশ হাজার সুইডিশ সৈন্য ১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়ান এলাকাতে ঢুকে পড়ল।পিটার একবার শান্তি প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু চার্লস জবাব দেন মস্কোতে বসে তিনি শান্তির আলোচনা করবেন। তিনি সোজা মস্কোর দিকে এগিয়ে চললেন, যাতে পিটার বাধ্য হন বাল্টিক অঞ্চল থেকে সেনা সরিয়ে আনতে। চার্লসের উদ্দেশ্য মুখোমুখি লড়াই করে রাশিয়ান বাহিনী ধ্বংস করে দেয়া। পিটার ফাঁদে পা না দিয়ে সেনাদল নিয়ে মস্কোর দিকে পিছিয়ে যান। চলার পথে সমস্ত কিছু পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়, যাতে সুইডিশ বাহিনী ব্যবহারের জন্য কোনো কিছু স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করতে না পারে।
এদিকে হলোজিন (Holowczyn) আর স্মাইলিয়ান্সকে (Smolensk) বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে দুটি রাশিয়ান বাহিনীকে পরাজিত করে চার্লস তখন মস্কো থেকে দশ দিনের দূরত্বে। কিন্তু ৪০,০০০ সেনার জন্য যে বিপুল রসদ দরকার তা চার্লসের সাথে ছিল না, কাজেই রাশিয়ানদের জ্বালাও-পোড়াও নীতি তাকে কিছুটা বেসামাল করে দিল। ফলে মস্কোর দিকে যাত্রা আপাতত মুলতবি করে ১৭০৮ সালে রসদপত্রের জন্য চার্লস ইউক্রেনে অবস্থান নেন। জেনারেল লিয়েভেনহপ্টকে নির্দেশ দেয়া হলো রিগা থেকে অতিরিক্ত সৈন্য এবং রসদপত্র নিয়ে চার্লসের সাথে মিলিত হবার। লিয়েভেনহপ্টের প্রতিক্ষায় চার্লস তাঁবু খাটালেন নিপার (Dniper) নদীর ধারে মগিলভ শহরে।
এদিকে ইউক্রেনিয়ান কস্যাকদের সামরিক কম্যান্ডার মাজেপ্পা (Ivan Mazeppa) সুইডিশ রাজাকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সংবাদ পাঠালেন। তিনি চাচ্ছিলেন চার্লসের সাহায্যে ইউক্রেন থেকে পিটারকে বিতাড়িত করতে। চার্লস জেনারেলদের পরামর্শ উপেক্ষা করে মাজেপ্পার সাথে যোগ দিতে এগিয়ে যান, লিয়েভেনহপ্টকে আদেশ করা হলো না থেমে চার্লসকে অনুসরণ করার।
পিটার গুপ্তচর মারফত মাজেপ্পার বিশ্বাসঘাতকতার সংবাদ আগেই পেয়েছিলেন। একদল রাশান সেনা মাজেপ্পার প্রধান কেন্দ্র বাতুরান তছনছ করে দিল। আরেকদল লিসেনার কাছে (Lesnaya) ঝাঁপিয়ে পড়ল লিয়েভেনহপ্টের উপর। মাত্র ৬,০০০ সেনা আর স্বল্প পরিমাণ মালামাল নিয়ে লিয়েভেনহপ্ট কোনোমতে পালিয়ে আসলেন। শীত চলে আসায় যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেল। চার্লস ইউক্রেনে অবস্থান নিলেন। কিন্তু প্রচণ্ড শীতে তার বাহিনী লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। শীত শেষে মাত্র ১৮,০০০-২০,০০০ সেনা লড়াইয়ের উপযুক্ত ছিল।
ব্যাটল অফ পোল্টাভা
পুনরায় লড়াই শুরু হলে মাজেপ্পা আর তার দলবল পিটারকে একদিকে ব্যস্ত রাখল। এই অবসরে ১৭০৮ সালের মে মাসে চার্লস ভরস্কলা (Vorskla) নদীর তীরবর্তী পোল্টাভা নগরী অবরোধ করলেন। শহর থেকে রসদপত্র ছিনিয়ে নেয়ার পাশাপাশি দক্ষিণ দিক থেকে মস্কোর দিকে যাবার রাস্তা পরিস্কার করাও তার উদ্দেশ্য ছিল। মাজেপ্পার ব্যবস্থা করে পিটার জুন মাসে পোল্টাভাতে এলেন। ২৭ জুন দুই পক্ষের ছোটখাট সংঘর্ষে চার্লস খারাপভাবে আহত হলে সেনাদলের নেতৃত্ব তুলে দেন লিয়েভেনহপ্ট আর রিয়েনখেল্টের হাতে। সুইডিশ বাহিনীর তখন সরঞ্জামের অভাব প্রকট। রাইফেলের জন্য গানপাউডার কম, রাশিয়ানদের তুলনায় কামানের সংখ্যাও নগণ্য। কাজেও সরাসরি বেয়নেট চার্জ করার ফয়সালা করা হলো। শহরের দিকে কিছু সেনা রেখে ১২,৫০০ সৈন্য আর চারটি কামান পিটারের বিরুদ্ধে নামানো হলো।
এদিকে পিটার প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিলেন। নিজের শিবির ঘিরে তিনি বসালেন একশটি কামান, আর তৈরি করলেন বহু ছোট ছোট প্রতিরক্ষামূলক স্থাপনা (Redoubt)। লড়াই শুরু হলে চার্লসের দৃঢ় নেতৃত্বের অভাবে সুইডিশরা সমস্যায় পড়ল। লিয়েভেনহপ্ট আর রিয়েনখেল্টের মাঝে যোগাযোগের ঘাটতি তৈরি হয়। লিয়েভেনহপ্ট প্রতিরক্ষামূলক স্থাপনাগুলো পাশ কাটিয়ে সরাসরি পিটারের শিবিরের দিকে অগ্রসর হলেও সঠিকভাবে নির্দেশ না বোঝায় অনেক ছোট ছোট দল বিক্ষিপ্তভাবে স্থাপনাগুলোর চারদিকে রাশিয়ানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। রাশিয়ানদের হাতে তারা পরাজিত হলে লিয়েভেনহপ্টের মূল বাহিনী বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পিটার তার মূল সেনাদলের প্রায় ৪০,০০০ সৈন্য নিয়ে এবার তার উপর আঘাত করেন। প্রথমে সুইডিশরা রাশিয়ান ব্যূহ ভেদ করতে পারলেও কামানের গোলায় ঝাঁঝরা হয়ে যায়। ১০ হাজারের বেশি হতাহত সঙ্গী ফেলে সুইডিশ সেনারা পালিয়ে যায়। চার্লসের গর্বের বাহিনী ধ্বংস হয়ে গেল।
পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ
পরের প্রায় পাঁচ বছর চার্লস তুরস্কে অটোমানদের কাছে স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলেন। রাশিয়ার সাথে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে তিনি তাদের উস্কে দেন। তুর্কিদের কাছে পিটার পরাজিত হন, কিন্তু চার্লসের প্রত্যাশামত তারা পিটারকে হত্যা করেনি। ১৭১৩ সালে অ্যাড্রিয়ানোপোলের চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়ান আর অটোমানদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে চার্লস তুরস্ক ত্যাগ করেন। তিনি চলে যান সুইডিশ পোমেরানিয়াতে, নতুন করে সেনা সংগ্রহ করতে থাকেন।
ফ্রেডেরিক উইলিয়াম ততদিনে প্রুশিয়ার সিংহাসনে বসেছেন। হ্যানোভার ও প্রুশিয়া এতদিন নিরপেক্ষ থাকলেও যুদ্ধের মোড় কোনদিকে যাচ্ছে বুঝতে তাদের অসুবিধা হল না। চার্লসের বিরুদ্ধে নতুন করে ডেনমার্ক, রাশিয়া, স্যাক্সোনি জোট বাঁধলে হ্যানোভার ও প্রুশিয়া তাদের সমর্থন করে। ব্রিটেনও তাদের সাথে যোগ দিল। ১৭১৫ সালে সম্মিলিত আক্রমনে পতন ঘটল পোমেরানিয়ার। চার্লস সুইডেনে ফিরে যান। তাকে চাপে রাখতে জোট সম্মত হয়। সুইডেনের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের লাগাম টানতে জার্মান রাষ্ট্রগুলির গুরুত্ব অনুধাবন করে পিটার ১৭১৬ সালে প্রুশিয়া সফর করেন। উদ্দেশ্য তাদের সাথে দীর্ঘ মেয়াদে মিত্রতা জারি রাখা। বার্লিনে অ্যাম্বার রুম দেখে পিটার মুগ্ধ হন। সুযোগসন্ধানী ফ্রেডেরিক উইলিয়াম এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন। অ্যাম্বার রুম তার কাছে অপ্রয়োজনীয় বাহুল্য মাত্র। তাই রাশিয়ার সাথে মৈত্রী করতে পিটারকে তিনি দু’চোখের বিষ অ্যাম্বার রুম উপহার দেন। প্রুশিয়ার সাথে রাশিয়ার বেশ ভাল সম্পর্ক তৈরি হলো।
এদিকে চার্লস তখনো পরাজয় স্বীকার করেননি। ৬০,০০০ সৈন্য নিয়ে তিনি ১৭১৮ সালে নরওয়ে আক্রমণ করে বসেন। ফ্রেড্রিকশ্যাল (Fredrickshall) দুর্গ অবরোধ চলাকালে নভেম্বরের তিরিশ তারিখ তিনি সেনাদের প্রস্তুতি পরিদর্শনে বের হলেন। হঠাৎ একটি বন্দুকের গুলি তার মাথায় লাগলে তিনি মারা যান। এই গুলি কোন পক্ষ থেকে ছোড়া হয়েছিলে তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ বলে চার্লসের অব্যাহত যুদ্ধে বিরক্ত কোনো সুইডিশ সেনাই গুলি মেরে দিয়েছিল, অন্য দল দাবি করে বিপক্ষ দলের ছোড়া গুলি কোনোভাবে তার মাথায় এসে লেগেছিল।
গ্রেট নর্দার্ন ওয়ারের সমাপ্তি
চার্লস ছিলেন চিরকুমার। সুতরাং সুইডিশ মুকুট চলে গেল বোন উলরিকা আর তার স্বামী ফ্রেডেরিকের কাছে। সুইডেন তখন নিঃশেষিত প্রায়, তাই অপমানজনক চুক্তি মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তিন বছর ধরে দর কষাকষি শেষে স্টেটিন শহর আর পশ্চিম পোমেরানিয়া দিয়ে দেয়া হলো প্রুশিয়াকে, একীভূত পোমেরানিয়া রাজ্যভুক্ত করার অভিলাষ তাদের পূরণ হলো। বাল্টিকের দক্ষিণের কিছু এলাকা পড়ল হ্যানোভারের ভাগে। ১৭২১ সালে রাশিয়ার সাথে আলাদা করে নিস্টাড (Nystad) চুক্তিতে পূর্ব বাল্টিক তীর ঘেঁষে লিভোনিয়া, এস্থোনিয়া, রিগা, ইনগ্রিয়াসহ বিশাল এলাকা পিটার নিজের করে নেন। পরাশক্তি হিসেবে সুইডেনের আধিপত্য শেষ হয়ে গেল, উত্থান হলো রাশিয়ান ভল্লুকের। আর জার্মানিতে নিরবে নিভৃতে প্রুশিয়া প্রস্তুত হলো বড় মঞ্চে নিজেদের আগমন জানান দিতে।