কিরগিজস্তান
‘কিরগিজ প্রজাতন্ত্র’ (কিরগিজ: Кыргыз Республикасы, ‘কিরগিজ রেসপুবলিকাসি’; রুশ: Киргизская Республика, ‘কিরগিজস্কায়া রেসপুবলিকা’) মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র স্থলবেষ্টিত ‘বৃহত্তর তুর্কি’ (Turkic) রাষ্ট্র। ১,৯৯,৯৫১ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট এই রাষ্ট্রটির উত্তরে কাজাখস্তান, পশ্চিমে উজবেকিস্তান, দক্ষিণে তাজিকিস্তান এবং পূর্বে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন অবস্থিত। রাষ্ট্রটি স্থলবেষ্টিত এবং রাষ্ট্রটির আশেপাশের অঞ্চলগুলো কখনো ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল না (চীন ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটেনের আধা–উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল, কিন্তু কিরগিজস্তানের সীমান্তবর্তী জিনজিয়াং–এ ব্রিটিশদের প্রভাব ছিল খুবই সীমিত)। এজন্য ব্রিটেনের পক্ষে বর্তমান কিরগিজস্তানের ভূখণ্ডে আক্রমণ চালানো বা উপনিবেশ স্থাপন করা ছিল খুবই কঠিন। ব্রিটেনের সুবিখ্যাত নৌবাহিনীর এক্ষেত্রে কোনো কার্যকারিতা ছিল না। অবশ্য তাই বলে যে ব্রিটিশরা এই অঞ্চলে একেবারেই নিষ্ক্রিয় ছিল, এমনটাও কিন্তু নয়।
সপ্তম শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত বর্তমান কিরগিজস্তানের ভূখণ্ডে কিরগিজদের একটি নিজস্ব রাষ্ট্রকাঠামো ছিল, যেটি ইতিহাসবিদদের কাছে ‘কিরগিজ খাগানাত’ নামে পরিচিতি অর্জন করেছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মোঙ্গল আক্রমণের ফলে এই রাষ্ট্রটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং এরপর থেকে বিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত জাতিগত কিরগিজদের স্বতন্ত্র কোনো রাষ্ট্র ছিল না। বিভিন্ন রাষ্ট্রের হাত ঘুরে বর্তমান কিরগিজস্তানের ভূখণ্ড প্রধানত উজবেক–নিয়ন্ত্রিত বুখারা খানাতের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু ১৭০৯ সালে উজবেকদের মিঙ্গ গোত্রভুক্ত শায়বানি বংশীয় শাহরুখ বেক বুখারা খানাতের অন্তর্ভুক্ত ফারগানা উপত্যকার পূর্বাংশে খোকান্দ শহরকে কেন্দ্র করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই রাষ্ট্রটি ‘খোকান্দ খানাত’ নামে পরিচিতি অর্জন করে। ১৭৭৪ থেকে ১৭৯৮ সালের মধ্যে রাষ্ট্রটি চীনকেন্দ্রিক চিং সাম্রাজ্যের করদ রাষ্ট্র (vassal/tributary state) ছিল, কিন্তু এরপর পুনরায় স্বাধীন হয়ে যায়।
বর্তমান কিরগিজস্তানের বৃহদাংশ, কাজাখস্তানের দক্ষিণ–পূর্বাংশ, উজবেকিস্তানের পূর্বাংশ এবং তাজিকিস্তানের পূর্বাংশ নিয়ে খোকান্দ খানাত গঠিত ছিল। ১৮১৫ সালে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের চূড়ান্ত পরাজয়ের পর মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের জন্য ব্রিটেন ও রাশিয়ার মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সেসময় রাশিয়ার বিশাল ভূখণ্ড ছিল, কিন্তু তাদের উষ্ণ জলীয় বন্দরের (warm water port) সংখ্যা ছিল খুবই কম। ব্রিটেনের আশঙ্কা ছিল, রুশরা উষ্ণ জলীয় বন্দরের খোঁজে মধ্য এশিয়া দখল করে ভারতীয় মহাসাগর অঞ্চলে আক্রমণ চালাতে পারে। ভারতবর্ষ সেসময় ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল এবং অত্যন্ত লাভজনক এই উপনিবেশের প্রতি কোনো ধরনের হুমকি সহ্য করতে তারা প্রস্তুত ছিল না। এজন্য নেপোলিয়নীয় যুদ্ধসমূহের অবসানের পর থেকেই ব্রিটেন মধ্য এশীয় রাষ্ট্রগুলোতে প্রভাব বিস্তারের জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালাতে শুরু করে।
সেসময় মধ্য এশিয়ায় তিনটি বৃহৎ রাষ্ট্র (বুখারা আমিরাত, খোরেজম খানাত ও খোকান্দ খানাত) ও বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ছিল। এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঐক্য ছিল না এবং রাষ্ট্রগুলো প্রায়ই একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকত। এর ফলে এতদঞ্চলে রুশ সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রচেষ্টাকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। রুশরা যাতে এই অঞ্চলে অগ্রসর হতে না পারে এবং ব্রিটিশ–শাসিত ভারতবর্ষ অভিমুখে আক্রমণ চালাতে না পারে, সেজন্য ব্রিটিশরা মধ্য এশীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যবর্তী বিরোধ নিরসন করে রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে একটি রুশবিরোধী জোট গঠনের প্রচেষ্টা চালায়। ১৮৪১ সালে ব্রিটিশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন আর্থার কনোলি খোকান্দে গমন করেন এবং খোকান্দ ও বুখারার মধ্যবর্তী বিরোধ নিরসনের প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং ১৮৪১ সালের নভেম্বরে তিনি খোকান্দ ত্যাগ করে বুখারায় গমন করেন। সেখানে বুখারার আমির নাসরুল্লাহ খান কনোলিকে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে বন্দি করেন এবং পরবর্তীতে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।
এভাবে মধ্য এশীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যবর্তী দ্বন্দ্ব নিরসনের ব্রিটিশ প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৮৪২ সালে বুখারা খোকান্দের ওপর আক্রমণ চালায় এবং খোকান্দের ‘খান’ (শাসক) মুহাম্মাদ আলী খান বুখারান সৈন্যদের নিকট পরাজিত ও বন্দি হন। তাকে হত্যা করে বুখারার আমির খোকান্দে নিজের পছন্দনীয় একজন শাসককে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেন এবং এর মধ্য দিয়ে খোকান্দ কার্যত বুখারার আশ্রিত রাষ্ট্রে (protectorate) পরিণত হয়। পরবর্তী দুই দশক ধরে খোকান্দে ব্যাপক অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চলতে থাকে এবং এই দ্বন্দ্বের বিভিন্ন পর্যায়ে বুখারা ও রাশিয়া খোকান্দে হস্তক্ষেপ করে। ১৮৬০–এর দশকে রাশিয়া চূড়ান্তভাবে খোকান্দ অধিকারের সিদ্ধান্ত নেয়।
১৮৬৪ সালে রুশরা উত্তর খোকান্দের অংশবিশেষ দখল করে নেয়। রাশিয়ার বিপুল সামরিক শক্তির মোকাবিলা করা গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত খোকান্দের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এজন্য খোকান্দ ব্রিটেনের কাছে সামরিক সহায়তা প্রার্থনা করে। কিন্তু মাত্র ৮ বছর আগে ব্রিটেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী পূর্বাঞ্চলীয়/ক্রিমিয়ান যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এবং নতুন করে রুশদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার কোনো আগ্রহ তাদের ছিল না। তদুপরি, আফগানিস্তান সেসময় ব্রিটিশ প্রভাব বলয়ের বাইরে ছিল এবং এর ফলে ব্রিটিশ–শাসিত ভারতবর্ষ থেকে খোকান্দে সৈন্য প্রেরণ করা ব্রিটিশদের জন্য কঠিন ছিল। এজন্য ব্রিটিশরা খোকান্দকে সামরিক সহায়তা প্রদান করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। ১৮৬৮ সাল নাগাদ খোকান্দ রাশিয়ার কাছে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয় এবং একটি চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়ার আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
পরবর্তীতে অবশ্য ব্রিটিশ কৌশলবিদরা খোকান্দকে সহায়তা না করার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আফসোস করেন। কারণ, ১৮৭৫–১৮৭৬ সালে খোকান্দে একটি রুশবিরোধী বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং রুশরা এই বিদ্রোহ দমন করে খোকান্দ রাষ্ট্রটিকেই বিলুপ্ত করে ফেলে। খোকান্দের ভূখণ্ডকে তারা রাশিয়ার তুর্কিস্তান জেনারেল–গভর্নরেটের অন্তর্ভুক্ত করে এবং প্রাক্তন খোকান্দ রাষ্ট্র উক্ত জেনারেল–গভর্নরেটের অধীনস্থ ফারগানা প্রদেশে পরিণত হয়। এই পর্যায়ে ব্রিটিশদের পক্ষে আর অঞ্চলটিতে সামরিক হস্তক্ষেপ করা সম্ভব ছিল না।
অবশ্য ১৯১৭ সালে সংঘটিত বলশেভিক বিপ্লব/অভ্যুত্থানের পর বলশেভিক কেন্দ্রীয় সরকার রাশিয়ার অন্যান্য প্রান্তিক প্রদেশের মতো তুর্কিস্তান জেনারেল–গভর্নরেটের ওপর থেকেও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং ১৯১৮ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে মিত্রশক্তির রাশিয়া আক্রমণের অংশ হিসেবে ব্রিটিশরা বর্তমান কাজাখস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের ভূখণ্ডে আক্রমণ পরিচালনা করে। একই সময়ে স্থানীয় বলশেভিকরা প্রাক্তন তুর্কিস্তান জেনারেল–গভর্নরেটের ভূখণ্ডে ‘তুর্কিস্তান সোভিয়েত ফেডারেটিভ প্রজাতন্ত্র’ নামক একটি আইনত স্বাধীন (কিন্তু কার্যত বলশেভিক কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত) রাষ্ট্র স্থাপন করে, এবং রাষ্ট্রটির রাজধানী ছিল তাসখন্দ। বর্তমান কিরগিজস্তানের সিংহভাগ ভূখণ্ড এই রাষ্ট্রটির অন্তর্ভুক্ত ছিল। ব্রিটিশরা ‘তাসখন্দ সোভিয়েতে’র সঙ্গে আলোচনা করে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করে এবং তুর্কিস্তানকে বলশেভিক রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজস্ব প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চালায়।
ব্রিটিশদের এই প্রচেষ্টা সফল হলে তুর্কিস্তান (এবং বর্তমান কিরগিজস্তানের ভূখণ্ড) ব্রিটিশ প্রভাবাধীনে চলে যেত এবং সেখানে ব্রিটিশ সামরিক উপস্থিতি স্থাপিত হতো। কিন্তু তাসখন্দ সোভিয়েত ব্রিটিশদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং ১৯২০ সাল নাগাদ বলশেভিকদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে ব্রিটিশরা মধ্য এশিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। এর ফলে কিরগিজস্তানের ভূখণ্ডে ব্রিটিশ সামরিক কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারেনি। এভাবে ইতিহাসের ঘটনাচক্রের (এবং নিজস্ব ভৌগোলিক অবস্থানের) কারণে কিরগিজস্তান কখনো ব্রিটিশ আক্রমণের সম্মুখীন হয়নি।
গুয়াতেমালা
‘গুয়াতেমালা প্রজাতন্ত্র’ (স্পেনীয়: República de Guatemala) মধ্য আমেরিকায় অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। ১,০৮,৮৮৯ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট এই রাষ্ট্রটির উত্তরে ও পশ্চিমে মেক্সিকো, উত্তর–পূর্বে বেলিজ ও ক্যারিবিয়ান সাগর, পূর্বে হন্ডুরাস, দক্ষিণ–পূর্বে এল সালভাদর এবং দক্ষিণে প্রশান্ত মহাসাগর অবস্থিত। রাষ্ট্রটির সমুদ্রসীমা রয়েছে এবং দীর্ঘদিন যাবৎ রাষ্ট্রটির ভূখণ্ড ব্রিটেনের প্রতিদ্বন্দ্বী স্পেনের উপনিবেশ ছিল, সুতরাং ব্রিটেন কর্তৃক গুয়াতেমালার ভূখণ্ডে আক্রমণ পরিচালনার একটি উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা ছিল। কার্যত বিভিন্ন সময়ে গুয়াতেমালার ভূখণ্ডে ব্রিটিশ নাগরিকরা শত্রুভাবাপন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। কিন্তু এই কার্যক্রমকে ‘আক্রমণ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।
বর্তমান গুয়াতেমালার ভূখণ্ড ছিল বিখ্যাত মায়া সভ্যতার কেন্দ্রভূমি। ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেন বর্তমান গুয়াতেমালার ভূখণ্ড দখল করে নেয় এবং সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করে। স্পেনীয়দের অধীনে গুয়াতেমালা ছিল একটি ‘ক্যাপ্টেন্সি–জেনারেল’ এবং বর্তমান গুয়াতেমালা, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস ও এল সালভাদর এবং মেক্সিকোর চিয়াপাস প্রদেশের ভূখণ্ড গুয়াতেমালা ক্যাপ্টেন্সি–জেনারেলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে গুয়াতেমালা ক্যাপ্টেন্সি–জেনারেল স্পেনীয় সাম্রাজ্যের ‘নিউ স্পেন ভাইসরয়্যাল্টি’র অংশ ছিল, কিন্তু কার্যত এর প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল নিউ স্পেন থেকে স্বতন্ত্র।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে ব্রিটিশ নাবিক স্যার ফ্রান্সিস ড্রেক ও স্যার থমাস ক্যাভেন্ডিশ গুয়াতেমালার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে বেশ কয়েকবার হানা দেন। তারা উভয়েই গুয়াতেমালার উপকূলীয় অঞ্চল অতিক্রম করে নিউ স্পেনের (বর্তমান মেক্সিকো) হুয়াতুলকোয় আক্রমণ পরিচালনা করেন। অর্থাৎ, ব্রিটিশ নাগরিকরা গুয়াতেমালার জলসীমায় ও স্থলে শত্রুভাবাপন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। কিন্তু তাদের এই কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং এর পশ্চাতে ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ সমর্থন ছিল না। এজন্য এগুলোকে ‘ব্রিটিশ আক্রমণ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।
সপ্তদশ শতাব্দীতে এই অঞ্চলে প্রায়ই জলদস্যুরা আক্রমণ চালাত এবং এই জলদস্যুদের মধ্যে অনেকেই ছিল ব্রিটেন থেকে আগত। ১৬৫২ সালে স্পেনীয়রা ইসাবাল হ্রদ অঞ্চলকে জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য এতদঞ্চলে একটি দুর্গ নির্মাণ করে। ধারণা করা হয়, ব্রিটিশ জলদস্যুরা রিও দুলসে অতিক্রম করে গুয়াতেমালার এল এস্তর শহরে রসদপত্র (ইংরেজিতে ‘Store’ বা ‘স্টোর’) সংগ্রহ করতে আসত এবং সেখান থেকে শহরটির এরকম নামকরণ হয়েছে। অর্থাৎ, এই অঞ্চলে ব্রিটিশ জলদস্যুদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। কিন্তু জলদস্যুরা কোনো সরকারের অধীনস্থ নয়, এজন্য গুয়াতেমালার ভূখণ্ডে ব্রিটিশ জলদস্যুদের কার্যক্রমকে ‘ব্রিটিশ আক্রমণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না।
১৮২১ সালে গুয়াতেমালা ক্যাপ্টেন্সি–জেনারেল স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ‘মধ্য আমেরিকা ফেডারেল প্রজাতন্ত্র’ হিসেবে মেক্সিকান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু ১৮২৩ সালে প্রজাতন্ত্রটি মেক্সিকো থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অবশেষে ১৮৪১ সালে ফেডারেল প্রজাতন্ত্রটি ভেঙে বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় এবং এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি ছিল বর্তমান গুয়াতেমালা। স্বাধীন গুয়াতেমালার সঙ্গে ব্রিটেনের ভূখণ্ডগত বিরোধ দেখা দেয়।
স্বাধীনতা লাভের পর থেকে গুয়াতেমালা উত্তর–পূর্ব সীমান্তবর্তী ব্রিটিশ উপনিবেশ ‘ব্রিটিশ হন্ডুরাস’কে (বর্তমান বেলিজ) নিজস্ব ভূখণ্ডের অংশ হিসেবে দাবি করে আসছিল। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে গুয়াতেমালা ব্রিটিশ হন্ডুরাস আক্রমণ করে ভূখণ্ডটি জোরপূর্বক দখল করে নেয়ার হুমকি প্রদান করে। প্রত্যুত্তরে ব্রিটেন ব্রিটিশ হন্ডুরাস ও গুয়াতেমালার মধ্যবর্তী সীমান্ত বরাবর এক কোম্পানি সৈন্য মোতায়েন করে, কিন্তু গুয়াতেমালা তাদের হুমকি বাস্তবায়িত করেনি। ১৯৫৭ সালে গুয়াতেমালা আবার ব্রিটিশ হন্ডুরাস আক্রমণের হুমকি দেয়, এবং ব্রিটিশরা গুয়াতেমালার সীমান্ত বরাবর সৈন্য মোতায়েন করে, কিন্তু উভয় পক্ষের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ হয়নি। ১৯৫৮ সালে গুয়াতেমালা কর্তৃক সমর্থিত ‘বেলিজ লিবারেশন আর্মি’র সদস্যরা সীমান্ত অতিক্রম করে ব্রিটিশ হন্ডুরাসে প্রবেশ করে এবং সেখানে গুয়াতেমালার পতাকা উত্তোলন করে, কিন্তু একটি সংক্ষিপ্ত সংঘর্ষের পর ব্রিটিশ সৈন্যরা তাদেরকে বন্দি করে।
বস্তুত গুয়াতেমালার তদানীন্তন সামরিক সরকার অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সমস্যা থেকে জনসাধারণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাখার জন্য ব্রিটিশ হন্ডুরাস ইস্যুকে ব্যবহার করে এবং এর মাধ্যমে গুয়াতেমালান জনসাধারণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী মনোভাবের বিস্তার ঘটিয়ে বামপন্থীদের প্রভাব হ্রাস করার প্রচেষ্টা চালায়। এই উদ্দেশ্যে তারা বিভিন্ন সময়ে ব্রিটিশ হন্ডুরাসকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে এবং দ্বন্দ্বের ফাঁকে ফাঁকে আলোচনাও চালিয়ে যায়। কিন্তু এই আলোচনাগুলো প্রত্যেক বারই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
১৯৭২ সালে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা ব্রিটিশ সরকারকে জানায় যে, গুয়াতেমালা শীঘ্রই ব্রিটিশ হন্ডুরাসের ওপর আক্রমণ চালাতে যাচ্ছে। এরপর ব্রিটেন ব্রিটিশ হন্ডুরাসে ৮,০০০ সৈন্য ও একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার প্রেরণ করে এবং প্রত্যুত্তরে গুয়াতেমালাও ব্রিটিশ হন্ডুরাসের সীমান্ত বরাবর সৈন্য সমাবেশ করে, কিন্তু এবারও কোনো যুদ্ধ হয়নি। ১৯৭৫ সালে গুয়াতেমালা আবার বেলিজের সীমান্ত বরাবর সৈন্য সমাবেশ করে এবং প্রত্যুত্তরে ব্রিটেনও পুনরায় বেলিজে সৈন্য মোতায়েন করে। উক্ত ব্রিটিশ সৈন্যদলে ছিল এক ব্যাটারি ১০৫ মি.মি. ফিল্ড গান, বিমান–বিধ্বংসী ক্ষেপনাস্ত্র ইউনিট, ৬টি যুদ্ধবিমান ও একটি ফ্রিগেট। এই পর্যায়ে বহুসংখ্যক গুয়াতেমালান সৈন্য সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে যায় এবং গুয়াতেমালান সরকার বুঝতে পারে যে, তাদের সশস্ত্রবাহিনী ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয়। ফলে তারা উত্তেজনা প্রশমনের সিদ্ধান্ত হয়। অবশেষে ১৯৮১ সালে বেলিজ ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
সামগ্রিকভাবে, গুয়াতেমালার ইতিহাসে রাষ্ট্রটির ভূখণ্ড বেশ কয়েকবার ব্রিটিশ নাবিক ও জলদস্যুদের আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে, কিন্তু সেগুলোকে গুয়াতেমালার ওপর ব্রিটিশ আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। অনুরূপভাবে, বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ হন্ডুরাস/বেলিজের দখল নিয়ে ব্রিটেন ও গুয়াতেমালার মধ্যে বেশ কয়েকবার সামরিক সংঘাত সৃষ্টির উপক্রম হয়েছে, কিন্তু কোনো বারই উভয় পক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি। ফলে ব্রিটিশ সৈন্যদেরকেও কখনো গুয়াতেমালার ভূখণ্ডে আক্রমণ পরিচালনা করতে হয়নি। এজন্য গুয়াতেমালা জাতিসংঘের সেই ২২টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে একটি, যারা কখনো ব্রিটিশ আক্রমণের শিকার হয়নি।