১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলের সাথে প্রতিবেশি আরব রাষ্ট্রগুলোর যে কয়টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, তার মধ্যে ১৯৬৭ সালের তৃতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ছয় দিনের যুদ্ধ নামে পরিচিত এই যুদ্ধে ইসরায়েল নাটকীয়ভাবে তিনটি আরব রাষ্ট্রকে পরাজিত করে এবং জেরুজালেম, পশ্চিম তীর, গাজা এবং গোলান মালভূমিসহ সম্পূর্ণ ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে নেয়।
বর্তমানে ফিলিস্তিন সংকটের যে স্বরূপ, তার অনেকটাই ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের ফলাফল। এই যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত গাজা ছিল মিসরের নিয়ন্ত্রণে, আর আল-আকসা মসজিদ এবং পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীর ছিল জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে। অন্য কথায়, ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে পরাজয়ের পরেও আরবদের হাতে ফিলিস্তিনের ২৮% ভূমির নিয়ন্ত্রণ ছিল। কিন্তু ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পর ১০০% ভূমিই তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, কী ছিল এই ছয় দিনের যুদ্ধের প্রেক্ষাপট? কীভাবে শুরু হয়েছিল এই যুদ্ধ? কে ছিল এই যুদ্ধের জন্য দায়ী? ইসরায়েলি সরকারি ভাষ্যে তো বটেই, আপনি যদি গুগলে বা ইউটিউবে গিয়ে এই যুদ্ধের কারণ জানতে চেয়ে অনুসন্ধান করেন, তাহলে আপনার সামনে ইংরেজিতে যতগুলো আর্টিকেল এবং ডকুমেন্টারি আসবে, তার অধিকাংশতেই দেখবেন এই যুদ্ধের জন্য একচেটিয়াভাবে আরবদেরকে, বিশেষ করে মিসরকে দায়ী করা হয়েছে। এসব আর্টিকেল এবং ডকুমেন্টারিতে ঘটনাপ্রবাহ এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, আপনার মনে হবে নিজের আত্মরাক্ষার জন্য সে সময় যুদ্ধ করা ছাড়া ইসরায়েলের যুদ্ধে জড়ানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক ইতিহাসবিদই এ ধরনের প্রচলিত ইতিহাসের বিরোধিতা করেছেন। এবং এই তালিকায় আছেন খোদ ইসরায়েলি ইতিহাসবিদগণও। দীর্ঘদিন গোপন থাকার পর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবমুক্ত ইসরায়েলি আর্কাইভের নথিপত্র থেকেই তারা প্রমাণ করেছেন, এই যুদ্ধে ইসরায়েল মোটেও বাধ্য হয়ে জড়ায়নি। বরং ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই অপেক্ষা করছিল পশ্চিম তীরসহ সমগ্র ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে বৃহত্তর ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করার। ১৯৬৭ সাল তাদেরকে সে সুযোগই এনে দিয়েছিল মাত্র।
এরকমই একজন ইতিহাসবিদ হলেন ইংল্যান্ড প্রবাসী ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ, ইউনিভার্সিটি অফ এক্সেটারের শিক্ষক এবং সেখানকার ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর প্যালেস্টাইন স্টাডিজের পরিচালক, অধ্যাপক ইলান পাপে। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট নিয়ে তার একাধিক বই আছে, যেগুলোতে তিনি ইসরায়েলি নথিপত্রের আলোকেই প্রচলিত ইসরায়েলপন্থী ইতিহাসের বিরোধিতা করেছেন। তার রচিত “10 Myths About Israel” এমনই একটি বই, যার ১০টি অধ্যায়ে তিনি ইসরায়েল সম্পর্কে প্রচলিত ১০টি মিথ্যা প্রচারণার জবাব দিয়েছেন। তারই একটি হলো ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধ সংক্রান্ত ইসরায়েলি প্রচারণার বিরুদ্ধে তার জবাব।
ইলান পাপে তার ছয় দিনের যুদ্ধ সংক্রান্ত অধ্যায়টি শুরু করেছেন ১৯৪৮ সালের যুদ্ধের প্রসঙ্গ অবতারণার মধ্য দিয়ে। তার মতে, সে সময়ই ইসরায়েলি রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃবৃন্দের লক্ষ্য ছিল জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত সমগ্র ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে নেওয়া। কিন্তু সেটা তারা করতে পারেনি মূলত জর্ডানের সাথে তাদের গোপন চুক্তির কারণে।
ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের শেষ দিনগুলোতে জর্ডানের তৎকালীন বাদশাহ আব্দুল্লাহ বিন হুসেইনের সাথে জায়নিস্ট নেতাদের এই মর্মে সমোঝোতা হয় যে, ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন ছেড়ে যাওয়ার পরপরই ইসরায়েল যখন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিবে, তখন আরবরা যদি ইসরায়েলের উপর আক্রমণ করে, জর্ডান তাতে কেবল নামেমাত্র অংশগ্রহণ করবে। বিনিময়ে ইসরায়েল সম্পূর্ণ ফিলিস্তিন দখল না করে জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রণ জর্ডানের ছেড়ে দেবে।
কিন্তু পরবর্তীতে ইসরায়েলি রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃবৃন্দের অনেকেই এই সমঝোতার সিদ্ধান্তের কারণে সমগ্র ফিলিস্তিন দখল করতে না পারাকে হারানো সুযোগ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ইসরায়েলের প্রধান প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ন এই সমঝোতা মেনে চললেও একে “সর্বনাশা ঐতিহাসিক ভুল” হিসেবে আখ্যায়িত করে মন্তব্য করেছেন, এর জন্য ইসরায়েলের ভবিষ্যত প্রজন্ম পরিতাপ করবে।
অন্যান্য ইতিহাসবিদদের লেখা বই এবং ইসরায়েলের সামরিক নথিপত্রের রেফারেন্স দিয়ে ইলান পাপে তার বইয়ে দাবি করেছেন, ১৯৪৮ সালের পর থেকেই ইসরায়েলের রাজনৈতিক, সামরিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ তাদের এই ভুল শুদ্ধ করার সুযোগ অনুসন্ধান করছিল। বিশেষ করে ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকেই তারা পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল, কীভাবে জেরুজালেম এবং পশ্চিম তীর দখল করে বৃহত্তর ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করা যায়।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধের আগেও তারা একাধিকবার তাদের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার কাছাকাছি অবস্থায় চলে গিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ ১৯৫৮ এবং ১৯৬০ সালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ন পশ্চিম তীর দখল করার উদ্যোগ নিয়েও শেষ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক চাপের কথা বিবেচনা করে তা বাতিল করে দিয়েছিলেন। তাছাড়া সে সময় তার আরও একটি ভয় ছিল, পশ্চিম তীর দখল করে নিলে যে বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের অধিবাসী হয়ে পড়বে, তাতে ইসরায়েলের জনমিতিই পরিবর্তিত হয়ে যাবে।
১৯৬৭ সালের মতোই ১৯৫৮ এবং ১৯৬০ সালেও ইসরায়েলের প্রধান আশঙ্কা ছিল মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুল নাসেরকে নিয়ে। ১৯৫৬ সালে ইসরায়েল, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামরিকভাবে পরাজিত হলেও সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করার মধ্য দিয়ে আব্দুল নাসের রাজনৈতিকভাবে বিজয়ী হয়েছিলেন। ফলে আরব বিশ্বে তার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছিল এবং তার ফ্রি অফিসারদের বিপ্লব সমগ্র আরব বিশ্বকে প্রভাবিত করতে শুরু করেছিল। বিশেষ করে ১৯৫৮ সালে আরব বিশ্বের একাধিক রাষ্ট্রে জামাল আব্দুল নাসেরের প্রভাব প্রবলভাবে অনুভূত হচ্ছিল।
সে সময় ইসরায়েলের আশঙ্কা ছিল, আব্দুল নাসেরের ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্টের প্রভাবে জর্ডানেও হয়তো এরকম কোনো অভ্যুত্থান বা বিপ্লব ঘটতে পারে। যেহেতু পশ্চিম তীর ছিল জর্ডানের অধীনস্থ, তাই এরকম কিছু ঘটলে ইসরায়েলের পশ্চিম তীর দখল করার স্বপ্ন অধরাই রয়ে যাবে। ফলে মোহশে দায়ানের নেতৃত্বে ইসরায়েলের সরকার এবং সেনাবাহিনীর একটি শক্তিশালী লবি প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়নকে চাপ দিতে থাকে, তিনি যেন ন্যাটোর কাছে আগেভাগেই পশ্চিম তীর দখল করে নেওয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
সে বছর ইরাকে আব্দুল করিম কাসেমের নেতৃত্বে একদল সেনা অফিসার যখন মিসরের ফ্রি অফিসারদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে হাশেমী রাজপরিবারকে উচ্ছেদ করে ক্ষমতা দখল করে, তখন পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো লেবাননকে নিয়েও উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। ফলে ন্যাটো সম্ভাব্য বিপ্লব বা সামরিক অভ্যুত্থানের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য লেবাননে মার্কিন নৌবাহিনী এবং জর্ডানে ব্রিটিশ স্পেশাল ফোর্স প্রেরণ করে। তারপরেও ইসরায়েল যখন পশ্চিম তীরকে ‘রক্ষা’র জন্য সেনাবাহিনী পাঠানোর প্রস্তাব দেয়, তখন আমেরিকা তাতে আপত্তি জানায়।
আমেরিকার আপত্তির মুখে সেবারের মতো ইসারয়েল পিছিয়ে যায়। তাছাড়া ইসরায়েলের সামরিক লবির চাপ সত্ত্বেও বেন গুরিয়ন নিজেও সেই মুহূর্তে পশ্চিম তীর দখল করতে রাজি ছিলেন না, কারণ তার মতে সোয়া মিলিয়ন জনসংখ্যার ইসরায়েলের পক্ষে আরো এক মিলিয়ন ফিলিস্তিনিসহ পশ্চিম দখল করে নেওয়াটা বিপজ্জনক হতো। কিন্তু সেবার সহজে যুদ্ধ এড়ালেও দুই বছর পর ১৯৬০ সালে যুদ্ধ এড়ানো বেন গুরিয়নের জন্য আরেকটু কঠিন ছিল।
১৯৬০ সালে ইসরায়েলের সাথে সিরিয়ার উত্তেজনা চরমে পৌঁছে গিয়েছিল। মূলত ১৯৪৯ সালের যুদ্ধবিরতির পর থেকেই জাতিসংঘ ঘোষিত ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ নিয়ে ইসরায়েলের সাথে সিরিয়ার দ্বন্দ্ব চলছিল। ইসরায়েল প্রায়ই অবৈধ স্থাপনার বাসিন্দাদেরকে এবং কৃষকদেরকে ঐসব নিষিদ্ধ এলাকা সংলগ্ন জমিতে চাষাবাদ করার জন্য প্রেরণ করত, যার ফলে প্রায়ই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হতো। ঠিক এই ঘটনাই ঘটেছিল ১৯৬০ সালেও। সেবার ইসরায়েলের এরকম উস্কানির ফলে সৃষ্টি হওয়া উত্তেজনা শেষ পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত বিমান যুদ্ধ পর্যন্ত গড়িয়েছিল।
একই সময় ইসরায়েলের ন্যাশনাল ওয়াটার ক্যারিয়ার নির্মাণ নিয়েও দেশটির সাথে সিরিয়ার উত্তেজনা চলছিল। ন্যাশনাল ওয়াটার ক্যারিয়ার হচ্ছে খাল এবং পাইপলাইনের সমন্বয়ে গঠিত দীর্ঘ জলপথ, যার মাধ্যমে ইসরায়েল গ্যালিলি সাগর (লেক টাইবেরিয়াস বা তাবারিয়া হ্রদ) থেকে বিপুল পরিমাণ স্বাদু পানি দেশটির অন্যান্য অংশে স্থানান্তর করে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সিরিয়ার গোলান মালভূমির সীমান্তে অবস্থিত হওয়ায় এই হ্রদের পানির উপর সিরিয়ানদেরও অধিকার ছিল এবং এর পানি সিরিয়ার প্রয়োজনও ছিল।
সে সময় সিরিয়া এবং মিসর একত্রিত হয়ে ইউনাইটেড আরব রিপাবলিক নামে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠন করেছিল, যার প্রেসিডেন্ট ছিলেন জামাল আব্দুল নাসের। সিরিয়ার সাথে ইসরায়েলের দ্বন্দ্ব এমনিতেই নাসেরকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। তাছাড়া সিরিয়ানরাও নাসেরকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে, ইসরায়েল অচিরেই গোলান মালভূমির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য সিরিয়ার উপর পূর্ণ আক্রমণ করতে যাচ্ছে। ফলে নাসের ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। তিনি সিনাই উপত্যকায় সৈন্য মোতায়েন করার এবং সুয়েজ খালে ইসরায়েলি জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিতে শুরু করেন।
বাস্তবে অবশ্য নাসেরের সে সময় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর পরিকল্পনা ছিল না। তিনি চাইছিলেন যুদ্ধে না জড়িয়েই ফিলিস্তিন সংকটের অচলাবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে। তিনি চাইছিলেন একইসাথে আলোচনার মাধ্যমে এবং চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ইসরায়েলের কাছ থেকে যথাসম্ভব সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করে নিতে। এ উদ্দেশ্য তিনি যুদ্ধে না জড়িয়েই যুদ্ধের হুমকি দিয়ে ইসরায়েলের উপর সর্বোচ্চ পরিমাণে চাপ সৃষ্টি করার নীতি গ্রহণ করেছিলেন, যা ব্রিঙ্কম্যানশিপ (Brinkmanship) নীতি নামে পরিচিত ছিল।
মাঝখানে কিছুদিন যখন ডেভিড বেন গুরিয়ন ক্ষমতা থেকে দূরে ছিলেন, তখন মিসরের সাথে ইসরায়েলের কিছুটা সমঝোতার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ১৯৫৫ সালে বেন গুরিয়ন যখন পুনরায় ক্ষমতা ফিরে পান, তখন সেই সম্ভাবনাও নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি ক্ষমতা থেকে দূরে থাকার সময়ও বেন গুরিয়ন তার প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে সেনাবাহিনীর কমান্ডারদেরকে প্ররোচিত করেছিলেন গাজা উপত্যকায় অভিযান চালিয়ে মিসরের কাছ থেকে তা দখল করে নিতে। এবং দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরপরই ১৯৫৬ সালে তিনি ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের সাথে মিলে মিসরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন, যার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল নাসেরকে ক্ষমতাচ্যুত করা।
কাজেই ১৯৬০ সালে যখন ইসরায়েলের সাথে কোনো ধরনের সমঝোতার সম্ভাবনা ছিল না, এবং নাসেরও সরাসরি যুদ্ধ শুরু করতে আগ্রহী ছিলেন না, তখন তিনি প্রথমবারের মতো তার ব্রিঙ্কম্যানশিপ নীতি প্রয়োগ করেন। তিনি ১৯৫৬ সালের যুদ্ধের পর থেকে জাতিসংঘ কর্তৃক বেসামরিক এলাকা হিসেবে ঘোষিত সিনাই উপদ্বীপে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। জাতিসংঘ এর কঠোর নিন্দা জানায় এবং অবিলম্বে সেনা প্রত্যাহার করার জন্য মিসরকে চাপ দেয়। এবং ইসরায়েল তাদের রিজার্ভ বাহিনীকে তলব করলেও পরিষ্কার বার্তা দেয় যে তারাও যুদ্ধে জড়াতে আগ্রহী না। ফলে সেবারের মতো উত্তেজনা প্রশমিত হয়। কিন্তু ১৯৬৭ সালে যখন প্রায় একই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, তখন তার পরিণতি হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এর কারণ ছিল, মূলত ১৯৬৩ সাল থেকেই সেনাবাহিনী, সিভিল সার্ভিস এবং অ্যাকাডেমিয়া থেকে আগত একদল ইসরায়েলি বিশেষজ্ঞ বিস্তারিত একটি কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত করে রেখেছিল যে, যদি কখনও সুযোগ আসে, তাহলে কীভাবে জরুরি অবস্থা জারি করে, সামরিক আইন প্রবর্তন করে ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেগুলো পরিচালনা করা হবে। এবং ১৯৬৭ সালেই ইসরায়েলের সামনে সেই সুযোগ চলে আসে।
১৯৬৬ সালে সালাহ জাদিদের নেতৃত্বে সিরিয়ার নিও-বাথ পার্টি এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেওয়ার পর থেকেই মূলত ইসরায়েলের সাথে সিরিয়ার উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। ক্ষমতা দখলের পরপরই সালাহ জাদিদের সরকার ইসরায়েলের ওয়াটার ক্যারিয়ার নির্মাণের জবাবে নিজেরা পাল্টা ওয়াটার ক্যারিয়ার নির্মাণ শুরু করে এবং জর্ডান নদীর মোহনা থেকে পানি নিজেদের এলাকায় স্থানান্তরিত করার উদ্যোগ নেয়। ইসরায়েল এই প্রকল্পের উপর বিমান হামলা চালালে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়।
তাছাড়া সিরিয়ার এই নতুন সরকার ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগঠন পিএলওর প্রতিও সমর্থন এবং সহায়তা বৃদ্ধি করে। তাদের সমর্থনে ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে ফাতাহর গেরিলারা গোলান মালভূমি থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি করে। ইসরায়েল পাল্টা গোলান মালভূমিতে বিমান হামলা চালায়। এরকম পরিস্থিতিতে ১৯৬৬ সালের শেষের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন মিসরকে জানায়, তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ইসরায়েল অচিরেই সিরিয়ার উপর আক্রমণ করে গোলান মালভূমি দখল করে নিবে।
ফলে ১৯৬০ সালের মতো নাসের পুনরায় তার ব্রিঙ্কম্যানশিপ নীতি প্রয়োগ করতে শুরু করেন। ইসরায়েলের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য তিনি সিনাই উপদ্বীপে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন এবং তিরান প্রণালী বন্ধ করে দেন। ১৯৬০ সালের মতোই এবারও নাসেরের উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধে না জড়িয়েই ইসরায়েলকে তাদের আক্রমণাত্মক মনোভাব থেকে নিবৃত্ত করা। কিন্তু এবার ফলাফল হয় বিপরীত। এবার মিসর সিনাইয়ে সেনাবাহিনী পাঠানোর পরপরই জাতিসংঘ সেখানে থাকা শান্তিরক্ষীবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে এবং ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করার পূর্ণ অজুহাত পেয়ে যায়। এবং জুনের ৫ তারিখে মিসরীয় বাহিনীর উপর আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে যুদ্ধের সূচনা করে।
ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করেছিল মিসরের বিরুদ্ধে, সিনাই উপদ্বীপে। দুই দিনের মধ্যেই তারা একযোগে মিসর এবং সিরিয়াকে পরাজিত করে গাজা, সিনাই এবং গোলান দখল করে নেয়। জর্ডানের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ শুরু করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ শুরুর আগেই জর্ডান ইসরায়েলকে বার্তা পাঠিয়েছিল যে, মিসর এবং সিরিয়ার সাথে চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধ শুরু হলে তাদেরকেও সেই যুদ্ধে অংশ নিতে হবে, কিন্তু সেটা হবে খুবই সীমিত। তারা ইসরায়েলের সাথে সত্যিকার অর্থে যুদ্ধে যেতে চায় না।
কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ইসরায়েল জর্ডানের উপর আক্রমণ করে তাদের সম্পূর্ণ বিমানবাহিনী ধ্বংস করে দেয়। ফলে জর্ডানও পাল্টা তেল আবিবে গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করে। এবং এই অজুহাতে ইসরায়েল জর্ডানীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে পুরোমাত্রায় আক্রমণ করে এবং জেরুজালেমসহ সমগ্র পশ্চিম তীর দখল করে নেয়। বাস্তবায়িত হয় সমগ্র ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে নেওয়ার তাদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা।
প্রচলিত ইতিহাসে যেরকম দাবি করা হয়, ছয় দিনের এই যুদ্ধে ইসরায়েল জড়িয়েছিল বাধ্য হয়ে, সেটা সত্য হলে যুদ্ধের পরপরই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রেজল্যুশন মেনে তারা অন্তত পশ্চিম তীরের অবৈধ দখল থেকে সরে যেত। কিন্তু যুদ্ধের পরপরই অনুষ্ঠিত ইসরায়েলের মন্ত্রীসভার অধিবেশনগুলোর রেকর্ড থেকে দেখা যায়, তাদের সেরকম ইচ্ছা কখনোই ছিল না। ১৯৪৮ সাল থেকেই তাদের পরিকল্পনা ছিল ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ জেরুজালেমসহ যত বেশি সংখ্যক ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে নেওয়া এবং একবার দখল করার পর কোনোভাবেই সেটা হাতছাড়া না করা।
মন্ত্রীসভার বৈঠকগুলোতে ইসরায়েল কয়েকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমত, যেকোনো উপায়েই তাদেরকে পশ্চিম তীরের দখল ধরে রাখতে হবে, কারণ পশ্চিম তীর ছাড়া ইসরায়েল টিকে থাকতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, দখলকৃত এলাকাগুলোর ফিলিস্তিনি জনসংখ্যাকে তারা ইসরায়েলের নাগরিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে নিবে না। জনমিতির পরিবর্তন রোধ করার লক্ষ্যে তারা তাদেরকে নাগরিকত্ব না দিয়ে পরিণত করবে রাষ্ট্রবিহীন, নাগরিত্ববিহীন এক জনগোষ্ঠীতে। এবং তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তারা মিসরের সাথে সিনাই এবং সিরিয়ার সাথে গোলান নিয়ে দেন দরবার করবে, কিন্তু গাজা এবং পশ্চিম তীরকে তারা কোনো উপায়েই হাতছাড়া করবে না।
১৯৬৭ সালেে এক সংবাদ সম্মেলনে ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লেভি এশকল তাদের এই মূলনীতির কথা পরিষ্কারভাবে স্বীকারও করে ফেলেছিলেন। কিন্তু এরপরেই তারা বুঝতে পারেন, প্রকাশ্যে এটা স্বীকার করাটা তাদের জন্য লাভজনক না। ফলে এরপর থেকে প্রকাশ্যে শান্তি আলোচনার কথা বলেন, বাস্তবে তাদের মূলনীতি এখনও অপরিবর্তিতই আছে- গাজা এবং পশ্চিম তীর তারা হাতছাড়া করবেন না।
এবং গত পাঁচ দশক ধরে ঠিক সেটাই হয়ে এসেছে। ইসরায়েল বিভিন্ন সময় শান্তি আলোচনার ভান করেছে, ফিলিস্তিনিদের সাথে অসলো চুক্তিও করেছে, কিন্তু বাস্তবে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে যেন একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র কখনোই প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে। পাঁচ দশক পরে আজও তারা ১৯৬৭ সালের সেই ছয়দিনের যুদ্ধে দখল করা গাজা এবং পশ্চিম তীর কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদার পর গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিলেও সেটাকে তারা অবরুদ্ধ করে রেখেছে চতুর্দিক থেকে। আর পশ্চিম তীরের কিছু কিছু অংশকে স্বায়ত্ত্বশাসন দিলেও সেখানকার ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এখনও তাদেরই মুখাপেক্ষী।
ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান কীভাবে হবে, কিংবা আদৌ হবে কিনা, কেউ জানে না। কিন্তু এতদিন ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের ইতিহাসটাও যে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে ছিল, অন্তত সেটাতে সাম্প্রতিক সময়ে পরিবর্তন আসছে। ইলান পাপের মতো ইসরায়েলের নতুন ধারার ইতিহাসবিদরাই তাদের বইপত্র এবং লেখালেখির মাধ্যমে ইসরায়েল সংক্রান্ত বিভিন্ন ‘মিথ’ ভেঙে দিচ্ছেন। এটাও হয়তো হতে পারে পরিবর্তনের পথে ছোট একটা পদক্ষেপ।