Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মহাত্মা গান্ধী কি বর্ণবাদী ছিলেন?

ঘানা, পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ। আফ্রিকা মহাদেশের আর দশটি দেশের মতো এখানেও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরা শত শত বছর ধরে বসবাস করে আসছে। অন্যান্য দেশের মতো ঔপনিবেশিক দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি এই দেশটিও। ইউরোপীয়রা একসময় স্বর্ণের খোঁজে এসেছিল এই দেশে, তাই এটি একসময় পরিচিত ছিল ‘গোল্ড কোস্ট’ (Gold Coast) হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইংল্যান্ডের উপনিবেশগুলো স্বাধীন হতে শুরু করলে আফ্রিকা মহাদেশের প্রথমদিকে স্বাধীনতা পাওয়া দেশগুলোর মধ্যে ঘানা ছিল অন্যতম। দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় ‘ইউনিভার্সিটি অব ঘানা’।

২০১৬ সালের দিকে ইউনিভার্সিটি অব ঘানায় তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির দেয়া একটি ভার্স্কয নিয়ে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থী সকলেই ভার্স্কয অপসারণের দাবিতে শ্রেণীকক্ষ ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। তারা সম্মিলিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে পিটিশন জমা দেন। পিটিশনে বর্ণবাদের দোহাই দিয়ে মহাত্মা গান্ধীর ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলতে অনুরোধ করা হয়। তাদের মতে, মহাত্মা গান্ধী ছিলেন একজন ‘বর্ণবাদী’। তার পরিবর্তে আফ্রিকার কিংবদন্তিদের সম্মান জানানোর কথা বলেছিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দুই বছর পর, ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মূর্তি অপসারণ করে।

গচহআিআিত
মহাত্মা গান্ধীর ভাস্কর্য টেনে নামিয়ে ফেলা হচ্ছে ঘানা বিশ্ববিদ্যালয়ে; image source: bbc.com

শুধু ঘানাতে নয়, জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর ইউরোপজুড়ে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করলে আন্দোলনের অংশ হিসেবে বর্ণবাদের সাথে জড়িয়ে থাকা যেসব ব্যক্তির ভাস্কর্য রং মেখে নষ্ট করে দেয়া হয়, কিংবা উপড়ে ফেলা হয়, তাদের মধ্যে মহাত্মা গান্ধীর ভাস্কর্যও রয়েছে। যে মানুষটি ভারতকে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন, যার ডাকে লাখ লাখ মানুষ সাত-পাঁচ না ভেবে আন্দোলনে নেমে গিয়েছে, ভারতবাসী ভালোবেসে যাকে ‘বাপুজি’ ডাকে এবং ‘জাতির পিতা’র সম্মান প্রদান করে, তার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ ওঠা কিছুটা অস্বাভাবিক নয় কি? তিনি নিজেই তো ব্রিটিশদের বৈষম্যমূলক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। তাহলে তিনি কেন বর্ণবৈষম্যের দায়ে অভিযুক্ত হবেন?

মহাত্মা গান্ধীর যশ-খ্যাতি শুধু ভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। উপনিবেশবাদ-বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি একজন আন্তর্জাতিক কিংবদন্তি, যিনি মার্টিন লুথার কিংবা নেলসন ম্যান্ডেলাদের মতো বিশ্বখ্যাত মানুষদের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন। নিপীড়নবাদী শাসকদের বিরুদ্ধে তার অহিংসপন্থা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য জায়গা দখল করে রাখবে।

জবিআুআুআ
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তথা উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে মহাত্মা গান্ধী অনন্য জায়গা দখল করে থাকবেন;
image source: britannica.com

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, যিনি মহাত্মা গান্ধী হিসেবেই ব্যাপক পরিচিত, তার বিরুদ্ধে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনকারীরা কেন বর্ণবাদের মতো গুরুতর অভিযোগ আনছে, সেই প্রেক্ষাপট জানতে হলে আমাদেরকে অতীতে ফিরে যেতে হবে।

যুবক গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিলেন সেখানকার ভারতীয় ব্যবসায়ীদের আইনগত ব্যাপারগুলো দেখাশোনা করার জন্য। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখতে পান, কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের পাশাপাশি ভারতীয়রাও শ্বেতাঙ্গদের মাধ্যমে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। বৈষম্যের প্রতিবাদ করার জন্য তাকে ট্রেন থেকেও নামিয়ে দেয়া হয়েছিল! এসব বিষয়ের জন্য তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ প্রশাসনের কাছে ভারতীয়দের প্রতি বৈষম্য দূর করতে গতানুগতিক উপায়ে প্রতিবাদ জানান।

আফ্রিকা ও ইউরোপের বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের কর্মীদের আপত্তির জায়গাটা আসলে ঠিক এখানেই। মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশদের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন যেন ভারতীয়দের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণগুলো যাতে আর না করা হয়। কিন্তু ঠিক একই সময়ে আফ্রিকার স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকরা প্রচন্ড বর্ণবৈষম্যের শিকার হচ্ছিল, যেটির বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে তিনি তেমন কথা বলেননি, প্রতিবাদ জানাননি। অর্থাৎ তার সমালোচকদের মতে, তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের পাশাপাশি ভারতীয়দেরও সুযোগ-সুবিধা চাইছিলেন, অথচ কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি যে প্রবল বৈষম্য চলছিল, এর বিরুদ্ধে তিনি নীরবতা পালন করেন।

২০১৫ সালের দিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় অশ্বিন দেশাই ও গুলাম ভাহেদ নামের দুজন অ্যাকাডেমিক ব্যক্তিত্ব প্রায় সাত বছরের গবেষণার পর ‘দ্য সাউথ আফ্রিকান গান্ধী: স্ট্রেচার-বিয়ারার অব এম্পায়ার’ (The South African Gandhi: Stretcher-Bearer of Empire) নামে একটি বই প্রকাশ করেছেন। এই বইটি প্রকাশ করতে তাদের অনেক নথিপত্র ঘাঁটতে হয়েছে। গান্ধী যে সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থান করেছিলেন (১৮৯৩–১৯১৪), সে সময়ের অনেক পুরনো তথ্যের সন্ধান পাওয়া যাবে এই বইয়ে। এতদিন ধরে ভারতীয় ইতিহাসবিদদের লেখায় মহাত্মা গান্ধীর যে সন্ন্যাসী-ঘরানার রূপ তৈরি করা হয়েছিল, তা অনেকটাই পাল্টে যাচ্ছে এই বইয়ের কারণে।

হআহচগচগচ
দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থানকালে কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে গান্ধীর মন্তব্যগুলো ছিল চরম বিতর্কিত; image source: scroll.in

১৮৯৩ সালে নাটাল পার্লামেন্টে পাঠানো এক লেখায় তিনি বলেন, “সাধারণ ধারণা এই যে ভারতীয়রা আফ্রিকান স্থানীয় অসভ্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় জাতিগতভাবে কিছুটা উঁচুশ্রেণীর।” ব্রিটিশরা ভারতীয় ও আফ্রিকানদের বসবাসের জন্য একই জায়গা নির্ধারণ করে দেয়ার প্রতিবাদে ১৯০৪ সালে গান্ধী জোহানেসবার্গের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে চিঠি লিখে প্রতিবাদ জানান। ডারবানে যখন মহামারীর কালো থাবা জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলতে শুরু করে, গান্ধী তখন লিখেছিলেন যে যতদিন কৃষ্ণাঙ্গ ও ভারতীয়রা একই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে থাকবে, ততদিন মহামারী চলতে থাকবে। অর্থাৎ তিনি ভারতীয়দের জন্য কৃষ্ণাঙ্গমুক্ত আলাদা হাসপাতালের দাবি তোলেন। এছাড়া জুলু বিদ্রোহের সময় তিনি ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছিলেন বলে জানা যায়।

মহাত্মা গান্ধীর জীবনীগ্রন্থের রচয়িতা রাজমোহন গান্ধী লিখেছেন, তরুণ গান্ধী যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় পা রাখেন, তখন তিনি সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গদের দুর্দশা কিংবা বর্ণবৈষম্য সম্পর্কে খুব বেশি অবগত ছিলেন না। এজন্য প্রাথমিকভাবে তিনি তার স্বজাতির লোকদের অধিকারের জন্য লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেন। এমনকি তিনি এটাও দাবি করেন যে, বাস্তবে মহাত্মা গান্ধীর লড়াই কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে ওঠে এবং পরবর্তীতে তারা নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই শুরু করে। গান্ধীর পক্ষে যারা কথা বলেন, তাদের মতে, বিংশ শতকের শুরুর দিকে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার নিয়ে কথা বলা খুব সহজ কাজ ছিল না।

গান্ধীকে নিয়ে লেখা আরেকজন প্রসিদ্ধ লেখক হলেন রমাচন্দ্র গুহ। তার মতে, গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম বছরগুলোতে বাস্তবেই কিছুটা বর্ণবাদী ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি বাস্তবতা বুঝে ওঠেন এবং কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের জন্যও কথা বলতে শুরু করেন। এজন্য মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র কিংবা নেলসন ম্যান্ডেলারা তার বিতর্কিত মন্তব্য কিংবা লেখাগুলো সম্পর্কে জানার পরও তার দাবি আদায়ের পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন।

হচুডিচহ
image source: history.com

সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার দুজন অধ্যাপকের লেখনীতে গান্ধীর দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থানকালীন যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তাতে তাকে বর্ণবাদী মনে হতেই পারে। কখনও কৃষ্ণাঙ্গদের বর্ণবাদী উপায়ে সমালোচনা করেছেন, তাদের সাথে মিশতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। এছাড়া তিনি শ্বেতাঙ্গ শাসকগোষ্ঠীর কাছে কখনও কৃষ্ণাঙ্গদের সমঅধিকার চাননি, বরং ভারতীয়দের ব্রিটিশদের সমান অধিকার, নিদেনপক্ষে কৃষ্ণাঙ্গদের চেয়ে বেশি অধিকার প্রার্থনা করেছেন। অর্থাৎ তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থানের সময় কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের নিজেদের সমান ভাবতে পারেননি, তাদের নিচুজাত হিসেবেই বিবেচনা করেছেন।

Related Articles