Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দ্য ডন রেইড: নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসের কালো অধ্যায়

উনিশ শতকে পৃথিবীর অনেক দেশের অর্থনীতিতে বিরাট পালাবদল শুরু হয়। শত শত বছর ধরে চলে আসা কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে দেশগুলো মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে, যান্ত্রিক শিল্পকারখানাগুলোর দ্রুত প্রসার ঘটে। মূলত ইউরোপীয় রেনেসাঁর পর থেকে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার গতিবৃদ্ধি হয় বহুগুণ, যার প্রভাব পড়ে অনেক দেশের অর্থনীতিতে। কৃষিপণ্যকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে শিল্পপণ্যে রূপান্তরিত করতে যেসব অনাধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করা হতো, সেগুলোর আধুনিকায়ন হয়। ফলে শিল্পপণ্যের উৎপাদন বেড়ে যায় বহুগুণ, নতুন নতুন শিল্প গড়ে ওঠে। ইতিহাসে এই অর্থনৈতিক পালাবদলের ঘটনা স্থান পেয়েছে ‘শিল্পবিপ্লব’ হিসেবে। শিল্পবিপ্লব ইউরোপে শুরু হলেও পরবর্তীতে ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্বে। যে দেশে শিল্পবিপ্লব হতো, সেদেশের অর্থনীতিতে কৃষিশিল্পের ভূমিকা ক্রমেই গৌণ হয়ে যেত। ফলে কৃষিশিল্পের সাথে সম্পৃক্ত জনগোষ্ঠীর বিকল্প আয়ের উৎস বের করতে হতো।

নয়বনয়নসাম
শিল্পবিপ্লবের ফলে শিল্পনির্ভর অর্থনীতি গড়ে ওঠে পৃথিবীর অনেক দেশে; image source: history.com

শিল্পবিপ্লবের পর থেকে যখন অর্থনীতিতে শিল্পের প্রভাব বহুগুণ বেড়ে যায়, তখন অসংখ্য কারখানা প্রতিষ্ঠার সুবাদে শ্রমিকের চাহিদাও বেড়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, কৃষিশিল্পের অবনমনের ফলে যেসব কৃষিশ্রমিক বেকার হয়ে যান, তারাই পরবর্তীতে শিল্পকারখানায় শ্রমিক হিসেবে যোগদান করেন। কারখানার মালিকেরা সবসময় চেষ্টা করেন কীভাবে সস্তাশ্রম কাজে লাগানো যায়। এতে তাদের মুনাফা বেশি থাকে।

নিউজিল্যান্ডে ১৮৭০ সাল থেকেই শিল্পবিপ্লবের হালকা আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নিউজিল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব নতুন মাত্রা লাভ করে। শিল্পের প্রসারে নতুন নতুন কারখানা গড়ে ওঠে যেগুলোতে প্রচুর পরিমাণ শ্রমিকের দরকার ছিল। সেখানকার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর চেয়ে বাইরের প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলো থেকে আসা মানুষকে তুলনামূলক কম মজুরিতে খাটানো যেত। এজন্য নিউজিল্যান্ডে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তাহিতি, সামোয়া, টোঙ্গা কিংবা ভানুয়াতুর মতো দ্বীপগুলো থেকে যেসব মানুষ এসেছিলেন, তাদেরকে স্বাগত জানানো হয়।

প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে কেন অধিবাসীরা নিউজিল্যান্ডে আসতে শুরু করেছিল, সেটি পরিষ্কার হবে পশ্চিম সামোয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি তুই আতুয়া তুপুয়া তামাসেসের (১৯৭৬-৮২) বক্তব্য থেকে। তিনি বলেছিলেন, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীরা নিউজিল্যান্ডে আসতো প্রধানত তিনটি কারণে- কাজের সুযোগ, পর্যাপ্ত অর্থের হাতছানি এবং সন্তানদের পড়াশোনার সুব্যবস্থা। সেসময় এই তিন সুবিধা যারা ভোগ করতে, তাদেরকেই সমাজে সফল হিসেবে গণ্য করা হতো। আর নিউজিল্যান্ডে শিল্পকারখানায় কাজ করার মাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থ পাওয়া যেত, সেটি দিয়ে স্বদেশে ফিরে অনায়াসে বাড়ি নির্মাণ করতে পারত দ্বীপের অধিবাসীরা। যেহেতু প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে কারখানায় কাজের তেমন সুযোগ ছিল না, সন্তানদের যথাযথ শিক্ষার সুব্যবস্থা ছিল না, তাই সেখানকার অধিবাসীরা নিউজিল্যান্ড গমনকেই জীবিকা নির্বাহের প্রধান উপায় হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন।

জতলগেব
মানচিত্রে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, যেগুলো থেকে অভিবাসীদের আগমন ঘটেছিল নিউজিল্যান্ডে; image source: travelgudier.com

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্রায় তিন দশক ধরে নিউজিল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব চলমান ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে কিছু ঘটনা নিউজিল্যান্ডের অর্থনীতিকে থমকে দেয়। যেমন নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অংশীদার ইংল্যান্ড ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়। ফলে নিউজিল্যান্ড তার শিল্পপণ্যের বিশাল বাজার হারিয়ে ফেলে। আরব-ইসরায়েল যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পৃথিবীব্যাপী খনিজ তেলের দাম বেড়ে যায় কয়েক গুণ। দেখা যায়, আরবদের নিষেধাজ্ঞা দেয়ার আগে তেলের প্রতি ব্যারেলের দাম ছিল তিন ডলার, কিন্তু নিষেধাজ্ঞার পর প্রতি ব্যারেল তেলের দাম গিয়ে দাঁড়ায় বিশ ডলারে! যেহেতু খনিজ তেল ছাড়া শিল্পপণ্যের কারখানা অচল, তাই বাধ্য হয়ে মাত্রাতিরিক্ত দামেই কিনতে হতো কারখানা মালিকদের। খনিজ তেলের দামবৃদ্ধির ফলে প্রতিটি পণ্যে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী, কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে গেলে বাজারে তার চাহিদা কমে যায়। নিউজিল্যান্ডে একটা সময়ে গিয়ে শিল্পপণ্যের চাহিদা না থাকার কারণে অসংখ্য কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।

অসংখ্য কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া ও খনিজ তেলের মূল্যবৃদ্ধির জন্য নিউজিল্যান্ডের অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশটিতে বেকারত্বের হার বেড়ে যায়, যার কারণে নিউজিল্যান্ডের সমাজে জনমনে অসন্তোষের মাত্রা বেড়ে যায়। প্রবাসী হিসেবে কাজ করতে আসা প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের এই অর্থনীতির অবনমনের কারণ হিসেবে দেখানোর প্রচলন শুরু হয়, যেটি ছিল পরিষ্কার বর্ণবাদী আচরণ। নিউজিল্যান্ডের স্থানীয় অধিবাসীরা মনে করেছিল, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীরা এসে তাদের কর্মক্ষেত্র দখল করেছে, তাদেরকে বেকারত্ব বরণে বাধ্য করেছে। মূলধারার গণমাধ্যম অভিবাসীদের সম্পর্কে বিভিন্ন নেতিবাচক তথ্য প্রচার করতে শুরু করে, যেগুলো অসন্তোষ আরও বাড়িয়ে তোলে। সবমিলিয়ে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে নিউজিল্যান্ডের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও একসময় গণমাধ্যমের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অভিবাসীদের প্রতি বর্ণবাদী আচরণের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে ফেলে।

হডহডজডকত
আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খনিজ তেলের দাম বৃদ্ধি পায়, যেটি নিউজিল্যান্ডের অর্থনীতির জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল; image source: thebalance.com

১৯৬৪ সালে নিউজিল্যান্ডে অভিবাসী আইন তৈরি করা হয়, যেটি ছিল সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বেশ অপর্যাপ্ত। ১৯৬৮ সালে সেই আইন সংশোধন করা হয়। সংশোধনের পর নিউজিল্যান্ডের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া হয়। যারা ভিসায় নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় ধরে অবস্থান করছিল, তাদেরকে নিউজিল্যান্ড থেকে বের করে দেয়ার মতো ক্ষমতা দেয়া হয়। এছাড়া পুলিশ যেকোনো সময়, যেকোনো অবস্থায় অভিবাসীদের থাকার জায়গায় হানা দিতে পারবে এবং নিউজিল্যান্ডে থাকার ও কাজ করার ওয়ার্ক পারমিট চেক করতে পারবে– এই ধরনের ক্ষমতাও প্রদান করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যেত, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অভিবাসীদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তাদের ট্রাভেল এজেন্টদের কাছে জমা থাকত এবং ভাড়া পুরোটা পরিশোধ করার পর তারা সেগুলো নিজেদের কাছে নিয়ে আসতে পারত। এই ধরনের অভিবাসীরা চাইলেও হুটহাট করে পুলিশি তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদের মুখে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে পারত না।

হতপগকগেগ
অভিযান চলাকালীন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অভিবাসীদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হতো; image source: abc.net.au

১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬– তিন বছরে অসংখ্যবার নিউজিল্যান্ডের পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেসব প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অভিবাসীদের ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাদের খুঁজে বের করতে বাড়িতে, চার্চে, হোটেলে, কারখানায় ও রাস্তায় হঠাৎ করে অভিযান পরিচালনা করছিল। ব্যাপক ধরপাকড়ের মুখে অসংখ্য অভিবাসীকে গ্রেফতার করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিউজিল্যান্ডের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান পরিচালনা করত গভীর রাতে কিংবা খুব ভোরে। এজন্য এই অভিযানকে অভিহিত করা হতো ‘দ্য ডন রেইড’ হিসেবে।

১৯৭৪ সালে অভিযান শুরু হওয়ার পর লেবার পার্টির প্রেসিডেন্ট সাময়িকভাবে অভিযান বন্ধের নির্দেশ দেন এবং যাদের ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট সংক্রান্ত জটিলতা ছিল, তাদেরকে সেগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য দু’মাস সময় দেন। কিন্তু নির্বাচনের পর লেবার পার্টির প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতার হাতবদল ঘটে এবং তারা অভিযান পুনরায় শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৫-৭৬ সালে অসংখ্যবার অভিযান চালানো হয়, যেগুলো অভিবাসীদের মনে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করে।

নিউজিল্যান্ডে শুধু প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দারাই কাজ করতে এসেছিল– ব্যাপারটি কিন্তু এমন নয়। আমেরিকা ও ব্রিটেন থেকেও অসংখ্য মানুষ জীবিকার তাগিদে সেই দেশে গিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, পুলিশের অভিযানের শিকার হচ্ছিল শুধু সামোয়া, ফিজি, টোঙ্গা ও ভানুয়াতু ইত্যাদি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপের বাসিন্দারা, যাদের গণমাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছিল। ধরপাকড়ের শিকার হওয়াদের ৮০ শতাংশ ছিল এই দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসী, অথচ তারা ছিল মোট অভিবাসীর মাত্র ৩০ শতাংশ। অসংখ্য ব্রিটিশ কিংবা আমেরিকান অভিবাসীর ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট সংক্রান্ত সমস্যা থাকার পরও তাদেরকে কোনো হয়রানির শিকার হতে হয়নি। নিউজিল্যান্ডের পুলিশের এই বর্ণবাদী আচরণের জন্যই মূলত এই ঘটনাকে নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসের কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

Rifjvkckc
অতিসম্প্রতি সেইসময়ের বর্ণবাদী আচরণের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন; image source: smh.co.au

পলিনেশিয়ান প্যান্থার নামে এক গ্রুপে এ ধরনের বর্ণবাদী আচরণ বন্ধের প্রতিবাদে গড়ে উঠেছিল ১৯৭০ সালের দিকে। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে তারা সেই বর্ণবাদী আচরণের জন্য নিউজিল্যান্ড সরকার যেন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের মানুষের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে, তার দাবি জানিয়ে আসছিল। অবশেষে এই বছরের ১লা আগস্ট প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন দ্য ডন রেইডের শিকার হওয়ার ব্যক্তিদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন। তিনি বলেছেন, সেসময়ের অভিবাসী আইন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের মানুষদের উপর বর্ণবাদী আচরণের বৈধতা দিতেই প্রণয়ন করা হয়েছিল। এই ক্ষমাপ্রার্থনার মাধ্যমে সেই সময়ে পুলিশি নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হওয়ার মানুষেরা কিছুটা হলেও ন্যায়বিচার পাওয়ার অনুভূতি লাভ করেছেন। শুধু ক্ষমাপ্রার্থনাই নয়, অভিবাসী থেকে পরবর্তীতে নিউজিল্যান্ডের নাগরিক হওয়া ব্যক্তিদের জন্য বিভিন্ন বৃত্তি দেয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী।

Related Articles