সাইবেরিয়া, নামটি শোনার সাথে সাথে চোখের সামনে ভেসে উঠে বরফের পর। যত দূর চোখ যায় জনমানবহীন প্রতিকূল পরিবেশের এই রাজ্যে মানুষের বসতিও অনেক কম। পৃথিবীর বুকে এই হিমের রাজ্য সাইবেরিয়াকে জ্ঞানের আলোয় উষ্ণ করতেই কিনা ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত সরকার সাইবেরিয়ায় বিজ্ঞান-নগরী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিজ্ঞানের জগতে পাকা আসনে গেড়ে বসতে শুরু করে। মহাকাশ থেকে অণু-পরমাণু সবকিছু নিয়েই আমেরিকা তখন বিজ্ঞানের তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হতে থাকে। তাই আমেরিকার সাথে পাল্লা দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির জগতে চালকের আসনে বসাতেই নিকিতা ক্রুশ্চেভ এই প্রকল্পের দিকে মনোযোগী হয়েছিলেন। রাশিয়ান ভাষায় এই বিজ্ঞান-নগরীর নাম দেওয়া হয়েছিলো ‘Akademgorodok’।
কিন্তু সাইবেরিয়াতেই কেন?
সাইবেরিয়ার অন্যতম বৃহত্তম শহর নভোসাইবেরিস্ক থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে গড়ে তোলা হয়েছিলো শিক্ষা আর গবেষণার এই তীর্থভূমি। বছরের ছয় মাস শীতের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকা এই নগরীতে তাপমাত্রা মাইনাস চল্লিশের ঘরেও চলে যায় হরহামেশা। আর বিজ্ঞাননগরীর সীমানা থেকে একটু দূরেই তাকালেই দেখা মিলে মেরু ভালুকদের আনাগোনা। ফলে প্রশ্ন থেকেই যায়, পৃথিবীর অন্যতম বড় এই দেশের বাকি জায়গা বাদ দিয়ে দুর্গম আর প্রতিকূল পরিবেশে ঘেরা এই সাইবেরিয়াতেই কেন গড়ে তোলা হয়েছিলো এই নগরী!
জারের আমল থেকেই গুরুতর যেকোনো অপরাধের শাস্তি হিসেবে সাইবেরিয়ায় নির্বাসন দেওয়ার চিত্র ছিলো বেশ কঠিন। এ কারণে সাইবেরিয়ার ব্যাপারে সাধারণ জনগণের মধ্যে তৈরি হয়েছিলো নেতিবাচক ধারণা। কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদের এই অপার লীলাভূমিকে গড়ে তুলতে হলে যে দক্ষ জনসম্পদ দরকার তা সংগঠিত করতে সোভিয়েত প্রশাসন বরাবরই হিমশিম খাচ্ছিলো। তাই বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির তীর্থভূমি নির্মাণ করে নতুন প্রজন্মের মন থেকে সাইবেরিয়ার ব্যাপারে এই নেতিবাচকতা দূর করার পাশাপাশি দীর্ঘকাল থেকে অব্যবহৃত সম্পদের খনিকে দেশের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা থেকেই এই শহর নির্মাণের উদ্যোগ শুরু হয়।
গবেষণা আর চিন্তার স্বাধীনতা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরেই সোভিয়েত ইউনিয়ন বিজ্ঞানচর্চায় বেশ পিছিয়ে পড়ে। বহু খ্যাতিমান বিজ্ঞানী আর গবেষকরা নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নে গবেষণার বাজেট কমছে, বিজ্ঞানীদের অনেকের গবেষণাগারে ঝুলছে তালা, অনেকেই জেলে বন্দী। এমতাবস্থায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিণত হয় ‘ব্রেইন ড্রেইনে’। তাই এই প্রতিভাবান আর তরুণ গবেষকদের ধরে রাখাও ছিলো এই বিজ্ঞান-নগরীর অন্যতম উদ্দেশ্য।
নভোসাইবেরিস্ক স্টেট ইউনিভার্সিটি ছাড়াও মোট পয়ত্রিশটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয় পুরো এলাকাজুড়ে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রত্যেকে বিজ্ঞানের আলাদা আলাদা শাখা নিয়ে কাজ করলেও তাদের মধ্যে সমন্বয় গড়ে তোলাও ছিলো এই বিজ্ঞান-নগরীর অন্যতম উদ্দেশ্য। সাইবেরিয়ার দুর্গম এলাকায় গড়ে তোলা প্রথম গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি ছিলো ‘ইনস্টিটিউট অফ হাইড্রোডায়নামিক্স’। এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মিখাইল লাভরেনত্যিফ প্রথমে মস্কোর নগরজীবন ছেড়ে সাইবেরিয়ায় আসতেই রাজী ছিলেন না। কিন্তু বিশ্বমানের গবেষণাগার আর সরঞ্জাম ব্যবহার করে গবেষণা করে দেওয়ায় সাইবেরিয়াকেই নিজের গন্তব্য বানিয়ে নেন এই বিজ্ঞানী।
সাধারণ পরিবেশে যে পরীক্ষানিরীক্ষাগুলো করার সু্যোগ যারা পেতেন না, সাইবেরিয়ার নির্জন অরণ্যে সেই সুবিধাটাও দেওয়া হয় বিজ্ঞানীদের। কোষবিদ্যা আর জীনতত্ত্ব গবেষণা প্রতিষ্ঠানে দিমিত্রি বেলায়েভ তার নতুন নতুন বন্য প্রাণীকে পোষ মানানোর কাজ শুরু করেন। এই গবেষণাগারে একধরনের শিয়ালের শংকর তৈরি করা হয়, যাদের আচরণ অনেকটাই কুকুরের মতো। এই গবেষণাগারে কম করে হলেও ৫০ ধরনের প্রাণীর শংকর তৈরি করা হয়। এই ধরনের শংকর কৃষিক্ষেত্রে এবং শিকার আহরণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
চারদিকে গহীন অরণ্যে ঘেরা এই ‘সিলিকন জঙ্গলে‘ জীববিজ্ঞানের অমীমাংসিত সব রহস্য থেকে শুরু করে পরমাণুর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়েও গবেষণা করার সু্যোগ করে দেওয়া হয় রাশিয়ান তরুণদের। এই নগরীতে একদম প্রথম দিকে কাজ করতে আসা বিজ্ঞানীদের একজন ছিলেন ভিক্টর ভারাণ্ড। ‘ইনস্টিটিউট অফ ইনঅরগ্যানিক কেমিস্ট্রিতে’ গবেষক হিসেবে যোগ দেওয়ার সময় তার চোখমুখে ছিলো রাজ্যের অনিশ্চয়তা। কিন্তু গিয়ে নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, ২৫ হাজার বাসিন্দার প্রায় সবাই তরুণ। প্রাণোচ্ছলতায় মূখর হয়ে উঠছে সব গবেষণা প্রতিষ্ঠান। ষাটের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নজুড়ে খাদ্য আর বাসস্থানের সংকট ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছিলো। এমতাবস্থায় এই গবেষণাগারের আশপাশের এলাকাজুড়ে প্রায় পয়ষট্টি হাজার লোকের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেয় সোভিয়েত সরকার। উন্নত খাদ্যের সরবরাহও নিশ্চিত করা হয় এই এলাকার বাসিন্দাদের জন্য।
চিন্তার স্বাধীনতা
বিশাল সব গবেষণাগারের নানা ধরনের উন্নত যন্ত্রপাতির সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বিজ্ঞানীরা পেয়েছিলেন চিন্তার স্বাধীনতা। স্টালিনের দমননীতির অনেক স্মৃতিচিহ্ন তখনো রয়ে গিয়েছিলো সোভিয়েত সমাজে, কিন্তু সাইবেরিয়ার এই শহরটি তা থেকে ছিলো স্বাধীন। এই এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছিলো সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র, যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নে নিষিদ্ধ অনেক শিল্পীর শিল্পকর্মের প্রদর্শনী পর্যন্ত হয়েছিলো।
পাশাপাশি ‘Cybernetics‘ কিংবা ‘Genetics‘ এর মতো বিজ্ঞানের উঠতি শাখাকে মস্কোতে তখন ‘বিপজ্জনক অপবিজ্ঞান’ হিসেবে প্রচার করা হচ্ছিলো, কিন্তু এই নগরীর পরিচালক মিখাইল লাভরেনত্যিফের পৃষ্ঠপোষকতায় এই দুটি শাখায় বিজ্ঞানীরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে। এমনকি এই নগরীর গবেষণাগারে বসেই গারশ বুদকার নামের এক পদার্থবিদ পৃথিবীর প্রথম ‘সাবএটমিক কোলাইডার‘ যন্ত্রটি তৈরি করেছিলেন এই নগরীতে বসেই।
একটি স্বপ্নরাজ্যের পতন
সবকিছু ঠিকঠাক চলতে থাকলে এই নগরীতে ধীরে ধীরে নেমে আসে রাজনৈতিক কালোছায়া। ১৯৭০ সালে ব্রেঝনেভ শাসনামলে এই এলাকার উপর নজরদারী বাড়ানো হয়। সামরিক বিভিন্ন খাতে গবেষণার বাজেট বাড়ানোয় মৌলিক বিজ্ঞানের দিকগুলো আস্তে আস্তে অবহেলিত হয়ে পড়ে। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়ে এই নগরী। বাজেট সংকট আর রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে পড়ে আবারো স্থবিরতা নেমে আসে রাশিয়ার বিজ্ঞান অঙ্গনে। দেশের সেরা মেধারা পাড়ি জমাতে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ত্রিশ বছরের উত্তরোত্তর সাফল্যের চিহ্ন বহনকারী ল্যাবগুলো পরিণত হয় কংক্রিটের জঙ্গলে। সাইবেরিয়ার গহীনে হারিয়ে যেতে শুরু করে সমৃদ্ধ সোনালী অতীত।
নিকিতা ক্রুশ্চেভ থেকে ভ্লাদিমির পুতিন
২০০৫ সালের দিকে পুতিন একবার ভারত সফরে এসেছিলেন, ভারতের দ্রুত উন্নয়নের পেছনের গল্পটা যে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি খাতে গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো, তা বুঝতে তার বিন্দুমাত্র দেরী হলো না তার। দেশে ফিরেই তিনি উদ্যোগ নিলেন ঝিমিয়ে পড়া শহরকে আবার জাগিয়ে তুলতে হবে। বিদেশী কোম্পানিকেও ব্যবসা করার এবং বিনিয়োগের সুযোগ করে দিলেন পুতিন।
এই নগরীতে শক্তিশালী অবকাঠামো থাকায় দেশী-বিদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগে এগিয়ে আসে। আইবিএম, ইন্টেল এর মত নামীদামী কোম্পানি সাইবেরিয়াতে গবেষণাগারে বিনিয়োগ করতে রাজী হয়ে গেলো। মোটমাট এক বিলিয়ন ডলারের বিশাল বিনিয়োগ নিয়ে এই বিজ্ঞানরাজ্য আবারো দাঁড়িয়ে গেলো।
বর্তমান অবস্থা
২০১১ সাল নাগাদ, এই এলাকায় আবারো নয় হাজার গবেষক, কর্মী আর বিজ্ঞানীর সমাগম হয়েছে। পুরোনো অবকাঠামো ঘিরে গড়ে উঠছে নতুন স্বপ্নরাজ্য।
শুধুমাত্র ২০১১ সালেই এই শহর থেকে প্রযুক্তি খাতের বার্ষিক আয় দাঁড়িয়েছে সতের বিলিয়ন রুবল, যেখানে মস্কোভিত্তিক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক আয় ছিলো চার বিলিয়ন রুবল। তাই সঠিক বিনিয়োগ আর দক্ষ নেতৃত্বের ধারা অব্যাহত থাকলে সাইবেরিয়ার গহীনে লুকিয়ে থাকা এই নগরীই হয়তো হয়ে উঠবে রাশিয়ার ‘সিলিকন ভ্যালি’।
ফিচার ইমেজ: bloomberg.com