Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হারানো গুপ্তধনের খোঁজে

পৃথিবীতে হারিয়ে যাওয়া গুপ্তধনের সংখ্যা যত না বেশি, তারচেয়েও বেশি হলো গুপ্তধন খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা। গুপ্তধনের গালগল্প আর গুজবে কান দিয়ে কত লোকের সলিল সমাধি ঘটেছে কিংবা খনির নিচে চাপা পড়ে মরেছে তার ইয়ত্তা নেই। ইতিহাসের সেই হারানো গুপ্তধনের গল্পগুলোই তুলে ধরা হলো আজকের এ লেখায়।

মেনোরাহ

নির্ভেজাল সোনা দিয়ে বানানো বাতিদান “মেনোরাহ”-এর মূল্য নির্ধারণ করা এক কথায় অসম্ভব। এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে অসাধারণ এক ইতিহাস। স্বয়ং হযরত মূসা (আঃ) জেরুসালেমের মন্দিরে এটি স্থাপন করেন। তিনি নিয়মিত সাতটি বাতিদানের বাতি জ্বালাতেন খাঁটি জলপাইয়ের তেল দিয়ে। মেনোরাহকে প্রাচীন আমল থেকেই ইহুদীদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হতো, এমনকি আধুনিক ইসরাইলেও মেনোরাহকে কোট অফ আর্মস হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

৭০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রোমানরা জেরুজালেম আক্রমণ করার সময় এটি লুট করে রোমের “টেম্পল অফ পিস”-এ নিয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৯১ খ্রিষ্টাব্দে মন্দিরটিতে আগুন ধরে গেলে আগুনের সাথেই ধ্বংস এটি হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়।

“মেনোরাহ” – হযরত মুসা (আঃ) যে বাতি জ্বালিয়েছিলেন

কুসানাজি

সূর্যোদয়ের দেশ জাপান থেকে হারিয়ে যাওয়া গুপ্তধনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বস্তুটি হলো কুসানাজি। জাপানের রাজার জন্য বানানো এই বিশেষ তরবারির সাথে হারিয়ে যাওয়া অন্য দুইটি জিনিস হলো ব্রোঞ্জের আয়না “ইয়াতা নো কাগামি” এবং বহুমূল্য রত্ন, নাম “ইয়াসাকানি নো মাগাতামা”। জাপানের রুপকথা অনুযায়ী, স্বয়ং দেবতা এসে এটি উপহার দিয়ে যান এবং তরবারিটি দিয়ে বাতাসের গতিপথ পরিবর্তন করে ফেলা যায়! কথিত আছে ইয়ামাতো তাকেরু নামের এক যোদ্ধা তার বীরত্বের জন্য এটি রাজার কাছ থেকে উপহার পান। এক জমিদার তাকে মেরে ফেলার জন্য মাঠের ঘাসে আগুন দিয়ে দিলে তাকেরু তার তরবারি দিয়ে বাতাসের গতিপথ সেই জমিদারের দিকেই ঘুরিয়ে দেন। এজন্য এর নাম “স্বর্গের মেঘ একত্রকারী তরবারি” থেকে পরিবর্তন করে “ঘাস কাটা তরবারি” রাখা হয়!

১১৮৫ সালের দিকে জাপানের ক্ষমতা দখলের যুদ্ধ “গেনপেই”-এ তরবারিটিসহ সেই আয়না এবং রত্ন হারিয়ে যায়। যদিও জাপান সরকার দাবি করে তরবারিটি ভালভাবেই সংরক্ষিত রয়েছে, তারপরও সেটি কখনো পরীক্ষা করে দেখা হয়নি।

“কুসানাজি” – যে তরবারি দিয়ে বাতাস নিয়ন্ত্রণ করা যায়

লা নচে ত্রিস্তে

অ্যাজটেকদের সোনার গল্প কে না শুনেছেন? হার্নান কর্টেজ যখন ইউকাটান পেরিয়ে মেক্সিকোতে পা রাখলেন, অ্যাজটেকরা তখন ভেবেই নিয়েছিল সেই সাদা দেবতা অবশেষে ফিরে এসেছেন! কর্টেজ তাদের গুপ্তধন দেখতে চাইলে সম্রাট মন্টেজুমা লুকিয়ে রাখা ধনসম্পত্তির বিশাল ভান্ডার দেখিয়ে দেন। পরবর্তীতে কর্টেজ তার দেবতার মুখোশ খুলে ফেলে রাজধানী টেনোচটিটলান আক্রমণ করলে মন্টেজুমা ভালো পরিমাণ সোনাই দেবতাকে ঘুষ হিসেবে পাঠিয়ে দেন, কিন্তু কর্টেজ তাতেও সন্তুষ্ট ছিলেন না।

পরবর্তীতে কর্টেজ রাজধানীতে ঢুকে স্বর্ণ ভান্ডারটি আর খুঁজে পাননি। ঠিক ঐ সময়েই অ্যাজটেক যোদ্ধারা স্প্যানিশদেরকে রাজধানীতে অবরোধ করে রাখে। খাদ্য-পানির অভাবে ধুঁকতে থাকা স্প্যানিশরা রাতের অন্ধকারে অ্যাজটেকদের চোখে ধুলো দিয়ে পালানোর সময়ই অ্যাজটেকদের আক্রমণে বেশিরভাগ সৈন্যই মারা যায়, বেঁচে ফিরতে পারেন কর্টেজসহ গুটিকয়েক লোক। সেই রাতকেই বলা হয় “লা নচে ত্রিস্তে” বা দুঃখের রাত, একইসাথে স্প্যানিশ সৈন্যরা মারা যায় আর কালের অতলে হারিয়ে যায় মন্টেজুমার ঘুষ পাঠানো সেই বিশাল পরিমাণ সোনা।

পরবর্তীতে কর্টেজ অ্যাজটেকদের নৃশংসভাবে নির্যাতন করেও, অ্যাজটেকদের মুখ খোলাতে পারেননি। কথিত আছে মন্টেজুমার সেই রত্নভান্ডার কর্টেজ আক্রমণ করার আগেই উতাহ-এর পর্বতে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।

লা নচে ত্রিস্তের ভয়াল রাত

আইরিশ ক্রাউন জুয়েলস

আয়ারল্যান্ডের সেইন্ট প্যাট্রিক নাইটদের জন্য তৈরি এই বহুমুল্যবান রত্নটি ১৭৮৩ সালে রাজা তৃতীয় জর্জের আদেশে বানানো হয়েছিল। ৩৯৪টি দুষ্প্রাপ্য রত্ন দিয়ে তোরি এই রত্নের বর্তমান দাম ধরা হয় দেড় মিলিয়ন পাউন্ড এবং তা ঐতিহাসিক মূল্য বাদ দিয়েই। ১৯০৭ সালে ডাবলিন দুর্গের সুরক্ষিত ভল্ট থেকে হঠাত করেই উধাও হয়ে যায় এই ক্রাউন জুয়েল। রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড আয়ারল্যান্ড ভ্রমণের কয়েকদিন আগে রত্ন সুরক্ষিত আছে কিনা দেখতে গিয়েই চুরিটি ধরা পড়ে।

অতি সুরক্ষিত ভল্ট থেকে চুরি হয়ে যাওয়া আইরিশ ক্রাউন জুয়েলস

লিমা শহরের গুপ্তধন

মেসো-আমেরিকান সভ্যতাগুলোর মধ্যে একেবারে উপরের সারিতে থাকা ইনকাদেরও ধরাশায়ী হতে হয়েছিল স্প্যানিশ কনকুইস্টেডরদের হাতে। স্প্যানিশ চার্চগুলো লুটপাট চালিয়ে পাহাড়সমান সম্পদ জমা করে পেরুর রাজধানী লিমাতে। তৎকালীন আমলের প্রায় ৬০ মিলিয়ন ইউরোর এই ধন-সম্পদের মধ্যে ছিল মেরি ও যিশুর দুইটি পূর্ণায়ত সোনার মূর্তি!

দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো একে একে স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় পেরুতেও বিক্ষোভের দানা বেড়ে উঠতে শুরু করে। তাই লিমার ভাইসরয় দ্রুত এই বিশাল ঐশ্বর্য মেক্সিকোতে পাচার করতে দায়িত্ব দেন ক্যাপ্টেন উইলিয়াম থম্পসনকে। কিন্তু উইলিয়াম থম্পসন বিশাল সম্পদের বহর দেখে লোভ সামলাতে পারেননি, দায়িত্বরত পাহারাদারদের গলা কেটে দুফাঁক করে সাগরে ভাসিয়ে পালিয়ে যান কোকোস আইল্যান্ডে। বর্তমানে কোস্টারিকা নামের এই ক্যারিবিয়ান দ্বীপে মাটির নিচে পুঁতে রাখেন খাঁটি ইনকা গোল্ড।

কিছুদিন পরেই জাহাজসহ ধরা পড়েন উইলিয়াম থম্পসন, তিনি আর তার ফার্স্ট মেট ছাড়া সবাইকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয় জলদস্যুতার অভিযোগে। থম্পসন আর তার ফার্স্ট মেটকে তাদের লুকিয়ে রাখা গুপ্তধন ফিরিয়ে দেওয়ার শর্তে মৃত্যুদন্ড স্থগিত রাখা হয়। স্প্যানিশদেরকে পুরো কোস্টারিকার আগামাথা হাঁটিয়ে জঙ্গলের কাছাকাছি আসতেই ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যান দুইজনে। তারপর থেকে উইলিয়াম থম্পসন আর তার গুপ্তধন কোনটাই আর দেখা যায়নি।

পাতিয়ালা নেকলেস

১৯২৮ সালে ফ্রান্সের বিখ্যাত জুয়েলারি কোম্পানি “কার্তেয়া” পাতিয়ালার তৎকালীন মহারাজা ভূপিন্দার সিং-এর জন্য একটি নেকলেস তৈরি করে। ২,৯৩০টি হীরার টুকরো দিয়ে বানানো এই নেকলেসের মাঝখানে ছিল আকারের দিক থেকে পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম হীরা “De Beers”! এছাড়াও নেকলেসে বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য বার্মিজ চুনিপাথরও ছিল। রাজার মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর পর ১৯৪৮ সালে নেকলেসটি হারিয়ে যায়।

৩৪ বছর পর “De Beers” হীরাটি জেনেভার নিলামে বিক্রি হয় ৩.১৬ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে। ১৯৯৮ সালের দিকে নেকলেসটি খুঁজে পাওয়া যায় লন্ডনের এক জুয়েলারি দোকানে, বড় আকৃতির হীরাগুলো ছাড়া। কার্তেয়া কোম্পানি নেকলেসটি কিনে কৃত্তিম হীরা দিয়ে নেকলেসটি আবার পুরোনো রূপে ফিরিয়ে দেন।

ভূপিন্দার সিং-এর গলায় পাতিয়ালা নেকলেস

“De Beers” – পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম হীরা

অ্যাম্বার রুম

দুষ্প্রাপ্য অ্যাম্বারের প্যানেল এবং সোনা দিয়ে বানানো অ্যাম্বার রুম তৈরি করেন জার্মান ভাস্কর আন্দ্রেয়াস শ্লাটার। চারজন ভাস্কর ও অ্যাম্বার শিল্পী মিলে প্রায় সাত বছর ধরে এটি নিয়ে কাজ করার পর এর স্থান হয় বার্লিন সিটি প্যালেসে। প্রুশিয়ার রাজা (তৎকালীন জার্মানি) প্রথম ফ্রেডারিক উইলিয়াম ১৭১৬ সালে রাশিয়ার জার “পিটার দ্য গ্রেট”-কে বন্ধুত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ উপহার দেন। ৫৫ বর্গমিটার এবং ৬ টন ওজনের বিশাল এই ঘরটি রাখা ছিল রাশিয়ান রাজাদের গরম কাটানোর জায়গা ক্যাথেরিন প্রাসাদে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করলে অ্যম্বার রুমটি সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কিন্তু সময়সাপেক্ষ এবং অ্যাম্বার নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে তা আর সরানো হয়নি। পরে জার্মান সেনারা দক্ষ ভাস্করের সহায়তায় অ্যাম্বার রুমটি কোয়েনিগসবার্গে নিয়ে আসে। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের শেষ দিকে কোয়েনিগসবার্গে সোভিয়েত রেড আর্মিরা পৌঁছানোর আগেই ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ার ফোর্সের বোমার আঘাতে পুরো শহর ধ্বংস হয়ে যায়, সাথে হারিয়ে যায় অ্যাম্বার রুমও।

চোখ ধাঁধানো অ্যাম্বার রুম

আওয়া মারু জাহাজ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের নৌ-বাহিনীতে ব্যবহার হওয়া আওয়া মারু জাহাজ যুদ্ধের শেষদিকে রেড ক্রসের ত্রাণবহনকারী জাহাজ হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে, একই সাথে যুদ্ধে আহত সৈনিকদের হাসপাতাল হিসেবেও ব্যবহার করা হতো। সিঙ্গাপুর থেকে জাপানের উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় আমেরিকান সাবমেরিন “ইউএসএস কুইনফিশ”-এর টর্পেডোর আঘাতে জাহাজটি ডুবে যায়। জাহাজটি তখন বহন করছিল ৪০ টন সোনা, ১২ টন প্লাটিনাম এবং ৩০ কেজি হীরাসহ প্রায় ৫ বিলিয়ন সমমূল্যের সম্পদ। আওয়া মারুকে ভুল করে ডেস্ট্রয়ার জাহাজ ভেবে টর্পেডো ছোঁড়ায় প্রান হারায় ২০০৩ জন মানুষ! বেঁচে যান মাত্র একজন, “কান্তোরা শিমোদা” যিনি তিন তিনবার টর্পেডোর আঘাতে ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে জীবিত ফিরতে পেরেছেন!

এখনো পৃথিবীর লোকজন ইনকাদের সোনা খুঁজে বেড়ায় অ্যান্ডিজের চূড়ায়, কেউ খুঁজে বেড়ায় “এল ডোরাডো”-র গুপ্তধন। গুপ্তধনের ঐতিহাসিক গল্পগুলো এভাবেই চলতে থাকবে সময়ের অন্তিমকাল পর্যন্ত।

 

This article is in Bangla. It is about

References:

Featured Image: 

Related Articles