Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মুঘল সাম্রাজ্যের নতুন দিগন্ত: সম্রাট হুমায়ুনের ঘটনাবহুল শাসনামল

৯৩৭ হিজরির জমাদিউল আউয়াল মাসের ১০ তারিখ অনুযায়ী, ১৫৩০ সালের ৩০ ডিসেম্বরে হিন্দুস্তানের মুঘল সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন সদ্য প্রয়াত সম্রাট বাবরের জ্যেষ্ঠপুত্র নাসিরুদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুন। সিংহাসনে আরোহণ করে সাম্রাজ্যের দায়িত্ব নিজ হাতে বুঝে পাওয়ার জন্য হুমায়ুনের কিছুটা সময় প্রয়োজন ছিল। তাই এই সময়টুকুতে তিনি তার পরিবার কিংবা আত্মীয়স্বজন কারো সাথেই দেখা করতে পারেননি। সিংহাসন নিজ অধিকারে পাওয়ার কয়েকদিন পর তিনি তার পরিবারের সাথে দেখা করেন। শুধু সম্রাট নয়, বরং পরিবারের কর্তা হিসেবে তিনি সবার খোঁজখবর নেন এবং সদ্য প্রয়াত সম্রাট বাবরের জন্য শোক প্রকাশ করে সবাইকে সান্ত্বনা দেন।

দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট হুমায়ুন; Source: Wikimedia Commons

একই দিনে হুমায়ুনের সৎ ছোটভাই হিন্দাল মির্জা কাবুল থেকে দিল্লি এসে পৌঁছান। কাবুলে অবস্থানকালে বাদশাহ বাবরের অসুস্থতার সংবাদ তার কাছে পাঠানো হয়েছিল। সংবাদ শুনেই তিনি আগ্রার পথে ছুটতে থাকেন। কিন্তু পিতার শেষ সময়ে তিনি উপস্থিত থাকতে পারেননি। অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শুয়ে বারবার হিন্দাল মির্জার খোঁজ করেছিলেন বাবর। কিন্তু পিতাকে শেষবারের মতো দেখার সৌভাগ্য হয়নি। দেখে সম্রাট হুমায়ুন হিন্দালকে বুকে টেনে নেন। পিতার নিকট থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ তাকে দ্রুত বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

সম্রাট বাবরের মৃত্যুর পর হুমায়ুনের প্রধান কাজ ছিল নিজের প্রশাসন গুছিয়ে নেওয়া। এসময় বাবরের শাসনামলের অনেক কর্মীই আশংকা করছিল তাদের পূর্বের দায়িত্ব কিংবা সুযোগ সুবিধা বহাল থাকবে কিনা। কিন্তু হুমায়ুন সবাইকে আশ্বস্ত করে নিজেদের পূর্বের পদমর্যাদা কিংবা অন্যান্য রাজকীয় সুযোগ সুবিধা বহাল রাখার নির্দেশ দেন। মুঘল সম্রাট হিসেবে হুমায়ুনের এ ঘোষণায় সবাই আশ্বস্ত হন।

হুমায়ুন যখন মুঘল সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসেন, তখন দেখতে পান রাজকোষ অনেকটাই ফাঁকা। সম্রাট বাবরের কোমল হৃদয় আর প্রজাদের প্রতি অতিরিক্ত বদান্যতার ফল ছিল এটি। তিনি দিল্লি আর আগ্রা অধিকার করেই প্রজাদের মাঝে বিপুল অর্থ বিতরণ করেন। তাছাড়া প্রজাদের মন জয় করার জন্য সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে শুরু করেন, যা হুট করে সাম্রাজ্যের রাজকোষে চাপ প্রদান করে। গুলবদন বেগম তার ‘হুমায়ুননামা’ গ্রন্থে এই অবস্থার আরেকটি কারণ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন,

“যুদ্ধ জয়ের পর  (পানিপথের যুদ্ধ) আমার পিতা মহান বাদশাহ পাঁচজন রাজার ধনসম্পদ নিজ অধিকারে নিয়ে নেন এবং সকল অর্থ সৈন্য ও সহযোগীদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। এ প্রথাটি হিন্দুস্তানি আমিরদের পছন্দ হয়নি। তারা প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন। তাদের কাছে এভাবে অর্থের অপচয় সঠিক মনে হয়নি। তারা আমার পিতাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন এভাবে অর্থভাণ্ডার নিঃশেষ করা ঠিক হবে না। আগে নতুন বিজেতারা এসে বরং যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে পাওয়া অর্থের আরো বৃদ্ধি ঘটাতেন। কিন্তু আমার পিতা এসব আলোচনাকে আমলে নেননি। তিনি তার অভিপ্রায় ও নিজ সংস্কৃতিকেই বহাল রাখলেন। বণ্টন করে দিলেন সকল সম্পদ।”

তাছাড়া, পরবর্তীতে প্রজাদের বিভিন্ন প্রকার কর মওকুফ করার কারণেও রাজকোষ কিছুটা সংকুচিত অবস্থাতে ছিল।

বাবরের শাসনামলের রৌপ্য মুদ্রা; Source: coinindia.com

হুমায়ুনের সিংহাসন প্রাপ্তিতে বাবরের সময়কার অনেক সেনাপতিই নাখোশ ছিলেন। তারা শুরুর দিকে হুমায়ুনের আদেশ তেমনভাবে মানতেন না। এছাড়া সিংহাসনের প্রশ্নে শুরুতেই তাকে বিভিন্ন বিদ্রোহের মোকাবেলা করতে হয়, যা দমন করতে বেশ ভালো পরিমাণ সম্পদের প্রয়োজন পড়ে। তাই সিংহাসন প্রাপ্তির পর রাজকোষের এই অবস্থা প্রাথমিকভাবে হুমায়ুনকে কিছুটা চাপের মুখে ফেলেছিল।

প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর যখন অসুস্থ ছিলেন, হুমায়ুন তখন কালিঞ্জরের বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু বাবরের অসুস্থতার কারণে আগ্রায় ফিরে আসায় কালিঞ্জর অবরোধ প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছিল। সিংহাসনে বসার পর ১৫৩১ সালে হুমায়ুন আবারো কালিঞ্জর অবরোধের দিকে মনোযোগ দিলেন। কালিঞ্জর দুর্গটি বুন্দেলখন্ডের শেষ প্রান্তে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১,২০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত খুবই সুরক্ষিত ও শক্তিশালী একটি দুর্গ। এটি জয় করা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। কারণ, ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে অবস্থিত হওয়ায় এখানে অভিযান চালানো প্রায় অসম্ভব ছিল। পূর্বে এই দুর্গটি দখল করার চেষ্টা করেছিলেন কুতুব উদ্দিন আইবেক, শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ আর নাসিরুদ্দিন মাহমুদের মতো দিল্লির সুলতানশাহী শাসনামলের শাসকরা। কিন্তু দুর্গমতার জন্য কেউই দুর্গটি দখল করতে পারেননি।

১৮১৪ সালে অঙ্গিত কালিঞ্জর দুর্গের ছবি; Source: Wikimedia Commons

হুমায়ুন যখন পুনরায় কালিঞ্জর অবরোধ করে বসে আছেন, সে সময়েই একটি দুঃসংবাদ এসে পৌছায়। দিল্লির লোদি সালতানাতের শেষ সুলতান ইব্রাহীম লোদির ভাই মাহমুদ লোদি আবারো মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য শক্তি সঞ্চয় করছে। সংবাদটি সত্যিই বিপজ্জনক। হুমায়ুন আফগানদের সক্ষমতা সম্পর্কে বেশ ভালো জানতেন। তিনি জানেন সংগঠিত হবার মতো প্রয়োজনীয় সুযোগ পেলে তারা মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই তিনি দ্রুত কালিঞ্জর অবরোধ শেষ করতে চাইলেন। অনেক আলাপ আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত প্রায় ১২ মণ স্বর্ণ আর হুমায়ুনের অধীনে সামন্ত রাজা হিসেবে থাকার চুক্তিতে রাজপুত এই রাজ্যটি থেকে তিনি অবরোধ তুলে নিয়ে আফগানদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন।

সামরিক কিংবা রাজনৈতিক, যে দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হোক না কেন, এই সিদ্ধান্তটি হুমায়ুনের জন্য বিরাট ভুল ছিল। কারণ কালিঞ্জর প্রায় তার হাতের মুঠোতেই ছিল। তাড়াহুড়া করে অবরোধ তুলে না নিলে তিনি ধীরেসুস্থেই কালিঞ্জর জয় করে আফগানদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে পারতেন।

কালিঞ্জর দুর্গের অভ্যন্তরে ‘রানো মহলের’ প্যানারমিক দৃশ্য; Source: Wikimedia Commons

এদিকে সত্যিকার অর্থেই মাহমুদ লোদির নেতৃত্বে আফগানরা মুঘলদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছিল। মাহমুদ লোদির প্রধান দুই সেনাপতি বিবন খান জালওয়ানী আর শেখ বায়েজীদ কারমালি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত দক্ষ যোদ্ধা ছিলেন। সেইসাথে নিজেদের সাহসিকতা আর বীরত্বের জন্য আফগানদের নিকট তারা বেশ সমাদৃতও ছিলেন। মাহমুদ লোদির নেতৃত্বে আফগানরা তাদের প্রথম আঘাতটি হানে জৈনপুরে। জৈনপুরে মুঘল প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন মুঘল সেনাবাহিনীর দক্ষ জেনারেল জুনায়েদ বারলাস। কিন্তু আফগানদের এই আক্রমণ থেকে তিনি জৈনপুরকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হলেন।

জৈনপুরে মুঘলদের বিরুদ্ধে অপ্রত্যাশিত সহজ এই বিজয়ে আফগানরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। বিজয়ের পর তারা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। এদিকে হুমায়ুন যে তাদের ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে, এই খবর তাদের ছিল না। ফলাফল, খুব সহজেই দৌরার যুদ্ধে আফগানরা পরাজিত হয়ে পিছু হটে। ছত্রভঙ্গ আফগান বাহিনীর একটি বিশাল অংশ শের খানের নেতৃত্বে চুনার দুর্গে আশ্রয় নেয়। দুর্গটি বারানসীর দক্ষিণ-পশ্চিম দিক বরাবর গঙ্গার তীরে অবস্থিত।

১৮০৩ সালে অঙ্কিত চুনার দুর্গের একটি ছবি; Source: Wikimedia Commons

চুনার দুর্গে আফগান সেনাদের বিরাট একটি অংশ আশ্রয় নেয়ায় হুমায়ুন সেখানে অবরোধ করেন। কিন্তু দুর্গ অবরোধকালে তিনি সংবাদ পেলেন গুজরাটের বাহাদুর শাহ আগ্রাতে হুমায়ুনের অনুপস্থিতির সুযোগে আগ্রা অভিমুখে অভিযান চালানোর জন্য অগ্রসর হচ্ছে। হুমায়ুন পড়ে গেলেন উভয় সংকটে। তিনি জানেন, তার অনেক সেনাপতি কিংবা সভাসদ এখনো তাকে মন থেকে মেনে নেয়নি। বাহাদুর শাহের অভিযান শুরু হলে তারা দল বদল করতে সময় নেবে না। ফলে দ্রুতই আগ্রার পতন ঘটবে।

কিন্তু এদিকে আফগানদের সুরাহা না করে পিছু হটা মানে শত্রুকে পেছনে মুক্ত করে দিয়ে আসা। অনেক চিন্তাভাবনা করে হুমায়ুন শেষ পর্যন্ত আগ্রা রক্ষাকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে শের খানের সাথে একটি চুক্তিতে সাক্ষর করে তিনি চুনার দুর্গ অবরোধ তুলে নিয়ে আগ্রার দিকে অগ্রসর হন। চুক্তির শর্তানুসারে শের খান হুমায়ুনের অধীনস্থ সামন্ত রাজা হিসেবে চুনার দুর্গ নিজের অধিকারে রাখবেন এবং বার্ষিক কর প্রদান করবেন।

সমসাময়িককালে চুনার দুর্গের ছবি; Source: tutorialspoint.com

রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে হুমায়ুন যে অনেকটাই অপরিপক্ব ছিলেন, তা তার এই সিদ্ধান্ত থেকেই বোঝা যায়। তিনি শের খানকে বিশ্বাস করে চুনার দুর্গ শাসনের অধিকার দিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি শের খানের উচ্চাকাঙ্ক্ষা কিংবা শক্তি সম্পর্কে কোনো ধারণাই রাখেননি। তার উপর তিনি শের খানকে তার বাহিনী গুছিয়ে নেয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিয়ে এসেছেন।

হুমায়ুন তার শাসক জীবনে অসংখ্য ভুল করেছেন। সেসবের মাশুল কড়ায় গণ্ডায় দিতে হয়েছিল পথে পথে ভিখিরির মতো ঘুরে ঘুরে। যে সময় তার বিরুদ্ধে আফগান মাহমুদ লোদি, গুজরাটের বাহাদুর শাহ কিংবা শের খানের মতো শক্তি একের পর এক মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল, তখন তিনি আগ্রা ফিরে নিজেকে আমোদ প্রমোদে ব্যস্ত রাখলেন। যে সময় তার বিরুদ্ধে নিজের আত্মীয়রাই একের পর এক ষড়যন্ত্র করছিল, তখন তাদের লঘু শাস্তি দিয়ে ছাড় দিচ্ছিলেন। অথচ, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এসব অপরাধের শাস্তি হতে পারতো মৃত্যুদণ্ড।

তিনি তার বিপদের সময় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিয়ে উৎসবে মেতে রইলেন। গুলবদন বেগম রচিত ‘হুমায়ুননামা’ গ্রন্থের বর্ণনা থেকেই তা স্পষ্ট হবে।

‘এসময় বাদশাহ হুমায়ুন চুনার যুদ্ধ শেষে নিরাপদে আগ্রায় ফিরে আসেন। এ উপলক্ষ্যে আমার মা বিশাল ভোজের আয়োজন করলেন। সমস্ত নগর আলোকমালায় সুসজ্জিত করা হলো। তিনি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সৈন্যদের প্রতি নির্দেশ জারি করলেন তারাও যেন নিজেদের আবাসিক এলাকা সুসজ্জিত করেন। এদিন থেকে হিন্দুস্তানে উৎসবে আলোকসজ্জা করা রেওয়াজে পরিণত হলো।

মঞ্চে (ভোজ অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে) একটি চারধাপ বিশিষ্ট সিংহাসন স্থাপন করা হলো। সিংহাসনটি বহুমূল্যবান মণিমাণিক্যে খচিত ছিল। এর ওপর রাখা হয়েছিল তাকিয়া ও বালিশ। এগুলো স্বর্ণের সুতোয় নকশা শোভিত ছিল। দর্শক আসনের ওপর যে বিশাল শামিয়ানা টানানো হয়েছিল তার ভেতরের দিকটায় ব্যবহার করা হয়েছিল ইউরোপীয় ব্রোকেড আর বাইরের দিকটায় ব্যবহার করা হয়েছিল পর্তুগীজ কাপড়। শামিয়ানার খুঁটিগুলোতেও স্বর্ণের কারুকাজ করা হয়েছিল। সবকিছুই হয়েছিল চমৎকার অলঙ্করণ সমৃদ্ধ।

আমার মায়ের শিবিরও সুসজ্জিত করা হয়েছিল। দরজার সামনে ঝোলানো হয়েছিল স্বর্ণের কারুকাজখচিত গুজরাটি কাপড়ের পর্দা। ভেতরে রাখা হয়েছিল বহু মূল্যবান গোলাপজলদানি, মোমবাতিদানি আর পানি খাওয়ার গ্লাস। সকল কিছুই মণিমাণিক্য আর স্বর্ণ নিয়ে সজ্জিত ছিল।

এ ঐশ্বর্যপূর্ণ ভোজ উৎসবে আমার মা আমন্ত্রিতদের মধ্যে বারো সারি উট, বারো সারি খচ্চর, সত্তরটি সওয়ারি ঘোড়া এবং একশোটি সাধারণ ঘোড়া বিতরণ করেন। এছাড়াও তিনি সাত হাজার জনকে রাষ্ট্রীয় খেলাত দান করেন। এ উৎসব সাত দিনব্যাপী উদযাপিত হয়েছিল।’

যে সময় সাম্রাজ্যের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ আরো সুসংহত করে শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নেয়ার কথা ছিল, সেসময় তিনি অযথা আমোদ প্রমোদ করে মূল্যবান সময় নষ্ট করছিলেন।

১৫৩৩ সালের ৮ মে, আগ্রায় হুমায়ুনের মা মাহাম বেগম ইন্তেকাল করেন। বাবরের মৃত্যুর পর মাহাম বেগমের এই আকস্মিক মৃত্যু মুঘল পরিবারের জন্য বিরাট এক ধাক্কা ছিল। বাবরের বেশ কয়েকজন স্ত্রী থাকলেও মাহাম বেগম সবচেয়ে বেশি মর্যাদা পেতেন এবং একমাত্র তারই অধিকার ছিল রাজদরবারে সম্রাটের পাশে বসার। মাহাম বেগমের এই মৃত্যুতে হুমায়ুন কিছুটা ভেঙ্গে পড়েন। হুমায়ুনের এই দুঃসময়ে হুমায়ুনের পাশে থেকে সবসময় তাকে সান্ত্বনা আর সাহস যোগাতেন হুমায়ুনের ফুপু খানজাদা বেগম। কার্যত মাহাম বেগমের মৃত্যুর পর খানজাদা বেগমের কাছেই দায়িত্ব এসে পড়ে মুঘল পরিবারের অভ্যন্তরীন বিভিন্ন বিষয় সামলানোর।

মায়ের মৃত্যু শোক সামলে নিয়ে প্রায় ৪০ দিন পর জুলাই মাসে হুমায়ুন দিল্লিতে যান। তিনি দিল্লিতে একটি নতুন রাজধানী তৈরির স্বপ্ন দেখতে থাকেন। তার ইচ্ছাতেই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় ঐতিহাসিক ‘দ্বীন-পানাহ’ নগরী বা ‘ঈমানদারদের আশ্রয়স্থল’-এর। মুঘল স্থাপত্যবিদদের দক্ষতায় খুব দ্রুত এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ‘দ্বীন-পানাহ’-এর নির্মাণ শেষ করে প্রায় ১ বছর পর হুমায়ুন আবারো আগ্রা ফিরে যান।

দাস্ত মুহাম্মদের অঙ্কিত চিত্রতে তরুণ আকবরের সাথে হুমায়ুনের ছোটভাই হিন্দাল মির্জা; Source: Wikimedia Commons

আগ্রা ফিরে গিয়ে ‘দ্বীন-পানাহ’-এর নির্মাণ কাজের সমাপ্তি ও ভাই হিন্দাল মির্জার বিয়ে উপলক্ষ্যে বেশ কয়েকটি রাজকীয় ভোজের আয়োজন করা হয়। হিন্দাল মির্জার বিয়ে ঠিক করা হয়েছিল বিদ্রোহী জামান মির্জার বোন সুলতানা বেগমের সাথে। হিন্দাল মির্জার সাথে সুলতানা বেগমের এই বিয়ে জীবিত থাকতে মাহাম বেগমই ঠিক করে রেখেছিলেন। কিন্তু তার অসুস্থতার কারণে তখন আর বিয়েটি হয়নি। মাহাম বেগমের মৃত্যুর পর খানজাদা বেগমই নিজ আগ্রহ আর দায়িত্ব নিয়ে বিয়েটি সম্পন্ন করেন। এই বিয়ের রাজনৈতিক আর কূটনৈতিক গুরুত্ব ছিল অনেক। জামান মির্জা হুমায়ুনের সিংহাসনে আরোহণের সময় বিরোধিতা করেছিলেন। ফলে জামান মির্জা ও হুমায়ুনের মধ্য একধরনের শত্রুতার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এই বিয়ের ফলে হুমায়ুনের সাথে জামান মির্জার সমস্ত অতীত তিক্ততা মুছে যায়।

হুমায়ুন মূলত জামান মির্জাকে ক্ষমা করেছিলেন, কারণ তিনি তার সৎ বড় বোন মাসুমা বেগমের স্বামী ছিলেন। এদিকে হিন্দাল মির্জা তার কন্যাকে বিয়ে করায় সম্পর্কের দিক দিয়ে তিনি হিন্দাল মির্জার শ্বশুরও হয়ে যান। এছাড়া জামান মির্জা তৈমুরের বংশধরও ছিলেন।

হিন্দাল মির্জার সাথে জামান মির্জার কন্যার বিয়ের পর হুমায়ুন জামান মির্জাকে বিহারের গভর্নরের দায়িত্ব দিয়ে বিহার পাঠিয়ে দেন। হুমায়ুন আশাবাদী ছিলেন এর ফলে জামান মির্জার মন থেকেও সমস্ত শত্রুতা মুছে যাবে। মুঘল পরিবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমৃদ্ধ হিন্দুস্তান গড়ার কাজে হাত দেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হুমায়ুনের আশা আর পূরণ হয়নি। বিহারে সুযোগ পেয়েই জামান মির্জা আবারো বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন।

জামান মির্জার বিদ্রোহের প্রস্তুতির খবর গুপ্তচরের মাধ্যমে ঠিকই হুমায়ুনের কানে পৌঁছে গেল। জামান মির্জাকে দ্রুত গ্রেফতার করা হলো। এসময় বিদ্রোহের সহযোগী হিসেবে সুলতান মুহাম্মদ মির্জা ও ওয়ালি খাব সুলতানকে (ঐতিহাসিকগণ তাকে ‘নাই খাব সুলতান’ নামেও উল্লেখ করেছেন) আটক করা হয়। সুলতান মুহাম্মদ মির্জা ছিলেন জামান মির্জার মামাতো ভাই। হুমায়ুন তার মামা ও শ্বশুর ইয়াদগার বেগ তাগাইর হেফাজতে তাদের আটক করে রাখার নির্দেশ দিলেন। হুমায়ুনের পক্ষ থেকে আরেকটি নির্দেশনাও ছিল। বিশ্বাসঘাতকতা ও বিদ্রোহের অপরাধে জামান মির্জা, সুলতান মুহাম্মদ মির্জা ও ওয়ালি খাব সুলতানকে যেন অন্ধ করে দেয়া হয়।

সেই সময় রাজকীয় পরিবারের সাথে সম্পর্কযুক্ত কাউকে বিশ্বাসঘাতকতা কিংবা বিদ্রোহের অপরাধে প্রথমেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো না। বরং, অভিযুক্ত ব্যক্তি যেন আবার বিদ্রোহ কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করার সুযোগ না পায়, সেজন্য অন্ধ করে দেওয়া হতো। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে। পুরো বিষয়টি নির্ভর করতো সম্রাটে ব্যক্তিগত ইচ্ছা আর অভিযুক্ত ব্যক্তি বংশ কিংবা পদমর্যাদার উপর।

সম্রাটের এই নির্দেশে ওয়ালি খাব সুলতান নিজের দৃষ্টিশক্তি হারালেন। কিন্তু সুলতান মুহাম্মদ মির্জা তার দুই পুত্র উলুঘ মির্জা ও শাহ মির্জাকে নিয়ে পালাতে সক্ষম হলেন। এরপর দীর্ঘদিন তারা হিন্দুস্তানে হুমায়ুনকে নানাভাবে উৎপাত করে যন্ত্রণা দিয়েছেন।

আর জামান মির্জার কী হলো? জামান মির্জা যেভাবেই হোক ইয়াদগার বেগ তাগাইর মন জয় করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ভাগিনা ও জামাতা হুমায়ুনের সরাসরি আদেশ লঙ্ঘন করে তিনি জামান মির্জাকে অন্ধ না করে কারাগারে আটক করে রেখেছিলেন। কিন্তু ধুরন্ধর জামান মির্জা শেষ পর্যন্ত কারাগার থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। পালিয়ে গিয়ে তিনি আশ্রয় নেন হুমায়ুনেরই শত্রু গুজরাটের বাহাদুর শাহের দরবারে।

পালিয়ে বাহাদুর শাহের কাছে আশ্রয় নেয়ার সময় অপরিণামদর্শী জামান মির্জা কি ভেবেছিলেন তিনি মুঘল সাম্রাজ্যকে আবারো একটি দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের মুখে ফেলতে যাচ্ছেন? এদিকে জামান মির্জা পালিয়ে যাওয়ায় ইয়াদগার বেগ তাগাই ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি হুমায়ুনের ক্রোধের ভয় পাচ্ছিলেন। উপায় না দেখে তিনিও জামান মির্জার পথ ধরে গুজরাট গেলেন। তিনি চাইছিলেন, যে করেই হোক জামান মির্জাকে আবারো ফিরিয়ে আনবেন। কিন্তু তার সেই প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলো।

বাহাদুর শাহের সাথে এমনিতে হুমায়ুনের তিক্ত কোনো সম্পর্ক ছিল না। তবে বাহাদুর শাহ আলাউদ্দিন আলম খানের পুত্র তাতার খানের প্ররোচনায় মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময়েই জামান মির্জার গুজরাটের দরবারে আগমন ঘটে।

গুজরাটের বাহাদুর শাহ; Source: historydiscussion.net

মুঘল সম্রাট হুমায়ুন জামান মির্জাকে ফিরিয়ে দিতে বাহাদুর শাহের দরবারে দূত প্রেরণ করেন। জবাবে বাহাদুর শাহ উদ্ধত আচরণ করেন। এর ফলে মুঘল সাম্রাজ্যের সাথে গুজরাটের সংঘর্ষ একরকম নিশ্চিতই হয়ে যায়। এরপর মুঘল সেনাবাহিনী এবং গুজরাটের সেনাবাহিনী- উভয়ই একে অপরকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।

তথ্যসূত্র

  1. মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়, সাহাদত হোসেন খান, আফসার ব্রাদার্স, ২য় মুদ্রণ (২০১৫), প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৩
  2. হুমায়ুননামা, মূল: গুলবদন বেগম, অনুবাদ: এ কে এম শাহনাওয়াজ, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০১৬
  3. ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ: মোগল পর্ব), এ কে এম শাহনাওয়াজ, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ৩য় সংস্করণ (২০১৫), প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০২

এই সিরিজের আগের পর্বসমূহ

১। প্রাক-মুঘল যুগে হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা || ২। তরাইনের যুদ্ধ: হিন্দুস্তানের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া দুই যুদ্ধ || ৩। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: দাস শাসনামল || ৪। রাজিয়া সুলতানা: ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক || ৫। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: খিলজী শাসনামল || ৬। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তুঘলক শাসনামল || ৭। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তৈমুরের হিন্দুস্তান আক্রমণ ও সৈয়দ রাজবংশের শাসন || ৮। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: লোদী সাম্রাজ্য || ৯। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর গঠন এবং গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস || ১০। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত কিছু অস্ত্রশস্ত্র || ১১। জহির উদ-দিন মুহাম্মদ বাবুর: ‘একজন’ বাঘের উত্থান || ১২। বাদশাহ বাবরের কাবুলের দিনগুলো || ১৩। বাদশাহ বাবর: হিন্দুস্তানের পথে || ১৪। বাদশাহ বাবরের হিন্দুস্তান অভিযান: চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি || ১৫। মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান: হিন্দুস্তানে বাবরের চূড়ান্ত লড়াই || ১৬। খানুয়ার যুদ্ধ: মুঘল বনাম রাজপুত সংঘাত || ১৭। ঘাঘরার যুদ্ধ: মুঘল বনাম আফগান লড়াই || ১৮। কেমন ছিল সম্রাট বাবরের হিন্দুস্তানের দিনগুলো? || ১৯। মুঘল সম্রাট বাবরের মৃত্যু: মুঘল সাম্রাজ্য এবং হিন্দুস্তানের উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের অকাল পতন || ২০। সিংহাসনের ষড়যন্ত্র পেরিয়ে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের অভিষেক

ফিচার ইমেজ: flickr.com

Related Articles