Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শেইখা লাতিফা: দুবাই প্রিন্সেসের অন্তর্ধান রহস্য

নিখোঁজ হওয়ার আগে আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন রাশেদ আল-মাকতুমের কন্যা প্রিন্সেস লাতিফার সর্বশেষ ছবিটি ছিল একটি সেলফি। ফিনিশ নাগরিক, লাতিফার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী টিনা জুহাইনেনের গাড়িতে বসে তিনি যখন সেলফিটি তুলছিলেন, তখন তারা দুবাই ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন ওমানের দিকে। তাদের পরিকল্পনা ছিল ওমানে গিয়ে এক ফরাসি গুপ্তচরের সাথে তার ইয়াটে চড়ে ভারতে যাবেন, এরপর সেখান থেকে প্লেনে করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করবেন।

পথ তখনো অনেক বাকি, কিন্তু লাতিফার বিশ্বাস ছিল তিনি সহজেই পালিয়ে যেতে পারবেন। আরব আমিরাতের সীমান্ত পেরিয়ে যখন তারা ওমানে প্রবেশ করেন, তখন তাদের মধ্যে ছিল অ্যাডভেঞ্চারের অনুভূতি। দুই যুবতী নারী ড্রাইভ করে পালিয়ে যাচ্ছেন দেশ ছেড়ে, পেছনে হয়তো আরব আমিরাতের পুলিশ বাহিনী তাদের খোঁজে পুরো দেশ চষে ফেলছে- ব্যাপারটার মধ্যে বেশ সিনেমাটিক একটা ভাব আছে।

টিনা জুহাইনেনের সাথে লাতিফার (বামে) সেলফি; Image Source: Latifa/BBC/Detained in Dubai

লাতিফা যখন সেলফিটি তুলছিলেন, তখন টিনা মজা করে নিজেদেরকে তুলনা করেছিলেন ‘থ্যালমা অ্যান্ড লুইজ’ এর সাথে। রিডলী স্কট পরিচালিত ১৯৯১ সালের ঐ হলিউড চলচ্চিত্রের প্রধান দুই নারী চরিত্র গাড়িতে করে পুরো আমেরিকা চষে বেড়াতে থাকে, আর আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে একের পর এক অপরাধ করে যেতে থাকে। টিনার তুলনা শুনে অবশ্য সাথে সাথেই প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন লাতিফা। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর এই প্রথম অজানা এক আশঙ্কায় কেঁপে উঠেছিল তার বুক। কারণ ‘থ্যালমা অ্যান্ড লুইজ’ চলচ্চিত্রের পরিণতিটা দুই নায়িকার জন্য শুভ ছিল না।

টিনার তুলনা এবং লাতিফার আশঙ্কা খুব একটা অমূলক ছিল না। তাদেরকে ‘থ্যালমা অ্যান্ড লুইজ’ এর মতো একই পরিণতি বরণ করতে হয়নি ঠিকই, কিন্তু তাদের অভিযানও শেষপর্যন্ত সফল হয়নি। আমেরিকায় পৌঁছার অনেক আগে ভারতের কাছাকছি গিয়েই নিখোঁজ হয়ে যান তারা। তাদের পালিয়ে যাওয়ার সুদীর্ঘ পরিকল্পনা, পালানোর প্রচেষ্টা এবং শেষে নিখোঁজ হওয়ার কোনোটাই থ্যালমা অ্যান্ড লুইজের চেয়ে কম নাটকীয় ছিল না।

থ্যালমা অ্যান্ড লুইজ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য; Image Source: intofilm.org

শেইখা লাতিফা বিনতে মোহাম্মদের জন্ম ১৯৮৫ সালে, আরব আমিরাতের রাজকীয় আল-মাকতুম পরিবারে। তার বাবা শেখ মোহাম্মদ বিন রাশেদ আল-মাকতুম বর্তমানে আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী এবং দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্য দুবাইয়ের আমির। শেখ মোহাম্মদ বিভিন্ন সময় মোট ছয়টি বিয়ে করেছিলেন বলে জানা যায়, যদিও এদের মধ্যে মাত্র দুই জন স্ত্রীই বেশি আলোচিত। লাতিফার মা, আলজেরিয়ান নাগরিক হুর্‌রিয়া আহমেদ আল-মা’শ, শেইখ মোহাম্মদ বিন রাশেদের অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত স্ত্রীদের মধ্যে একজন। শেখ মোহাম্মদের ৩০ সন্তানের মধ্যে হুর্‌রিয়ার ঘরে মোট চারটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে, যাদের মধ্যে লাতিফা তৃতীয়।

প্রিন্সেস লাতিফা ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠেছেন প্রাচুর্যের মধ্যে। তাদের পরিবার বিশ্বের অন্যতম ধনী পরিবারগুলোর মধ্যে একটি। তার বাবা শেখ মোহাম্মদের সম্পত্তির পরিমাণ ১৮ বিলিয়ন ইউরোর সমান বলে অনুমান করা হয়। লাতিফার বাস ছিল দুবাইয়ের বিশাল রাজকীয় প্রাসাদে, যার চারটি উইংয়ের ৪০টি কক্ষ পরিবারের বিভিন্ন নারী সদস্যদের জন্য বরাদ্দ ছিল। প্রাসাদের ভেতরে ছিল সুইমিং পুল, স্পা, অ্যাথলেটিক কম্পাউণ্ডসহ যাবতীয় ভোগ-বিলাসের ব্যবস্থা। পরিবারের নারীদের সেবার জন্য প্রাসাদে নিয়োজিত ছিল শতাধিক গৃহকর্মী।

শেখ মোহাম্মদ বিন রাশেদ আল-মাকতুম; Image Source: sheikhmohammed.ae

ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা শেইখা লাতিফা ছিলেন একজন দক্ষ স্কাই ডাইভার। সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্কাই ডাইভার স্টেফানিয়া মার্টিনেঞ্জোর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া লাতিফাকে প্রায়ই দেখা যেত আরব আমিরাতের জাতীয় পতাকা গায়ে জড়িয়ে প্লেন থেকে প্যারাশূটে করে ঝাঁপিয়ে পড়তে। অসীম, মুক্ত আকাশে দুই হাত ছড়িয়ে ভাসতে থাকা লাতিফাকে দেখে মনে হতো, তিনিই যেন আরব আমিরাতের উন্নয়নের, নারী স্বাধীনতার প্রতীক! কিন্তু নিখোঁজ হওয়ার আগে রেকর্ড করে যাওয়া এক ভিডিওতে লাতিফা দাবি করেন, এ সবই ছিল ভাঁওতা, লোক দেখানো স্টান্টবাজি। তার দাবি, গত ১৮ বছর ধরে তিনি কার্যত বন্দী ছিলেন!

লাতিফার বন্দী জীবনের শুরু হয় ২০০০ সাল থেকে, যখন তার বড় বোন শামসা তাদের ইংল্যান্ডের প্রাসাদ থেকে পালিয়ে যায়। সে সময় তারা সপরিবারে ইংল্যান্ডে বসবাস করছিলেন, যেখানে শেখ মোহাম্মদের নামে প্রায় ৫,০০০ একর জমি এবং ৭৫ মিলিয়ন ইউরো মূল্যের একটি প্রাসাদ আছে। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ১৯ বছর বয়সী শামসা বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তবে কিছুদিনের মধ্যেই শেখ মোহাম্মদের ভাড়া করা প্রাইভেট গোয়েন্দারা তাকে খুঁজে বের করে এবং দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।

আকাশ থেকে ঝাঁপ দিচ্ছেন প্রিন্সেস লাতিফা; Image Source: juanmayer.com

তখন থেকেই শুরু হয় শামসার বন্দী জীবন, সেই সাথে লাতিফার জীবনেও নেমে আসে প্রচণ্ড কড়াকড়ি। তবে এর দুই বছর পর যখন ১৬ বছর বয়সী লাতিফা নিজেই বাড়ি থেকে প্রথমবারের মতো পালাতে গিয়ে বর্ডারে ধরা পড়েন, তখন থেকেই মূলত তিনিও কার্যত বন্দী হয়ে পড়েন। লাতিফার বক্তব্য অনুযায়ী, তাকে এবং শামসাকে সে সময় নিয়মিত শারীরিক নির্যাতন করা হতো, ঘরে বন্দী করে রাখা হতো এবং নার্সদের মাধ্যমে ড্রাগ দিয়ে অর্ধচেতন করে রাখা হতো। সে সময় দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত তিনি বন্দী অবস্থায় কাটিয়েছিলেন।

লাতিফার ইচ্ছে ছিল বিদেশে গিয়ে ডাক্তারি পড়ার, কিন্তু তার পরিবার থেকে তাকে সে অনুমতি দেওয়া হয়নি। তিনি নিজে যেন কোথাও যেতে না পারেন, সেজন্য তার বাবা তার পাসপোর্ট সরিয়ে ফেলেন। তাকে তার বান্ধবীদের বাসায়ও যেতে দেওয়া হতো না। তিনি শপিংয়ে যেতে পারতেন, ইচ্ছে মতো টাকা খরচ করতে পারতেন, স্কুবা ডাইভিং, স্কাই ডাইভিং শিখতে যেতে পারতেন, কিন্তু সারাক্ষণ তাকে থাকতে হতো ড্রাইভারের নজরদারির মধ্যে। লাতিফার ভাষায়, তার জীবনে কোনো স্বাধীনতা ছিল না, ন্যায় বিচার ছিল না। তার মতে, তাদের সমাজে, তাদের পরিবারে, নারীদের জীবনের কোনো মূল্যই ছিল না।

লাতিফার বড় বোন শামসা বিনতে মোহাম্মদ আল-মাকতুম; Image Source: Daily Mirror

২০১১ সাল থেকে লাতিফা দ্বিতীয়বারের মতো পালানোর পরিকল্পনা করতে শুরু করেন। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার তিনি পরিকল্পনা করতে থাকেন অত্যন্ত সাবধানে এবং সময় নিয়ে। প্রথমেই তিনি যোগাযোগ করেন সাবেক ফরাসি ব্যবসায়ী এবং সাবেক নেভি অফিসার হার্ভে জুঁবের সাথে। হার্ভে জুঁবে তার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে নিজেকে গোয়েন্দা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তার দাবি অনুযায়ী, আরব আমিরাতে ব্যবসায়ী পরিচয়ে বসবাসের সময় তিনি কর্তৃপক্ষের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন এবং শেষমুহূর্তে বোরকা পরে এবং স্কুবা ডাইভিং করে পালাতে সক্ষম হন।

জুঁবে প্রথমে লাতিফার কথা বিশ্বাস করেননি। আমিরাতের প্রধানমন্ত্রীর কন্যা পালানোর জন্য তার সাহায্য চাইছে- ব্যাপারটা বিশ্বাস করা কঠিন। তিনি ভেবেছিলেন এটা তাকে ফাঁদে ফেলার কোনো একটা ষড়যন্ত্র। কিন্তু দীর্ঘ দিন অনুসন্ধানের পর তিনি বুঝতে পারেন, লাতিফা সত্যই বলছে। ফলে তিনি তার সাথে নিয়মিত ইমেইলে যোগাযোগ করতে শুরু করেন, তাকে বিভিন্ন বুদ্ধি দিতে শুরু করেন। জুঁবের পরামর্শে লাতিফা পালানোর প্রস্তুতি হিসেবে টাকা জমাতে থাকেন এবং শেষপর্যন্ত প্রায় ৪ লাখ ডলারের সমপরিমাণ অর্থ জোগাড় করেন।

হার্ভে জুঁবে এবং টিনা জুহাইনেন; Image Source: Nick Edwards/Daily Mail

২০১৪ সালে লাতিফার পালানোর পরিকল্পনার সাথে যুক্ত হন ফিনল্যান্ডের নাগরিক টিনা জুহাইনেন। শুরুতে তিনি ছিলেন লাতিফার ব্রাজিলিয়ান মার্শাল আর্ট, ক্যাপোয়রার প্রশিক্ষক। ধীরে ধীরে লাতিফার সাথে তার গভীর বন্ধুত্ব স্থাপিত হয় এবং তিনি হয়ে উঠেন লাতিফার স্কাই ডাইভিং, শপিংসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ডের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। একপর্যায়ে লাতিফা তাকে পালানোর পরিকল্পনার কথা খুলে বলেন এবং তার সাহায্য চান। লাতিফার পক্ষ হয়ে টিনা একাধিকবার জুঁবের সাথে সাক্ষাৎও করেন।

পালানোর প্রস্তুতি হিসেবে টিনা লাতিফাকে সাঁতার, স্কুবা ডাইভিং, জেট স্কি চালনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে তাদের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়ে আসে। তাদের পরিকল্পনা ছিল প্রথমে লাতিফার ড্রাইভারের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা টিনার গাড়িতে করে বর্ডার পাড়ি দিয়ে ওমানে যাবেন। সেখান থেকে জেট স্কিতে চড়ে ওমানের সমুদ্রসীমা পাড়ি দিয়ে আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় অবস্থিত হার্ভে জুঁবের ইয়াটে গিয়ে উঠবেন। এরপর ভারতে গিয়ে সেখান থেকে প্লেনে চড়ে সোজা চলে যাবেন আমেরিকায়। এরপর সুযোগ বুঝে বড় বোন শামসাকেও তিনি আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন।

পালানোর প্রস্তুতি হিসেবে স্কুবা ডাইভিং অনুশীলন করছেন লাতিফা; Image Source: Sky News

পরিকল্পনার অংশ হিসেবে লাতিফা এবং টিনা প্রতিদিন সকালে একসাথে নাস্তা করার অভ্যাস গড়ে তুলতে শুরু করেন। লাতিফার ড্রাইভার যখন ব্যাপারটিতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখে ড্রাইভারের মনে সন্দেহ না জাগিয়েই টিনার সাথে নাস্তা করার জন্য যান লাতিফা। কিন্তু সেখানে গিয়েই তিনি পোশাক পরিবর্তন করে এবং সানগ্লাস চোখে দিয়ে টিনার গাড়ির বুটে লুকিয়ে তার সাথে বেরিয়ে পড়েন। নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে বুট থেকে বেরিয়ে তিনি এসে বসেন টিনার পাশে। এরপর দুজন মিলে পরিকল্পনা অনুযায়ী ওমানের বর্ডার পেরিয়ে গিয়ে উঠেন জুঁবের ইয়াটে।

সবকিছুই পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোচ্ছিল। ইয়াট ছুটে চলছিল ভারতের দিকে। হার্ভে জুঁবে ভারতীয় এক সাংবাদিকের সাথে যোগাযোগ করছিলেন যেন কোনো ঝামেলা ছাড়াই তারা ভারত থেকে আমেরিকার প্লেন ধরতে পারেন। কিন্তু তাদের তখনও ধারণাই ছিল না যে, আরব আমিরাতের দক্ষ ভাড়াটে হ্যাকার বাহিনী, যারা কাতারের আমিরের আইফোন পর্যন্ত হ্যাক করে ফেলতে পারে, তারা ততক্ষণে তাদের ফোন ট্র্যাক করে তাদের অবস্থান বের করে ফেলেছে এবং আমিরাতের সাথে রাজনৈতিক মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ ভারতীয় সরকারকে তারা ততক্ষণে হাত করে ফেলেছে

যে পথ ধরে পালিয়েছিলেন লাতিফা; Image Source: The Guardian

মার্চের ৪ তারিখে যখন লাতিফাদের ইয়াটটি ভারতের গোয়া সমুদ্রবন্দর থেকে ৩০ মাইল দূরে, তখন ভারতীয় কোস্টগার্ড তাদেরকে ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলতে শুরু করে। রাত দশটার সময় দুটি স্পীডবোটে করে ছয় থেকে আট জন ভারতীয় কমান্ডো ইয়াটের উপর আক্রমণ চালায়। তারা ইয়াট লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে এবং স্মোক গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এরপর ইয়াটে উঠে ক্রুদেরকে বেঁধে ফেলে এবং মারধোর করে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই হেলিকপ্টারে করে সেখানে এসে পৌঁছে অন্তত দশজন আমিরাতী সৈন্য। লাতিফার প্রচন্ড আপত্তির মুখে এবং ভারতীয় কোস্টগার্ডদের কাছে বারবার আশ্রয় চাওয়া সত্ত্বেও তাকে হেলিকপ্টারে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। টিনা, জুঁবে এবং অন্যান্য ক্রুদেরকে ইয়াটে করেই ভারতীয় কোস্টগার্ডের প্রহরায় আমিরাতের ন্যাভাল বেইজ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়।

নিখোঁজ হওয়ার আগে রেকর্ড করা ভিডিওতে লাতিফা; Image Source: Youtube

ইয়াটে উঠার পর থেকেই লাতিফা সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলেন, যেন তিনি বিপদে পড়লে তারা সংবাদটি কভার করে। কিন্তু আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রীর কন্যার ওমান হয়ে সমুদ্র পথে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার কাহিনীটি এতই নাটকীয় ছিল যে, কোনো সাংবাদিককেই তিনি সেটা বিশ্বাস করাতে পারছিলেন না। তার পলায়ন এবং অপহরনের ঘটনাটি তাই চারদিন পর্যন্ত বিশ্ববাসীর কাছে অজানাই রয়ে যায়। মার্চের ৯ তারিখে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ডেইলি মেইল প্রথম তার অপহরণের সংবাদটি প্রকাশ করে।

লাতিফা যদিও আশাবাদী ছিলেন, তিনি নিরাপদেই পালিয়ে যেতে পারবেন, তবুও তার মনের গভীরে ক্ষুদ্র একটি আশঙ্কা শেষপর্যন্ত রয়েই গিয়েছিল। তাই পালানোর কয়েকদিন আগে তিনি তার বান্ধবী টিনার বাসায় বসে ৩৯ মিনিটের একটি ভিডিও রেকর্ড করে গিয়েছিলেন, যেখানে তিনি তার পালানোর পুরো প্রেক্ষাপট সাবলীল ইংরেজিতে বর্ণনা করেছিলেন। তার অপহরণের এক সপ্তাহ পরে মার্চের ১১ তারিখে ভিডিওটি ইন্টারনেটে প্রকাশ পায়। এর পরপরই আমিরাতী কর্তৃপক্ষ টিনা, জুঁবেসহ অন্যান্য ক্রুদেরকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু লাতিফার সংবাদ বিশ্ববাসীর কাছে তখনও অজানাই রয়ে যায়।

জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার সাবেক হাইকমিশনার ম্যারি রবিনসনের সাথে লাতিফা; Image Source: AFP

অনেক সময় সাধারণ কোনো সাংবাদিক কিংবা মানবাধিকার কর্মী, বা সাধারণ কোনো ব্যক্তিকে ভিন্ন দেশ থেকে অপহরণের সংবাদেও অনেক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কিন্তু আরব আমিরাতের শাসকশ্রেণির ক্ষমতার কারণেই হোক, আর অন্য যেকোনো কারণেই হোক, লাতিফার সংবাদটি নিয়ে কিছু মানবাধিকার সংস্থার রুটিন বিবৃতি প্রদান ছাড়া তেমন কোনো আলোড়ন সৃষ্টি হয়নি। প্রায় আট মাস পর, গত ৬ ডিসেম্বর, ঘটনাটি নিয়ে বিবিসি  Escape from Dubai: The Mystery of the Missing Princess শিরোনামে দুই পর্বের একটি ডকুমেন্টারি প্রচার করে।

এই ডকুমেন্টারি প্রচারিত হওয়ার পর প্রথমবারের মতো শেখ মোহাম্মদের কার্যালয়ের বরাতে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। সেখানে দাবি করা হয়, প্রিন্সেস লাতিফা এবং প্রিন্সেস শামসা দুজনেই তাদের পরিবারের সাথে অবস্থান করছেন এবং দুজনেই ভালো আছেন। এছাড়াও বিবৃতিতে দাবি করা হয়, প্রিন্সেস লাতিফার সাময়িক অন্তর্ধান ছিল মূলত সাবেক ফরাসি স্পাই হার্ভে জুঁবে এবং তার সহযোগীদের একটি চক্রান্ত, যারা লাতিফার মুক্তির জন্য ১০০ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দাবি করেছিল।

লাতিফার সৎ মা, প্রিন্সেস হায়া বিনতে হুসেইনের সাথে বাবা শেখ মোহাম্মদ বিন রাশেদ আল-মাকতুম; Image Source: emirateswoman.com

এর কিছুদিন পর আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার সাবেক হাইকমিশনার ম্যারি রবিনসন, শেখ মোহাম্মদ এবং তার অপর স্ত্রী, ফার্স্ট লেডি হায়া বিনতে হুসেইনের আমন্ত্রণে দুবাই সফর করেন। শেখ মোহাম্মদের এই স্ত্রী হচ্ছেন জর্ডানের সাবেক বাদশাহ্‌ হুসেইনের কন্যা, দীর্ঘকাল আয়ারল্যান্ডে বসবাস করার সুবাদে যার সাথে আগে থেকেই ম্যারি রবিনসনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল

ঐ সফর থেকে ফিরে এসে ম্যারি রবিনসন দাবি করেন, প্রিন্সেস লাতিফা মূলত মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন, কিন্তু এখন তিনি নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণ করছেন এবং সুস্থ হয়ে উঠছেন। তিনি আরও বলেন, প্রিন্সেস লাতিফা তার পরিবার সম্পর্কে অন্যের লিখে দেওয়া মিথ্যা বক্তব্য পাঠ করে রেকর্ড করার জন্য এখন অনুতপ্ত। একই সময়ে আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষ তিনটি ছবি প্রকাশ করে, যেখানে প্রিন্সেস লাতিফাকে ম্যারি রবিনসনের পাশে ডাইনিং টেবিলে বসে থাকতে দেখা যায়।

কিন্তু ছবিগুলোতে ম্যারি রবিনসনকে হাস্যোজ্জ্বল দেখা গেলেও প্রিন্সেস লাতিফার মলিন মুখে ক্যামেরার দৃষ্টি এড়িয়ে থাকার প্রচেষ্টা সহজেই ধরা পড়ে। ছবি থেকেই বোঝা যায় পালানোর আগে রেকর্ড করে যাওয়া তার বক্তব্যের সত্যতা:

এই ভিডিও যদি আপনাদের চোখে পড়ে, তার মানে খারাপ কিছু ঘটেছে। হয়তো আমি মারা গিয়েছি, অথবা আমি অত্যন্ত, অত্যন্ত, অতন্ত্য খারাপ পরিস্থিতিতে আছি।

This article is in Bangla language. It's the story of the disappearance of Princess Sheikha Latifa, the daughter of Prime Minister of UAE.

All the references are hyperlinked inside.

Featured Image: Princess Latifa/BBC/Detained in Dubai

Related Articles