Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

চা শ্রমিক: জন্ম জন্মান্তরের দুষ্টচক্রে বাঁধা যাদের জীবন

চা বাগান, পাহাড়ের ঢালে সাজানো সবুজের সমারোহ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় আমাদের। এই বাগানের পাতা থেকে তৈরি চা আমাদের ক্লান্তি দূর করে, মনে প্রশান্তি দেয়। নানা জরিপের তথ্যে চোখ বুলিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের দশম বৃহৎ চা উৎপাদনকারী দেশ আর রপ্তানিতে নবম।

বাংলাদেশে চা চাষের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ আর পুরাতন। ১৮৫৪ সালে সিলেটে যখন চায়ের বাগান করে চা উৎপাদন শুরু হয় তখন সিংহভাগের দখলে ছিল ব্রিটিশ বণিকরা। মাইলের পর মাইল বিশাল এই চা বাগানে কাজ করবার জন্য দরকার ছিল বিপুল শ্রমিক। বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশসহ ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে  নিচু বর্ণের হিন্দু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজনকে কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে চা বাগান এলাকাগুলোতে নিয়ে আসা হয়। চা বাগানের মাঝে ছোট মাটির ঘরে চা শ্রমিকদের বসবাস শুরু হয়।

রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে একটি কুড়ি আর দুটি পাতা ছিড়ে শৌখিন মানুষের কাপে চা পৌঁছে দিচ্ছে চা শ্রমিকরা। মাঝে পেরিয়ে গেছে অনেক সময়, ভারত ভাগ হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু চা শ্রমিকদের ভাগ্য চা বাগানের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির গণ্ডিতে বাঁধা পড়ে আছে। বংশানুক্রমে সমাজের মূলধারা থেকে বিছিন্ন এই মানুষগুলোর নিজেদের ভূমির অধিকার নেই, দিনে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা মজুরীর চক্রে বাঁধা এদের জীবন। 

চা শ্রমিকদের জীবন বাঁধা পড়েছে চা বাগানেই; Image Source: Mahfuzul Hasan Bhuiyan

বৃহত্তর সিলেট এলাকার দেড় শতাধিক চা বাগানে কর্মরত আছে এক লাখ আঠারো হাজার চা শ্রমিক। ইংরেজ আমলে ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিয়ে আসা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এই শ্রমিকেরা মাইলের পর মাইল পাহড়ি টিলা আর ঢাল পরিষ্কার করে চা বাগানের সূত্রপাত করেছিল। বিনিময়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই মানুষেরা চা শ্রমিকের কাজটিই করে যাচ্ছে।

মোট চা শ্রমিকের প্রায় ৬৪ শতাংশই নারী এবং তাদের প্রায় সবাই খুব ছোটবেলা থেকেই চা বাগানে কাজ করা শুরু করেছে। প্রতিটি চা শ্রমিককে দিনে ২৩ কেজি চা পাতা তোলার লক্ষ্য দিয়ে দেওয়া হয়। বাগান বিশেষে হয়তো এই লক্ষ্যটি ১৮ থেকে ২৪ কেজিতে উঠানামা করে।

তবে এই লক্ষ্য দিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটি সিলেটের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য চা বাগানেও আছে। আর এই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে কাটা যায় মজুরী। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে যেমন মজুরী কাটা যায় তেমনি লক্ষ্যের চেয়ে বেশি পাতা তুলতে পারলে প্রতি কেজি পাতার জন্য দুই থেকে তিন টাকা বাড়তি মজুরী দেওয়া হয়।

লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হলে মজুরী কাটা যায়; Image Source: Philip Gain

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষ্যে অর্জনে চা শ্রমিকেরা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাহায্য নেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের শিশু সদস্যদের যুক্ত করা হয়। যে বয়সে শিশুটির সময় কাটানোর কথা ছিল স্কুলের প্রাঙ্গণে সমবয়সীদের সাথে খেলাধুলা করে সেখানে দুটি পাতা আর একটি কুঁড়ির খোঁজ করতেই অস্ত যায় সোনালী সূর্য।

তবে, খোলা চোখে চা বাগানে শিশু শ্রমের ব্যাপারটি সেই অর্থে দৃশ্যমান নয়। পরিবারের বাকি সদস্যদের সাথে কাজ করতে করতে চা বাগানের কাজে জড়িয়ে যায় তারা। তবে পূর্ণবয়স্ক হওয়ার আগে নিবন্ধিত করা হয় না তাদের। ফলে মালিকপক্ষের কাঁধে শিশুশ্রমের দায় চাপানো যায় না। পরিবারের সদস্যরা কয়েক টাকা বাড়তি মজুরীর আশায় নিজেরাই তাদের সন্তানদের কাজে নিয়োজিত করে থাকেন।

লক্ষ্য অর্জনের জন্য মায়ের সাথে কাজে নামে শিশুরাও; Image Source: countercurrents.org

চা বাগানের চৌহদ্দিতে মাঝেমধ্যেই দেখা মিলে স্কুলের। ইউনিসেফ কিংবা অন্য কোনো দাতব্য সংস্থার স্কুলের রঙিন দালানগুলো দূর থেকে ডাকতে থাকে শিশুদের। চা শ্রমিকদের অনেকেই এখন স্বপ্ন দেখেন তাদের সন্তানেরা চা বাগানের বাইরে পা রাখবে। কিন্তু সেই আশা অনেক সময় ধোঁয়ার মতো শূন্যে মিলিয়ে যায়।

প্রাথমিক কিংবা প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা হলেও চা বাগান এলাকা থেকে বহুদূরের উচ্চ বিদ্যালয়ে সন্তানদের পাঠাবার সাহস করেন না অনেকেই। মূলধারার জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে যেতে আছে ভাষার সমস্যাও। বিভিন্ন জরিপের ফলাফল বলছে চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে দশটিরও বেশি ভাষা প্রচলিত আছে। চা বাগানের শ্রমিকদের যেহেতু আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, বিহারের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল, স্বাভাবিকভাবেই তাদের মাতৃভাষা ছিল আলাদা। 

চা বাগানের একটি প্রাক প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষা নিচ্ছে শিশুরা; Image Source: dhakatribune.com

উড়িষ্যা থেকে আসা চা শ্রমিকের বংশধরেরা কথা বলেন ‘দেশালি’ ভাষায়, যেটি বাংলা আর ওড়িয়া ভাষার একটি মিশ্রিত রূপ। প্রচলিত আছে ভোজপুরি, হিন্দি, অসমীয়া, মুন্ডা, ওরাং, তেলেগু, খাসি আর সাঁওতালী ভাষাও। দারিদ্র্যের যাঁতাকলে পিষ্ট প্রান্তিক এই মানুষগুলোর কাছে মাতৃভাষা চর্চা আর নিজেদের ভাষায় লেখাপড়ার দাবিটাও ঝাপসা হয়ে আছে। 

জীবনের দুষ্টচক্র

চা গাছ রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচর্যা আর চা পাতা সংগ্রহের প্রধান কাজটি নারী শ্রমিকেরা করে আসছে বংশানুক্রমে। নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় অনেক যত্নের সাথে এই কাজ করে। পুরুষ শ্রমিকদের একটি বড় অংশই কাজ করে চা পাতা প্রক্রিয়াজাত করার কারখানায়, নিরাপত্তাকর্মী, চা পাতা পরিবহন, ওজনকারী, বাগানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কর্মচারীদের বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কিংবা শ্রমিকদলের সর্দার হিসেবে। কিন্তু চা শ্রমিকদের এই বিশাল অংশের কি চা বাগানে কাজ করা ছাড়া অন্য কোনো কাজ করার সুযোগ নেই?

এই প্রশ্নের মূল উত্তর লুকিয়ে আছে চা শ্রমিকদের আবাসন ব্যবস্থার সাথে। ১৮৫৪ সাল থেকেই যখন চা শ্রমিকদের ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিয়ে আসা হয় তখনই তাদের আবাসনের দায়িত্ব নিয়েছিল চা বাগানের মালিক সম্প্রদায়। চা বাগানে কাজ করে এমন যে কারো আবাসন চা বাগান কর্তৃপক্ষই করে দেবে। চা বাগানে কাজ করে না এমন কেউ চা বাগানে বসবাস করতে পারবে না। ফলে চা বাগানের আবাসন বাঁচিয়ে রাখতে প্রতি পরিবারের অন্তত একজনকে চা শ্রমিক হিসেবে বংশানুক্রমে কাজ করেই যেতে হবে।

স্বল্প মজুরীতে ক্রমবর্ধমান পরিবারের চাহিদা মেটাতে একই পরিবার থেকে অনেকেই চা বাগানে কাজ নিতে শুরু করে। পরিবার আলাদা হয়ে গেলে চা বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের নতুন আবাসনের ব্যবস্থা করে দেয়।

মালিক কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা করে আবাসনের; Image Source: Sheikh Nasir

এই স্বল্প মজুরীতে যেখানে তাদের জীবন ধারণই কঠিন সেখানে তাদের কেউ টাকা সঞ্চয় করে জমি কিনে মূলধারার সমাজে বসবাস শুরু করবে এই চিন্তাটিও করা কঠিন। ভাষা আর সংস্কৃতির বিস্তর ফারাকের কারণে মূলধারার বাঙালি সমাজের কাছেও নিগ্রহের শিকার এই চা শ্রমিকেরা। চা বাগানের শিশুরাও প্রাক প্রাথমিক আর প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পেরোতেই ডাক পড়ে চা বাগানে কাজ করার। পরিবারের বয়স্ক সদস্যের কেউ চা শ্রমিকের পদ থেকে অবসর নিলে সেই পরিবারের কাউকে চা শ্রমিক হিসেবে নিবন্ধনের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, যাতে তার পরিবারের আবাসনটি টিকিয়ে রাখা যায়।

এভাবে যুগের পর যুগ ধরে চা বাগানের ভেতরেই জীবন বাঁধা পড়ে আছে তাদের। চা বাগানের শ্রমিকেরা বংশানুক্রমে শত শত বছর ধরে চা বাগানের ভেতরের জমিতে বসবাস করেও পায় না জমির মালিকানা, এক টুকরো জমির জন্য এরা জিম্মি হয়ে আছে মালিকশ্রেণির কাছে। তবে এর মধ্যেও খুব অল্পসংখ্যক লোক চা বাগান থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষা গ্রহণ করে মূলধারার সমাজে মিশতে শুরু করেছেন।

চা শ্রমিকদের নেতাদের নিয়ে গঠিত হয় পঞ্চায়েত। এই পঞ্চায়েতের মূল কাজ চা শ্রমিকদের সাথে চা বাগানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্বন্দ্ব নিরসন করা, মালিকপক্ষের কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা কিংবা বকেয়া মজুরী আদায়ে সহায়তা করা। এছাড়াও পঞ্চায়েত শ্রমিকদের মধ্যবর্তী পারিবারিক কিংবা সামাজিক দ্বন্দ্ব নিরসন, বিয়ে, সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব পালন করে থাকে।

পাতা তোলা শেষে আঁটি বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে চা শ্রমিকেরা; Image Source: Md Akhlas Uddin

চা বাগানে শ্রমিক বিদ্রোহও হয়েছে অনেকবার। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিদ্রোহটি হয়েছিল ১৯২১ সালের ২০ মে। বৃহত্তর সিলেট এলাকার চা বাগানের প্রায় ত্রিশ হাজার শ্রমিক ‘মুল্লুকে চলো’ এই নামে আন্দোলনের ডাক দেয়। নিজের জন্মভূমিতে ফিরে যাবার লক্ষ্যে তারা চা বাগান থেকে বেরিয়ে দলে দলে রওনা হয় চাঁদপুরের মেঘনা ঘাটের দিকে। তবে সেখানে চলে পুলিশের গুলি, মারা যায় অনেকেই। বাকিরা জীবনের ভয়ে পালিয়ে আবারো চা বাগানে আশ্রয় নেয়। 

চা বাগানে অল্প করে হলেও শিক্ষার আলো পৌঁছাতে শুরু করেছে, চা বাগানের শ্রমিকেরা নিজেরাই এখন বিশ্বাস করে শিক্ষাই হতে পারে ভাগ্য পরিবর্তনের হাতিয়ার। তবে প্রান্তিক এই জনপগোষ্ঠীর দরকার একটু সহানুভুতি, ভালোবাসা আর মানুষ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ানোর অধিকার। 

This article is about the life and struggle of tea plantation workers of Bangladesh.

Information source: 
A Study Report on Working Conditions of Tea Plantation Workers in Bangladesh (Published by ILO Country Office for Bangladesh)

Featured Photo Source: Md Arifur Rahman (www.flickr.com)

Related Articles