Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভারতের ‘এসএলভি-থ্রি’ উৎক্ষেপণ, ইতিহাস রচিত হয়েছিল যে দিনটিতে

আগস্ট, ১৯৭৯; শ্রীহরিকোটা,ভারত। এ. পি. জে আব্দুল কালাম একইসাথে প্রচন্ড উৎকণ্ঠা ও অধীর আগ্রহ নিয়ে কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে আছেন। কন্ট্রোল রুমে তার সাথে আরো আছে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে বিশেষজ্ঞদের একটি দল। আর মাত্র আট মিনিটের মধ্যে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে ভারতের প্রথম স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল, ‘এসএলভি-থ্রি’। রকেটটি উৎক্ষেপণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে অটোমেটিক সিস্টেমের হাতে। কম্পিউটার শেষবারের মতো যাচাই করে নিচ্ছে কোথাও কোনো গন্ডগোল আছে কি না।

শুধু আব্দুল কালামই নন, এ প্রজেক্টের সাথে জড়িত হাজারো ইঞ্জিনিয়ার, কয়েক হাজার কর্মীরাও প্রহর গুনছেন; গত সাত বছর ধরে তাদের লাগাতার পরিশ্রমের ফসল আজ চূড়ান্ত পরীক্ষায় নেমেছে। এ প্রজেক্ট কি সফল হবে? ভারত কী পারবে পৃথবীর ষষ্ঠ দেশ হিসেবে নিজস্ব রকেট দিয়ে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে? শুভ সংবাদ শোনার প্রত্যাশায় কান পেতে আছে গোটা ভারতবাসী।

চার মিনিটের মাথায় কম্পিউটার থেকে সিগন্যাল আসলো, ‘ডোন্ট লঞ্চ’। মুহূর্তের জন্য যেন থমকে গেল সবকিছু। কন্ট্রোল রুমে সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। ততক্ষণে রকেট সিস্টেমের সবক’টি যন্ত্রাংশ সক্রিয় হয়ে গেছে। জ্বালানি, প্রোপ্যালান্ট, ইলেকট্রনিক সিস্টেম সহ সবগুলো অংশ জীবন্ত হয়ে উঠেছে মহাকাশে যাত্রার জন্য। এদিকে কম্পিউটারের বলছে, এখন উৎক্ষেপণ করা যাবে না।

এসএলভি-থ্রি; source: indiatimes.in

মুহূর্তের মধ্যে কম্পিউটার থেকে একটি প্রিন্ট-আউট বেরিয়ে এলো। তার ভাষ্যমতে, রকেট সিস্টেমের দ্বিতীয় স্টেজে ঝামেলা বেঁধেছে। সেখানের কন্ট্রোল সিস্টেমে একটি লিকেজ আছে। এ. পি. জে আব্দুল কালাম জবাবের প্রত্যাশায় ঘুরে তাকালেন বিশেষজ্ঞদের দিকে। এ সেক্টরে তাদের প্রত্যেকের অভিজ্ঞতাই বেশ সমৃদ্ধ। বিশেষজ্ঞরা জানালেন, দ্বিতীয় স্টেজে কোনো লিকেজ থাকলেও তা প্রশমিত করার মতো যথেষ্ট পরিমাণ অক্সিডাইজার মজুদ আছে রকেটে। চাইলে এখনো রকেটকে উৎক্ষেপণ করা সম্ভব।

মিশন ডিরেক্টর এ. পি. জে আব্দুল কালাম তাদের কথায় সম্মত হলেন। নিজ কাঁধে গোটা দায়ভার নিয়ে কম্পিউটারের অটোমেটিক সিস্টেমকে বন্ধ করে দিলেন। ম্যানুয়ালি রকেট লঞ্চ করা হলো। বিশেষজ্ঞদের মতামত কি সঠিক ছিল? শেষ পর্যন্ত এসএলভি-থ্রি’র ভাগ্যে কী ঘটেছিলো? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার আগে চলুন এ সম্পর্কে আরেকটু বিস্তারিত জেনে নিই।

বর্তমান দুনিয়ায় কোনো দেশের স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ তেমন আহামরি কোনো ঘটনা নয়। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দেশ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করছে, এমনকি বিভিন্ন কোম্পানিরও আছে নিজস্ব স্যাটেলাইট। কিন্তু যেটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা। এখন পর্যন্ত পুরো পৃথিবীতে মাত্র দশটি দেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা আছে। অন্য দেশগুলো এসকল দেশের সিস্টেম ব্যবহার করেই তাদের স্যাটেলাইট লঞ্চ করে। যেমন বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ লঞ্চ হওয়ার কথা আছে আমেরিকার ফ্লোরিডার একটি লঞ্চপ্যাড থেকে।

ভিক্রম সারাভাইয়ের সাথে আব্দুল কালাম; source: thequint.com

ভারত যখন নিজস্ব স্যাটেলাইট লঞ্চ সিস্টেম তৈরির প্রজেক্ট হাতে নেয়, তার আগে এ সক্ষমতা অর্জন করেছে মাত্র পাঁচটি দেশ। ভারতের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশকে মহাকাশ জয়ের এমন দুঃসাহসী স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলেন ডক্টর ভিক্রম সারাভাই। কেবল স্বপ্ন দেখিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি, এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিজ হাতে গড়ে তুলেছিলেন ডক্টর এ. পি. জে আব্দুল কালামের মতো অনন্য কয়েকজন ব্যক্তিকে। তার হাত ধরেই জন্ম নিয়েছিল ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানাইজেশন (ISRO)।

১৯৭২ সালে এসে ইসরো’র ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করেন প্রফেসর সতীশ ধাওয়ান। এ বছরেই তিনি ভারতের প্রথম স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল তৈরির প্রজেক্ট হাতে নেন। এ প্রজেক্ট পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় এ. পি. জে আব্দুল কালামকে। ভারতের সবগুলো প্রযুক্তি গবেষণাকেন্দ্র থেকে প্রয়োজনীয় লোকবল ও সুবিধাদি নেয়ার স্বাধীনতা দেয়া হয় তাকে। এ প্রজেক্ট সম্পন্ন করার সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয় সাত বছর।

ঠিক সাত বছর পরই এ. পি. জে আব্দুল কালামও তার টিম এসএলভি-থ্রি’র কাজ সম্পন্ন করেন। সতের টন ভর ও বাইশ মিটার দীর্ঘ এ রকেটটি নির্মাণ করা হয়েছিলো ‘বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টার’ এ। এটি চল্লিশ কেজির স্যাটেলাইট বহন করতে সক্ষম ছিল। চারটি স্টেজে তৈরি এ রকেটের ছিল চারশ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্ব অতিক্রম করার সক্ষমতা।

স্যাটেলাইটকে পৃথিবীর কক্ষপথে সফলভাবে স্থাপন করাই মূলত এ ধরনের রকেট তৈরির উদ্দেশ্য। আর এজন্য প্রয়োজনীয় বেগ প্রদান করা হয় এ চারটি স্টেজের মাধ্যমে। এ চারটি স্টেজকে বলতে চারটি রকেটকে একসাথে জুড়ে দেয়া বোঝানো হয়, যেগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে গিয়ে একে একে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এভাবে একাধিক রকেট ব্যবহারের বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে ভর কমানো।

মাল্টিস্টেজ রকেট; source: wasfun.weebly.com

রকেটের ভর যত কম রাখা যায় ততই ভালো। কারণ ভর  কম হলে, রকেটের চূড়ান্ত বেগ অর্জন সহজ হয়। এছাড়া রকেটের জ্বালানির এক বড় অংশ ব্যয় হয়ে যায় রকেটের প্রথমদিকের গতিবেগ তৈরি করতে। তাই অধিকাংশ জ্বালানি পৃথিবীর বায়ুমন্ডল পার হতে হতেই খরচ হয়ে যায়। এই বেশী পরিমান  জ্বালানি বহন বা প্রক্রিয়াকরণ করার জন্য বেশ ভারী যন্ত্রাদির দরকার হয়। এসব যন্ত্রাদিকে পুরোটা পথ বয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তাই একাধিক স্টেজের রকেট ব্যবহার করা হয়।

প্রথমে রকেট যখন যাত্রা শুরু করে তখন প্রথম স্টেজের রকেটের জ্বালানি খরচ হতে থাকে। এরপর একটি পর্যায় পেরিয়ে এর জ্বালানি প্রায় শেষ হয়ে যায়। ততক্ষণে রকেট একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ উচ্চতা ও গতিবেগ অর্জন করে ফেলে। এরপর প্রথম স্টেজ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এবার দ্বিতীয় স্টেজের জ্বালানি ব্যয় হতে শুরু করে। এভাবে একে একে তিনটি রকেট বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই তিনটি স্টেজ কক্ষপথে স্যাটেলাইট স্থাপনের প্রয়োজনীয় দিক, গতিবেগ ইত্যাদি প্রদান করে। সবশেষে চতুর্থ স্টেজের দেয়া গতিবেগের মাধ্যমে স্যাটেলাইটকে কক্ষপথে স্থাপন করা হয়। এসব জটিল হিসাব-নিকাশ আগেই করা হয়। সে অনুযায়ী প্রস্তত করা হয় রকেটকে।

এসএলভি-থ্রি রকেটটিও এভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিল। ম্যানুয়াল মুডে রকেটটি লঞ্চ করার পরবর্তী একশ সেকেন্ড প্রথম স্টেজের দায়িত্ব। প্রথম স্টেজের রকেট বেশ সফলভাবেই তার কাজ শেষ করল। কিন্তু সবাই তখন উৎকণ্ঠায় আছেন দ্বিতীয় স্টেজ নিয়ে; এখানেই ঝামেলা দেখা দিয়েছিল। প্রথম স্টেজ শেষ হবার পর এক সেকেন্ডও যায়নি পুরো রকেটটি শূন্যে পাক খেয়ে ঘুরে গেল। এর জন্য স্থির করা নির্দিষ্ট দিক হারিয়ে ফেলল রকেটটি। সবাই বুঝতে পেরেছিলেন, তারা রকেটটিকে হারিয়ে ফেলেছেন।

এসএলভি-থ্রি টিমের কয়েকজন; source: sreedhar-abdulkalams.blogspot.com_

স্যাটেলাইটকে কক্ষপথে স্থাপন করার বদলে গোটা রকেট সিস্টেমটি বঙ্গোপসাগরে ঠাঁই নিল। এটি একটি ব্যর্থ প্রজেক্ট ছিল। এ. পি. জে আব্দুল কালাম সহ সকল কর্মীরা মুষড়ে পড়ল তাদের এত পরিশ্রমের এই করুণ পরিণতি দেখে। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়। প্রেস কনফারেন্স তখনও বাকী। এটি জনগণের অর্থে করা প্রজেক্ট। জনগণের কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে। প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে এ দায় আব্দুল কালামের ঘাড়েই বর্তায়।

প্রফেসর সতীশ ধাওয়ান আব্দুল কালামকে সাথে নিয়ে প্রেস কনফারেন্সে গেলেন। শ’খানেক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক জড়ো হয়েছেন এর বিস্তারিত জানার জন্য। চারদিক থেকে নানা তির্যক প্রশ্ন ছুটে আসছে। একজন তো বলে বসলেন, “আপনারা কীভাবে পারলেন দেশের কোটি কোটি টাকা বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দিতে?”। এমন আরো অনেক প্রশ্ন। সাংবাদিকদের হাত থেকে আব্দুল কালামকে আড়াল করে রাখলেন প্রফেসর সতীশ ধাওয়ান। তিনি নিজেই প্রেসকে সামলালেন।

আব্দুল কালাম ও তার দলের ব্যর্থতাকে তিনি নিজের ব্যর্থতা হিসেবে নিয়ে নিলেন। সকল বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার ও কর্মীদের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা ঘোষণা করে জানালেন, “আমরা এবার হয়তো ব্যর্থ হয়েছি কিন্তু অচিরেই আমরা সফলতা অর্জন করব।” প্রফেসর সতীশ ধাওয়ান সেদিন এ ভূমিকা না নিলেও পারতেন। তিনি ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান, এ প্রজেক্টের দায়ভার আনায়াসেই তিনি আব্দুল কালামের দলের ওপর চাপিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু সতীশ ধাওয়ান তা করেননি।

ইন্ধিরা গান্ধীর সাথে সতীশ ধাওয়ান ও আব্দুল কালাম; source: scoopnest.com

তিনি তার কর্মকর্তাদের ওপর আস্থা রেখেছিলেন। সে আস্থার প্রতিদানও দিয়েছিলেন তারা। এ ঘটনার এক বছর পর ১৯৮০ সালের ১৮ জুলাই এসএলভি-থ্রি আবার লঞ্চের জন্য তৈরি হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সকল স্টেশনের সাউন্ডবক্সে ভেসে আসে এ. পি. জে আব্দুল কালামের কণ্ঠস্বর “হিয়ার ইজ ইওর মিশন ডাইরেক্টর। স্যাটেলাইট ইজ ইন দ্য অরবিট এন্ড উই কনগ্র্যাচুলেট ইউ।” সেবার এসএলভি-থ্রি’র প্রত্যেকটি স্টেজই সঠিকভাবে কাজ করে এবং রোহিনি স্যাটেলাইটকে স্থাপন করে পৃথিবীর কক্ষপথে। ষষ্ঠ দেশ হিসেবে নিজস্ব রকেট সিস্টেম দিয়ে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের গৌরব অর্জন করে ভারত।

গোটা ভারতের জন্য এটি একটি অসাধারণ অর্জন ছিল সন্দেহ নেই। তবে এর চেয়েও সুন্দরতম একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয় এর আধঘন্টা পর। প্রফেসর সতীশ ধাওয়ানের কল ভেসে আসে আব্দুল কালামের ফোনে। প্রফেসর ধাওয়ান বলেন, “যাও এবার তুমি প্রেস কনফারেন্স পরিচালনা করে আসো।” প্রফেসর সতীশ ধাওয়ান এবার এ. পি. জে আব্দুল কালামকে দেশবাসীর অভিনন্দন গ্রহণ করার সুযোগ করে দিলেন।

এটিকে সতীশ ধাওয়ানের নেতৃত্বের এক উজ্বল দৃষ্টান্তই বলতে হয়। ব্যর্থতার সময় গোটা দেশ যখন ক্ষিপ্ত তখন তিনি আড়াল করে রেখেছিলেন তার অধীনস্থকে। সাফল্যের পর সবাই যখন ফুলেল মালা নিয়ে বরণ করতে প্রস্তুত তিনি তখন সামনে এগিয়ে দিয়েছেন অভিনন্দনের আসল দাবিদারকে।

ফিচার ইমেজ: antrix.co.in

Related Articles