২৪ জুন, ১৯৭৮। রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, সানা, উত্তর ইয়েমেন। উত্তর ইয়েমেনের সামরিক রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল আহমাদ আল–ঘাশমির সঙ্গে দক্ষিণ ইয়েমেনের রাষ্ট্রপতি সালিম রুবাইয়া আলীর একজন বিশেষ দূত দেখা করতে এসেছেন। দক্ষিণ ইয়েমেনি দূতের হাতে একটি ব্রিফকেস, যেটিতে অত্যন্ত গোপনীয় রাষ্ট্রীয় কাগজপত্র রয়েছে বলে দূত উত্তর ইয়েমেনি রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তারক্ষীদের জানিয়েছিলেন। আল–ঘাশমি তার অফিসে দক্ষিণ ইয়েমেনি দূতের সঙ্গে করমর্দন করলেন, এরপর তাকে আসন গ্রহণের জন্য বললেন। উভয়ে আসন গ্রহণ করার পর দক্ষিণ ইয়েমেনি দূত তার ব্রিফকেসটি খুললেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে চারদিক কেঁপে উঠলো। উত্তর ইয়েমেনি রাষ্ট্রপতির দেহরক্ষীরা ছুটে এসে দেখতে পেল, আল–ঘাশমি এবং দক্ষিণ ইয়েমেনি দূত উভয়েরই ছিন্নবিচ্ছিন্ন মৃতদেহ পড়ে আছে অফিস কক্ষে। আল–ঘাশমি আন্দাজও করতে পারেননি যে, দক্ষিণ ইয়েমেনের রাজনীতিবিদরা নিজেদের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তাকে একটি গুটি হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
সে সময় দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছে; পাশাপাশি চীনও নিজেকে একটি স্বতন্ত্র শক্তিতে পরিণত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। স্নায়ুযুদ্ধের পুরো সময়টা জুড়ে উভয় পরাশক্তিই বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারের তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। এই প্রতিযোগিতার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল ষড়যন্ত্র, গুপ্তহত্যা, আগ্রাসন, অভ্যুত্থান, পাল্টা–অভ্যুত্থান আর নানা ধরনের কূটকৌশল। ১৯৫৩ সালে পূর্ব জার্মানিতে গণবিক্ষোভ দমন, ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত সৈন্য কর্তৃক ইমরে নেগির সরকারকে উৎখাত, ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত–নেতৃত্বাধীন ওয়ারশ জোট কর্তৃক আলেক্সান্দর দুবচেকের সরকারকে উৎখাত, কিংবা ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্য কর্তৃক হাফিজুল্লাহ আমিনের সরকারকে উৎখাত– এই ঘটনাগুলো স্নায়ুযুদ্ধের ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু অনুরূপ একটি সোভিয়েত সামরিক হস্তক্ষেপ প্রায় দৃষ্টির অন্তরালে থেকে গেছে। সেটি হলো ১৯৭৮ সালে দক্ষিণ ইয়েমেনে সোভিয়েত ও কিউবান সৈন্য কর্তৃক সালিম রুবাইয়া আলীর সরকারকে উৎখাত।
১৯৯০ সালের পূর্বে বর্তমান ইয়েমেন একক রাষ্ট্র ছিল না, বরং পরস্পরের প্রতি প্রায়শ শত্রুভাবাপন্ন দুইটি রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। এগুলোর মধ্যে একটি ছিল ‘ইয়েমেন আরব প্রজাতন্ত্র’, যেটির রাজধানী ছিল সানা শহরে এবং যেটি পরিচিত ছিল ‘উত্তর ইয়েমেন’ নামে। অপরটি ছিল ‘জনগণতান্ত্রিক ইয়েমেন প্রজাতন্ত্র’, যেটির রাজধানী ছিল এডেন শহরে এবং যেটি পরিচিত ছিল ‘দক্ষিণ ইয়েমেন’ নামে। দক্ষিণ ইয়েমেন ১৮৩০–এর দশকের শেষভাগ থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। ১৯৬৩ সালে দক্ষিণ ইয়েমেনে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয় (যেটিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরোক্ষ সমর্থন ছিল) এবং ১৯৬৭ সালে অঞ্চলটি ‘গণপ্রজাতন্ত্রী ইয়েমেন’ নামে স্বাধীনতা অর্জন করে।
দক্ষিণ ইয়েমেনের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদানকারী দল ‘জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট’ (National Liberation Front, ‘NLF’) স্বাধীনতা লাভের পর রাষ্ট্রটির শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৯ সালে দলটি দক্ষিণ ইয়েমেনকে একটি মার্ক্সবাদী–লেনিনবাদী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে এবং ১৯৭০ সালে রাষ্ট্রটির নাম পরিবর্তন করে ‘জনগণতান্ত্রিক ইয়েমেন প্রজাতন্ত্র’ (People’s Democratic Republic of Yemen, ‘PDRY’) নামকরণ করে। আরব বিশ্বে দক্ষিণ ইয়েমেন ছিল প্রথম ও একমাত্র কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। স্বভাবতই দক্ষিণ ইয়েমেনের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
দক্ষিণ ইয়েমেন ছিল অত্যন্ত দরিদ্র একটি রাষ্ট্র এবং এতে কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল না বললেই চলে। ১৯৭০–এর দশকের শেষদিকে রাষ্ট্রটির জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২০ লক্ষ। তদুপরি, দক্ষিণ ইয়েমেনের সঙ্গে প্রতিবেশী বা নিকটবর্তী রাষ্ট্রগুলোর (যেমন: উত্তর ইয়েমেন, সৌদি আরব বা ওমান) সম্পর্ক মোটেই ভালো ছিল না। কারণ একদিকে যেমন দক্ষিণ ইয়েমেন এই রাষ্ট্রগুলোর বিভিন্ন বামপন্থী দলকে সমর্থন করতো, অন্যদিকে তেমনই এই রাষ্ট্রগুলোও কমিউনিস্ট দক্ষিণ ইয়েমেনকে সহ্য করতে পারত না।
কিন্তু দক্ষিণ ইয়েমেনের ভূকৌশলগত অবস্থান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরব বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ রাষ্ট্র সৌদি আরবের সঙ্গে দক্ষিণ ইয়েমেনের সীমান্ত ছিল এবং রাষ্ট্রটি দক্ষিণ লোহিত সাগরের প্রবেশমুখে অবস্থিত ছিল, যেটি ভারত মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যে অবস্থিত। দক্ষিণ ইয়েমেনের নিকটেই অবস্থিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাব-এল-মান্দেব প্রণালী, যার মধ্য দিয়ে পশ্চিম ইউরোপের জ্বালানির চাহিদার ৪০% যাতায়াত করে। তদুপরি, এডেনের প্রাকৃতিক গভীর সমুদ্রবন্দর ছিল আরেকটি ভূরাজনৈতিক পুরস্কার।
এমতাবস্থায় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সোভিয়েত বলয়ভুক্ত অন্যান্য রাষ্ট্র (বিশেষত কিউবা ও পূর্ব জার্মানি) দক্ষিণ ইয়েমেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। দক্ষিণ ইয়েমেনের সামরিক বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রের প্রায় পুরোটাই সোভিয়েত বলয়ভুক্ত রাষ্ট্রগুলো থেকে আসতো। রাষ্ট্রটিতে সোভিয়েত প্রভাব ছিল অত্যন্ত বিস্তৃত। প্রায় ১,০০০ সোভিয়েত সৈন্য রাষ্ট্রটিতে মোতায়েনকৃত ছিল এবং আরো প্রায় ৮০০ থেকে ১,০০০ সোভিয়েত সামরিক উপদেষ্টা দক্ষিণ ইয়েমেনি সশস্ত্রবাহিনীতে কর্মরত ছিল। এডেন ছিল সোভিয়েত নৌবাহিনীর ভারত মহাসাগরীয় নৌবহরের রসদপত্র সরবরাহ কেন্দ্র এবং সোকোত্রা দ্বীপেও একটি সোভিয়েত নৌঘাঁটি ছিল। এমনকি দক্ষিণ ইয়েমেনের সমুদ্র উপকূলে যে মাছ ধরার ট্রলারগুলো ছিল সেগুলোতেও সোভিয়েত কর্মকর্তাদের উপস্থিতি ছিল।
কেবল সোভিয়েত ইউনিয়নই নয়, সোভিয়েত বলয়ভুক্ত কিউবা ও পূর্ব জার্মানিও দক্ষিণ ইয়েমেনে বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল। দক্ষিণ ইয়েমেনে প্রায় ৬০০ কিউবান সামরিক উপদেষ্টা কর্মরত ছিল এবং তারা দক্ষিণ ইয়েমেনি সশস্ত্রবাহিনীকে (বিশেষত নৌ ও বিমানবাহিনী) প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি ‘গণ মিলিশিয়া’ (People’s Militia) নামক একটি আধা–সামরিক বাহিনীও গড়ে তুলেছিল। কিউবান তত্ত্বাবধানে সৃষ্ট এই বাহিনীটির সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ২০,০০০ (দক্ষিণ ইয়েমেনি সশস্ত্রবাহিনীর প্রায় সমান) এবং প্রশিক্ষণ ও সামরিক সরঞ্জামের দিক থেকে বাহিনীটি দক্ষিণ ইয়েমেনি সশস্ত্রবাহিনীর চেয়ে অগ্রসর ছিল। একই সময়ে দক্ষিণ ইয়েমেনে ১০০ জনেরও বেশি পূর্ব জার্মান নিরাপত্তা উপদেষ্টা কর্মরত ছিল এবং তাদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে দক্ষিণ ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা ‘তানজিম’ গড়ে উঠেছিল।
১৯৬৯ সালের ২২ জুন থেকে এনএলএফ নেতা সালিম রুবাইয়া আলী ছিলেন দক্ষিণ ইয়েমেনের রাষ্ট্রপতি পরিষদের সভাপতি, অর্থাৎ রাষ্ট্রপ্রধান। অন্যদিকে, এনএলএফ–এর মহাসচিব এবং দক্ষিণ ইয়েমেনি আইনসভা সুপ্রিম পিপলস কাউন্সিলের প্রেসিডিয়ামের সভাপতি ছিলেন আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাইল। আলী এবং ইসমাইল উভয়েই ছিলেন বামপন্থী ও মার্ক্সবাদী, কিন্তু তাদের মধ্যে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক মোটেই ভালো ছিল না। রুবাইয়া আলী ছিলেন অনেকটা পিকিংপন্থী এবং পার্শ্ববর্তী রক্ষণশীল রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তিনি সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে, ইসমাইল ছিলেন কট্টর মস্কোপন্থী এবং পার্শ্ববর্তী রক্ষণশীল রাষ্ট্রগুলোতে বামপন্থী সংগঠনগুলোকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করতেন। তদুপরি, দক্ষিণ ইয়েমেনের শাসনক্ষমতা নিয়েও তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল।
কিন্তু সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ ইয়েমেন সোভিয়েত বলয়েই ছিল, এজন্য প্রাথমিকভাবে মস্কো রুবাইয়া আলীকে সহ্য করে। কিন্তু ক্রমেই ক্রেমলিনের অধিকর্তারা তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে থাকে। কারণ আলী ক্রমশ দক্ষিণ ইয়েমেনকে সোভিয়েত বলয় থেকে দূরে সরিয়ে একটি অধিকতর নিরপেক্ষ অবস্থানে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করেন। একই বছরে মুসলিম–অধ্যুষিত সোমালিয়া ইথিওপিয়ার সোমালি–অধ্যুষিত ওগাদেন অঞ্চল আক্রমণ করে। ইথিওপিয়ার অধীনস্থ ইরিত্রিয়ায় ইতোমধ্যেই স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ চলছিল। এই দ্বন্দ্বে অধিকাংশ আরব রাষ্ট্র সোমালিয়া ও ইরিত্রিয়ার পক্ষে ছিল এবং এজন্য রুবাইয়া আলী এই যুদ্ধে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সোভিয়েত বলয়ভুক্ত রাষ্ট্রগুলো সোমালি–ইথিওপীয় যুদ্ধে ইথিওপিয়ার পক্ষ অবলম্বন করে এবং ১২,০০০ থেকে ২৪,০০০ কিউবান সৈন্য ও ১,৫০০ সোভিয়েত সামরিক উপদেষ্টা এই যুদ্ধে সরাসরি ইথিওপিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করে। ইথিওপিয়ায় যুদ্ধরত কিউবান ও সোভিয়েতদের রসদপত্র সরবরাহের জন্য মস্কো এডেনকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি প্রার্থনা করে এবং ইথিওপিয়ার পক্ষে যোগদানের জন্য দক্ষিণ ইয়েমেনকে আহ্বান জানায়। রুবাইয়া আলী এর কোনোটাতেই আগ্রহী ছিলেন না, কিন্তু দক্ষিণ ইয়েমেনি সরকারের মস্কোপন্থীদের চাপে তিনি উভয় ক্ষেত্রেই হার স্বীকার করতে বাধ্য হন। দক্ষিণ ইয়েমেন সোমালি–ইথিওপীয় যুদ্ধে ইথিওপিয়ার পক্ষে এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য প্রেরণ করে এবং প্রায় ১০০ দক্ষিণ ইয়েমেনি সৈন্য এই যুদ্ধে প্রাণ হারায়।
রুবাইয়া আলীর ক্রমশ সোভিয়েতবিরোধী কার্যকলাপে মস্কো উদ্বিগ্ন হয়। ১৯৭৩ সালে মিসর এবং ১৯৭৭ সালে সোমালিয়া সোভিয়েত বলয় ত্যাগ করে মার্কিন বলয়ে যোগদান করেছিল এবং দক্ষিণ ইয়েমেনেও অনুরূপ ঘটনা ঘটতে পারে বলে মস্কো আশঙ্কা করছিল। সোমালিয়ায় সোভিয়েত নৌঘাঁটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ভারত মহাসাগরে সোভিয়েত নৌশক্তি বজায় রাখার জন্য দক্ষিণ ইয়েমেন মস্কোর জন্য আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এ সময় ভারত মহাসাগরে মার্কিন উপস্থিতি বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং সেটির মোকাবেলা করার জন্য ঐ অঞ্চলে সোভিয়েত উপস্থিতি বৃদ্ধি করার ছিল মস্কোর জন্য জরুরি। তদুপরি, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পূর্ব ইউরোপীয় মিত্র রাষ্ট্রগুলোর জ্বালানি তেলের চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং জ্বালানি তেলের সরবরাহ নিশ্চিত রাখতে মস্কো সামগ্রিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের উপস্থিতি বর্ধিত করতে আগ্রহী ছিল। এই পরিস্থিতিতে দক্ষিণ ইয়েমেনকে তারা কোনোক্রমেই নিজেদের বলয়ের বাইরে যেতে দিতে রাজি ছিল না।
এ সময় দক্ষিণ ইয়েমেনের অভ্যন্তরে রুবাইয়া আলী ও ইসমাইলের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আরো তীব্র হয়। স্বাভাবিকভাবেই মস্কো এই দ্বন্দ্ব ইসমাইলকে সমর্থন দিচ্ছিল। দক্ষিণ ইয়েমেনি সেনাবাহিনীর অধিকাংশ ইউনিট রুবাইয়া আলীর পক্ষে ছিল এবং ১৯৭৮ সালের মে মাসে আলী প্রায় ১৫০ জন ইসমাইলপন্থী সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল ইসমাইলের ক্ষমতাকে ধ্বংস করে দেয়া। একই বছরের জুন মাসে রুবাইয়া আলী মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং দক্ষিণ ইয়েমেনকে সোভিয়েত বলয় থেকে বের করে আনার সম্ভাবনায় ওয়াশিংটন প্রস্তাবটি লুফে নেয়। ২৪ জুন আলী উত্তর ইয়েমেনের রাষ্ট্রপতি আহমাদ আল–ঘাশমির কাছে একজন বিশেষ দূত প্রেরণ করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল ইসমাইলের ক্ষমতা ধ্বংস করার জন্য উত্তর ইয়েমেনের সঙ্গে একটি গোপন সমঝোতায় পৌঁছানো।
কিন্তু এই দূত এডেন ছেড়ে যাওয়ার আগেই পূর্ব জার্মান কর্মকর্তাদের নির্দেশে দক্ষিণ ইয়েমেনি গোয়েন্দা সংস্থা দূতকে গ্রেপ্তার করে এবং বন্দি করে রাখে। তার পরিবর্তে আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাইলের একজন লোককে দূত সাজিয়ে আল–ঘাশমির কাছে পাঠানো হয়। রুবাইয়া আলী এই ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। নকল দূতের বহন করা ব্রিফকেস বোমা বিস্ফোরিত হয়ে দূত এবং উত্তর ইয়েমেনি রাষ্ট্রপতি দু’জনেই নিহত হন। উত্তর ইয়েমেনের অন্যান্য নেতারা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দক্ষিণ ইয়েমেনকে দায়ী করেন এবং দক্ষিণ ইয়েমেনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
এই কূটনৈতিক সঙ্কট নিরসনের জন্য ইসমাইল এনএলএফ–এর কেন্দ্রীয় কমিটির জরুরি বৈঠক আহ্বান করেন। রুবাইয়া আলী এটিকে একটি ফাঁদ হিসেবে বিবেচনা করেন এবং বৈঠকে যোগ না দিয়ে তার পদত্যাগপত্র জমা দেন। বৈঠকে ইসমাইল সৃষ্ট সঙ্কটের জন্য আলীকে দায়ী করেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটি ১২০–৪ ভোটে আলীকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রধানমন্ত্রী আলী নাসির মুহাম্মদ হাসানি দক্ষিণ ইয়েমেনের নতুন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা ইসমাইলের হাতে ন্যস্ত হয়।
বস্তুত এটি ছিল একটি রাজনৈতিক অভ্যুত্থান। ইসমাইল প্রথমে উত্তর ইয়েমেনি রাষ্ট্রপতিকে খুন করান, এরপর এর ফলে উত্তর ইয়েমেনের সঙ্গে সৃষ্ট সঙ্কটকে কাজে লাগিয়ে রুবাইয়া আলীকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। তার এই অভ্যুত্থানে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল এবং পরবর্তী ঘটনাবলিতে তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
রুবাইয়া আলী ক্ষমতাচ্যুত হলেও ইয়েমেনি সেনাবাহিনীর অধিকাংশ ইউনিট এবং প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ড বাহিনী তখনো তার অনুগত ছিল। এদেরকে ব্যবহার করে আলী একট পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি বাব-এল-মান্দেব প্রণালীর নিকটবর্তী সামরিক ঘাঁটিতে যান এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি প্রাসাদে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তার অনুগত সৈন্যরা এডেন দখল করে নেয়ার জন্য অগ্রসর হয়।
দক্ষিণ ইয়েমেনের জনসাধারণ ঘটনা কোনদিকে অগ্রসর হচ্ছে তার কিছুই বুঝতে পারছিল না। এডেনের বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাভাবিক অনুষ্ঠান সম্প্রচারের পরিবর্তে কুরআন তিলাওয়াত প্রচারিত হচ্ছিল, কিন্তু চলমান অভ্যুত্থান বা পাল্টা অভ্যুত্থান সম্পর্কে কোনো খবরই জনগণকে জানানো হচ্ছিল না।
২৬ জুন রুবাইয়া আলীর অনুগত সৈন্যরা এডেনে প্রবেশ করলে ইসমাইলের অনুগত ও কিউবান উপদেষ্টাদের দ্বারা পরিচালিত ‘গণ মিলিশিয়া’ তাদেরকে বাধা দান করে এবং উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়। পূর্ব জার্মান উপদেষ্টাদের দ্বারা পরিচালিত দক্ষিণ ইয়েমেনি গোয়েন্দা পুলিশ বাহিনীও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। ইতোমধ্যে ইথিওপিয়া থেকে প্রায় ৫,০০০ কিউবান সৈন্যকে সোভিয়েত সামরিক পরিবহন বিমানে করে এডেনে নিয়ে আসা হয় এবং তারাও ‘গণ মিলিশিয়া’র পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তীব্র যুদ্ধের পর রুবাইয়া আলীর অনুগত সৈন্যরা পরাজিত ও এডেন থেকে বিতাড়িত হয়।
একই দিনে কিউবানদের দ্বারা পরিচালিত ‘গণ মিলিশিয়া’ সৈন্যরা রাষ্ট্রপতি প্রাসাদ আক্রমণ করে এবং কিউবান সৈন্যরা তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। রুবাইয়া আলীর অনুগত সৈন্য এবং প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ড বীরত্বের সঙ্গে প্রাসাদ রক্ষা করছিল। এ সময় এডেন সমুদ্রবন্দরে থাকা সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজ থেকে প্রাসাদটির ওপর ব্যাপক গোলাবর্ষণ করা হয় এবং কিউবান ও সোভিয়েত পাইলটদের দ্বারা চালিত দক্ষিণ ইয়েমেনি যুদ্ধবিমানগুলো প্রাসাদটির ওপর বোমাবর্ষণ করে। জল, স্থল ও আকাশ থেকে প্রচণ্ড আক্রমণের সম্মুখীন হয়ে রুবাইয়া আলীর সৈন্যরা রণে ভঙ্গ দেয় এবং রুবাইয়া আলী ইসমাইলের অনুগত সৈন্যদের হাতে বন্দি হন।
রুবাইয়া আলীকে বন্দি করার পর তাঁর বিচারের জন্য একটি বিপ্লবী আদালত বসে এবং বিচারে অন্যান্য অভিযোগের সাথে তাঁকে ‘সমাজতান্ত্রিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে, বিশেষত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে দক্ষিণ ইয়েমেনের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তোলা’র অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। আদালত রুবাইয়া আলী এবং তাঁর দুই সমর্থক (ও এনএলএফ নেতা) জাসেম সালেহ ও সালেম আওয়ারকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। একই দিনে তাঁদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
রুবাইয়া আলীর মৃত্যুদণ্ডের ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে দক্ষিণ ইয়েমেনি সেনাবাহিনীর আরো কয়েকটি ইউনিট বিদ্রোহ করে এবং এডেনের বাইরে আরো কয়েক দিন যুদ্ধ চলে। কিউবান সৈন্যদের সহযোগিতায় এই বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে ১৯৭৮ সালের জুনে দক্ষিণ ইয়েমেনের সামরিক অভ্যুত্থানপর্বের অবসান ঘটে।
সোভিয়েত–সমর্থিত এই অভ্যুত্থানটির ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এটি গণমাধ্যমে বা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তেমন কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। এই অভ্যুত্থানের ফলে দক্ষিণ ইয়েমেনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা সৌদি আরবের সম্পর্কোন্নয়নের সম্ভাবনার অবসান ঘটে এবং রাষ্ট্রটি সুদৃঢ়ভাবে সোভিয়েত বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। রাষ্ট্রটিতে সোভিয়েত সামরিক উপস্থিতি আরো বৃদ্ধি পায়। কিন্তু দক্ষিণ ইয়েমেনি নেতৃবৃন্দের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব চলতে থাকে এবং ১৯৯০ সালে দক্ষিণ ইয়েমেনে সমাজতন্ত্রের অবসানের আগে এর অবসান ঘটেনি।
এই ঘটনাটি আরব বিশ্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী’ ভাবমূর্তিকে আরো জোরদার করে। রক্ষণশীল মার্কিনপন্থী আরব রাষ্ট্রগুলো তো বটেই, এমনকি ইরাক ও সিরিয়ার মতো আপাতদৃষ্টিতে সোভিয়েতপন্থী রাষ্ট্রগুলোও মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে পড়ে। এ সময় এমনিতেই মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েত প্রভাব হ্রাস পাচ্ছিল এবং একটি আরব রাষ্ট্রের সরকারের অপসারণে সোভিয়েত ও কিউবান প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ এই প্রক্রিয়াকে আরো ত্বরান্বিত করে।
সর্বোপরি, ১৯৭৮ সালে দক্ষিণ ইয়েমেনের অভ্যুত্থানের ঘটনাটি সম্ভবত পরবর্তী বছরে অর্থাৎ ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে মস্কোকে উৎসাহিত করেছিল। মস্কোর নীতিনির্ধারকরা হয়ত ভেবেছিলেন যে, দক্ষিণ ইয়েমেনের সরকারকে তারা যেভাবে সহজে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করতে পেরেছিলেন, আফগানিস্তানেও ঠিক একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। বস্তুত সোভিয়েতরা সত্যিই ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি হাফিজুল্লাহ আমিনকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পেরেছিল, কিন্তু পরবর্তীতে তারা সেখানে প্রায় ৯ বছরব্যাপী একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, যেটি তাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে এনেছিল।