Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর গঠন এবং গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস

হিন্দুস্তান! বিচিত্র আর ভালোবাসাময় এক ভূখন্ডের নাম! হিন্দুস্তানের মাটির এক বিশেষত্ব হচ্ছে একে সহজে জয় করা যায় না। হিন্দুস্তানের মাটিকে জয় করতে হলে রক্তপাতের প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শক্তি এই হিন্দুস্তানের মাটি দখল করতে চেয়েছে, সময়ে সময়ে করেছেও। পৃথিবীতে ইসলামের পুনরাগমনের পর খুব দ্রুতই তুলনামূলক উন্নত জীবনদর্শন আর উন্নত, সুসভ্য সংস্কৃতি নিয়ে ইসলাম পৃথিবীর বিভিন্ন আনাচে কানাচে পৌঁছে গিয়েছিলো। ঠিক একইভাবে ইসলাম এসেছিলো হিন্দুস্তানের মাটিতেও। হিন্দুস্তানের দলিত আর নিম্নবর্ণের মানুষেরা ইসলামকে ঠিকই আঁকড়ে ধরেছিলো। তাদের মাধ্যমেই হিন্দুস্তানের অজানা, অচেনা মাটিতে প্রতিষ্ঠা পায় ইসলাম। ধীরে ধীরে হিন্দুস্তানের মাটিতে গড়ে ওঠে বিভিন্ন ছোট-বড় মুসলিম সালতানাত। ১২০৬ সাল থেকে ১৫২৬ সাল পর্যন্ত হিন্দুস্তান শাসন করেন দুর্ধর্ষ দিল্লি সালতানাতের বিভিন্ন সুলতানরা। হিন্দুস্তানের দীর্ঘ ইতিহাসে এরপর স্বমহিমায় নিজেদের জায়গা করে নেন মুঘল সাম্রাজ্যের মহান সুলতানরা।

মুঘল পতাকা; Source: shutterstock.com

হিন্দুস্তানের মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সুলতান জহির উদ্-দিন মুহাম্মদ জালাল উদ্-দিন বাবর, যার জন্ম হয়েছিলো ফারগানা নামক ছোট্ট রাজ্যের একটি শহরে। ফারগানা আধুনিক উজবেকিস্তানের একটি ছোট অংশ মাত্র। জীবনের বিভিন্ন বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে মধ্য এশিয়া থেকে একটি দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী নিয়ে সুলতান বাবর জয় করেছিলেন হিন্দুস্তান নামক ভূখন্ডটি। তবে অন্যান্য বিজেতাদের মতো হিন্দুস্তান জয়ের পর এর সম্পদ আহরণ করে হিন্দুস্তান ত্যাগ করে চলে যাননি তিনি। বরং পরম মমতায় আপন করে নিয়েছিলেন হিন্দুস্তানের মাটিকে। হিন্দুস্তানের প্রতি সম্রাট বাবরের এক বিশেষ আবেগ কাজ করতো, তিনি আসলে না দেখেই হিন্দুস্তানকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন, যা তার আত্মজীবনী ‘বাবরনামা’ পাঠ করলে খুব সহজেই বোঝা যায়। হিন্দুস্তানও কিন্তু সুলতান বাবরকে পরম মমতায় স্বাগত জানাতে ভুলেননি। মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর তিনি ও তার উত্তরাধিকারীরা মিলে প্রায় ৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শাসন করেছেন এই হিন্দুস্তানকে!

মুঘল সেনাবাহিনীর উৎপত্তি হয়েছিলো সম্রাট বাবরের হাত ধরেই। মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন জাতির যোদ্ধাদের সংমিশ্রণে বাবর তার সেনাবাহিনী গঠন করেছিলেন। বাবরের উত্থানের সাথে সাথে আফগান, বাদাখাশান, তাজিকসহ বিভিন্ন উপজাতি গোত্রগুলোর বিখ্যাত সব যোদ্ধারা তার আশেপাশে ভীড় জমাতে শুরু করলে তিনি তাদের নিজ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে নেন। এক্ষেত্রে তার উঁচু ব্যক্তিত্ব আর বংশপরিচয় তাকে বিশেষভাবে সহায়তা করেছিলো। সম্রাট বাবরের রক্ত সরাসরি তৈমুর আর চেঙ্গিস খানের রক্তের সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়ায় তিনি বিভিন্নভাবে অপ্রত্যাশিত সাহায্য পেতেন। এমনকি তিনি শিয়া পারস্যে সাম্রাজ্যের সামরিক সহায়তাও জোগাড় করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন! আর প্রথমদিকে তার সেনাবাহিনীর কামানগুলোর জোগান তো উসমানী সালতানাত বা অটোমান সাম্রাজ্যই দিয়েছিলো! এছাড়া পরবর্তীতেও তিনি অটোমান সাম্রাজ্য থেকে বিভিন্ন সামরিক সহায়তা পেতেন।

হিন্দুস্তানে সাম্রাজ্যের গঠনের প্রাথমিক সময়ে শুধুমাত্র মুসলিমরাই পরাক্রমশালী রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারতেন, পরবর্তীতে হিন্দুদেরও সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো। মুঘল সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হিন্দুদের মাঝে আবার রাজপুতদের সংখ্যাই ছিলো বেশি। সম্রাট হুমায়ুনের সময় আফগানরা বিদ্রোহ করলে আফগানদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা কিছুদিন বন্ধ ছিলো। পরে অবশ্য আবারো আফগানদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো।

পানিপথের যুদ্ধে মুঘল সেনাবাহিনীর অবস্থানের একটি চিত্র। ছবিটিতে মুঘল আর্টিলারী বাহিনীকে দেখা যাচ্ছে; Source: topyaps.com

সাম্রাজ্য গঠনের পর সম্রাট বাবর মাত্র ৪ বছরের কিছু বেশি সময় হিন্দুস্তান শাসন করতে পেরেছিলেন। পরবর্তী শাসক সম্রাট হুমায়ুনের জীবনও কেটেছে যুদ্ধক্ষেত্রে। আর তার জীবনের অনেকটা অংশই কেটেছে পথে পথে পালিয়ে। তৃতীয় মুঘল সম্রাট জালাল উদ্-দিন মুহাম্মদ আকবরের সময় মুঘল সাম্রাজ্য স্থিতিশীলতা অর্জন করেছিলো। সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন সেনাবাহিনীর। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি স্থায়ী কোনো বাহিনীর প্রয়োজন মনে করেননি। স্থায়ী সেনাবাহিনী তৈরির পরিবর্তে তিনি ‘মানসবদার’ নামে একটি পদ্ধতির উদ্ভব ঘটিয়েছিলেন। মানসবদাররা সম্রাটের প্রয়োজন অনুযায়ী যুদ্ধের জন্য সেনাদের প্রশিক্ষণ দিতো। এসব প্রশিক্ষিত যোদ্ধারাই সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার কাজ করতেন। মানসবদারদের সরবরাককৃত সৈন্য ছাড়াও অবশ্য আরো দুই শ্রেণীর সৈন্য সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য সবসময় তৈরি থাকতেন। তাদের যথাক্রমে দাখিলি ও আহাদি সৈন্য বলা হতো। চতুর্থ আরেক শ্রেণীর সেনাদলের অস্তিত্ব ছিলো যাদের সরবরাহ করতো ‘সরদার’ পদমর্যাদার একশ্রেণীর রাজকীয় কর্মচারীরা। সরদাররা স্বায়ত্বশাসন ভোগ করতেন আর সম্রাটের প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন সংখ্যক সেনাকে প্রশিক্ষণ দিতেন। তাদের সবধরনের সুযোগ-সুবিধা কেন্দ্র থেকে দেয়া হতো।

আমাদের আজকের আলোচনা এই দুর্ধর্ষ রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীকে নিয়েই। তো চলুন জেনে নেয়া যাক কেমন ছিলো রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনী!

স্থায়ী সেনাবাহিনী

রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনী নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই চলে আসবে সাম্রাজ্যের স্থায়ী সেনাবাহিনীর কথা। মুঘল সেনাবাহিনীতে স্থায়ী সৈন্য খুব কম ছিলো। সম্রাটের ব্যক্তিগত বাহিনী হিসেবে একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী ছিলো। এই বাহিনীতে মূলত সম্রাটের আত্মীয়স্বজন, বিশ্বস্ত মানুষজন এবং বিশ্বস্ত গোত্রগুলো থেকে সেনা নিয়োগ দেয়া হতো।

স্থায়ী সেনাবাহিনীর স্বতন্ত্র বিভিন্ন শাখা ছিলো। যেমন- অশ্বারোহী বাহিনী, গোলন্দাজ বাহিনী, পদাতিক বাহিনী ইত্যাদি। পুরো বাহিনীটিই উন্নত অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করতো। এই বাহিনীটি সম্রাটের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনী বা ‘রয়্যাল গার্ড’ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এছাড়া প্রাসাদের নিরাপত্তা রক্ষা, মূল সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ ও সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজও এই বাহিনী করতো। স্থায়ী সেনাবাহিনীর জন্য নির্দিষ্ট বেতন বরাদ্দ ছিলো।

সাওয়ার খান। সম্রাট শাহজাহানের দেহরক্ষী বাহিনীর একজন সদস্য; Source: উইকিমিডিয়া কমন্স

মানসবদার

সম্রাট আকবর সর্বপ্রথম মুঘল সেনাবাহিনীতে এই ‘মানসবদারি’ প্রথাটি শুরু করেন। এই প্রথানুযায়ী, রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনী সম্রাটের একক কমান্ডে না থেকে বরং ছোট-বড় বিভিন্ন ইউনিটে বিভক্ত হয়ে গোটা সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো। মুঘল সেনাবাহিনীর ছোট-বড় এসব ইউনিটের দায়িত্বে থাকতেন একজন করে ‘মানসবদার’। মানসবদারদের মর্যাদা নির্ভর করতো তাদের অধীনস্ত সৈন্যের সংখ্যার উপর। সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ, বেতন-ভাতা প্রদান ইত্যাদির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সম্রাটের পক্ষ থেকে মানসবদারদের কাছে হস্তান্তর করা হতো, বিনিময়ে মানসবদাররা নির্দিষ্ট সংখ্যক সৈন্যকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত করে তুলতো। আর নিজেদের অধীনস্ত সৈন্যের সংখ্যার ভিত্তিতে মর্যাদা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন।

‘মানসবদার’ মূলত একটি সরকারি পদবী। এই ব্যবস্থার অধীনে মোট ৩ ধরনের মানসবদারের অস্তিত্ব ছিলো। ‘আশাব-উস-সাইফ’ ছিলো মূলত সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত, রাজকর্মচারীরা ‘আশাব-উল-কালাম’ আর ধর্মতত্ববিদরা ‘আশাব-উল-আমানাহত’ শ্রেণীতে অবস্থান করতেন। ‘আশাব-উস-সাইফ’ আর ‘আশাব-উল-কালাম’’- এই দুই পদবীপ্রাপ্ত শ্রেণীকে সামরিক শ্রেণী হিসেবে চিহ্নিত করা হতো।

সামরিক উপাধীপ্রাপ্ত মানসবদারদের অধীনে পদবী অনুযায়ী সর্বনিম্ন ২০ জন সৈন্য থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৭ হাজার পর্যন্ত সৈন্য থাকতো। শুরুর দিকে শুধুমাত্র শাহজাদাদের জন্য ৭ হাজার থেকে শুরু করে ১০ হাজার পর্যন্ত সৈন্যের মানসবদারি সংরক্ষিত থাকতো। কিন্তু সম্রাট জাহাঙ্গীর আর সম্রাট শাহজাহানের সময় থেকে রাজদরবারের সভাসদদের জন্য ৭ হাজার থেকে ৮ হাজার সৈন্যের মানসবদারি সংরক্ষিত থাকতো। এ সময় রাজপরিবারের সদস্যরা ৫০ হাজার সৈন্যের মানসবদারির দায়িত্ব পেতেন।

‘মানসবদারি’-র দায়িত্ব কেউ উত্তরাধিকারী সূত্রে অর্জন করতে পারতো না, বরং স্বয়ং মুঘল সম্রাট নিজে মানসবদারদের নিয়োগ, বদলি কিংবা পদোন্নতি দিতেন। সম্রাট আকবরের সময় মনসবদারদের নগদে বেতন প্রদান করা হতো, পরবর্তীতে রাজস্বের মাধ্যমে তাদের বেতন পরিশোধ করা হতো।

প্রথমদিকে মুঘল সেনাবাহিনীর আকার ছোট ছিলো। এমনকি মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর যখন ইব্রাহীম লোদির ১ লাখের বেশি সংখ্যক সৈন্যের বাহিনীর মুখোমুখি হন, তখন বাবরের সেনাবাহিনীতে নিজস্ব সৈন্য ছিলো মাত্র ১২ হাজার! কিন্তু হিন্দুস্তান জয়ের পর সেনাবাহিনীর আকার বাড়তে থাকে, আর বিশাল এই সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণের জন্যই প্রবর্তন করা হয় ‘মানসবদারি’ প্রথাটি। সম্রাট আকবর নিশ্চয়ই সাম্রাজ্যের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য এই প্রথাটির প্রচলন করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় গোটা ব্যবস্থাটিই মুঘল সেনাবাহিনীর অন্যতম প্রধান ত্রুটি ছিলো! এই ব্যবস্থায় সেনাবাহিনী সম্রাটের একক কমান্ডে না থেকে ছোট-বড় বিভিন্ন ইউনিটে ছড়ানো ছিটানো থাকতো। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের মোতায়েন করা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার ছিলো। তাছাড়া মূল দুর্বলতার পেছনে দায়ী ছিলো মানসবদারদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি। বেশি সৈন্যের মানসবদারিত্ব অর্জনের জন্য তারা সবসময়ই বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকতো। যা মুঘল সাম্রাজ্যকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিলো।

মুঘল আর্টিলারী বা গোলন্দাজ বাহিনী

রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর একটি দুর্ধর্ষ শাখা ছিলো আর্টিলারি বা গোলন্দাজ বাহিনীটি। মুঘল সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলোতে অগ্রবর্তী বাহিনীর একেবারে প্রথম সারিতেই মোতায়েন করা হতো মুঘল আর্টিলারি বা গোলন্দাজ বাহিনীকে। ছোট-বড় বিভিন্ন কামানের সমষ্টিতে এই বাহিনীটিকে গড়ে তোলা হয়েছিলো। কামানগুলোকে টেনে নেয়ার জন্য সংরক্ষিত হাতি আর ষাঁড়ের বিশাল এক বহর ছিলো।

শিল্পীর কল্পনায় সম্রাট আকবরের আর্টিলারী বাহিনীর যোদ্ধারা; Source: Pinterest

যুদ্ধক্ষেত্রে ‘আরাবাহ’ নামক কৌশলে আর্টিলারি বাহিনীকে মোতায়েন করা হতো। এই কৌশলে ঘোড়া বা গরুর গাড়িকে দড়ি বা শেকল দিয়ে বেঁধে অগ্রবর্তী বাহিনীর অবস্থানের সামনে রাখা হতো। পরপর দুটি গাড়ির মাঝে বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা থাকতো। এই ফাঁকা জায়গাগুলোতে আর্টিলারি বাহিনীর কামানগুলোকে বসানো হতো। আবার ম্যাচলকধারী যোদ্ধারা গাড়িগুলোকে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করতে পারতেন। দড়ি বা শেকল দিয়ে সংযুক্ত গাড়িগুলো শত্রু বাহিনীর জন্য প্রাথমিক বাঁধা হিসেবে কাজ করতো। তাছাড়া শত্রুরা যেন খুব সহজেই এই বাঁধা পর্যন্ত পৌছাতে না পারে, সেজন্য আর্টিলারি বাহিনীর অবস্থানের সামনে গভীর পরিখা খনন করা থাকতো। কামান ছাড়াও আর্টিলারি বাহিনীতে মর্টার, গ্রেনেড আর রকেট ব্যবহার করা হতো। মর্টার ব্যবহারকারী সৈন্যদের ‘দাগেনদাজ’ বলা হতো। ‘রাদানদাজ’ বলা হতো গ্রেনেড নিক্ষেপকারী সৈন্যদের, আর রকেট নিক্ষেপকারী সৈন্যদের নাম ছিলো ‘তাখশ-আনদাজ’।

শত্রুর উপর প্রাথমিক আক্রমণ চালিয়ে তাদের সেনাদের অবস্থান ভেঙ্গে দেয়ার জন্য রাজকীয় মুঘল আর্টিলারি বাহিনীর জুড়ি ছিলো না। হিন্দুস্তান আক্রমণের সময় মুঘল সম্রাট বাবর ইব্রাহীম লোদির হস্তীবাহিনীর বিরুদ্ধে এই আর্টিলারি বাহিনীটিকে ব্যবহার করে ব্যাপক সফলতা পেয়েছিলেন। আর তাই হিন্দুস্তান বিজয়ের রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর এই ইউনিটটির প্রতি বিশেষভাবে যত্ন নেয়া হতো। পূর্বে বিভিন্ন অবরোধ যুদ্ধে দুর্গ ভেঙ্গে শত্রুপক্ষকে আত্মসমর্পণ করাতে অনেক সময় লেগে যেতো। কিন্তু এই আর্টিলারি বাহিনীর গোলাগুলো খুব দ্রুতই শত্রুদুর্গের দেয়াল ভেঙ্গে ফেলতে সক্ষম ছিলো। ফলে অবরোধ যুদ্ধগুলো খুব দ্রুতই সফলতার মুখ দেখতে পেতো।

মুঘল আর্টিলারী; Source: উইকিমিডিয়া কমন্স

তবে আর্টিলারি বাহিনীর একটি ত্রুটিও ছিলো। আর তা হলো এই বাহিনীর কামানগুলো বেশ ভারী হওয়ার কারণে এদের যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করা বিরাট সময়সাপেক্ষ ব্যপার ছিলো। যুদ্ধে শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর চলাচলের গতিই অনেক কিছু পাল্টে দিতে পারতো। আর তাই এ ধরনের যুদ্ধে কামানগুলোর উপরে খুব একটা ভরসা করা যেতো না। তাছাড়া প্রায়ই নির্মাণ ত্রুটির কারণে কামানগুলো বিষ্ফোরিত হতো, যা রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীতে অহেতুক প্রাণহানি ঘটাতো। এমন ত্রুটিযুক্ত একটি কামানের বিষ্ফোরণেই মারা গিয়েছিলেন হিন্দুস্তানের সুরি বংশের প্রথম সুলতান শের শাহ সূরী!

রাজকীয় ক্যাভালরী বাহিনী বা অশ্বারোহী বাহিনী

দুর্ধর্ষ মুঘল সেনাবাহিনীর প্রধান এবং সবচেয়ে শক্তিশালী স্তম্ভ ছিলো এই বাহিনীর এই অশ্বারোহী ইউনিটটি! যুদ্ধক্ষেত্রে আর্টিলারি বাহিনীর ঠিক পেছনেই অশ্বারোহী বাহিনীকে মোতায়েন করা হতো। মুঘল সেনাবাহিনীর অশ্বারোহী সৈন্যদের পদবি ছিলো ‘সওয়ার’। তবে এই বাহিনীতে যে শুধুমাত্র ঘোড়াই থাকতো, তা নয়। ঘোড়া ছাড়াও অশ্বারোহী বাহিনীর নিজস্ব উট, হাতি, ঘোড়ার গাড়ি ও গাধা থাকতো। এক হাজার অশ্বারোহী সৈন্যের কোনো মানসবদারকে সবসময় ৪ শত ঘোড়া, ৩২০টি ঘোড়ার গাড়ি, ২ শত হাতি, ১৬০টি উট এবং ৪০টি গাধা সংরক্ষণ করতে হতো। মুঘল সেনাবাহিনীতে প্রধানত আরবীয় ঘোড়া, তুর্কী ঘোড়া এবং ইরানী ঘোড়া ব্যবহৃত হতো। আর সেনাবাহিনীর উট প্রতিপালনের জন্য বিখ্যাত ছিলো গুজরাট, সিন্ধু, আজমীর, জয়সালমীর আর থানেশ্বর।

হালকা অস্ত্রে সজ্জিত মুঘল ক্যাভালরী বাহিনীর একজন যোদ্ধা; Source: quora.com

সেনাবাহিনীর জন্য ঘোড়া অবশ্য সম্রাটের পক্ষ থেকে দেয়া হতো না। বরং যেসব যোদ্ধারা নিজেরা মুঘল সেনাবাহিনীতে ঘোড়া প্রদান করতে পারতেন বা ঘোড়া কেনার সামর্থ্য রাখতেন, শুধুমাত্র তারাই মুঘল সেনাবাহিনীর অশ্বারোহী ইউনিটে যোগদান করতে পারতেন।

সম্রাট আকবরের সময় তার অশ্বারোহী বাহিনীতে সৈন্য ছিলো প্রায় ৪ লাখ, সম্রাট শাহজাহানের বাহিনীতে অশ্বারোহী সৈন্য ছিলো ২ লাখের কাছাকাছি। আর সম্রাট আওরঙ্গজেবের বাহিনীতে অশ্বারোহী সৈন্য ছিলেন প্রায় ৩ লাখ।

মুঘল ইনফ্যান্ট্রি বা পদাতিক বাহিনী

যুদ্ধক্ষেত্রে ক্যাভেলরী বা অশ্বারোহী বাহিনীর পেছনেই মোতায়েন করা হয় ইনফ্যান্ট্রিম্যান বা পতাদিক বাহিনীকে। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর এই শাখাটি তুলনামূলক দুর্বল ছিলো। তবে যে সময়ের কথা আলোচনা করা হচ্ছে, সেই সময়ে সেনাবাহিনীর সক্ষমতা বিবেচনা করা হতো অশ্বারোহী বাহিনীর সক্ষমতার উপরেই। তাই পদাতিকরা তুলনামূলক একটু দুর্বল হবেই, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। পদাতিক সেনারা মূলত তরবারী, ঢাল, বর্শা, পিস্তল, ম্যাচলক বন্দুক ইত্যাদি ব্যবহার করতেন।

ম্যাচলক বন্দুকসহ একজন মুঘল পদাতিক সৈন্য; Source: উইকিমিডিয়া কমন্স

যুদ্ধের সময় পদাতিক সেনাদের সরবরাহ করতেন মানসবদাররা। তবে সম্রাটের নিজের ব্যক্তিগত বাহিনীতে কিছু সংখ্যক পদাতিক সৈন্য ছিলো। তাদের ‘আহশাম’ বলা হতো।

উট বাহিনী

দুর্দান্ত মুঘল সেনাবাহিনীর অন্যতম শক্তিস্তম্ভ ছিলো বাহিনীর এই অংশটি। এই বাহিনীটিকে ‘জাম্বুরাক’ বলা হতো। সম্রাট হুমায়ুন সর্বপ্রথম মুঘল সেনাবাহিনীর জন্য এই জাম্বুরাক বাহিনীটি তৈরি করেন। মরু যুদ্ধের জন্য এই বাহিনীটি ছিলো অদ্বিতীয়। যুদ্ধক্ষেত্রে পদাতিক বাহিনীর পরেই উট বাহিনীকে মোতায়েন করা হতো।

জাম্বুরাক বাহিনীর প্রতিটি উটের উপরে থাকতো ছোট ছোট কামান। এই ছোট কামানগুলোকে ‘সুইভেল গান’ বলা হতো। সুইভেল গানটিকে যন্ত্রের সাহায্যে উটের পিঠের উপর ঘোরানো যেতো। আর ফায়ারিং এর সময় উটগুলোর হাঁটু ভেঙ্গে বসতে হতো।

ইম্পেরিয়াল মুঘল ক্যামেল আর্টিলারী বাহিনীর দুটি উট। এই বাহিনীকে ‘জাম্বুরাক’ নামেও ডাকা হতো; Source: উইকিমিডিয়া কমন্স

প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে মোতায়েন করা ছাড়াও পরিবহনের কাজে ব্যবহারের জন্যও বিপুল সংখ্যক উট বরাদ্দ ছিলো। মূলত মরুভূমিতে এসব উট ব্যবহার করা হতো। এই ধরনের উটগুলো বেশ কয়েকদিন পানি পান না করেও প্রায় ২০০ কেজি বোঝাসহ দিনে ৩০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব পাড়ি দিতে পারতো। আর বোঝাশূন্য অবস্থায় জাম্বুরাক বাহিনীটি দ্রুতগামী অশ্বারোহী বাহিনীর সাথেও তাল মেলাতে পারতো। মূলত মরুর প্রাণী হলেও হিন্দুস্তানের পূর্বাঞ্চলের জন্য উটদের প্রতিকূল আবহাওয়ায় বিভিন্ন অভিযানে মোতায়েন করা হতো। দিল্লি সহ আগ্রা, ফৈজাবাদ আর লখনৌতে মুঘল সেনাবাহিনীর জন্য সবসময় ১ লাখ উট প্রস্তুত থাকতো।

হস্তীবাহিনী

হিন্দুস্তানের যুদ্ধের ইতিহাস ঘাঁটলে প্রায় প্রতিটি যুদ্ধেই হাতির দেখা মিলবে। মুঘলদের পূর্বপুরুষরা অবশ্য এই হাতিদের সাথে তেমন একটা পরিচিত ছিলেন না। তৈমুর হিন্দুস্তান অভিযানের সময় হিন্দুস্তানের এই বাহিনীটি নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলেন। একইভাবে হিন্দুস্তানের এই হস্তীবাহিনীটি নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ভুগছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং বাবরও!

হস্তীবাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে সম্মুখভাগে মোতায়েন করা হতো না। কারণ আহত বা নিহত হলে বিশালাকার হাতির জন্য সেনাবিন্যাস ভেঙ্গে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতো। এ কারণে হস্তীবাহিনীকে মোতায়েন করা হতো যুদ্ধক্ষেত্রের পেছনের দিকে। হস্তীবাহিনীর সামনেই থাকতো রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর উট বাহিনীটি।

সম্রাট শাহজাহানের সময় হস্তীবাহিনীতে নিয়োগ দেয়া একটি হাতির তৈলচিত্র; Source: ranasafvi.com

হস্তীবাহিনীর একটি বিশাল ত্রুটি ছিলো প্রচন্ড শব্দে এরা ঘাবড়ে যেত। সম্রাট বাবর হিন্দুস্তান অধিকারের সময় একই পদ্ধতিতে ইব্রাহীম লোদিকে পরাজিত করেছিলেন। ইব্রাহীম লোদি বাবরের সেনাবিন্যাস ভাঙ্গার জন্য হাতিগুলোকে সামনে মোতায়েন করে এগিয়ে দিয়েছিলেন। সম্রাট বাবরের কামানগুলো থেকে গোলা নিক্ষেপ করা হলে এই যুদ্ধহাতিগুলো ভয় পেয়ে ইব্রাহীম লোদির সেনাবাহিনী বরাবর তীব্রবেগে ছুটে পালিয়েছিলো। নিজের হাতির পায়ের নিচেই পিষ্ট হচ্ছিলেন ইব্রাহীম লোদির বাহিনীর সেনারা!

জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষিত মুঘল যুদ্ধ হাতির একটি প্রতিকৃতি; Source: deadliestfiction.wikia.com

হিন্দুস্তান অধিকারের পর মুঘল সেনাবাহিনীর জন্য একটি স্বতন্ত্র হাতি ইউনিট তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে সত্যিকার অর্থে এই হস্তীবাহিনী খুব একটা গুরুত্ব বহন করতো না। কারণ সম্রাট বাবরের আগমনের সাথে সাথে হিন্দুস্তানে কামানের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়, আর যুদ্ধক্ষেত্রে যত বেশি গোলাবারুদের ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে, হস্তীবাহিনীও যুদ্ধে নিজেদের গুরুত্ব হারাতে থাকে।

সালাত আদায়ের পর সম্রাট তার সভাসদের সাথে দুর্গে ফিরে যাচ্ছেন। তৈল চিত্রটি মার্কিন চিত্রকর এডওয়ার্ড লর্ড উইকসের আঁকা; Source: উইকিমিডিয়া কমন্স

যুদ্ধের সময় হস্তীবাহিনীর মূল লক্ষ্য থাকতো সম্রাট বা কমান্ডারদের নিরাপত্তা বিধান করা। হাতির উপরে একধরনের মঞ্চ বসানো থাকতো, যাকে ‘হাওদা’ বলা হয়। স্বয়ং সম্রাট বা সম্রাটের পক্ষ থেকে যুদ্ধ পরিচালনাকারী কমান্ডাররা এই হাওদায় বসে যুদ্ধক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করতেন। তবে যুদ্ধ ছাড়াও সম্রাট, শাহজাদা, রাজপরিবারের সদস্যদের শিকার কিংবা ভ্রমণের জন্য হাওদাযুক্ত হাতি ব্যবহৃত হতো।

সম্রাটের শিকারের সময় ব্যবহৃত একটি হাতির ছবি; Source: উইকিমিডিয়া কমন্স

যা-ই হোক, যুদ্ধের জন্য বিপুল সংখ্যক হাতি সংরক্ষণ করে রাখা হতো। শত্রু সৈন্যরা যদি মুঘল সেনাবাহিনীর কোনো অংশ ভেদ করে মূল সেনাবাহিনীর ভেতরে ঢুকে যেতো, তাহলে দ্রুত সংরক্ষিত হস্তীবাহিনীকে সেসব স্থানে মোতায়েন করা হতো, যাতে মুঘল সেনাবিন্যাস ঠিক থাকে। এছাড়া অবরোধ যুদ্ধের সময় দুর্গ অবরোধ কিংবা দুর্গের দেয়াল ভাঙ্গার কাজে হস্তীবাহিনী ব্যবহৃত হতো। হস্তীবাহিনীকে রসদ পরিবহনের কাজেও ব্যবহার করা হতো।

হাতির পিঠে চড়ে ভ্রমণরত সম্রাট আকবর; Source: oldindianarts.in

নৌবাহিনী

মুঘলদের পূর্বপুরুষরা সমুদ্রের সাথে পরিচিত ছিলেন না। আর হিন্দুস্তান অধিকারের পর সম্রাট বাবর এবং হুমায়ুন সমুদ্র পর্যন্ত হিন্দুস্তানের অধিকার অর্জন করতে পারেননি। তাই নৌবাহিনী তৈরির প্রয়োজনও ছিলো না। সম্রাট আকবর গুজরাট অধিকারের পর সর্বপ্রথম সমুদ্র পর্যন্ত অধিকার লাভ করেন। কিন্তু দেখা যায়, কার্যকর একটি নৌবাহিনী তৈরি করতে তিনি ব্যর্থ হন। তার এই ব্যর্থতার মাশুল কিন্তু একদিন ঠিকই মুঘল সাম্রাজ্যকে দিতে হয়েছিলো! মূলত একটি কার্যকর নৌবাহিনী না থাকা ছিলো মুঘল সেনাবাহিনীর অন্যতম একটি দুর্বলতা যা একসময় গোটা হিন্দুস্তান শাসনকারী মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলো। শক্তিশালী আর কার্যকর একটি নৌবাহিনী না থাকায় লুটেরা ব্রিটিশ, পর্তুগীজ আর ফরাসী নৌবাহিনী বিনা বাধায় হিন্দুস্তানের উপকূলে পৌঁছে গিয়েছিলো। সম্রাট এসব লুটপাটকারী দস্যুদের বাধা প্রদানের ক্ষেত্রে কিছুই করতে পারেননি!

উল্লেখযোগ্য কোনো নৌবাহিনী না থাকলেও সমুদ্রে বেশ কিছু মুঘল পরিবহন জাহাজ ছিলো, যেগুলো মূলত মক্কায় হজ্বযাত্রী বহন করতো আর বিভিন্ন বন্দর থেকে মুঘল সেনাবাহিনীর জন্য ঘোড়া আমদানী করতো। আর সমুদ্রভিত্তিক কোনো নৌবাহিনী না থাকলেও সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরের নদীগুলো দিয়ে যোগাযোগ কিংবা অভিযানের জন্য মুঘল সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৌকা কিংবা জাহাজ নিয়ে ছোট আকারের একটি নৌবহর ছিলো। নৌবহরের এসব জাহাজ সমুদ্রে অভিযানের জন্য উপযুক্ত ছিলো না। তবে এই নৌবহর নদী দিয়ে অভিযানের ক্ষেত্রেও তেমন কার্যকর কিছু ছিলো না। নদীভিত্তিক নৌবহরের নৌকা আর জাহাজগুলোতে ছোট ছোট কামান রাখা হতো। তবে আক্ষরিক অর্থে, এই বাহিনীতে কোনো নিয়মতান্ত্রিক সেনা প্রশিক্ষণ ছিলো না, ছিলো না কোনো শৃঙ্খলাও! এমনকি মুঘল সেনাবাহিনীর এই নৌ ইউনিটটি মগ আর পর্তুগীজ জলদস্যুদের মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছিলো। পরবর্তীতে বাংলার নিরাপত্তার জন্য মীর জুমলা ও শায়েস্তা খান মুঘল নৌবহরকে কিছুটা আধুনিকায়ন করেন।

Mrauk U সাম্রাজ্যের বৌদ্ধ সম্রাট সান্ডা থুধাম্মার সময় চট্টগ্রাম ও এর আশেপাশের এলাকার মুসলিমদের উপর নির্যাতন বৃদ্ধি পেলে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৬৬৫ সালে রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর একটি নৌ ইউনিটকে চট্টগ্রামে মোতায়েন করেন। চিত্রটিতে মুঘল নৌবাহিনীকে যুদ্ধরত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে; Source: উইকিমিডিয়া কমন্স

সম্রাট আওরঙ্গজেব তার সময়ে বিদেশী দস্যু শক্তিগুলো হাত থেকে হিন্দুস্তানের পশ্চিম উপকূল রক্ষার জন্য মোটামুটি মানের একটি নৌবাহিনী দাঁড় করান। তিনি এই বাহিনীর নেতৃত্ব সিদি ইয়াকুবের হাতে দেন। আর সিদি ইয়াকুবের নেতৃত্বাধীন নৌবাহিনীটি যদি মূল ভূখন্ড দিয়ে আক্রান্ত হয় তাহলে সহায়তার জন্য বিজাপুরের সুলতানকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু হিন্দু মারাঠা নেতা শিবাজী সিদি ইয়াকুবের উপর হামলা চালালে বিজাপুরের সুলতান তাকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসেননি!

কিন্তু ঘটনা যা-ই হোক, একটি সুশৃঙ্খল আর দুর্ধর্ষ নৌবাহিনী গঠন করতে মুঘল সম্রাটরা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন, যার খেসারত দিতে হয়েছিলো মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে। এমনকি এই ব্যর্থতার জন্যই ইংরেজ, ফরাসী আর পর্তুগীজদের মতো সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো বিনা বাধায় হিন্দুস্তানের উপকূলে অবতরণ করতো, আর হিন্দুস্তানকে শোষণ করতো। মুঘল সম্রাটদের শুধুমাত্র এই ভুলটির জন্যই ইংরেজরা প্রায় ২০০ বছর ধরে হিন্দুস্তানে অবাধে লুটপাট চালাতে পেরেছিলো!

জাতিগত দিক থেকেই মুঘলরা দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন। আর তৎকালীন বিশ্বব্যবস্থায় অন্যান্য রাজশক্তিগুলোর মতোই মুঘল শাসনও নির্ভর করতো সামরিক শক্তির উপরেই। রাজকীয় মুঘল সেনাবাহিনীর পদভারে তখন হিন্দুস্তানের মাটি প্রকম্পিত হতো, মুঘল ঘোড়াগুলো হিন্দুস্তানের আনাচে কানাচে ছুটে বেড়াতো। এগুলো সব অতীতের কথা! গৌরবময় মহান মুঘল সাম্রাজ্য আজ আর নেই, মুঘল সাম্রাজ্য এখন কেবলই অতীত গৌরবের ধ্বংসস্তুপের ছাইয়ের ন্যায়। কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যের অর্জনগুলো কিন্তু আজও আধুনিক ভারত ভোগ করছে। হিন্দুস্তান কখনোই ঐক্যবদ্ধ কোনো রাষ্ট্র ছিলো না। মুঘলরা সমগ্র হিন্দুস্তনকে এক করে মুঘল পতাকার নিচে নিয়ে এসেছে। আর সমগ্র হিন্দুস্তানকে এক করতে মুঘলদের সাহায্য করেছে তাদের সহনশীলতা, ভ্রাতৃত্ববোধ আর ভিন্ন ধর্মালম্বীদের কাছে টেনে নেয়ার সৎসাহসটি। এক্ষেত্রে দুর্ধর্ষ মুঘল সেনাবাহিনীর কৃতিত্ব কোনো অংশে কম নয়।

মুঘল মুসলিম সেনাদের পাশে থেকে একই সাথে হিন্দুস্তানের বৃহত্তর স্বার্থে এক কাতারে থেকে লড়াই করেছিলেন মুঘল সেনাবাহিনীর হিন্দু যোদ্ধারাও। মুসলিম আর হিন্দুদের এক কাতারে নিয়ে এসে একটি শক্তিশালী হিন্দুস্তান গড়েছিলেন মুঘল সুলতানরা। আর এই ভ্রাতৃত্ববোধসম্পন্ন মুঘল সেনাবাহিনীর তৎপরতাই হিন্দুস্তানকে এক সুতোয় গাঁথতে পেরেছিলো। হিন্দুস্তানে আজ মুঘল শাসকরা নেই, নেই তাদের দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনীটিও। কিন্তু তাই বলে হিন্দুস্তানের প্রতি তাদের কষ্টার্জিত অর্জনকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না!

তথ্যসূত্র:

১। বাবরনামা (জহির উদ দিন মুহাম্মদ বাবর, অনুবাদঃ মুহম্মদ জালালউদ্দীন বিশ্বাস)

২। মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়সাহাদত হোসেন খান

এই সিরিজের আগের পর্ব

১। প্রাক-মুঘল যুগে হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা

২। তরাইনের যুদ্ধ: হিন্দুস্তানের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া দুই যুদ্ধ

৩। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: দাস শাসনামল

৪। রাজিয়া সুলতানা: ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক

৫। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: খিলজী শাসনামল

৬। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তুঘলক শাসনামল

৭। দিল্লি সালতানাতের ইতিকথা: তৈমুরের হিন্দুস্তান আক্রমণ ও সৈয়দ রাজবংশের শাসন

৮। দিল্লী সালতানাতের ইতিকথা: লোদী সাম্রাজ্

ফিচার ইমেজঃ Pinterest.com

Related Articles