জার্মান একনায়ক অ্যাডলফ হিটলার সারা জীবনে পাঁচ হাজারেরও বেশি সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তা হিসেবে উপস্থিত থেকেছেন। সেসব অনুষ্ঠানে তার বক্তব্য উপস্থিত শ্রোতাবৃন্দকে বলা যায় চেয়ারে বসে থাকতে বাধ্য করতো। এতটাই আকর্ষণীয় ছিলো তার বাচনভঙ্গি। রন রজেনবামের বই ‘Explaining Hitler’-এ ফরাসি-আমেরিকান ঔপন্যাসিক জর্জ স্টেইনার হিটলারের কন্ঠস্বরকে অভিহিত করেছিলেন বেশ গাম্ভীর্যপূর্ণ ও মন্ত্রমুগ্ধকর হিসেবে।
১৯৪১ সালের জুন মাসে নাৎসি জার্মানি হামলা চালায় সোভিয়েত ইউনিয়নে। শুরুর দিকে সফলতা পেলেও পরে হোঁচট খেতে থাকে নাৎসি বাহিনী। তাদের অগ্রযাত্রাকে বেশ ভালোভাবেই থমকে দিতে সক্ষম হয় সোভিয়েতরা। ১৯৪২ সালে এক গোপন সফরে হিটলার গিয়েছিলেন ফিনল্যান্ডে। অফিসিয়ালি সবাই জানতো ৪ জুন দেশটির ফিল্ড মার্শাল ও ডিফেন্স ফোর্সের কমান্ডার-ইন-চিফ কার্ল গুস্তাফ এমিল ম্যানারহাইমের ৭৫তম জন্মদিনে অংশ নিতে গিয়েছিলেন হিটলার। কিন্তু বাস্তবে তাদের মাঝে আরো অনেক গোপন বিষয়েই আলাপচারিতা হয়েছিলো।
ব্যক্তিগত আলাপচারিতা সারার জন্য অবশ্য ম্যানারহাইম হেডকোয়ার্টারের বদলে তার ব্যক্তিগত ট্রেনকেই বেছে নিয়েছিলেন। সবার সাথে পরিচয়পর্ব শেষে হিটলারকে নিয়ে ম্যানারহাইম তার ব্যক্তিগত ওয়াগনে ঢোকেন। সেখানে চুরুট, ড্রিঙ্কস ও লাঞ্চের পাশাপাশি চলতে থাকে নানা বিষয়ে আলাপচারিতা। ফিনিশ সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার থর ড্যামেনের দায়িত্ব ছিলো সেদিন ম্যানারহাইমের উদ্দেশ্যে হিটলারের দেয়া শুভেচ্ছাবার্তা রেকর্ড করে রাখার। সেজন্য সেই ওয়াগনে তিনি বড় একটি কালো মাইক্রোফোন সেটও করে রেখেছিলেন। শুভেচ্ছাবার্তা দেয়ার পর হিটলার ম্যানারহাইমের সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা শুরু করে দেন। ওদিকে মাইক্রোফোন যে চালু করা আছে আর তাতে তাদের কথাবার্তা যে রেকর্ড হচ্ছে সেটা তিনি একবারেই খেয়াল করেন নি।
অমন সুযোগ ড্যামেন হাতছাড়া করতে চাইলেন না। তাই গোপনে রেকর্ডিং চালিয়ে যেতে লাগলেন তিনি। এগারো মিনিট পরে এসএস সদস্যদের দৃষ্টিগোচর হয় বিষয়টি। সাথে সাথেই তারা ড্যামেনকে রেকর্ড বন্ধ করতে বলে। পাশাপাশি গলা কেটে দেয়ার হুমকিও দেয়া হয় তাকে দূরে থেকে হাত নাড়িয়ে। ড্যামেন কাজ করছিলেন ফিনল্যান্ডেরই ব্রডকাস্টিং কোম্পানি yle এর হয়ে। এসএস সদস্যরা চেয়েছিলেন রেকর্ডিংটা যেন নষ্ট করে ফেলা হয়। কিন্তু yle এর অনুরোধে তা আর করা হয় নি। তবে তারা কথা দেয় যে, একটি বন্ধ কন্টেইনারে রেকর্ডিংটি রাখা হবে। সেখান থেকে কখনোই সেটা বের করা হবে না।
এটিই হিটলারের একমাত্র রেকর্ড করা কণ্ঠস্বর যেখানে তিনি আনঅফিসিয়াল স্বরে কথা বলেছেন। পাশাপাশি গলার স্বর স্বাভাবিক রাখা অবস্থায় হিটলারের অত্যন্ত স্বল্প সংখ্যক যে রেকর্ডিংগুলো পাওয়া গেছে, সেগুলোর মাঝে এটি একটি। এখানে অপারেশন বারবারোসায় তাদের পরাজয়ের কারণ; উত্তর আফ্রিকা, যুগোস্লাভিয়া ও আলবেনিয়ায় ইতালির পরাজয়ের কারণ; সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্ত্রশস্ত্রের সমাহার এবং রোমানিয়ার তেলের কূপগুলো নিয়ে আলাপ করেছিলেন হিটলার।
মূল আলাপের ইংরেজি অনুবাদ অন্তর্জালের দুনিয়াতেই আছে। সেটারই ভাবানুবাদ তুলে ধরা হলো এই লেখায়।
হিটলার: … খুবই ভয়াবহ একটি বিপদ, সম্ভবত সবচেয়ে ভয়াবহ। এর সম্পূর্ণ বিস্তৃতি এখন আমরা কেবল বিচারই করতে পারবো। আমরা নিজেরাও বুঝতে পারিনি এই স্টেটটা (সোভিয়েত ইউনিয়ন) কী পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত।
ম্যানারহাইম: না, আমরা এ সম্পর্কে চিন্তাও করি নি।
হিটলার: আমিও না।
ম্যানারহাইম: উইন্টার ওয়্যারের সময়, উইন্টার ওয়্যারের সময়ও এমনকি আমরা এ সম্পর্কে ধারণাই করতে পারি নি। অবশ্যই…
হিটলার: (কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে) অবশ্যই।
ম্যানারহাইম: কিন্তু আসলে কীভাবে তারা (এমনটা করলো) এবং এখন কোনোই সন্দেহ নেই সবই (অস্ত্রশস্ত্র) তাদের মজুদ করে রাখা ছিলো।
হিটলার: অবশ্যই। তাদের এত বিপুল সংখ্যক অস্ত্রশস্ত্র আছে যা লোকে শুধু অনুমানই করতে পারে। বেশ, যদি কেউ আমাকে বলতো যে একটা দেশ, যার… (হঠাৎ করে দরজা খোলা ও বন্ধ হওয়ার শব্দে হিটলারের কথায় ছেদ পড়ে)। যদি কেউ আমাকে বলতো যে একটা জাতি ৩৫,০০০ ট্যাঙ্ক নিয়ে যুদ্ধ শুরু করতে যাচ্ছে, তাহলে আমি বলতাম, “তুমি একটা বদ্ধ উন্মাদ!”
ম্যানারহাইম: পঁয়ত্রিশ!
হিটলার: পঁয়ত্রিশ হাজার ট্যাঙ্ক।
পেছন থেকে অন্য কেউ হঠাৎ কথা বলে উঠলো: পঁয়ত্রিশ হাজার ট্যাঙ্ক! হ্যাঁ!
হিটলার: এখন পর্যন্ত আমরা ৩৪,০০০ ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেছি। যদি কেউ আমাকে বলতো এ কথাটা, তাহলে আমি বলতাম, “তুমি!”, যদি তুমি আমার কোনো জেনারেল হয়ে আমাকে বলতে যে একটা দেশের ৩৫,০০০ ট্যাঙ্ক আছে, তাহলে আমি বলতাম, “বাছা, তুমি সবকিছু দ্বিগুণ নাহয় দশগুণ করে দেখছ। তুমি একটা আস্ত পাগল; তুমি ভূত দেখছ।” আমি এমনটাই মনে করতাম।
আমি আপনাকে বলেছিলাম আমরা ফ্যাক্টরির সন্ধান পেয়েছি। যেমন- সেগুলোর একটা ছিলো ক্রামাতোরস্কায়াতে। দুই বছর আগেও সেখানে মাত্র কয়েকশ ট্যাঙ্ক ছিলো। আমরা কিছুই জানতাম না। এখন সেখানে একটা ট্যাঙ্ক কারখানা আছে যেখানে প্রথম শিফটে ৩০,০০০ এর বেশি এবং পরের শিফটে ৬০,০০০ এর বেশি শ্রমিক কাজ করে। একটামাত্র ট্যাঙ্ক কারখানাতেই! বিশাল বড় এক কারখানা। এতগুলো শ্রমিক, যারা নিশ্চিতভাবেই পশুর মতো জীবনযাপন করতো এবং…
পেছন থেকে কেউ একজন হিটলারের কথার মাঝেই বলে উঠলো: দোনেৎস এলাকায়?
হিটলার: দোনেৎস এলাকায়। (এমন সময় কাপ ও প্লেটের নড়াচড়ার শব্দ শোনা যেতে লাগলো)।
ম্যানারহাইম: যদি আপনি বিবেচনায় আনেন যে তারা প্রায় ২০ বছর, প্রায় ২৫ বছরের স্বাধীনতা পেয়েছে নিজেদেরকে অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত করার…
হিটলার: (মৃদুস্বরে বাধা দিয়ে) এটা একেবারেই অবিশ্বাস্য ছিলো।
ম্যানারহাইম: আর সবকিছু, সবকিছুই যুদ্ধাস্ত্রের জন্য খরচ করেছে?
হিটলার: শুধুমাত্র যুদ্ধাস্ত্রের জন্য।
ম্যানারহাইম: শুধু যুদ্ধাস্ত্রের জন্য!
হিটলার: (দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) শুধুমাত্র, বেশ, যেমনটা তোমাদের প্রেসিডেন্টকে আমি আগেও বলেছিলাম- এ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিলো না। যদি এ সম্পর্কে আমার সামান্য ধারণাও থাকতো, তবে এটা আমার জন্য আরো বেশি কঠিন হতো। তারপরও যেকোনোভাবে আমি সিদ্ধান্ত নিতাম (আক্রমণের), কারণ এছাড়া আর কোনো সম্ভাবনাও ছিলো না। ‘৩০/’৪০ এর শীতের সময়ই এটা একপ্রকার নিশ্চিতই হয়ে যায় যে, যুদ্ধ শুরু করতেই হবে। আমি কেবল এতটুকু দুঃস্বপ্নই দেখেছিলাম, কিন্তু আরো দেখা বাকি ছিলো। কারণ একসাথে দুটো ফ্রন্টে যুদ্ধ চালানো একেবারেই অসম্ভব হতো। সেটা আমাদের একেবারেই ভেঙে দিতো।
এখন আমরা তখনকার সময়ের চেয়েও পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছি যে সেটা আমাদের ভেঙে দিতো। এবং… আমি চেয়েছিলাম, ’৩৯ এর শরতে আমি চেয়েছিলাম পশ্চিমে ক্যাম্পেইন করতে। ক্রমাগত চলতে থাকা খারাপ আবহাওয়া আমাদের বাধা দিয়েছিলো।
আমাদের পুরো অস্ত্রশস্ত্র, তুমি জানো, যা ছিলো, সবই ভালো আবহাওয়ায় যুদ্ধ করার জন্য। এগুলো খুবই কার্যকর, খুবই ভালো, কিন্তু কেবলই অনুকূল আবহাওয়ায় কাজ করার জন্য। যুদ্ধেই আমরা এটা দেখেছি। আমাদের অস্ত্রগুলো স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য (যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য) বানানো হয়েছিলো এবং আমরা সেটাই ভেবেছিলাম এবং সেটা ততদিন সত্যই ছিলো। আহ! কত আগে থেকেই তো এই মতবাদ চালু ছিলো- ‘তুমি শীতকালে যুদ্ধে জড়াতে যেও না’।
আমাদেরও জার্মান ট্যাঙ্ক ছিলো। সেগুলোর কোনো পরীক্ষা করা হয় নি; যেমন- শীতকালে যুদ্ধের জন্য সেগুলোকে প্রস্তুত করতে (কোনো পরীক্ষা করা হয় নি)। এর পরিবর্তে আমরা পরীক্ষা চালিয়ে প্রমাণ করলাম শীতকালে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া অসম্ভব!
এটা একেবারেই ভিন্ন একটা সূচনা (সোভিয়েতদের চেয়ে)। ১৯৩৯ এর শরত থেকে আমরা নিয়মিতই এ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি। আক্রমণের জন্য আমি মুখিয়ে ছিলাম এবং আমি নিশ্চিত ছিলাম ছয় সপ্তাহের ভেতরেই ফ্রান্সকে হারানো সম্ভব।
যা-ই হোক, আমরা কীভাবে এগোবো সেটা নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই হচ্ছিলো। তখন একটানা বৃষ্টি হচ্ছিলো। আমি নিজে ফ্রান্সের এলাকাগুলো বেশ ভালোভাবে চিনতাম এবং আমি নিজেও আমার অনেক জেনারেলের মতামত অগ্রাহ্য করতে পারি নি যে, আমাদের ট্যাঙ্কগুলো ততটা কার্যকর হবে না এবং বৃষ্টির জন্য আমাদের বিমানবাহিনী সম্ভবত অতটা কার্যকর আঘাত হানতে পারবে না।
আমি নিজে উত্তর ফ্রান্সকে ভালোমতো চিনি। আপনি জানেন, আমি গ্রেট ওয়্যারের সময় চার বছর যুদ্ধ করেছি। আর সেজন্যই দেরিটা হয়ে গেলো। যদি আমি ’৩৯ সালেই ফ্রান্সকে নিশ্চিহ্ন করে দিতাম, তাহলে পৃথিবীর ইতিহাসটা একেবারেই ভিন্ন হতো। কিন্তু আমাকে ১৯৪০ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে মে মাসের আগে এটা সম্ভবই ছিলো না। মে মাসের ১০ তারিখই ছিলো সবচেয়ে সুন্দর দিন এবং সেদিনই আমি অতর্কিত আক্রমণ করে বসি। ১০ তারিখে আক্রমণের নির্দেশ আমি ৮ তারিখেই দিয়েছিলাম। কিন্তু এরপরই আমাদেরকে পশ্চিমাঞ্চল থেকে পূর্বাঞ্চলে আমাদের ডিভিশনগুলোকে এমন বিশাল পরিসরে স্থানান্তর করতে হলো।
প্রথমে দখলের ব্যাপারটা, তারপর আমাদের দায়িত্ব পড়লো নরওয়েতে। আজ আপনাকে আমি খোলাখুলিই বলতে পারি যে, একই সময়ে আমরা বড় ধরনের দুর্ভাগ্যের শিকার হলাম। উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, ইতালির দুর্বলতার ব্যাপারটা। কারণ প্রথমত উত্তর আফ্রিকার পরিস্থিতি এবং দ্বিতীয়ত গ্রীস ও আলবেনিয়ার পরিস্থিতি- এগুলো আমাদের জন্য বিশাল বড় দুর্ভাগ্য। আমাদেরকে সাহায্য করতেই হতো। আমাদের জন্য এর অর্থ ছিলো নিজেদের বিমানবাহিনীকে বিভক্ত করে ফেলা, আমাদের ট্যাঙ্ক বাহিনীকে বিভক্ত করে ফেলা, যখন আমরা নিজেরাই পূর্বাঞ্চলের জন্য ট্যাঙ্কগুলোকে প্রস্তুত করছিলাম।
কলমের এক খোঁচাতেই দুইটা ডিভিশন, পুরো দুইটা আমাদের দিয়ে দেয়া লাগলো এবং পরবর্তীতে তৃতীয় আরেকটি ডিভিশনও তাতে যোগ হয়েছিলো। আমাদের প্রতিনিয়তই সেখানে নতুন সেনাদের স্থলাভিষিক্ত করতে হচ্ছিলো, ভয়াবহ পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছিলো সেখানে। রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ হচ্ছিলো মরুভূমিতে।
আপনি দেখতেই পাচ্ছেন এগুলো ঠেকানোর কোনো উপায়ই ছিলো না। মলোতোভের (সোভিয়েত মন্ত্রী) সাথে আমার একদিন আলাপ হয়েছিলো। সেদিনই নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিলো যে মলোতোভ যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েই ফিরে গিয়েছে এবং আমি যুদ্ধ শুরুর সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছিলাম এবং তাকে আগাম প্রতিহত করতেই আমি প্রত্যাখানটা করেছিলাম। এটাই ছিলো একমাত্র (উপায়) কারণ সে যে দাবিগুলো নিয়ে এসেছিলো সেগুলোর চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিলো ইউরোপ শাসন করা। (এখানে কিছুটা ফিসফিস করতে থাকেন হিটলার) তারপর আমি তাকে পেলাম, সবার সামনে না… (কী কথা হয় তা বোঝা যায় নি)।
১৯৪০ সালের শরৎকাল থেকে প্রতিনিয়ত আমাদের একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছিলো- আমরা কি সম্পর্ক ছিন্ন করবো (সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে)? তখন ফিনিশ সরকারকে আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম আলাপ চালিয়ে যেতে এবং কিছু সময় বের করতে এবং ধীরে-সুস্থে এ ব্যাপারটা নিয়ে কাজ করতে। কারণ আমি সবসময়ই ভয় পেতাম যে, শরতের শেষ নাগাদ রাশিয়া বুঝি রোমানিয়ায় আক্রমণ চালাবে এবং তেলের কূপগুলো দখল করে নেবে। এবং ১৯৪০ এর শেষ নাগাদও আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত থাকতাম না। যদি রাশিয়া রোমানিয়ার তেলের কূপগুলো দখল করে নিতো, তাহলে আমরা একপ্রকার হেরেই যেতাম। মাত্র ৬০ ডিভিশন রাশিয়ান সেনা দিয়েই অমনটা করা সম্ভব ছিলো।
রোমানিয়ায় তখন আমাদের বড় কোনো ইউনিটই ছিলো না। রোমানিয়ার সরকার মাত্র অল্প কিছুদিন আগে আমাদের সাহায্য চেয়েছে আর সেখানে আমাদের যা আছে তা সত্যিই হাস্যকর। শুধুমাত্র তেলের কূপগুলো দখল করলেই তাদের (রাশিয়ার) হয়ে যেত। আমাদের যে পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ছিলো তা দিয়ে কোনোভাবেই সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে যুদ্ধ শুরু করা যেত না। এমন কোনো প্রশ্ন করাই উচিত না। স্বাভাবিকভাবেই পূর্বাঞ্চলের দিকে সরে যাওয়া ততটা সুদুরপ্রসারী চিন্তা ছিলো না। ইউনিটগুলোকে প্রথমে পশ্চিমে ঠিকমতো পুনর্বিন্যস্ত করতে হয়েছিলো।
প্রথমে অস্ত্রগুলোর একটা ব্যবস্থা করতে হলো, কেননা আমাদের নিজেদেরও পশ্চিমের ক্যাম্পেইনে ভালোই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিলো। ১৯৪১ সালের বসন্তের আগে হামলা চালানো একেবারেই অসম্ভব হতো। আর রাশিয়ানরা যদি ১৯৪০ এর শরতে রোমানিয়ার তেলের কূপগুলো দখল করে নিতো, তাহলে ১৯৪১ সালে আমরা একেবারেই অসহায় হয়ে পড়তাম।
পেছন থেকে হঠাৎ কারো কথা: তেল ছাড়া…
হিটলার: (বাধা দিয়ে) আমাদের জার্মানির উৎপাদনও অনেক ছিলো। তারপরও বিমানবাহিনী, প্যাঞ্জার ডিভিশনের জন্য তেলের চাহিদা অনেক। তাদের যে পরিমাণ তেলের দরকার হয় তা কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়। আর রোমানিয়ার চার-পাঁচ মিলিয়ন টন বাড়তি তেল ছাড়া আমরা যুদ্ধই করতে পারতাম না এবং এমনটাই হতে দিতে হতো। আর এটাই ছিলো আমার সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার বিষয়।
সেজন্যই আমি আলোচনা চালিয়ে যেতে চাচ্ছিলাম যতক্ষণ না আমরা (মস্কোর) সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী চাহিদাগুলো প্রতিরোধের মতো যথেষ্ট শক্তিশালী না হয়ে উঠছি। কারণ সেই দাবিগুলো ছিলো কেবলই বলপ্রয়োগ করে কিছু আদায় করা। সেগুলো ছিলো জোরজবরদস্তি। রাশিয়ানরা জানতো আমরা পশ্চিমে ফেঁসে গেছি।
তারা জোরজবরদস্তি করে আমাদের থেকে সবকিছুই আদায় করতে পারতো। শুধুমাত্র যখন মলোতোভ আসলো, আমি তাকে জানালাম তাদের চাহিদাগুলো, তাদের সুবিশাল চাহিদাগুলো, আমরা গ্রহণ করতে পারছি না। এর মাধ্যমে মধ্যস্থতার বিষয়গুলো সেদিন সকালেই হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেলো।
চারটা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিলো। ফিনিশদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষার ব্যাপারে স্বাধীনতা নিয়ে সে বলেছিলো। আমি বললাম, “তুমি নিশ্চয়ই বলতে চাইবে না ফিনল্যান্ড তোমাদের জন্য হুমকিস্বরুপ?” কিন্তু সে বললো, “ফিনল্যান্ডে তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয় সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোতে আক্রমণ করার ব্যাপারে। তারা আমাদের সমাজের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ নেবে, পদক্ষেপ নেবে আমাদের বিরুদ্ধে। তারা ক্রমাগত আমাদের হয়রানি করতে থাকবে এবং একটি বৃহৎ শক্তি একটি ছোট দেশের কাছ থেকে হুমকি পেতে পারে না।”
আমি বললাম, “তোমার দেশের অস্তিত্ব ফিনল্যান্ডের কারণে হুমকির সম্মুখীন হতেই পারে না। এটা নিশ্চয়ই তুমি আমাকে বলতে চাইছ না…”
ম্যানারহাইম: (বাধা দিয়ে) হাস্যকর!
হিটলার: “… যে তোমাদের অস্তিত্ব ফিনল্যান্ডের কারণে হুমকির মুখে পড়ে গিয়েছে?” … তারপর আমি তাকে জানালাম, বাল্টিক এলাকায় আর কোনো যুদ্ধই আমরা কেবল দর্শক হিসেবে দেখবো না। প্রত্যুত্তরে রোমানিয়ায় আমাদের অবস্থানকে আমরা কীভাবে দেখছি সে সেটা জানতে চাইলো।
(হিটলার বললেন) তুমি জানো, আমরা তাদেরকে একটা নিশ্চয়তা দিয়েছি। (মলোতোভ জানতে চাইলেন) সেই নিশ্চয়তা কি রাশিয়ার বিপক্ষেও যাচ্ছে? তখনই তাকে আমি বললাম, “আমি মনে করি না এটা তোমাদের দিকে কিছু নির্দেশ করছে, কারণ আমি মনে করি না তোমাদের রোমানিয়ায় আক্রমণের কোনো ইচ্ছা আছে। তোমরা সবসময়ই বলেছ বেসারাবিয়া তোমাদের। কিন্তু তোমরা কখনোই বলো নি যে তোমরা রোমানিয়ায় হামলা চালাতে চাও।”
“হ্যাঁ”, সে বললো। কিন্তু সে আরো ভালো করে জানতে চাইলো সেই নিশ্চয়তা… (একটি দরজা খোলার সাথে সাথেই রেকর্ডিং বন্ধ হয়ে যায়)।
হিটলারের এ রেকর্ডিংটি মুক্তি পাবার পর অনেকেই এটি নকল বলে দাবি করেছিলেন, কারণ এতে হিটলারের কণ্ঠস্বর বেশ নরম শুনিয়েছিলো। তবে সেদিনের ছবিগুলোতে হিটলারকে মদ্যপান করতে দেখা গেছে যা তিনি খুব কমই করতেন। এটাও তার কণ্ঠস্বরের অমন শোনানোর পেছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে বলে অনেকের ধারণা। এটি শোনার পর হিটলারের সাবেক দেহরক্ষী ও রেডিও অপারেটর রোখাস মিশ্চ বলেন, “তিনি স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছেন, কিন্তু কণ্ঠস্বরের বিষয়টা নিয়ে আমি কিছুটা সমস্যায় পড়েছি। কণ্ঠস্বরের ওঠা-নামাটা ঠিক যুতসই লাগছে না। মাঝে মাঝে এটাকে ঠিক লাগছে, আবার অন্য সময় বেঠিক। আমার মনে হচ্ছে কেউ যেন হিটলারের অনুকরণ করছে… আসলেই মনে হচ্ছে কেউ তার অনুকরণ করেছে।”
পরবর্তীতে জার্মান ফেডারেল ক্রিমিনাল পুলিশ অফিস এই রেকর্ডিংটি নিয়ে আরো অনুসন্ধান চালায়। ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে ফ্রিকোয়েন্সি বিভাগের প্রধান ড. স্টেফান ফ্রোয়েরার জানান, “আমরা নিশ্চিত যে, এটাই হিটলারের কণ্ঠস্বর।”
এবার তাহলে হিটলারের কন্ঠস্বরটিই শুনে নিন নিচের ভিডিও থেকে।