Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রেডিয়াম গার্লস: নিজের অজান্তেই মৃত্যু ডেকে এনেছিল যে তরুণীরা (শেষ পর্ব)

আঠারো বছর বয়সী আমেরিকান তরুণী গ্রেস ফ্রায়ার স্বেচ্ছায় যোগ দেন ইউনাইটেড স্টেটস রেডিয়াম কর্পোরেশনের নিউ জার্সিস্থ কারখানায়। তার সামনে পুরো জীবন পড়ে ছিল। তিনি যখন কারখানায় যোগ দেন, তার ঠিক চারদিন আগে আমেরিকা বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেয়। তার নিজের দুই ভাইও মার্কিন সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। যেহেতু তিনি ছোটবেলা থেকেই দেশের জন্য কিছু করতে চাইতেন, তাই কারখানায় যোগ দিয়ে তিনি নিষ্ঠার সাথে কাজ করতে থাকেন। তার হাতে রং করা ডায়ালই যুদ্ধক্ষেত্রে স্বজাতির সৈন্যদের হাতে শোভা পাবে– এটি ভেবে তিনি গর্ববোধ করতেন। তাছাড়া দুই ভাই সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার পর তার পরিবারের হাল ধরার জন্য একজন ব্যক্তি দরকার ছিল যে অন্তত অর্থনৈতিকভাবে পরিবারকে সমর্থন করতে পারবে। ঘড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠানে চাকরি হয়ে যাওয়ার জন্য তার পরিবারের আর্থিক সমস্যাও দূর হয়ে যায়।

১৯২২ সালের দিকে গ্রেস ফ্রায়ারের একজন সহকর্মী, মলি ম্যাগিয়া অসুস্থতাজনিত কারণে প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যান। ম্যাগিয়া তার অসুস্থতার পেছনে সঠিক কারণ জানতেন না। প্রথমে তার প্রচন্ড দাঁতব্যথা শুরু হয়। তিনি ডাক্তারের কাছে যান এবং ডাক্তার তাকে যে দাঁতের গোড়ায় ব্যথা, সেই দাঁতটি তুলে ফেলতে বলেন। ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক তিনি তুলেও ফেলেন, কিন্তু তাতে তার সমস্যা একেবারে সমাধান হয়নি। অল্প কিছুদিন পরেই তার পরবর্তী দাঁতে ব্যথা শুরু হয় এবং এবারও ডাক্তারের পরামর্শ মতো দাঁত তুলে ফেলতে বাধ্য হোন। দাঁতের সমস্যার পর তার হাঁটুতে সমস্যা দেখা দেয়, ফলে তিনি আবার ডাক্তারের কাছে যান। ডাক্তার তার সমস্যাকে বাতের ব্যথা হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং তাকে অ্যাস্পিরিন নেওয়ার পরামর্শ দেন। অ্যাস্পিরিন নেয়ার পরেও তার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। তিনি হাঁটার শক্তি হারিয়ে ফেলেন।

ুচুচজগপগলহকগ
কারখানায় কাজ করা অনেক তরুণীরই চোয়াল ও গলায় সমস্যা দেখা দিয়েছিল; image source: allthatinteresting.com

যন্ত্রণার এখানেই শেষ ছিল না। মলি ম্যাগিয়ার একটার পর একটা দাঁত ডাক্তারের পরামর্শ মতো তুলে ফেলতে হয়, কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। এরপর তিনি নিচের চোয়ালে ব্যথা অনুভব করেন এবং ডেন্টিস্টের কাছে যান। ডেন্টিস্ট তার নিচের চোয়ালে হাত দিতেই অনেকখানি অংশ ভেঙে চলে আসে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে তার পুরো নিচের চোয়াল খুলে চলে আসে। ধীরে ধীরে সংক্রমণ আরও বাড়তে থাকে এবং একসময় গলাতেও তিনি বড় ধরনের সমস্যা অনুভব করেন। সেই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে তার মুখ থেকে গল গল করে রক্ত বেরোতে শুরু করে এবং সেদিনই তিনি মারা যান, মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে। তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে ডাক্তার সিফিলিসকে দায়ী করেন। তার মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে আরও অনেক নারী, যারা ইউনাইটেড স্টেটস রেডিয়াম কর্পোরেশনে কাজ করতেন, তারাও প্রায় অভিন্ন শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরিজীবী নারীদের যে সংগঠন ছিল (ইউএসআরসি/ USRC), তা রেডিয়াম পেইন্টিং ও কর্মজীবী নারীদের মৃত্যুর সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক আছে– তা দুই বছর ধরে অস্বীকার করেছিল। কিন্তু ক্রমান্বয়ে মৃত্যুর ঘটনাগুলোতে তাদের উপর চাপ বাড়তে থাকে, শেষে বাধ্য হয়ে তারা স্বাধীনভাবে তদন্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তদন্তের ফলাফলে দেখা যায়, কর্মরত নারীদের মৃত্যুর পেছনে আসলেই রেডিয়াম পেইন্টিং দায়ী। কিন্তু এই ফলাফল ইউনাইটেড স্টেটস রেডিয়াম কর্পোরেশনের প্রেসিডেন্ট অস্বীকার করেন এবং নিজেদের অর্থায়নে গবেষণা পরিচালনার উদ্যোগ নেন। তাদের পরিচালনা করা গবেষণায় বিপরীত ফলাফল আসে এবং তিনি আমেরিকার শ্রম বিভাগেও মিথ্যাচার করেন বলে ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়। তার মতে, কর্মজীবী সাবেক ও বর্তমান মহিলা যারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত তারা নিজেদের চিকিৎসার খরচ আদায় করে নেয়ার জন্য এই ধরনের ফন্দি আঁটছে।

জআজবপনলন
কারখানায় কাজ করা অনেক নারীরই চোয়াল ও গলায় সমস্যা দেখা দিয়েছিল; image source: allthatinteresting.com

পরবর্তীতে হ্যারিসন মার্টল্যান্ড নামের একজন চিকিৎসক বিভিন্ন যান্ত্রিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, রেডিয়ামের কারণেই সেই কারখানায় কর্মজীবী নারীদের মৃত্যু হয়েছিল। তিনি প্রমাণ করেন যে বাইরে থেকে রেডিয়াম কর্মজীবী নারীদের শরীরে প্রবেশ করে তাদের বিভিন্ন হাড়ের কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। যেমন- গ্রেস ফ্রায়ারের ক্ষেত্রে তার মেরুদণ্ড একেবারে ভেঙে গিয়েছিল। সবার আগে মৃত্যুবরণ করা মলি ম্যাগিয়ার নিচের চোয়াল একেবারে ভেঙে পড়েছিল। এছাড়া তিনি আরও প্রমাণ করেন যে অপরিকল্পিত ও অনিরাপদভাবে শরীরে রেডিয়াম প্রবেশ করলে তা তেজস্ক্রিয়তার মাধ্যমে ভয়াবহ ক্ষতিসাধন করে এবং পরবর্তীতে এই রেডিয়াম কোনোভাবেই শরীর থেকে বের করা সম্ভব নয়। তার গবেষণাকে ভ্রান্ত প্রমাণের জন্য রেডিয়াম কর্পোরেশনগুলো অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ব্যর্থ হয়।

গ্রেস ফ্রায়ারসহ আরও কিছু নারী ইউনাইটেড স্টেটস রেডিয়াম কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, কারণ তখনও আমেরিকার রেডিয়াম ঘড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো দেদারসে অল্পবয়সী মেয়েদের ডায়াল রংকারী হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছিল। তাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই এই নারীরা আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সবার প্রথমে দরকার ছিল একজন ভালো আইনজীবী যোগাড় করা। প্রায় দুই বছর ধরে গ্রেস ফ্রায়াররা আইনজীবী খুঁজেছেন, কিন্তু কেউই এই মামলা নিতে রাজি ছিল না। কিছু আইনগত জটিলতা ছিল, আবার অনেক আইনজীবী ভেবেছিলেন গ্রেস ফ্রায়ারদের দাবি পুরোপুরি মিথ্যা। এছাড়া শক্তিশালী রেডিয়াম ঘড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর দৌরাত্ম্যের বিপরীতে গিয়ে কোনো আইনজীবী মামলা লড়তে চাননি।

জআওবিবওগ
হ্যারিসন মার্টল্যান্ড, যিনি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে রেডিয়াম গার্লসদের মৃত্যুর সাথে কারখানার রেডিয়ামের সম্পর্ক আছে; image source: acsjournals.onlinelibrary.wiley.com

অবশেষে ১৯২৭ সালে রেমন্ড বেরি নামের একজন মেধাবী আইনজীবী তাদের কেস লড়ার সিদ্ধান্ত নেন। গ্রেস ফ্রায়ার ও তার চারজন সহকর্মী আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে নিজেদের দাবি উত্থাপন করেন। যুক্তিতর্ক শেষে আদালত গ্রেস ফ্রায়ারদের পক্ষে রায় দেয়। আমেরিকার ইতিহাসে এটি ছিল এক যুগান্তকারী রায়, কারণ এতদিন শ্রমিকদের জন্য সুরক্ষামূলক ব্যবস্থার কোনো বালাই ছিল না। কিন্তু এই আইনের পর আমেরিকার শ্রম আইনে বেশ বড় ধরনের পরিবর্তন আসে, যেকোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য শ্রমিকদের যথাযথ সুরক্ষার কথা বলা হয়। শ্রমিকদের বিভিন্ন অধিকার সংরক্ষণের কথা সংবিধানে স্থান পায়। এছাড়া আদালতের রায়ে প্রতিটি ভুক্তভোগীকে ঘড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ‘জরিমানা’ দিতে আদেশ দেয়া হয়।

একেবারে প্রথমদিকের মার্কিন ঘড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রেডিয়াম পেইন্টিংয়ের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে যারা মৃত্যুবরণ করেন, তাদেরকে ইতিহাস মনে রেখেছে ‘দ্য রেডিয়াম গার্লস’ হিসেবে। তাদের দুর্ভাগা জীবনকে কেন্দ্র করে চলচ্চিত্রও নির্মাণ করা হয়েছে। গ্রেস ফ্রায়ার ও তার অন্যান্য সহকর্মী পৃথিবীর শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে অনন্য জায়গা দখল করে থাকবেন, কারণ তাদের আইনি লড়াইয়ের ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মীদের স্বাস্থ্যসুরক্ষার ব্যাপার নিশ্চিত করতে বাধ্য হয়। তারা যখন আদালতের লড়াইয়ে বিজয় লাভ করেন, তখনও রেডিয়াম কর্পোরেশনগুলো শত শত কর্মচারী নিয়োগ দিচ্ছিল, যাদেরকে একইভাবে কোনো সুরক্ষা ছাড়াই রেডিয়াম পেইন্টিংয়ের মাধ্যমে নিজেদের জীবন বিপন্ন করতে হতো। গ্রেস ও তার সহকর্মী তথা রেডিয়াম গার্লরা হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে এনেছেন– এ কথা বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না।

এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্ব:

রেডিয়াম গার্লস: নিজের অজান্তেই মৃত্যু ডেকে এনেছিল যে মেয়েরা (পর্ব-০১)

Related Articles