গত জুলাইয়ের ৯ তারিখ স্বাধীনতার এক দশক উদযাপন করে দক্ষিণ সুদানের নাগরিকরা। ২০১১ সালের ৯ জুলাই দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ইতি ঘটায় দুই সুদানের নেতৃবৃন্দ। অবিভক্ত সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির এবং জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুনের উপস্থিতিতে সংবিধানে সই করে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন দক্ষিণ সুদানের নেতা সালভা কীর। এর মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ স্বীকৃত ১৯৩তম দেশ হিসেবে স্বাধীনতা অর্জন করে তেলসমৃদ্ধ দক্ষিণ সুদান। যদিও সুদানের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দক্ষিণ সুদানীরা সংগ্রাম চালিয়েছে কয়েক দশক ধরে, যে সংগ্রামে প্রাণ হারিয়েছে ১৫ লক্ষের অধিক মানুষ।
স্বাধীনতা অর্জনের পর এখন অবধি দক্ষিণ সুদান পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠতম দেশ। কিন্তু সুদান থেকে আলাদা হওয়ার পরেও গত দশ বছরে ঠিক কতটুকু উন্নতি তারা করতে পেরেছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। দুর্নীতি, সীমান্ত বিরোধ, রাজনৈতিক কোন্দল, তেল নিয়ে বিরোধসহ নানারকম সমস্যায় জর্জরিত দেশটি জাতিসংঘের সূচকে অত্যন্ত দরিদ্র দেশসমূহের একটি। সুদান থেকে আলাদা হওয়ার ২ বছরের মাথায় আরো একবার গৃহযুদ্ধ সংগঠিত হয় দেশটিতে। সেখানেও প্রাণ হারায় লাখ লাখ মানুষ। এছাড়াও দেশটির ২০ লাখ নাগরিক বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বর্তমানে ৮ মিলিয়ন জনসংখ্যার দক্ষিণ সুদান নিজেদের অফুরন্ত খনিজ সম্পদ থাকা স্বত্ত্বেও বিভিন্ন দাতা সংস্থার সাহায্যের উপর নির্ভরশীল।
অথচ স্বাধীনতা অর্জনের এক দশকে দেশটি পুনর্গঠিত হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে, ১০ বছর আগে রাজধানী জুবায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে এমন প্রতিজ্ঞা করেন সালভা কীর। আফ্রিকান ইউনিয়ন, জাতিসংঘ এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সামনে তিনি সেদিন যেসব প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তার কোনোটারই বাস্তবায়ন হয়নি। গত জুলাইয়ে ইউনিসেফ জানায়, দক্ষিণ সুদানের প্রায় ৩ লক্ষ শিশু অনাহারে ভুগছে। মূলত, স্বাধীনতার এক দশকে দক্ষিণ সুদানের পারিপার্শ্বিক সংকট শীর্ষক ইউনিসেফের এক বিবৃতিতে এই ভয়ঙ্কর তথ্য বেরিয়ে আসে। আর তাই আলোচনা করা দরকার স্বাধীনতার ১০ বছরে দেশটির নাগরিক জীবনযাপন এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে।
তেল নিয়ে বিরোধ
হিসেব করলে দেখা যাবে, অবিভক্ত সুদানের ৭৫ শতাংশ খনিজ সম্পদ, বিশেষ করে তেলের অবস্থান, দক্ষিণ সুদানের ভূগর্ভে। এক জরিপে দেখা গেছে, দেশটির শতকরা ৯৮ শতাংশ রাজস্ব আসে তেল রপ্তানি করে। যদিও তেল উত্তোলন থেকে শুরু করে রপ্তানিতে অনেকটাই সুদানের উপর নির্ভর করে দেশটি। কারণ সুদানের রয়েছে বন্দর এবং তেলের দীর্ঘ পাইপলাইন। আর এই কারণেই দক্ষিণ সুদান রপ্তানির জন্য সুদানের উপর শতভাগ নির্ভরশীল। স্বাধীনতা অর্জনের পর সুদানের সঙ্গে মূলত তেল রপ্তানি নিয়েই প্রথম বিরোধ সৃষ্টি হয়।
২০১২ সালের জানুয়ারিতে হঠাৎ করেই তেল উত্তোলন বন্ধ করে দেয় দক্ষিণ সুদান। প্রেসিডেন্ট সালভা কীর অভিযোগ করেন সুদান কর্তৃপক্ষ পাইপলাইন থেকে তেল চুরি করছে। এমতাবস্থায় সুদান সরকারের নির্দেশে দেশটির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তেলের পাইপলাইন থেকে তেল জব্দ করে। বাজারমূল্য অনুযায়ী সুদান কর্তৃক জব্দকৃত তেলের বাজারমূল্য ছিল ৮১ কোটি ডলার। এদিকে, দক্ষিণ সুদান আফ্রিকান ইউনিয়নে সুদানের বিরুদ্ধে তেল চুরির অভিযোগ করে। অন্যদিকে, সুদান জানায় রপ্তানি প্রক্রিয়ার বিভিন্ন খাতে বকেয়া পরিশোধ করেনি দক্ষিণ সুদান। স্বাধীনতার ছয় মাসের মাথায় আবারও যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হতে থাকে দেশ দুটি।
একই সঙ্গে সীমান্ত বিরোধের বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপিত হয়। অন্যদিকে, আফ্রিকান ইউনিয়ন জাতিসংঘের মধ্যস্থতা কামনা করায় জাতিসংঘের টনক নড়ে। প্রাথমিকভাবে জাতিসংঘ উভয় দেশকে সুরাহা করতে ৩ মাসের সময় বেধে দেয়। ২০১২ সালের আগস্টেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় আফ্রিকান ইউনিয়ন সময়সীমা আরো ২ মাস বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। দুই দেশের মাঝে মধ্যস্থতা করতে রাজি হন দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট থাবো এমবেকি। তিনি দুই সুদানের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যান। ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় উভয় দেশ, জাতিসংঘ এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে দফায় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। একপর্যায়ে দেশ দুটি তেলের মূল্য নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছায়, যদিও বৈঠকে তারা মূল্য প্রকাশ করেনি। সে সময় সুদানের প্রতিনিধি মুতরিফ সিদ্দিক জানান, দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা ইস্যুর সুরাহা হলে তেল নিয়ে সমঝোতা বাস্তবায়ন শুরু হবে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা
স্বাধীনতার পক্ষে গণভোটে জয়ের পর মোটামুটি দেশের সকল জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠন করে দক্ষিণ সুদানের নেতারা। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণকারী সালভা কীর ছিলেন দিনকা সম্প্রদায়ের নেতা। দেশটির সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় রাজনীতিতে দিনকাদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নুয়ের সম্প্রদায়। যদিও মিলিশিয়ারাও দিনকাদের মোটামুটি প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিল। যা-ই হোক, স্বাধীনতা অর্জনের পর সালভা কীরের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরকারের বিভিন্ন পদে সম্মানের সঙ্গে নিয়োগ প্রদান করা। আর মূলত এই কারণেই তিনি নুয়ের সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় নেতা রিয়েক মাচারকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নেন।
নবগঠিত সরকারের প্রথম বছর কোন্দল তেমন বোঝা যায়নি দেশটিতে। সুদানের সঙ্গে তেল নিয়ে বিরোধের মধ্য দিয়েই পার হয় দক্ষিণ সুদানের প্রথম বছর। কিন্তু এরই মাঝে দিনকা নেতারা প্রভাবশালী হয়ে উঠতে থাকে। প্রেসিডেন্ট সালভা কীরের ছায়াতলে থেকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোর দখল নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে প্রেসিডেন্টের অনুসারীরা। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে প্রেসিডেন্ট এক নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে ভাইস প্রেসিডেন্ট রিয়েক মাচারকে বরখাস্ত করে পুরো মন্ত্রীসভা ভেঙে দেন। বলতে গেলে এমন একটি পরিস্থিতির জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না দক্ষিণ সুদানের সাধারণ জনগণ। রিয়েক মাচারের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্টকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনেন সালভা কীর। অথচ স্বাধীনতা সংগ্রামে দুজনেই দুটি সম্প্রদায়ের নেতা হিসেবে আন্দোলন সংগ্রামে দক্ষিণ সুদানীদের পক্ষে লড়াই করেছেন।
রিয়েক মাচার এবং পুরো মন্ত্রীসভা বরখাস্ত হওয়ার ৫ মাস পর সমগ্র দেশজুড়ে শুরু হয় ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। ২০১৫ সাল অবধি কয়েকবার যুদ্ধবিরতির সন্নিকটে গিয়েও মুখ ফিরিয়ে নেন সালভা কীর এবং মাচার। এদিকে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে মিলিশিয়া গোষ্ঠীও এরই মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যুদ্ধবিরতিতে তারাও অংশীদার হতে চেয়ে বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতা চালায়। ২০১৬ সালে রাজধানী জুবায় ব্যাপক সহিংসতা শুরু হলে একপ্রকার পায়ে হেঁটে দেশত্যাগ করেন রিয়েক মাচার। অতঃপর জাতিসংঘ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কড়া হুঁশিয়ারিতে ২০১৮ সালে সালভা কীর এবং রিয়েক মাচার দ্বিতীয়বারের মতো শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তিতে প্রধান দুই পক্ষ ছাড়াও মিলিশিয়া এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বলেছিল জাতিসংঘ। চুক্তির মধ্য দিয়ে একটি জোট সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন সালভা কীর এবং রিয়েক মাচার।
জাতিসংঘ এবং মার্কিন সরকার ২০১৯ সালের মে মাসের মধ্যে একটি একতাবদ্ধ সরকার গঠনের নির্দেশনা দিলেও ব্যর্থ হয় দক্ষিণ সুদানের নেতারা। কারণ আঞ্চলিক সীমানা, নিরাপত্তাসহ বেশ কিছু বিষয়ে একমত হতে পারেনি দু’পক্ষ। অতঃপর নভেম্বর মাসের মধ্যে ঐক্যমতে পৌঁছানোর নির্দেশনা থাকলেও আবারও ব্যর্থ হন সালভা কীর এবং রিয়েক মাচার। ফলশ্রুতিতে, ওয়াশিংটন নিজেদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নেয় এবং দ্বন্দ্ব দীর্ঘায়িত করতে যারা চেষ্টা করছে তাদের উপর বিভিন্ন মেয়াদে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আনুষ্ঠানিকভাবে জোট সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে গৃহযুদ্ধের পরিধি কমিয়ে আনা গেলেও দুর্গম অঞ্চলে সহিংসতা বন্ধ করতে পারেনি তারা। সরকারের প্রধান দুটি পদে থেকেও নিজেদের মধ্যে বিরোধিতা চালিয়ে যান সালভা কীর এবং রিয়েক মাচার। অভিযোগ ওঠে, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের প্রধান বিষয়গুলো এড়িয়ে চলছেন সালভা কীর। অন্যদিকে, রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের নিজ দলে ভেড়াতে থাকেন মাচার। নিজেদের মধ্যে চলা এই ক্ষমতার লড়াইয়ের মাঝে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশটিকে দফায় দফায় সতর্ক করে আসছিল। কারণ জোট সরকারের অধীনে থেকেও দেশটির সেনাবাহিনী ছিল বিভক্ত এবং দপ্তরসমূহ ভাগাভাগি করে পরিচালনা করছিল উভয়পক্ষ।
আঞ্চলিক বিরোধ
প্রতিবেশী দেশ সুদানের সঙ্গে বিরোধীতা এবং দুই জাতিগোষ্ঠীর মধ্যকার ক্ষমতা নিয়ে বিরোধ ছাড়াও দেশটিতে আঞ্চলিক বিরোধ সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল রাজ্য সংক্রান্ত বিরোধ। ২০১৯ সাল অবধি ৬,৪৪,৩২৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের দেশটি সর্বমোট ৩২টি ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বিভক্ত ছিল। অন্ততপক্ষে আফ্রিকার আঞ্চলিক রাজনীতি, সুদানের প্রভাব বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় নতুন জোট সরকার এবং বিভক্ত সেনাবাহিনীর পক্ষে পুরো দেশটি ৩২টি ভিন্ন ভিন্ন প্রশাসনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা কতটা কষ্টসাধ্য ছিল।
২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন প্রধান দুই জাতিগোষ্ঠীর নেতাদের জোট সরকার গঠনের জন্য চাপ দিচ্ছিল, প্রেসিডেন্ট সালভা কীর তখন ৩২টি অঙ্গরাজ্যকে ১০টি অঙ্গরাজ্যে সীমাবদ্ধ করার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। যদিও প্রথমদিকে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন রিয়েক মাচার এবং তার সমর্থকেরা। বিরোধিতার স্পষ্ট কারণও রয়েছে। ২০১১ সালে দক্ষিণ সুদান যখন স্বাধীনতা অর্জন করে তখন সংবিধান অনুসারে ১০টি অঙ্গরাজ্যে বিভক্ত ছিল দেশটি। অতঃপর গৃহযুদ্ধ চলাকালে ২০১৫ সালে ২৮টি এবং ২০১৭ সালে ৩২টি অঙ্গরাজ্যে দেশকে বিভক্ত করেন প্রেসিডেন্ট সালভা কীর।
জোট সরকার গঠনের চাপের মুখে আবারও পূর্বের অবস্থানে ফিরে গিয়ে ১০টি রাজ্য গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়ায় রিয়েক মাচার এবং তার দলবল নিন্দা জানায়। একই বছর নিন্দা জানিয়ে মাচার বলেন, রাজ্যসংখ্যা নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকলে তিনি জোট সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে ফিরবেন না। এতে সালভা কীরের উপর আন্তর্জাতিক চাপ আরো বাড়তে থাকে। দফায় দফায় আলোচনার পর রাজ্যসংখ্যা কমানোর প্রশ্নে মাচার সমর্থকেরা প্রেসিডেন্ট সালভা কীরের সঙ্গে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। যদিও তেল উত্তোলনের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য রুয়েং-এর ভবিষ্যৎ কী হবে সেই ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেন তারা।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে ১০টি রাজ্যের পাশাপাশি আরো ২টি প্রশাসনিক এলাকা গঠনের ঘোষণা দেয় নবগঠিত জোট সরকারের প্রেসিডেন্ট সালভা কীর। এছাড়াও আরো ১টি অঞ্চলকে বিশেষ প্রশাসনিক মর্যাদা দেয়া হয়। মূলত অ্যাবেই অঞ্চলটি সুদানের সীমান্তবর্তী হওয়ায় বিশেষ প্রশাসনিক মর্যাদা পায় এটি। অন্যদিকে, ২টি প্রশাসনিক অঞ্চলের মর্যাদা পায় রুয়েং এবং পিবর। কারণ সেখানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তেলের মজুদ রয়েছে। ২০২০ সালের জোট সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাজ্যগুলো একজন করে গভর্নর দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। অন্যদিকে, একজন করে নির্বাহী দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে প্রশাসনিক এলাকাগুলো।
সরকারের দুর্নীতিতে জনগণের ভোগান্তি
স্বাধীনতা অর্জনকারী সর্বকনিষ্ঠ দেশটির ভূখণ্ড তেল সমৃদ্ধ হলেও সেখানকার মানুষের কাছে তেল বিক্রির অর্থ একেবারেই পৌঁছায় না। ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকা দিনকা এবং নুয়ের জাতিগোষ্ঠীর নেতারা কখনও জনগণের কথা ভাবেনি। ২০২০ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন দক্ষিণ সুদান বিষয়ক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়,
“দেশটির সরকারি কর্মকর্তারা সরকারি তহবিল লুটপাটের পাশাপাশি ঘুষ, দুর্নীতি, অর্থ পাচার এবং কর ফাঁকির মতো জঘন্যতম কাজে লিপ্ত। সময়ের পরিক্রমায় দুর্নীতি এতটা লাভজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, প্রতিটি সেক্টর এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিটি সংস্থাকে জিম্মি করে রেখেছে।”
জাতিসংঘ মনে করে, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ায় জনগণের নিকট জবাবদিহিতার বিষয়টি একেবারে আড়ালে চলে গিয়েছে। ফলশ্রুতিতে, মানবাধিকার নিয়ে একেবারেই উদাসীন হয়ে উঠেছে দক্ষিণ সুদান। স্বাধীনতার এক দশকেও তেল উত্তোলন এবং রপ্তানিতে বৈদেশিক নির্ভরশীলতা কমাতে না পারায় দেশটির শিক্ষিত সমাজেও সরকার ব্যাপকভাবে সমালোচিত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সালভা কীর কিংবা রিয়েক মাচার কেউই চায় না তেল উত্তোলনে বৈদেশিক নির্ভরশীলতা কমুক। কারণ যতদিন এভাবে চলবে ততদিন তারা লুটপাট করতে পারবে।
স্বাধীনতার এক দশক পরেও দক্ষিণ সুদানের ৮ মিলিয়ন মানুষ বিভিন্ন দাতা সংস্থার উপর নির্ভরশীল জীবনযাপন করছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। এছাড়াও চলতি বছরের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ছোটখাট সংঘাতের কারণে প্রায় ৩০,০০০ মানুষ দুর্ভিক্ষপীড়িত। ২০১৮ সাল অবধি সালভা কীরের সরকার বাৎসরিক বাজেটের ২.১১ শতাংশ অর্থ স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করে আসছে যা পৃথিবীতে অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় একেবারে কম। যদিও বর্তমানে দক্ষিণ সুদানে কর্মরত বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থার কর্মকর্তারা সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে।
চলতি বছরের জুন মাসে দক্ষিণ সুদানে নিযুক্ত জাতিসংঘের নতুন নির্বাহী কর্মকর্তা নিকোলাস হেইসন নিরাপত্তা কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেন। বিভিন্ন সংস্থার হয়ে কাজ করা কর্মীদের প্রতিনিয়ত লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। শুধুমাত্র জুন মাস অবধি দেশটিতে ৪ জন মানবতাবাদী কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন এই কর্মকর্তা। এছাড়াও প্রতিনিয়ত কয়েক মিলিয়ন ডলার মূল্যের সহায়তা সামগ্রী লুটপাট হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন। সর্বশেষ তিনি, ২০২০ সালে সাক্ষরিত শান্তিচুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে দেশটির প্রধান দুই নেতার প্রতি আহ্বান জানান।
দক্ষিণ সুদানের ভবিষ্যৎ কী?
গত এক দশকে দক্ষিণ সুদানের মানুষজন স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে যেসব নাগরিক সুবিধা পাওয়ার কথা তার কিছুই পায়নি। বরঞ্চ নেতৃবৃন্দ প্রতিনিয়ত ক্ষমতা দীর্ঘায়ত করার লক্ষ্যে নিজেদের মধ্যে সহিংসতা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, ২০২০ সালের শান্তিচুক্তি এবং জোট সরকার গঠন শুধুমাত্র লোকদেখানো। মূলত জাতিসংঘ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ সামাল দিতেই এত তোড়জোড়। ঘুরেফিরে সালভা কীর ২০১১ সাল থেকেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। অন্যদিকে, রিয়েক মাচার এখন অবধি দেশটির প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত।
দেশটির বর্তমান জোট সরকার ২০২৩ সালে জাতীয় নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। উল্লেখ্য, ২০১১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর এখন অবধি কোনো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি সেখানে। বিষয়টি যতটা হতাশার ততটাই উদ্বেগের। ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনের আগে বর্তমান প্রেসিডেন্ট সালভা কীর এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট রিয়েক মাচারকে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মহল। সুদানের জনগণ কী চায় সেই বিষয়ে জানার সুযোগ একেবারেই কম। কারণ দুটি ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকায় নাগরিকদের সামাজিক জীবনযাপনকে একটি বলয়ের মধ্যে রেখেছে ক্ষমতাসীনরা। এখন দেখার বিষয় স্বাধীনতার এক দশকেও অপরিবর্তিত থাকা দক্ষিণ সুদানের নাগরিকদের ভাগ্য পরিবর্তন হয় কিনা। আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি এখন ২০২৩ সালের নির্বাচনের দিকে।