আমেরিকায় কালো মানুষদের দাসত্বের ইতিহাস অন্তত চার শতাব্দী পুরনো। এই দীর্ঘ ইতিহাসের প্রায় সবটুকুই লেখা হয়েছে সাদা মানুষদের হাতে, কারণ নির্যাতিত কালো মানুষদের লেখার ক্ষমতা ছিল না। তবে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, অর্থাৎ দাসপ্রথার সায়াহ্নে কিছু কালো মানুষ কলম ধরলেন। লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করলে প্রাক্তন দাস হিসাবে নিজেদের দুর্বিসহ অভিজ্ঞতা, যেগুলো আজও দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী থাকা কালো মানুষের দুর্দশা ও গ্লানির জীবন্ত ইতিহাস হয়ে আমাদের অন্তরকে নাড়িয়ে দেয়। এই লেখাগুলো কখনো প্রকাশিত হয়েছে বই আকারে, আবার কখনো পুস্তিকা বা প্রচারপত্র হিসেবে ছোট পরিসরে।
মার্কিন ইতিহাসে এই লেখাগুলো দাসদের আত্মকথা (Slave Narratives) হিসেবে পরিচিত। নিঃসন্দেহে প্রাক্তন দাসদের এই আত্মকাহন মার্কিন সাহিত্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমেরিকার গৃহযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে সাহিত্য অভিব্যক্তি প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছিল দাসদের আত্মকথা। প্রাক্তন দাসদের স্মৃতিচারণমূলক প্রায় ৬৫টি লেখা সে সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। ভুক্তভোগী দাসদের নিজেদের জবানীতে লেখা এই গল্পগুলো গৃহযুদ্ধ পরবর্তী আমেরিকায় দাসপ্রথা বিলোপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। আমেরিকার গৃহযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পঞ্চান্নটির মতো দাসদের পূর্ণাঙ্গ আত্মকাহিনী প্রকাশিত হয়েছিল। সম্প্রতি নতুন আরো দুটি আত্মকাহিনী খুঁজে পাওয়া গিয়েছে যেগুলো ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে।
বেশ কয়েকজন প্রাক্তন দাস তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া ট্র্যাজেডি এবং দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়ার রোমাঞ্চকর কাহিনী লিখে তখন বিখ্যাত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে আমেরিকায় দাসপ্রথা বিলোপে তাদের অনেকে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং চিরস্থায়ীভাবে স্থান করে নিয়েছেন মার্কিন ইতিহাসে। এই লেখায় তুলে আনা হয়েছে সেরকম কিছু মানুষের গল্প।
ওলাউদা ইক্যুয়ানো
কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের একদম প্রথমদিককার আত্মকথনগুলোর মধ্যে ওলাউদা ইক্যুয়ানোর লেখা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দাস জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তার জীবন কাহিনী ‘The Interesting Narrative of the Life of O. Equiano, or G. Vassa, the African’ শিরোনোমে ১৭৮৯ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল।
ওলাউদা ইক্যুয়ানোর জন্ম ১৭৪৫ সালে নাইজেরিয়ায়। জাতিগতভাবে তিনি ছিলেন একজন ইগবো। মাত্র এগারো বছর বয়সে তাকে দাস হিসেবে বন্দী করা হয়। তারপর পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভার্জিনিয়ায়। সেখানে আসার পর ব্রিটিশ নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তা তাকে কিনেছিলেন। তিনি ইক্যুয়ানোকে লেখাপড়া শিখবার সুযোগ দিয়েছিলেন। তাকে গুস্তাব ভাসা নামটি সেই অফিসারই দিয়েছিলেন। একসময় ইক্যুয়ানোকে পুনরায় বিক্রি করা হয় একজন বণিকের কাছে। তিনি ছিলেন কোয়েকার। ইক্যুয়ানোকে তিনি ব্যবসার মাধ্যমে নিজের মুক্তি কেনার সুযোগ দিয়েছিলেন।
বুদ্ধিমান ইক্যুয়ানো সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পেরেছিলেন। উপার্জিত অর্থ সঞ্চয় করে কিনেছিলেন আজাদি। মুক্ত মানুষ হিসেবে তিনি লন্ডনে পাড়ি জমান ১৭৬৮ সালে এবং সেখানেই স্থায়ী হন। লন্ডনে তিনি দাসপ্রথাবিরোধী দলগুলোর সাথে সম্পৃক্ত হন এবং দাসপ্রথা বিলোপের লক্ষ্যে কাজ করতে থাকেন। ১৭৯২ সালে সুসানা কালেন নামে স্থানীয় এক মহিলাকে তিনি বিয়ে করেন। এই দম্পতির দুটি কন্যা সন্তান ছিল। ১৭৯৬ সালে সুসানা মারা যান। এর মাত্র এক বছর পর ১৭৯৭ সালের ৩১ মার্চ ইক্যুয়ানোও মৃত্যুবরণ করেন।
ইক্যুয়ানো তার আত্মজীবনীর প্রথম অধ্যায়ে পশ্চিম আফ্রিকায় কাটানো শৈশবের মুক্ত জীবনের সাবলীল বর্ণনা দিয়েছেন। দ্বিতীয় অধ্যায়ে একজন ভুক্তভোগীর দৃষ্টিকোণ থেকে লিখেছেন দাস হিসেবে বন্দী হওয়ার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা; লিখেছেন কীভাবে তিনি ও তার বোন দাস ব্যবসায়ীদের হাতে ধরা পড়েছিলেন। বোনের সাথে তার শেষ বিদায়ের আবেগঘন মুহূর্তটির বর্ণনা যেকোনো পাঠককে করে তুলতে পারে অশ্রুসিক্ত।
ইক্যুয়ানো তার আত্মজীবনীতে দাস ব্যবসার বিরুদ্ধে যেসব যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন সেগুলো ১৮০৭ সালে ব্রিটেনে দাসপ্রথা বিলুপ্তির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এখানে একটি ব্যাপার উল্লেখ্য, ইক্যুয়ানোর মৃত্যুর পরও বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত আমেরিকায় দাসপ্রথা জারি ছিল। তার জীবদ্দশায় আমেরিকায় দাসপ্রথা বিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠেনি। ফলে ১৮৩০ পরবর্তী দাসপ্রথা বিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল পরোক্ষ। তবে মার্কিন দাসপ্রথা বিলোপ আন্দোলনের সময় যে মানুষটির দাস জীবনের আত্মকথা সর্বপ্রথম বিখ্যাত হয়েছিল তার নাম ফ্রেডরিখ ডগলাস।
ফ্রেডরিখ ডগলাস
আমেরিকার দাসপ্রথা বিলোপের ইতিহাস ফ্রেডরিখ ডগলাস একটি অবিস্মরণীয় নাম। তিনি ছিলেন একাধারে একজন সমাজ সংস্কারক, লেখক, রাজনীতিবিদ এবং বক্তা। ১৮১৮ সালে মেরিল্যান্ডে জন্ম নেওয়া ডগলাস প্রথম জীবনে ছিলেন একজন দাস। তার মা ছিলেন সাদা-কালো মিশ্র জাতের কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। ডগলাস সম্পর্কে ঐতিহাসিক ডেভিড ডাব্লিউ ব্লাইট লিখেছেন, মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, তার বাবা শ্বেতাঙ্গ ছিলেন।
সে যা-ই হোক, পূর্বে কয়েকবার পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেও ১৮৩৮ সালে ডগলাস সাফল্যের সাথে পালাতে সক্ষম হন। ১৮৪০ এর দশকের শুরুতে ডগলাস ম্যাসাচুসেটস এন্টি স্লেভারি সোসাইটিতে যোগ দেন এবং দাসপ্রথার উপর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নিয়মিত বক্তব্য দিতে থাকেন। তবে ডগলাসকে খ্যাতি এনে দেয় তার আত্মকথা। অনেক তখন ভেবেছিল ডগলাস হয়তো তার দাস জীবনের দুর্দশার গল্প খানিকটা রং চড়িয়ে বলছেন। ধারণা করা হয়, ডগলাসের আত্নজীবনী লেখার অন্যতম কারণ ছিলো সমালোচকদের এই দাবিকে মিথ্যা প্রমাণ করা। ১৮৪৫ সালে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ডগলাসের আত্মকথা The Narrative of the Life of Frederick Douglass, an American Slave।
বলা বাহুল্য, এটি ডগলাসের লেখা সবচেয়ে বিখ্যাত এবং খুব সম্ভবত সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী রচনা। বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন প্রথিতযশা দাসপ্রথাবিরোধী নেতা লয়েড গ্যারিসন এবং ওয়েনডেল ফিলিপস। লয়েড গ্যারিসন ছিলেন নিউইয়র্কের বিখ্যাত এন্টি স্লেভারি সোসাইটি অফ আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা। ১৮৩৫ সালের বহুল আলোচিত প্যামফ্লেট ক্যাম্পেইন এই সংগঠনটির মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছিল। তাৎক্ষণিকভাবে বইটি জনপ্রিয় হলো। গোটা আমেরিকায় প্রচারিত হলো এর ১১ হাজার কপি। বইটি অনুদিত হলো ডাচ ও ফরাসি ভাষায়। ইউরোপেও প্রকাশিত হলো বইটি।
ডগলাসের খ্যাতি হু-হু করে বাড়তে লাগল। তবে খ্যাতির পাশাপাশি তাকে এর বিড়ম্বনাও পোহাতে হলো। রাতারাতি তারকা বনে যাওয়ায় ডগলাসের উপর অযাচিত কিছু বিপদ জুড়ে বসার আশঙ্কা দেখা দিল। শুভাকাংখীরা ভয় পাচ্ছিলেন, পরিচয় জানাজানি হয়ে যাওয়ায় ডগলাসের প্রাক্তন মালিক হয়তো তাকে ফেরত নেবার ব্যবস্থা করতে পারেন। তখনকার পরিস্থিতি বিচার করলে তাদের এই শঙ্কা অমূলক ছিল না। আমেরিকার আইনে দাসপ্রথা তখনো স্বীকৃত ছিল। ফলে আইনের চোখে ডগলাস একজন কৃতদাস ছিলেন।
১৮৪৫ সালে তাকে ব্রিটেনে পাঠানো হলো। ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ড সফরে ডগলাস সেখানকার বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচিত হন। তাকে বিভিন্ন চার্চ এবং চ্যাপেলে বক্তব্য দানের সুযোগ দেওয়া হয়। ব্রিটেনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ডগলাস বলেছিলেন, এখানে আমাকে মূল্যায়ন করা হয়েছে একজন মানুষ হিসেবে, আমার গাত্রবর্ণ দেখে নয়। এদিকে ব্রিটেনে ডগলাসের মুক্তির জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হলো এবং ডগলাসের প্রাক্তন মালিক থমাস উল্ডকে সেই অর্থ প্রদান করায় আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি দাসত্ব থেকে মুক্তি পেলেন। ১৮৪৭ সালে তিনি আমেরিকায় ফিরে আসেন। পরবর্তী দশকে তার আত্মজীবনীর হালনাগাদ সংস্করণ My Bondage And My Freedom শিরোনামে প্রকাশিত হয় এবং ১৮৮১ সালে তার আত্মজীবনীর সর্বশেষ সংস্করণ The Life and Times of Frederick Douglass শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
সজোনার ট্রুথ
আমেরিকার দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলনে সজোনার ট্রুথ উজ্জ্বলতম নামগুলোর একটি। ১৭৯৭ সালে নিউ ইয়র্কে দাস হিসেবে জন্ম নেওয়া সজোনার ট্রুথের প্রকৃত নাম ইসাবেলা বাউমফ্রি। নিউইয়র্কে ১৭৯৯ সালে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলেও সে সময় যারা দাস হিসেবে নিযুক্ত ছিল, তাদের মুক্তির সীমারেখা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ১৮২৭ সালের ৪ জুলাই। এই আইনের কারণে সজোনারকে মুক্তির অপেক্ষা করতে হলো দুই দশক। সজোনারের মালিক তাকে নির্ধারিত সময়ের এক বছর আগেই মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তার কথা রাখেননি। ক্ষুব্ধ সজোনার ১৮২৬ সালে তার শিশু কন্যাকে নিয়ে পালিয়ে যান। অনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তি পর্যন্ত, অর্থাৎ ১৮২৭ সালের ৪ জুলাই পর্যন্ত তিনি নিউপ্যালটজে ছিলেন।
১৯২৮ সালে দাসত্ব থেকে মুক্তির পর তিনি জানতে পারলেন, প্রাক্তন মালিক তার শিশুপুত্রকে আলাবামায় দাস হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছ। ক্রুদ্ধ সজোনার কোর্টের শরণাপন্ন হলেন। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মামলার রায় তাঁর পক্ষে এলো। আমেরিকার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন সাদা পুরুষের বিরুদ্ধে একজন কালো মহিলার আইনী বিজয় অর্জিত হলো। সজোনার খ্রিস্টধর্মের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। ইসাবেলা বাউমফ্রি থেকে সজোনার ট্রুথ হওয়ার পেছনে সেই অনুরাগ কাজ করেছিল। পরবর্তীতে তিনি ফ্রেডরিখ ডগলাস ও লয়েড গ্যারিসনদের সাথে দাসপ্রথা বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। ১৮৫০ সালে প্রকাশিত হয় তার আত্মকথা The Narrative of Sojourner Truth: A Northern Slave। তার বন্ধু অলিভ গিলবার্ট তার নির্দেশনায় বইটি লিখেছিলেন। লয়েড গ্যারিসন তা প্রকাশের ব্যবস্থা করে দেন। সজোনার ছিলেন একদম শুরুর দিকের একজন নারী অধিকারকর্মী। ৮৬ বছর বয়সে ১৮৮৩ সালে তার সংগ্রামী জীবনের অবসান ঘটে। স্মিথসোনিয়ান জার্নাল ২০১৪ সালে তাকে সর্বকালের সেরা ১০০ জন আমেরিকানের অন্তর্ভূক্ত করেছে।
হ্যারিয়েট অ্যান জ্যাকবস
হ্যারিয়েট জ্যাকবসের জন্ম নর্থ ক্যারোনিলায়, ১৮১৩ সালে। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন একজন দাসী। ছোটবেলায় মালিকের কাছে লিখতে পড়তে শিখেছিলেন। তবে ভদ্রমহিলার মৃত্যুর পর হ্যারিয়েট জ্যাকবসের মালিকানা স্থানান্তরিত হয় তার আত্মীয়দের কাছে। কিশোরী হ্যারিয়েটের উপর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে নতুন মালিকের। তিনি যৌন নিপীড়নের শিকার হন। নেমে আসে নির্যাতন। নির্যাতনের মাত্রা ক্রমশ বেড়েই চলছিল। শেষপর্যন্ত তার পক্ষে সয়ে যাওয়া আর সম্ভব হলো না।
১৮৩৫ সালে তিনি নর্থ ক্যারোলিনা থেকে পালানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু বিধি বাম। পালাতে গিয়ে আহত হন হ্যারিয়েট। ফলে বেশি দূর পালিয়ে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এদিকে হ্যারিয়েটের নানীকে তার মালিক কয়েক বছর আগে মুক্ত করে দিয়েছিল। তিনি আশ্রয় নিলেন নিজের নানীর কাছে এবং ধরা পড়ার ভয়ে, অবিশ্বাস্যভাবে সাতটি বছর ঘরের এককোনায় আত্নগোপনে ছিলেন। উপরন্তু তার স্বাস্থ্যের অবস্থা তেমন ভালো যাচ্ছিল না। তাকে উত্তরের দাসপ্রথামুক্ত রাজ্যগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য তার পরিবার চেষ্টা চালাতে থাকে। অবশেষে ১৮৪২ সালে একজন জাহাজের ক্যাপ্টেন তাকে উত্তরে নিয়ে যেতে রাজি হন। বছর তিনেক পর ১৮৪৫ সালে হ্যারিয়েট চলে আসেন নিউ ইয়র্কে। সেখান তিনি গৃহ পরিচারিকার কাজ নেন। কিন্তু তখনও তার মাথার উপর থেকে বিপদের মেঘ পুরোপুরি কেটে যায়নি। ফের ধরা পড়ার ভয় ছিল। ফলে তিনি ম্যাসাচুসেটসে চলে যান এবং লিখতে শুরু করেন আত্মজীবনী। ১৮৬২ সালে লিন্ডা ব্রেন্ট ছদ্মনামে প্রকাশ করেন তাঁর আত্মকথা Incidents in the Live of a Slave Girl
তাৎক্ষণিকভাবে বইটি যথেষ্ট সাড়া ফেলেছিল। তবে মার্কিন গৃহযুদ্ধের ডামাডোলে রচনাটি অনেকটা চাপা পড়ে যায়। বইটিকে ঠিক আত্মজীবনী না বলে হ্যারিয়েটের নিজের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হওয়া গল্প বলা চলে। বইটি প্রকাশের পরও তার ধরা পড়ার আশংকা ছিল। তাই নিজের পরিচয় গোপন রাখতে হয়েছে, গোপন রাখতে হয়েছে আশেপাশের মানুষগুলোর পরিচয়। গল্পের প্রধান চরিত্র লিন্ডা ব্রেন্টের মাঝে তিনি নিজেকে চিত্রিত করেছিলেন। গল্পের কাহিনী সামনে এগিয়েছে হুবহু হ্যারিয়েটের নিজের জীবন কাহিনীর মতো। তবে বইটিতে তিনি যোগ করেছিলেন কাল্পনিক কিছু চরিত্র। ১৮৯৭ সালে হ্যারিয়েট মৃত্যুবরণ করেন।
উইলিয়াম ওয়েলস ব্রাউন
উইলিয়াম ওয়েলস ব্রাউনের জন্ম ১৮১৫ সালে কেন্টাকিতে। কৈশোরে বেশ কয়েকজন মালিকের হাতে তার মালিকানা স্থানান্তর হয়। উনিশ বছর বয়সে ব্রাউন, মালিকের সাথে ওহাইও স্টেটের সিনসিনাটি শহরে আসেন। ততদিনে ওহাইও স্টেটে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ব্রাউন বুঝতে পারলেন, এটাই তার মুক্তির একদম মোক্ষম সুযোগ। তিনি সিনসিনাটি থেকে পালিয়ে ডেটনে চলে আসলেন। সেখানে তিনি দাসপ্রথাবিরোধী একজন মানুষের সহায়তা পেলেন। তার মাধ্যমে ব্রাউনের থাকার বন্দোবস্ত হলো। ব্রাউন অবশেষে ম্যাসচুসেটস চলে গেলেন এবং নিজের দাসজীবনের দুঃসহ স্মৃতিকথা লিখলেন Narrative of William W. Brown, a Fugitive Slave বইতে। এটি বোস্টনের এন্টি স্লেভারি অফিস থেকে ১৮৪৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।
বইটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এবং এর চারটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়া বইটির ব্রিটিশ সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছিল। ব্রাউন বক্তব্য দেওয়ার জন্য ইংল্যান্ডে গেলেন। তিনি ইংল্যান্ডে থাকাকালীন ১৮৫০ পালিয়ে যাওয়া দাসদের পুনরায় ফিরিয়ে আনার জন্য Fugitive Slave Law পাস হলো। ফলে তিনি দেশে ফিরতে নিরাপদ বোধ করলেন না। দেশে ফিরলে ধরা পড়তে পারেন এই ভয়ে তিনি ইউরোপে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। পরবর্তী কয়েক বছর তিনি ইউরোপেই ছিলেন। লন্ডনে বসে তিনি রচনা করেন তার সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস Clotel; or the President’s Daughter।
উপন্যাসটি নিয়ে গত শতাব্দীর শেষ দিক যথেষ্ট পর্যালোচনা হয়েছে। এমনকি একবিংশ শতাব্দীতেও সেই আলোচনা থেমে নেই। ‘ক্লোটেল’ উপন্যাসটি একটি কাল্পনিক প্রেক্ষাপটে রচিত। উপন্যাসের মূল চরিত্র ক্লোটেল। ব্রাউন এই উপন্যাসে ক্লোটেলকে চিত্রিত করেছেন থমাস জেফারসনের কন্যা হিসেবে। জেফারসন-কন্যা হলেও ক্লোটেল একজন দাসী। কারণ তার মা কিউরার ছিলেন জেফারসনের অধীনে থাকা অর্ধ-স্বাধীন দাসী। বাস্তবে জেফারসনের সাথে স্যালি হেমিংস নামের এক অর্ধ-স্বাধীন দাসীর দীর্ঘদিনের শারীরিক সম্পর্ক ছিল। স্যালি হেমিংস ছিলেন মুলাট্টো। উপন্যাসের কিউরারের মাঝে স্যালি হেমিংসকে চিত্রায়িত করেছেন ব্রাউন। এই উপন্যাসে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের দুঃখ-কষ্টের পাশাপাশি সাদা-কালো মিশ্র জাতের মানুষদের দুর্দশার সর্বব্যাপীতা ফুটে উঠেছে।
দেশে ফেরার পর তাঁর দাসপ্রথাবিরোধী কর্মকান্ড অব্যাহত থাকে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় তিনি ফ্রেডরিখ ডগলসের সাথে কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্যদের ইউনিয়ন আর্মিতে যোগদান করার জন্য অনুপ্রাণিত করতে থাকেন। পরে তিনি চিকিৎসক হিসেবে মনোনিবেশ করেন। পড়ালেখার প্রতি তার ঝোঁক সারাজীবন ছিল।
ব্রাউনের লেখালেখি শুধু আত্মজীবনী রচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ছিলেন একাধারে বেশ কয়েকটি ভিন্নধর্মী ধারার পথিকৃৎ। তিনি ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন, লিখেছেন গল্প ও নাটক। ১৮৫৮ সালে প্রথম আফ্রো-আমেরিকান নাট্যকার হিসাবে তার নাটক প্রকাশিত হয়। মার্কিন গৃহযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ১৮৬৭ সালে তিনি আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে আফ্রো-আমেরিকানদের ভূমিকা নিয়ে সর্বপ্রথম ইতিহাস রচনা করেন।
সলোমন নর্থাপ
সবসময় যে দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়া মানুষই তাদের আত্নকথা লিখেছেন এমন নয়। মুক্ত মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়ার পরেও দাসত্বের শৃঙ্খল পরতে হয়েছে এমন মানুষের আত্মকাহিনীও রয়েছে।
সলোমন নর্থাপের জন্ম ১৮০৭ বা ১৮০৮ সালের দিকে নিউ ইয়র্কে। তার বাবা ছিলেন একজন মুক্ত দাস এবং মা সাদা-কালো মিশ্র জাতের মুক্ত মহিলা। নর্থাপের নিজের জমি ছিল। তিনি পেশায় ছিলেন একজন বেহালা বাদক। ১৮৪১ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে বেহালা বাদকের চাকরি পান। সেখানে তখন দাসপ্রথা আইনসিদ্ধ ছিল।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেখানে নর্থাপ অপহৃত হন। তাকে দাস ব্যবসায়ীরা বিক্রি করে দেয়। বারো বছর দাস হিসেবে বন্দী থাকার পর একদিন চলে আসে বহু কাঙ্ক্ষিত মুক্তির সুযোগ। এক সুহৃদয় কানাডিয়ানের সহযোগিতায় অবশেষে পালাতে সক্ষম হন নর্থাপ। ১৮৫৩ সালে ৩ জানুয়ারি মিললো তার মুক্তি। দীর্ঘ বারো বছর দাসত্বের দুঃসহ স্মৃতি বর্ণনা দিয়ে সে বছরই তিনি লেখেন 12 Years a Slave। ২০১৪ সালে হলিউডের সেরা ছবি হিসেবে অস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র 12 Years a Slave সলোমন নর্থাপের জীবন কাহিনীর উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছিল। নর্থাপ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে দাসপ্রথা অবসানের উপর বক্তব্য দিতে লাগলেন। তবে ১৮৫৭ সালের পর তার ব্যাপারে আর তেমন কিছু জানা যায় না।
বর্ণ ইন স্লেভারি: স্লেভ ন্যারেটিভস ফ্রম দ্য ফেডেরাল রাইটার প্রজেক্ট
দাস হিসেবে জীবনের কোনো না কোনো সময় অতিক্রম করেছেন এমন অনেক মানুষ গত শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। ১৯৩০ এর দশকের শেষের দিকে মার্কিন সরকার তাদের কাহিনীগুলো লিখিতভাবে সংরক্ষণ করে রাখার জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত চলা এই প্রজেক্টে ২,৩০০ মানুষের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়, যারা প্রত্যক্ষভাবে দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী ছিলেন। বর্ণনাকারীরা সবাই ছিলেন বয়োঃবৃদ্ধ এবং তারা প্রায় ৭০ বছর আগের স্মৃতিচারণ করেছেন। তোলা হয় ৫০০টিরও বেশি সাদাকালো ছবি। ১৯৪১ সালে ছবি ও সাক্ষাৎকারগুলোকে সংকলন করে Slave Narratives: A Folk History of Slavery in the United States from Interviews with Former Slaves শিরোনামে ১৭ খন্ডে প্রকাশ করা হয়। ২০০০ থেকে ২০০১ সালে সিটিগ্রুপ ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় সেগুলোকে ডিজিটালাইজড করা হয় এবং এর পাশাপাশি দু’শোর মতো অপ্রকাশিত ছবি জনসম্মুখে প্রকাশিত করা হয়, যা লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসের ওয়েবসাইটে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত।
কেন স্লেভ ন্যারেটিভ গুরুত্বপূর্ণ?
দাসপ্রথার ভয়াবহতা নিয়ে আজ পর্যন্ত অনেক জনপ্রিয় সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের জন্ম হয়েছে। কিন্তু বড়পর্দায় চিত্রিত সেসব কাহিনী কিংবা চমৎকার বর্ণনাশৈলীতে লেখা উপন্যাসগুলো মন ছুঁয়ে গেলেও দাসপ্রথার প্রকৃত চিত্র উপস্থাপনে ততটা সফল হতে পারেনি, যতটা সফল হয়েছে প্রাক্তন দাসদের স্বীয় জবানীতে বর্ণিত নিজেদের দুঃখদুর্দশার কাহিনী। কারণ শোনা কথার উপর ভিত্তি করে, তৃতীয় ব্যক্তির হাতে রচিত সাহিত্যে কিংবা কল্পনার আশ্রয়ে নির্মিত চাকচিক্যে ভরা চলচ্চিত্রে যখন আমরা কোনো মানবিক বিপর্যয়ের গল্প শুনি, আমাদের কাছে তা অনেক সময় অবিশ্বাস্য ঠেকে। অপরদিকে, যিনি নিজেই একসময় দাসপ্রথার নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছেন, তার দুর্বল লেখনীও পাঠককে যতটা শিহরিত করতে পারে, কাহিনীর সত্যতা সম্পর্কে যতটা আশ্বস্ত করতে পারে, একটি শক্তিশালী পরোক্ষ বর্ণনা ততটা পারে না। আর তাই স্লেভ ন্যারেটিভ আজও এত গুরুত্বপূর্ণ, এত আলোচিত এবং পর্যালোচিত।
আজ আমেরিকায় আর কোনো কৃষ্ণাঙ্গ দাস নেই। তাদের বংশধররা আজ মুক্ত মানুষ, তাদের অনেকে আজ আমেরিকার নীতি নির্ধারক। মার্কিন সমাজে দাসপ্রথার ক্ষত হয়ত শুকিয়ে গেছে, কিন্তু চিহ্ন হিসেবে আজও টিকে আছে দাসদের আত্মকথা; দিয়ে যাচ্ছে অনাগত ভবিষ্যতের জন্য সতর্কবার্তা, যাতে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেয় মানুষ।