২০১৭ সালের সর্বশেষ রোহিঙ্গা নিধন শুরু হয় আগস্ট মাসের ২৫ তারিখে। এই দফায় গ্রামের পর গ্রাম ঘিরে ফেলে প্রায় ২৪ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়, ১৮ হাজারের বেশি নারী ধর্ষিত হন এবং সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেযন। বাংলাদেশের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে উপচে পড়া রোহিঙ্গাদের ঢল নামে এবং ইতোমধ্যে ২০১৮ সালেই জন্ম নিয়েছে প্রায় ৪৮ হাজার রোহিঙ্গা শিশু।
২০১৭ সালের রোহিঙ্গা নিধনকে মায়ানমার সরকার দ্বারা সংঘটিত ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ এবং ‘গণহত্যা’ বলে অভিহিত করেছে জাতিসংঘ, আইসিসিসহ আরো অনেক মানবাধিকার সংস্থা, এবং এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বিভিন্ন দেশের সরকার। জাতিসংঘ একে জাতিগত নির্মূলের উদাহরণ হিসেবে আখ্যা দিয়ে অং সান সু চির সমালোচনার পাশাপাশি বার্মিজ জেনারেলদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনেছে এবং আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে তাদের বিচারের দাবি জানিয়েছে (আগস্ট, ২০১৮)।
এছাড়াও ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে কানাডা সরকার এই গণহত্যায় নীরবে সায় দেয়ায় এবং এর পক্ষে সাফাই গাইবার কারণে অং সান সু চির কানাডীয় নাগরিকত্ব বাতিল করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থা এই বিপুল রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেশে ফিরে যাবার সুযোগ করে দিতে এবং শরণার্থী থাকা অবস্থায় তাদের বাঁচিয়ে রাখতে তহবিল সংগ্রহের জন্য আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশই এই রোহিঙ্গা নিধনের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং তা বন্ধে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মাক্রোঁ এবং রাশান প্রেসিডেন্ট পুতিনও এ গণহত্যার ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। চীনও রোহিঙ্গাদের প্রতি অবিচারের ব্যাপারে সমবেদনা জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ সকলেই জাতিসংঘের মাধ্যমেই মায়ানমারের বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে আগ্রহী, কিন্তু মায়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের প্রস্তাবিত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে রাশিয়া ও চীন বরাবরই নারাজ। বরং তারা এ সমস্যা সমাধানে মায়ানমারকে আরো সময় দিতে আগ্রহী।
এদিকে রোহিঙ্গা শরণার্থী পুষতে গিয়ে বাংলাদেশের অবস্থা শোচনীয় এবং তাদের জন্য প্রাপ্ত তহবিল বেশ অপ্রতুল বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় প্রায় ১,৪০০ ডলার এবং প্রতি বর্গ কি.মি. এ ১,২৫২ জন লোক বাস করে। পক্ষান্তরে, তুরস্কের মাথাপিছু আয় ১১,০০০ ডলার আর দেশটি বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে সাতগুণ বড়। অথচ তাদের দেশে তারা শরণার্থী প্রতি পায় ৮৫৩ ডলার আর বাংলাদেশ পায় মাত্র ১৪ ডলার। সাড়ে আট লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে প্রতিবেলা খাদ্য ত্রাণ দিতে হচ্ছে আর চলতি (২০১৯) বছরের জরুরি ত্রাণের প্রায় পুরোটাই ইতোমধ্যে শেষ। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় ত্রাণ তহবিলের মাত্র ৩৯% এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে এবং আরো ৫৭৯ মিলিয়ন ডলার পাওয়া বাকি।
বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া
মানবতার খাতিরে সীমান্ত খুলে দিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিশ্ববাসীর ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে। যদিও বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আনাগোনা নতুন কিছু নয়। কুতুপালং শরণার্থী শিবিরটি বর্তমানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শরণার্থী শিবির, যা মূলত ১৯৯১ সালে ততমাদো পরিচালিত রোহিঙ্গা নিধন অপারেশন পী থায়ার ফলে পালিয়ে আসা হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে অস্থায়ীভাবে যাত্রা শুরু করেছিল। এখন প্রায় এগার লাখ নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করছে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তের কিছু অংশে স্থল মাইন স্থাপন করেছে মিয়ানমার। তারা ১৯ বার বাংলাদেশের আকাশ সীমাও লঙ্ঘন করেছে বাংলাদেশকে উস্কে দিয়ে বিশ্ববাসীর মনোযোগ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে। কিন্তু বাংলাদেশ অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে মায়ানমারের সকল উস্কানি উপেক্ষা করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মানবিক প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশ সরকার অবিরাম আর্জি জানিয়ে যাচ্ছে যেন রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মায়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়।
বাংলাদেশের নোবেল জয়ী ড. মুহম্মদ ইউনুস ইতোমধ্যে সাত দফা প্রস্তাব পেশ করেছেন যেখানে কফি আনান কমিশনের দাবি বাস্তবায়নসহ মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য জাতিসংঘ পরিচালিত ক্যাম্পের কথা উল্লেখ আছে। ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে মায়ানমারের রোহিঙ্গা তাড়ন ও নিধনের সমালোচনা করেন। তিনিও কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন সহ রোহিঙ্গাদের জন্য রাখাইনে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণাধীন নিরাপদ এলাকা নিশ্চিত করতে নিম্নবর্ণিত দাবীসমূহ জানান:
প্রথমত, অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও ‘জাতিগত নিধন’ নিঃশর্তে বন্ধ করা;
দ্বিতীয়ত, অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করা;
তৃতীয়ত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় গড়ে তোলা;
চতুর্থত, রাখাইন রাজ্য হতে জোরপূর্বক বিতাড়িত সকল রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা;
পঞ্চমত, কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
চীন-ভারত দ্বৈরথে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত গুরুত্ব
বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রান্তিক দেশ হিসেবে পূর্ব-পশ্চিম সংযোগের ক্ষেত্রে বৈশ্বিকভাবে প্রতিবেশী দুটি দেশই সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং দুটি দেশই বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী। মিয়ানমার আকারে বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বড় এবং তুলনামূলকভাবে সম্পদ-সম্ভাবনায়। তবে বিনিয়োগের দিক দিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার প্রায় সমান গুরুত্বপূর্ণ।
জনসম্পদের প্রেক্ষাপটে মিয়ানমার পাঁচ-সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের বিপরীতে বাংলাদেশের আছে ১৬/১৭ কোটি মানুষের একটি বাজার, যা বাংলাদেশের জন্য বাণিজ্য সহায়ক। অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনা বিনিয়োগ রয়েছে এবং এই বিনিয়োগ ক্রমবর্ধমান। ২০১৮ সালে চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরের সময় প্রায় ৩৬ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। একইসাথে, চীন বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্রের প্রধান সরবরাহকারী দেশ। তাছাড়া বাংলাদেশ চীনা পণ্যের একটি বড় বাজারও বটে।
চীনের মতো ভারতও বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী। ২০১০ এবং ২০১৩ সালে দুটি চুক্তির মাধ্যমে ভারত ইতোমধ্যেই প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির ঢাকা সফরের সময় আরও সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছে। চীনের প্রতিশ্রুত বিনিয়োগের তুলনায় এ বিনিয়োগ অনেক কম হলেও কোনো দেশের সঙ্গে এটাই ভারতের সবচেয়ে বড় ঋণচুক্তি। ভারতের পণ্যবাণিজ্যও বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। বৈধভাবেই সে প্রতিবছর বাংলাদেশে ৬০/৬৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করে থাকে।
রাশিয়ায় সঙ্গেও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেশ পুরাতন ও নিয়মিত। রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের একটি চুক্তি রয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার হচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে এই তিন দেশেরই বাংলাদেশকে সমর্থন না করে মায়ানমারের পাশে দাঁড়ানো বাংলাদেশের জন্য বিস্ময়কর আর উদ্বেগজনক।
ভারতের ভাতৃত্ব
রোহিঙ্গা মুসলমান নিধন ইস্যুতে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার বেশ নীরব। মোদী এবং তার দল বিজেপির বিরুদ্ধে ভারতের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইসলামোফোবিয়া এবং সহিংসতা প্রচারের অভিযোগ রয়েছে। মোদীর মায়ানমার সফরে তিনি “রোহিঙ্গা” শব্দটি ব্যবহার করেননি, এবং রোহিঙ্গা জঙ্গিদের কার্যকলাপের নিন্দা করেছেন।
ভারতে প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে যাদের মধ্যে সাড়ে ১৬ হাজার জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার তালিকাভুক্ত। প্রায় ৭ হাজার ৯৬ জন রোহিঙ্গা আছে জম্মু-কাশ্মীরে, ৩ হাজার ৫৯ জন আছে হায়দ্রাবাদে, ১ হাজার ১১৪ জন আছে হরিয়ানায়, ১ হাজার ২০০ জন আছে পশ্চিম-উত্তর প্রদেশে, ১ হাজার ৬১ জন দিল্লিতে এবং ৪০০ জন রাজস্থানে ৷ তবে ভারত ইতোমধ্যে তাদের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভারত থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছে।
ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজু মিয়ানমার সরকারের অবস্থানের প্রতিধ্বনি করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের “অবৈধ অভিবাসী” হিসাবেই বর্ণনা করেছেন। যদিও রোহিঙ্গারা ভারতীয় আদালতে বহিষ্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। তবে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত সরকার জানিয়েছিল যে, ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশনে ভারত স্বাক্ষর করেনি এবং ভারতে অবস্থানরত বেশিরভাগ রোহিঙ্গাই আগস্ট ২০১৭ সালের সহিংসতার আগে ভারতে এসেছিলেন। কয়েকটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে যে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সন্দেহ করছে যে, ভারতের রোহিঙ্গা নেতারা পাকিস্তানি সন্ত্রাসীদের সাথে ষড়যন্ত্র করে ভারতে সহিংসতা চালানোর পরিকল্পনা করছে।
তবে বিজেপির আরেক নেতা বরুণ গান্ধী রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বহিষ্কারের সরকারের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিলেন এবং সতর্কতার সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাদের আশ্রয় দেবার আহ্বান জানিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমর্থন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। পরে মোদী মিয়ানমার থেকে ফিরে আসার পর ভারত সীমিত পরিসরে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ সহায়তা শুরু করে। অক্টোবর ২০১৭ সালে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এই সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানের জন্য ভারতের সমর্থন ব্যক্ত করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রাখাইন রাজ্যের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার আহ্বান জানান।
তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তারে চীনের আগ্রাসী ভূমিকায় ভারত শঙ্কিত। তাই মিয়ানমারকে কাছে টানতে কৌশলগত অবস্থানে পরিবর্তন আনতে চাইছে মোদী সরকার। কারণ আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের ভৌগোলিক যোগসূত্র মিয়ানমার। ‘লুক ইস্ট’ পলিসি কার্যকর করতে ইয়াঙ্গুনের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরো মজবুত করা দরকার। আর তাই চীনে ব্রিকস সম্মেলন শেষে ফেরার পথে ইয়াঙ্গুন সফরে অং সান সু চি ও মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেন মোদী।
তবে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে ভারত এবং চীন একই পৃষ্ঠায় রয়েছে। রাখাইন রাজ্যে উভয় দেশই প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করেছে এবং মিয়ানমার নেতৃত্বকে সমর্থন দিচ্ছে। যদিও এই প্রকল্পগুলোর কোনোটিই উত্তর রাখাইনের অস্থির অঞ্চলে নয়। যার মধ্যে ভারতের অর্থায়নে কালাদান মাল্টি-মডেল প্রকল্প এবং চীন-অর্থায়িত কিয়াকফিউ বন্দরগভীর সমুদ্রবন্দর, তেল-গ্যাস পাইপলাইন এবং চীনের রাজ্যে রেলপথ উল্লেখযোগ্য।
কিউক ফিউইউ চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বন্দরটি একটি চীনা তেল এবং গ্যাস পাইপলাইনের প্রবেশস্থান, যা মালাক্কা উপকূলকে এড়িয়ে মধ্য প্রাচ্য থেকে জ্বালানি আমদানির জন্য বিকল্প পথ। ভারত আশঙ্কা করে যে, কিয়াকফিউয়ের মতো প্রকল্পের মাধ্যমে চীন ঋণগ্রস্ত করে মায়ানমারের উপর নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে। তারা মিয়ানমারকে তার পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চলের বিকাশের জন্য একটি “ডি ফ্যাক্টো চিনা ক্লায়েন্ট স্টেট” হিসাবে গড়ে তুলতে চাইছে।
চীন যেখানে বড় বিনিয়োগের দিকে এগিয়ে গেছে, ভারত সেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিনোদন পরিষেবার মতো খাতগুলোতে প্রবেশের পদক্ষেপ নিয়েছে। মিয়ানমারের সাথে ভারতের আছে প্রায় ১,৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ স্থল সীমানা, পাশাপাশি একটি সামুদ্রিক অংশীদারিত্ব। উত্তর-পূর্বের চারটি রাজ্য, যেমন- অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর এবং মিজোরামের সাথে মিয়ানমারের সীমানা রয়েছে। তাই দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতাও আরো জোরদার করা অব্যাহত রয়েছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন কেন সবসময় মিয়ানমারের পক্ষে?
অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা চীনের চিরাচরিত পররাষ্ট্রনীতি, কারণ চীন চায় না যে তার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অন্য কোনো দেশ হস্তক্ষেপ করুক। এছাড়াও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও তেল-গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য মালাক্কা প্রণালী ছাড়াও মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে আরেকটি স্থলপথকে অক্ষুণ্ণ রাখা চীনের জন্য জরুরি।
গত দু’দশক ধরে চীনের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ বাণিজ্য সমুদ্রপথে হচ্ছে। সেই বাণিজ্য মালাক্কা প্রণালী দিয়ে হয় এবং চীন জানে যে তার সাথে শত্রুভাবাপন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং তার আঞ্চলিক মিত্ররা চাইলেই চীনের বাণিজ্যপথ বন্ধ করে দিতে পারে। এটাকেই বলে চীনের মালাক্কা সংকট। এখন বাণিজ্য পথ খোলা রাখার জন্য চীন যদি সেখানে নৌবাহিনী পাঠায়, তাহলে সংকট আরো ঘনীভূত হবে, যাকে বলে চীনের মালাক্কা ডাইলেমা। সেই মালাক্কা সংকটের কথা মাথায় রেখেই চীন স্থলপথে বিভিন্ন পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল এবং গ্যাস যাতে চীনে পৌঁছাতে পারে তার ব্যবস্থা করেছে।
এরকম দুটি পাইপলাইন আরাকান অর্থাৎ মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে এসে পৌঁছেছে। ভারতেরও এ ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে কালাদান এবং সিটওয়ে বন্দরে। কিন্তু চীনের অর্থনীতির জন্য এ দুটি পাইপলাইন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্যই চীন চাইছে না যে মিয়ানমার সরকার যেন আরাকানের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারায়, বা আরাকানকে কেন্দ্র করে চীন-মিয়ানমার সম্পর্ক খারাপ হোক।
এই রাজ্যেই কিয়াকফিউতে চীন একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। সাগর থেকে উত্তোলিত গ্যাস ইউন্নানে নিয়ে যেতে কিয়াকফিউ থেকেই নির্মাণ করেছে পাইপলাইন। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা এই রাজ্যের অর্থনীতিকে চাঙা করতে চীন সেখানে গড়ে তুলছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। চীনের বহুল আলোচিত এবং অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বৈশ্বিক উদ্যোগ বেল্ট অ্যান্ড রোডের আওতায় চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডরের আওতায় রেল এবং সড়ক সংযোগেরও অংশ হচ্ছে এই রাজ্য।
সব মিলিয়ে বলা চলে, মিয়ানমারে চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রধান অংশই রয়েছে রাখাইন রাজ্যে। জাতিগত বিভাজন ও বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে রাজ্যটিতে শিল্পায়নসহ অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের কথা আন্তর্জাতিক কমিশনের সুপারিশমালাতেও রয়েছে। রাজ্যটিতে ইতিমধ্যেই বড় আকারের চীনা বিনিয়োগ এসেছে। মিয়ানমার অবশ্য গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রকল্পটিকে কাটছাঁট করে ৭০০ কোটি ডলারের বদলে ১০০ কোটি ডলারের কিছু বেশি অঙ্কে নামিয়ে এনেছে। তবে মূল কথা হচ্ছে এই বন্দরটি ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের প্রভাব বজায় রাখার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
ইয়াঙ্গুন চীনা বিনিয়োগের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক চাপের মধ্যেও মিয়ানমারের সরকার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এ জড়িত হওয়ার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) হলো বিশ্বব্যাপী অবাধ বাণিজ্য পথ নিশ্চিত করতে এক চীনা কৌশল। যার সাথে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্য প্রাচ্য এবং আমেরিকার ১৫২টি দেশ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং বিনিয়োগ জড়িত। এখানে “বেল্ট” বলতে রেল পরিবহনের ওভারল্যান্ডের রুটগুলোকে বোঝায়, আর “রোড” বলতে সামুদ্রিক রুট বোঝায়।
মিয়ানমারে উপর চীনের প্রভাব ত্রিবিধ। দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে, মিয়ানমার চীনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য কূটনৈতিক লভ্যাংশ পায়। দেশীয় রাজনৈতিক স্তরে, দেশের জাতিগত সংগঠনের সাথে চীনের সম্পর্ক একে চলমান পুনর্মিলন প্রক্রিয়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার করে তোলে। অবশেষে, অর্থনৈতিক স্তরে, বিকল্প না থাকায় মায়ানমারকে চীনা বিনিয়োগের উপর নির্ভরশীল করে তোলে এবং এর ফলে শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনের পরেও চীনের প্রতি অনুকূল নীতিমালা নিশ্চিত করা যায়।
মায়ানমারের সামরিক এবং রাজনৈতিক উচ্চবিত্তদের সাথে চীনদের সখ্য এখনও প্রবল। যদিও মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা চীনের উপর নির্ভরতা হ্রাস করার জন্য ২০১১ সালে পশ্চিমাদের কাছে ঘেঁষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তবে রোহিঙ্গা সঙ্কট মিয়ানমারকে চীনের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছে। তাই এই মুহূর্তে জাতিসংঘের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাতমাদোসহ মিয়ানমারের সমস্ত রাজনৈতিক সত্তার জন্য ‘ভেটো’ ক্ষমতাধর চীন অপরিহার্য এক বন্ধু। এছাড়াও মায়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সামলাতেও তাদের চীনা সহায়তার বিকল্প নেই।
আন্তর্জাতিক বিশ্ব রোহিঙ্গা ইস্যুতে ত্রাণ সহায়তা ছাড়া প্রত্যক্ষ কোনো হস্তক্ষেপে আগ্রহী নয়। তারা জাতিসংঘের মাধ্যমেই যা করার করতে আগ্রহী। কিন্তু চীনের আপত্তির কারণে জাতিসংঘের আবার হাত-পা বাঁধা। উপরন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিজ নিজ স্বার্থে চীন-ভারতের এই যৌথ মৌনতা আর বাংলাদেশের শঙ্কিত হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তাই বিদ্যমান রোহিঙ্গা সমস্যার আশু কোনো সমাধান আদৌ এই মুহূর্তে কারো জানা আছে কি না তা আসলেই একটি বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন!
এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বসমূহ
১) রোহিঙ্গা রঙ্গ ১: বার্মিজ ইতিহাস পাঠ
২) রোহিঙ্গা রঙ্গ ২: ইউনিয়ন অব বার্মার স্বাধীনতা এবং গৃহযুদ্ধ কাতরতা (১৮২২-১৯৮৮)
৩) রোহিঙ্গা রঙ্গ ৩: ইউনিয়ন অব বার্মার স্বাধীনতা এবং গৃহযুদ্ধ কাতরতা (১৯৮৯ থেকে বর্তমান)
৪) রোহিঙ্গা রঙ্গ ৪: রোহিঙ্গা নিধন – ১৯৪২ সাল থেকে শুরু এক এথনিক ক্লিঞ্জিং