মধ্যপ্রাচ্য; প্রাচীন সভ্যতার সুতিকাগার। একসময়ের জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু। অথচ বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে যুদ্ধ-বিগ্রহ আর অশান্তি। স্বৈরশাসক, গৃহযুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ- এগুলোকেই মনে হয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নিয়তি। তবে এটাই কি হওয়ার কথা ছিল? খুব সম্ভবত না। আজকের আরব বিশ্বের এহেন দুর্গতির জন্য অনেকেই দায়ী করেন ১৯১৬ সালে হয়ে যাওয়া এক চুক্তিকে, ইতিহাসে যেটি সাইকস-পিকো চুক্তি নামে পরিচিত।
গোপন এই চুক্তিটি হয় ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের মধ্যে। ব্রিটেনের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন স্যার মার্ক সাইকস এবং ফ্রান্সের পক্ষে ফ্রসোয়া জর্জ পিকো। ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের মধ্যকার এই চুক্তির সাথে আরব বিশ্বের কী সম্পর্ক থাকতে পারে? এটা জানার আগে চলুন আরেকটু পেছন ফেরা যাক।
অটোমান সাম্রাজ্য ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ
অটোমান সাম্রাজ্য; পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী এই সাম্রাজ্য তাদের স্বর্ণযুগ পার করে ১৬০০ সাল থেকেই দুর্বল হতে থাকে। শিল্পবিপ্লব এবং রেনেসাঁর কারণে বদলে যাওয়া ইউরোপ অটোমানদের কাছ থেকে তাদের হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধার করতে থাকে। ১৯১২-১৩ সালের বলকান যুদ্ধের পর অটোমানরা ইউরোপের প্রায় সব অঞ্চল হারায়।
শুধু ইউরোপে নয়, অভ্যন্তরীন কোন্দল ও দুর্বল নেতৃত্বে জর্জরিত অটোমানরা ব্রিটেন ও ফ্রান্সের কাছে আরব বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলও হারাতে থাকে। ফ্রান্স ১৮৩০ সালে আলজেরিয়া এবং ১৮৮১ সালে তিউনিসিয়া দখল করে। ইতালি লিবিয়া দখল করে ১৯১১ সালে। অন্যদিকে ব্রিটেন ওমান (১৮৬১) ও কুয়েত (১৮৯৯)-এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।
অটোমান শাসক মুহাম্মদ আলী মিসর শাসন করতেন। ১৮৮২ সালে তার পুত্র শাসক থাকাকালে ব্রিটেন মিসরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগপর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের বাকি অংশগুলোতে তখনও অটোমানদের নিয়ন্ত্রণ ছিল।
জুলাই ১৯১৪; বিশ্বে বেজে ওঠে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা। ম্রিয়মান হয়ে পড়া এবং ‘ইউরোপের অসুস্থ ব্যক্তি’ হিসেবে পরিচিত অটোমান সাম্রাজ্য কেন্দ্রশক্তি তথা জার্মানি ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়।
শরীফ হোসাইন
সেসময় মক্কার আমির ছিলেন শরীফ হোসাইন। ১৯০৮ সালে তিনি এ দায়িত্বে নিযুক্ত হন। পবিত্র দুই নগরীর দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ায় মক্কার আমির পবিত্র হজ্বের দেখভাল করতেন এবং অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকলেও অনেকটা স্বায়ত্বশাসন ভোগ করতেন। মক্কার আমির এবং মহানবী (সা) এর বংশধর হওয়ায় পুরো আরব বিশ্বে শরীফ হোসাইনের উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল। আরবরা তখন অটোমান শাসনের প্রতি ছিল প্রচন্ড ক্ষুব্ধ। আরব জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা অটোমান শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখত। তবে অটোমানরা আরবদের চেয়ে সামরিক দিক থেকে ছিল অনেক এগিয়ে। অটোমান সেনাদের সামনে প্রযুক্তিগতভাবে ও দক্ষতায় আরবদের কোনো তুলনাই করা যেত না। ঠিক তখনই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরবদের কাঙ্ক্ষিত সেই পথকে বাস্তবতায় রূপ দেয়ার সুযোগ নিয়ে আসে।
শরীফ হোসাইন আলেপ্পো থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত সর্বত্র একটি অভিন্ন আরব রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন। বিভিন্ন দল-গোত্রে বিভক্ত আরবরা একটি অভিন্ন আরব রাষ্ট্রের স্বপ্নে শরীফ হোসাইনের ডাকে এগিয়ে আসে।
লরেন্স অফ আরাবিয়া
থমাস এডওয়ার্ড লরেন্স ছিলেন একজন ব্রিটিশ আর্কিওলজিস্ট। প্রত্নতাত্ত্বিক কাজে তিনি ১৯১০ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য চষে বেড়ান। সেসময় তিনি আরব সংস্কৃতি ও আরবি ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তাকে কায়রোতে ব্রিটিশ বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়। আরব সংস্কৃতির সাথে পূর্ব পরিচিত হওয়ায় তার দক্ষতাকে কাজে লাগায় ব্রিটিশ বাহিনী।
আরব বিদ্রোহ
১৯১৫-১৬ সালে শরীফ হোসাইন মিসরের ব্রিটিশ হাইকমিশনার স্যার হেনরি ম্যাকমাহনের সাথে কয়েকটি পত্র বিনিময় করেন। এতে তিনি একটি অভিন্ন স্বাধীন আরব রাষ্ট্রের বিনিময়ে অটোমানদের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহের কথা বলেন।
প্রতিপক্ষ অটোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে এমন বিদ্রোহের সুযোগ দেখে ব্রিটিশরা পরিস্থিতি লুফে নেয়। তারা অটোমানদের বিরুদ্ধে আরবদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। আরবরা ব্রিটিশদের পক্ষে যেতে রাজি হয়। তবে এক শর্তে- যুদ্ধ শেষে একটি অভিন্ন আরব রাষ্ট্রের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেবে ব্রিটেন।
১৯১৬ সালের ১ জুন শরীফ হোসাইন অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা দেন।
শরীফ হোসাইনের তৃতীয় পুত্র ফয়সালের নেতৃত্বে আরবরা যুদ্ধ করতে থাকে। আর ব্রিটিশদের পক্ষে লরেন্স তাদেরকে সবধরনের সহায়তা করেন। ব্রিটিশরা প্রথমত আরবদের সফলতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও লরেন্স তাদেরকে আশ্বস্ত করেন। তিনি জানান আরব বেদুইনরা স্বভাবগত যোদ্ধা। তাদের শুধু আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আরব সংস্কৃতি ও ভাষায় লরেন্সের দক্ষতা ব্রিটিশদের পক্ষে কাজ করে।
মরুভূমিতে চলাফেরা করে অভ্যস্ত আরবরা অটোমানদের বিরুদ্ধে ঝটিকা আক্রমণ ও গেরিলা যুদ্ধে সাফল্য পেতে থাকে।
সাইকস-পিকো চুক্তি
আরবদের কাছে স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দিলেও সেটা বাস্তবে রূপ দেয়ার কোনো ইচ্ছেই ব্রিটিশদের ছিল না। তারা বরং একইসাথে তাদের অন্য মিত্রদের সাথে আলোচনা করতে থাকে।
মিত্রশক্তি তথা ফ্রান্স, রাশিয়া ও ব্রিটেন নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ পরবর্তী অটোমান সাম্রাজ্যের ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে ঐক্যমতে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। ১৯১৫ সালের নভেম্বর থেকে ১৯১৬ সালের মে পর্যন্ত তাদের মধ্যে এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বৈঠক হয়। এই তিন পক্ষের মধ্যে ব্রিটেন ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী যারা আবার আরবদের সাথেও চুক্তি করেছিল!
১৯১৫ সালের ডিসেম্বর মাসের এক সকাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বয়স তখনও ১৮ মাসের কম। মার্ক সাইকস নামক জনৈক ব্রিটিশ কুটনীতিবিদ লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অফিসে হাজির হন। তার হাতে ছিল মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র এবং মনে এই মানচিত্র কেমনভাবে কাটাছেড়া করা হবে সেই পরিকল্পনা!
কথিত আছে, দেশের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের সামনে দাঁড়িয়ে স্যার মার্ক সাইকস মানচিত্রের মধ্যে নিজের আঙুল দিয়ে এক দাগ টানেন এবং বলেন, “আমি মরুভূমির মধ্যে একটি লাইন টানতে চাই। এমন একটি লাইন যার বিস্তৃতি হবে ‘Acre’ এর ‘e’ থেকে (তখনকার ফিলিস্তিন) ‘kirkurk’ এর ‘k’ পর্যন্ত (বর্তমানে যা ইরাকের মধ্যে)!“
তখন কে জানত এরকম একটি লাইন টেনে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের হাজার হাজার মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলা যায়!
প্রাথমিক সেই মানচিত্রটি নিচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে। মার্ক সাইকস তার পরিকল্পনায় জানান, ব্রিটিশরা এই লাইনের দক্ষিণ দিক এবং ফরাসিরা এর উত্তর দিক নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেবে।
অনেক আলোচনা পেরিয়ে ১৯১৬ সালের ১৬ মে ব্রিটেনের মার্ক সাইকস ও ফ্রান্সের ফ্রসোয়া পিকোর মধ্যে গোপন এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই সাজনভ এই চুক্তি অনুমোদন করেন।
যা ছিল সাইকস-পিকো চুক্তিতে
গোপন এই চুক্তিতে মধ্যপ্রাচ্যের এই অংশটিকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়। উপরের ছবি অনুযায়ী,
- প্রথম অংশটি বাগদাদ থেকে দক্ষিণে কুয়েত পর্যন্ত। এই অংশটি সরাসরি ব্রিটিশদের অধীনে থাকবে।
- দ্বিতীয় অংশটুকু থাকবে ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে। বর্তমান উত্তর ইরাক, জর্দান ও বর্তমান ইসরাইলের নেগেভ মরুভূমি থেকে মিসরের সিনাই উপত্যকা পর্যন্ত এই অংশের বিস্তৃতি।
- তৃতীয় অংশটি যা দক্ষিণ লেবানন থেকে তুরস্কের কয়েকটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত থাকবে সরাসরি ফ্রান্সের অধীনে।
- সিরিয়া মরুভূমির অংশটি যাবে ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণে।
- এই অংশটি ঐতিহাসিক জেরুজালেম এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে। এর সর্বধর্মীয় গুরুত্ব থাকার কারণে এটি থাকবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণে।
সাইকস-পিকো চুক্তিতে রাশিয়ার জারকে দেয়া হয় ইস্তাম্বুল, বসফরাস প্রণালীসহ বর্তমান তুরস্কের অনেকটুকু।
চুক্তির প্রভাব
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়েয় মাধ্যমে পতন হয় অটোমান সাম্রাজ্যের। হুবহু সাইকস-পিকো চুক্তির মাধ্যমে পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র ঠিক না করলেও এর প্রভাব রয়ে যায়। এই চুক্তিকে ভিত্তি ধরেই ১৯২০ সালের সান রেমো কনফারেন্সে প্রস্তাবিত ম্যান্ডেট পদ্ধতির মাধ্যমে আরব বিশ্বকে ভাগ করা হয়।
প্রথমত সাইকস-পিকো এবং পরবর্তী অন্য কোনো চুক্তিতেই আরব বিশ্বের মতামতকে গ্রহণ করেনি ব্রিটেন ও ফ্রান্স। বরং তারা নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে বিবেচনা করেনি আরবদের স্বার্থ। ঔপনিবেশিক ব্রিটেন ও ফ্রান্স সীমান্ত নির্ধারণ করার সময়ে এ অঞ্চলের জাতিগত, ভাষাগত ও ধর্মীয় পার্থক্য বিবেচনা করেনি, যার ফলশ্রুতিতে একই কুর্দি জাতি বিভিন্ন দেশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আবার শিয়া-সুন্নিসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও জাতিগত পার্থক্য থাকলেও তৈরি হয় এদের নিয়েই কোনো কোনো দেশ।
ব্যালফুর ঘোষণা
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ব্রিটেন একইসাথে শুধু আরব এবং ফ্রান্সের সাথেই চুক্তি করেনি, বরং ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গড়ার ব্যাপারে জায়নিস্টদের প্রতিশ্রুতি দেয়! তখনকার ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার ব্যালফুর জায়নিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা লর্ড ওয়াল্টার রথসচাইল্ডের কাছে লেখা এক চিঠিতে এই প্রতিশ্রুতি দেন। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর লেখা এই চিঠি পরবর্তীতে ‘ব্যালফুর ডিক্লারেশন’ নামে পরিচিতি পায় যা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এক ধাপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
‘সাইকস-পিকো’ লিকস
১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ার জারের পতন হয় এবং সমাজতান্ত্রিক শাসনের শুরু হয়। বিপ্লবের নেতা ভ্লাদিমির লেনিন পূর্ববর্তী সরকারের আর্কাইভ রেকর্ডে সাইকস-পিকো চুক্তির একটি কপি খুঁজে পান। এটি পরে কমিউনিস্ট রাশিয়ার ‘ইজভেসটিয়া’ পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। লেনিন চুক্তিটিকে ‘উপনিবেশবাদী ডাকাতদের চুক্তি’ বলে অভিহিত করেন।
সাইকস-পিকো চুক্তির শতাব্দী পার হয়ে গেলেও এর প্রভাব অশান্ত মধ্যপ্রাচ্যে এখনও বিদ্যমান। ফিলিস্তিন দখল থেকে শুরু করে আইসিসের উত্থান এসব কিছুকেই এই চুক্তির ফলাফল বলে অনেকে মনে করেন।
২০১৪ সালে আইসিস এক প্রোপাগান্ডা ভিডিও প্রকাশ করে। ভিডিওটির নাম দেয়া হয় ‘The end of sykes-picot’। সেখানে দেখা যায়, ইরাক-সিরিয়ার ‘সাইকস-পিকো বর্ডার’ বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
শেষ করা যাক একটি পুরোনো ইরাকি প্রবাদ দিয়ে,
“যদি আপনি টাইগ্রিস নদীতে দুটি মাছকে মারামারি করতে দেখেন, তবে জেনে রাখুন এর পেছনে ব্রিটিশদের হাত আছে!”