প্লাস্টিক কবে আবিষ্কার করা হয়েছিল? এই যে এত হাসি-ঠাট্টা যাকে নিয়ে, সেই চীনেই কি প্লাস্টিকের শুরু? প্লাস্টিকের গল্পটা এত নতুন নয়। খ্রিস্টের প্রায় দেড় শতক আগে মেক্সিকোতে ব্যবহার করা হয় পলিমারের বল। এরপর আরও কতশত বছর পর আসে প্লাস্টিকের মতোই আরেকটি উপাদান ‘পারকেসিন’। মজবুত রাবার আর নানারকম উপাদান তখন ডুবোজাহাজেও ব্যবহার করা হয়েছিল। তবে, এতকিছুতেও কিছু একটা কমতি যেন ছিল সবসময়। যেজন্য নিয়মিত নতুন কিছু আনার চেষ্টা করেন বিজ্ঞানীরা। তবে সেসব আবিষ্কার নিয়ে নয়, আজ আমরা কথা বলব আজ যে প্লাস্টিককে চিনি, তার শুরুটা নিয়ে। অনেকটা না চাইতেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল এই প্লাস্টিক।
১৯০৭ সালের ১১ জুলাই। ৪৩ বছর বয়সী বিজ্ঞানী লিও হেনরিক বায়েকল্যান্ড তখন সবে নতুন এক পদার্থ আবিষ্কার করেছেন। বিজ্ঞানী দারুণ খুশি। একটি জার্নালে নিজের সদ্য উদ্ভাবিত এই পদার্থ নিয়ে গর্ব করেন লিও। তিনি লেখেন,
“যদি আমি ভুল না করে থাকি, আমার এই উদ্ভাবন ভবিষ্যতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হবে”।
কিন্তু বিজ্ঞানী তো একজন সামান্য মানুষ ছিলেন। তিনি কীভাবে ভবিষ্যতকে জানবেন? সেদিনের সেই উদ্ভাবন প্লাস্টিক হিসেবে বর্তমানে আমার সবার জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বেলজিয়ামে জন্ম নেওয়া লিও’র বাবা পেশায় ছিলেন একজন মুচি। বাবা নিজে পড়াশোনা করেননি। লিও কেন যে এত পড়াশোনা করতে চান, সেটাও বুঝে উঠতে পারেননি। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই ছেলেকে তিনি ব্যবসার কাজে লাগিয়ে দেন। তবে লিওর মা একটু অন্যভাবেই ভাবছিলেন ছেলেকে নিয়ে।
মায়ের উৎসাহেই কাজের পাশাপাশি নৈশ বিদ্যালয়ে পড়ে স্কলারশিপ পান লিও। মাত্র ২০ বছর বয়সে রসায়নে ডক্টরেটও করেন। জীবন বেশ ভালোই চলছিল তার। বিয়ে করে নিউ ইয়র্কে এসে নিজের আবিষ্কৃত ফটোগ্রাফিক প্রিন্টিং পেপার বিক্রি করে বেশ ভালো আয় করেন লিও। কাজ করার আর প্রয়োজন ছিল না এই বিজ্ঞানীর। তবে রসায়নের প্রতি ভালোবাসা থেকেই হাডসন নদীর পাশে নিজের ঘর, আর সাথে একটা গবেষণাগার নির্মাণ করেন তিনি। সেবার সেখানেই ফরমালডিহাইড এবং ফেনল নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন।
না চাইতেই তার এই পরীক্ষা নতুন এক আবিষ্কারের সূচনা করে দেয়। টাইম ম্যাগাজিনে পরবর্তী সময়ে বড় বড় করে ছাপা হয় তার এ আবিষ্কারের কথা। সেদিনই প্লাস্টিকের আবিষ্কার করেছিলেন লিও। নিজের নতুন এই আবিষ্কারের নাম দিয়েছিলেন ‘বেকলাইট’। প্লাস্টিকের গুরুত্ব নিয়ে খুব একটা ভুল বলেননি লিও। প্রজন্মের পর প্রজন্ম জুড়ে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে তার এই আবিষ্কার। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের দৌরাত্ম্য এতটাই বেশি যে, সুজান ফ্রেইনকেল যখন এ নিয়ে নিজের বই ‘প্লাস্টিক: আ টক্সিক লাভ স্টোরি’ লেখেন, তাতে তিনি একটি গোটা দিনে তার ব্যবহৃত সব প্লাস্টিকের উপাদানের নাম লেখেন। আর তাতে দেখা যায় যে, একটি দিনে তার ব্যবহার করা ১৯৬টি জিনিসই প্লাস্টিকের তৈরি। অন্যদিকে প্লাস্টিক নয়, এমন জিনিসের সংখ্যা মাত্র ১০২!
প্লাস্টিকের পূর্ববর্তী রকম সেলুলয়েড তখনো রাজত্ব করছিল। সেটি সরিয়ে দিয়ে সে জায়গা দখল করে প্লাস্টিক। তবে বায়েকল্যান্ডের বুঝতে বেশি দেরি হয়নি যে, প্লাস্টিক সেলুলয়েডের চাইতেও অনেক বেশি ভিন্নতা ধারণ করতে সক্ষম। তিনি প্রচারণা শুরু করেন ভিন্ন ধারায়। এই একই উপাদানের হাজারটা ব্যবহার আছে, এমনটা বলে খুব একটা ভুল বলেননি লিও। টেলিফোন, বন্দুক, কফি মেকার- সবকিছুতেই একটু একটু করে প্রবেশ করে প্লাস্টিক। আর বেকলাইটের এ সাফল্যের পরই মানুষের মধ্যে চিন্তা কাজ করে, প্রকৃতিতে নেই এমন উপাদান তৈরি করার।
ইতোমধ্যে, ১৯২০-১৯৩০ এর মধ্যে প্লাস্টিক গবেষণাগার থেকে শুরু করে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। সেসময় প্লাস্টিক ছিল পলিস্টিরিন, পলিথিলিন ও নাইলন আকারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মানুষ প্লাস্টিকের ওপর অনেক বেশি ঝুঁকে পড়ে। আর সেখান থেকেই যুদ্ধের পরে জন্ম নেয় টাপারওয়্যারের মতো নিত্যনতুন সব পণ্য।
১৯৬৭ সালে ‘দ্য গ্রাজুয়েট’ নামক একটি চলচ্চিত্র বেশ পরিচিতি লাভ করে। সেখানে এক বয়স্ক নাগরিক একজন তরুণকে উপদেশ দিতে গিয়ে প্লাস্টিকের কথা বলেন। সেখানে প্লাস্টিক তখনো আগের প্রজন্মের কাছে নতুনত্ব আর নতুন সম্ভাবনার প্রতীক ছিল। আর এখন, এখনও সেটা ঠিক আগের মতোই আছে। আমাদের মানসিক দিক দিয়ে না হলেও, পরিমাণগত দিক দিয়ে প্রতি বছর প্লাস্টিকের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। যা বিশ বছর পর গিয়ে পরিমাণে দ্বিগুণ হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্লাস্টিক- ভালো, না খারাপ?
আপনার মনে হতেই পারে যে, প্লাস্টিক পরিমাণে অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে এবং এর হাত থেকে এখনই মুক্তি না পেলে সেটা আমাদের জন্য ক্ষতিকর ফলাফল বয়ে আনবে। হ্যাঁ, কথাগুলো একেবারে মিথ্যে নয়। প্লাস্টিক মাটিতে মিশে যাওয়ার মতো কোনো বস্তু নয়। এটি পানিতেও মিশে যায় না। ফলে প্রাণীদের উৎপাদনক্ষমতা কমিয়ে আনা থেকে শুরু করে তাদের মৃত্যু পর্যন্ত বয়ে নিয়ে আসে প্লাস্টিক। প্লাস্টিকের ক্ষতিকারক দিকের কারণে একজন মানুষের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাও তৈরি হয়। আবার, প্লাস্টিকের আছে ভালো দিকও। এই যে বড় বড় গাড়ি চলছে পথে, প্লাস্টিকের ব্যবহার হয় বলেই এরা এত হালকা হতে পারে এবং জ্বালানি খরচ কমে আসে।
ভঙ্গুর গ্লাসের বদলে প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করাটা নিরাপদ। এছাড়া, খাবার অনেকটা সময় ভালো থাকে প্লাস্টিকের কারণেই। কিন্তু এই ভালোগুলো তখনই নেওয়া সম্ভব, যখন বাড়তি প্লাস্টিক রিসাইকেল করা হয়। এ লক্ষ্যে কাজ করছে অনেকগুলো দেশ। প্লাস্টিকের গায়ে তিনকোনা একটি চিহ্ন নিশ্চয় দেখেছেন? সেখানে এক থেকে সাত পর্যন্ত সংখ্যা দেওয়া থাকে। এটি হলো রেজিন আইডেন্টিফিকেশন কোড। এ অনুযায়ী প্রতিটি দেশ তাদের প্লাস্টিককে কমিয়ে আনার বা রিসাইকেল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সমস্যা হলো, সবগুলো দেশে এ পরিমাণ এক নয়।
অনেক দেশ অবশ্য এক্ষেত্রে সফল হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তাইওয়ানের তাইপে-কে দেখা যায়। যেখানে, প্লাস্টিককে রিসাইকেল করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে নাগরিকদের জন্য। রিসাইকেলের পদ্ধতিটি সহজ। আর এমনটা না করলে জরিমানা দিচ্ছেন নাগরিকেরা। প্রোটোসাইক্লার নামক এই যন্ত্রটি বেশ অভিনব। আপনি একদিন দিয়ে প্লাস্টিক প্রবেশ করালে যন্ত্রটি সেটাকে থ্রিডি প্রিন্টারের ফিলামেন্টে পরিণত করে দেবে।
অনেক বাধাবিপত্তি এসেছে এবং আসছে এই গবেষণায়। প্লাস্টিক নিয়ে নতুন কী করা যায়, তা ভাবছেন সবাই। প্লাস্টিক বর্তমানে খুব অবহেলার একটি ব্যাপার হয়ে পড়েছে। তবে একটা সময় এটি মোটেও এমন ছিলো না। আশা করা যায় যে, প্লাস্টিককে ফেলে দেওয়ার জিনিস না ভেবে নতুন করে ব্যবহার করার উপায় হিসেবে ভাবতে শুরু করবেন একটা সময় সবাই। আর লিও বায়েকল্যান্ড? এমনটা সম্ভব হলে তিনিও হয়তো খুশিই হবেন!